লেখক নয় , লেখাই মূলধন

চমক মজুমদারের গল্প

বডি

চিত্র: পল ক্লি

আগুনটা গলা পেরিয়ে বুকের কাছাকাছি আসতেই আবার সরিতার মুখটা ভেসে উঠল শঙ্করের সামনে। ঢোক গিলে চোলাইটাকে পাকস্থলীতে চালান করে দাঁত কিড়মিড় করে বিড়বিড় করল ও, শালী রেন্ডি। চোখের সামনে থেকে সরিতা তখনও যায়নি। ওর আঁটো শরীর, উন্নত বুক শঙ্করকে আরও উত্তেজিত করে তোলে। পঞ্চাশ পেরোনো শঙ্কর সস্তার প্লাস্টিকের গ্লাসে চোলাই ঢালে আবার। চোখ বন্ধ করলেই ফুটে উঠছে সরিতার ছবি। সরকারি হাসপাতালের এই দিকটায় কেউ আসে না। মর্গের পিছন দিকটায় হাইড্রেনের পাশে দিব্যি বসে যায় চোলাইয়ের আড্ডা। যখন খুশি এসে বসে পড়লেই হল। ড্রাম থেকে সস্তা প্লাস্টিকের গ্লাসে চালান হয়ে যায় আগুনে তরল। মাঠের ওপাশ থেকে শুরু হয়েছে গ্রুপ ডি কোয়ার্টার। আদপে ওটা ডোম কলোনি। সরকারি হাসপাতালের সাফাইওয়ালা থেকে ডোম পর্যন্ত সবাই ওখানেই থাকে। আরও দূরে নার্স কোয়ার্টার, হাসপাতাল ভবন ইত্যাদি। খুব প্রয়োজন না হলে এদিকে পা মাড়ায় না কেউ। ওই ডোম কলোনিতেই থাকে শঙ্কর মল্লিক। ওখানে থাকে সরিতাও। শঙ্কর মল্লিক সরকারি হাসপাতালের ডোম। লোকে বলে বডি-শঙ্কর। বেওয়ারিশ মরা মর্গে রাখাই ওর কাজ। ডাক্তারবাবুরা কাটাছেঁড়া, পোস্টমর্টেম, সুরতহাল করার পর ও-ই পার্টির কাছে সুন্দর করে কাপড় জড়িয়ে বডি তুলে দেয়। বেওয়ারিশ বডি পড়ে থাকে মর্গের কোণে। হঠাৎ কোনোদিন সুপার সাহেবের সরকারি ফরমান এলে সে-সব লাশও পুলিশের গাড়িতে তুলে সরকারি শ্মশানে পুড়িয়ে আসে শঙ্কর। যদিও ও একা এসব করে না; সাথে আছে বিশু, সরকারি খাতায় ওর এটেনডেন্ট।
মদ না খেলে শঙ্করের চলে না। একটা হাফপ্যান্ট আর গলায় গামছা জড়িয়ে সকালেই বসে যায় হাইড্রেনের ধারে এই ঠেকে। থান ইটের উপর বসে চুমুক দেয় প্লাস্টিকের গ্লাসে। চুমুক দিতেই ম্যাজিক। সব মানবিক অনুভূতি উধাও। তখন ওর কাছে মৃত মানুষের শরীর শুধুই একটা বডি। দুর্ঘটনায় ছিন্নভিন্ন শরীর, নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসা শরীর; মাতাল শঙ্করের উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। ত্রিশ বছরের এই ডোম জীবনে ও বুঝে গেছে আসল সত্যটা। শিউরে ওঠা নয়; শুধুই নিয়ম মেনে এগিয়ে যাওয়া। মদ খেলেই কেমন যেন শক্তি এসে যায় শরীরে। ও ভুলে যায় বাচ্চা হতে গিয়ে ওর বউটার মরে যাওয়ার কথা, পঁচিশ বছর ধরে ওর একা থাকার কথা। শুধু মনে থাকে বডি তোলার কথা, ডেলিভারির কথা। আজকের মদটা কিন্তু শঙ্কর নিজের জন্য খাচ্ছে না, খাচ্ছে সরিতার জন্য। সরিতা বছর পঁচিশের বিধবা। শরীরে ভরন্ত যৌবন। ওর মা হাসপাতালের এটেনডেন্ট। সরিতাকে নিয়েই সারা ডোমপট্টিতে ফিসফাস। মা নাইট ডিউটিতে গেলেই সব দরজা জানলা বন্ধ হয়ে যায় ওর ঘরের। রাতের অন্ধকারে ঘরে ঢুকে আসে অচেনা পুরুষ। সরিতার চর্চা বস্তি ছাড়িয়ে ধাক্কা মারে মদের ঠেকেও। পয়সা ফেললেই নাকি পাওয়া যাবে ওর ঘরে ঢোকার চাবি। বিশুও রসিয়ে রসিয়ে বলতে থাকে সরিতার অঙ্গ-বিহঙ্গের কথা।
শঙ্কর মল্লিকের কাছে মানুষ মানে একটা বডি। জীবনের নিয়ম মেনে এগিয়ে যায় সেই বডি। বডির কোনো আনন্দ নেই, নেই হেসে ওঠা। শুধুই যা করে তা যেন নিয়ম মেনে। এই যে অফিসের ছোটোবাবু রোজ অ্যাটেনডেন্স খাতায় ওর টিপসই নিয়ে যায়, শঙ্করের কাছে ও-ও একটা বডি। যেদিন ওর বউটা মারা গেল, সাদা চাদর ঢাকা লাশটা দেখে ওর মনে হয়েছিল বউটা যেন এক্ষুনি শুয়ে পড়েছে। কাঁদতে কাঁদতে শঙ্কর দেখেছিল একটা মানুষ কীভাবে বডি হয়ে গেল। আর ওর বাচ্চাটা তো জন্ম থেকেই বডি। কবর দিতে দিতে ও গুলিয়ে ফেলেছিল মানুষ আর বডির পার্থক্যটা। সেই থেকে ঠান্ডা ঘরের লাশ আর বিশু সাগরেদ— সবাই ওর কাছে বডি। শঙ্করের মনে হয় যেন ও নিজেও একটা বডি, একটা জিন্দা লাশ। তাই পচা মরা মর্গ থেকে ডেডবডি বের করতে ওর বমি পায় না, বেরিয়ে আসা নাড়িভুঁড়িগুলো ভেতরে ঠেলে কাপড় জড়িয়ে সেলাই করতে ওর হাত কাঁপে না। কিন্তু বডিও মাঝে মাঝে মানুষ হয়। কানাঘুষো শুনতে শুনতে হঠাৎ একদিন সরিতার দিকে তাকিয়ে ছিল শঙ্কর। চোখে তো মেয়েটাকে রোজই পড়ে। কিন্তু সেদিন তাকিয়েছিল পুরুষের চোখে। ভরা স্তন, নিটোল নিতম্ব বডিতেও জান দিতে পারে বোধহয়। পঁচিশ বছরের নিঃসঙ্গ পৌরুষত্ব আবার জানান দিতে থাকে শঙ্কর ডোমকে। আর এই মেয়েকে কাছে পেতেও সমস্যা নেই। পয়সা ফেললেই খুলে যাবে দরজা। বিশুদের দেওয়া বর্ণনা আরও উৎসাহিত করে তোলে ওকে। কাল রাতে ঠেক থেকে ঘরে ফেরার সময় মাঠের কোণটায় হঠাৎ করে চোখে পড়ে যায় সরিতা। এদিকটায় হ্যালোজেনের আবছা আলো এসে পৌঁছায়। মাতাল শঙ্করের আবছায়াটা ডেকে ওঠে সামনে হেঁটে যাওয়া নারীমূর্তিকে— এ সরিতা।

মা নাইট ডিউটিতে গেলেই সব দরজা জানলা বন্ধ হয়ে যায় ওর ঘরের। রাতের অন্ধকারে ঘরে ঢুকে আসে অচেনা পুরুষ। সরিতার চর্চা বস্তি ছাড়িয়ে ধাক্কা মারে মদের ঠেকেও।

ঘুরে দাঁড়ায় নারীর ছায়া— ক্যায়া রে।
চুপ করে যায় শঙ্কর। কীভাবে কথাটা পাড়বে বুঝে পায় না। —ক্যায়া রে। কুছ তো বোল। চুপ কিঁউ হ্যায়? ধমকে ওঠে সরিতা।
—আজ রাত মেরি সাথ জায়গি ক্যায়া?
—কাঁহা? বিস্ময় ঝরে পড়ে সরিতার কন্ঠে।
—আজ রাত শুয়েগি মেরে বিস্তর পে? মাস্তি করেগি?
—হারামি। শালা। তেরা দিমাগ তো ঠিক হ্যায়?
—ফিকর মত কর। পয়সা তো মিলেগা। বরাবর মিলেগা। ইহ্‌ দেখ। বারমুডার পকেট থেকে এক দলা নোট বের করে আনে নেশাগ্রস্ত হাত।
—শালা আপনি উমর দেখি হ্যায়? গলা চড়াতে থাকে সরিতা।
—তো ক্যায়া? সভি তো যাতে হ্যায় তেরি বিস্তর পর…
—কামিনে। সরিতার চিৎকারে কথা থেমে যায় শঙ্করের। চারপাশের দু-চার জোড়া চোখও জড়ো হতে থাকে।
—ঠহ্‌র। তুঝে দিখাতি হু বুডধে। মেরি সাথ বদতমেজি?!
শঙ্কর ক্রমশ মানুষ থেকে বডি হতে থাকে।

আজকের নেশাটা নিজের জন্য নয়, সরিতার জন্য করছে শঙ্কর। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছে সরিতার শরীর। আর মনে পড়ে যাচ্ছে কালকের অপমানটা। পাকস্থলীতে আগুন ঢেলে চাপা দিতে চাইছে ও কালকের ঘটনা। শালিকে পেলে একদম রেপ করে দেব। এত দেমাগ হারামজাদির— নিজের মনে বিড়বিড় করে শঙ্কর। ওর মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে মানুষ আর বডি শঙ্করের। শান্ত হতে চাইছে ও। চাপা দিতে চাইছে কালকের ঘটনা। বারবার বডি হয়ে যেতে চাইছে ও।
—শঙ্কর, ছোটোবাবু ডাকছেন। অফিসের অ্যাটেন্ডেন্ট মিহির এসে ডেকে যায়।
ডেডবডি এসেছে নিশ্চয়। অফিস সুদ্ধু সবাই জানে প্রয়োজনের সময় কোথায় পাওয়া যাবে ওকে। বিশুকে নিয়ে ইট ছেড়ে উঠে পড়ে শঙ্কর। একবার জোরে ঝাঁকিয়ে নেয় নিজের মাথা। কাজের সময় এসেছে। এখন আরও গভীর ভাবে নিজেকে বডি করে নিতে চায় ও।
একটা পুলিশের গাড়ি। একটা মোটর ভ্যানে বডি নিয়ে এসেছে পার্টি। অভিজ্ঞ চোখে পার্টিকে মেপে নেয় শঙ্কর। বাড়ির লোকেরাই বডি নামাচ্ছে গাড়ি থেকে। ছোটোবাবু সব কাগজ মিলিয়ে নিচ্ছেন। শঙ্কর গিয়ে পাশে দাঁড়ায়।
—উফফ কী গন্ধ! সারাক্ষণ মাল খেয়ে চলেছে শালা। পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক চাপা দেয় অফিসের ছোটোবাবু। লোকটা যে কত হারামি তা হাড়ে হাড়ে জানে শঙ্কর। তবু অফিসের বাবু বলে কথা। একটা দেঁতো হাসি দেয় ও।
—সুইসাইড কেস। হ্যাঙিং। ফিমেল বডি।

চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছে সরিতার শরীর। আর মনে পড়ে যাচ্ছে কালকের অপমানটা। পাকস্থলীতে আগুন ঢেলে চাপা দিতে চাইছে ও কালকের ঘটনা। শালিকে পেলে একদম রেপ করে দেব।

আউরে যায় ছোটোবাবু। শুনতে শুনতে মনে মনে হিসেব করে নেয় শঙ্কর। জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক। ঝুলে পড়া সুইসাইড কেস— তার মানে কাটাছেঁড়া নেই। গলায় হয়তো দাগ থাকবে। খাটুনি কম। মনে মনে খুশিই হয় শঙ্কর। তবু খুশিটা বাইরে যাতে প্রকাশ না হয়, তা খেয়াল আছে অভিজ্ঞ শঙ্করের।
—নিন। আপনারা ডোমের সাথে কথা বলে নিন। আর এখানে একটা সই করে আমাকে ছেড়ে দিন।
ধূর্ত শিয়াল শিকার দেখেও যেমন না দেখার ভান করে ঝাঁপিয়ে পড়ার হিসেব করতে থাকে, ঠিক তেমনভাবেই ছোটোবাবু পার্টিকে শঙ্করের দিকে এগিয়ে দিয়ে নজর রাখতে থাকেন সবকিছুর উপর। শঙ্কর একটু সাইডে চলে আসে।
দুঃখ কান্নাকাটির মধ্যেই প্রতিটা পার্টিতে অন্তত এমন একজন লোক থাকে যে কঠিনভাবে যোগাড়যন্ত্র, দরদাম করতে পারে। দুঃখ তাকে তেমন ছুঁতে পারে না। শঙ্কর জানে সেই লোকগুলোও ওর মতন এক একটা বডি। এমনি একটা বডি ওর সাথে এসে দরদাম শুরু করে। শঙ্করের উসুল, দরদাম ঠিক না হলে ডেডবডিতে হাতও দেবে না। সরকারিভাবে যদিও এটা হওয়ার কথা নয়, তবুও সরকারি নিয়ম সরকারি লোকেরাই কে কবে মেনে চলেছেন! মালদার পার্টি বুঝেই দর হাঁকিয়ে দেয় শঙ্কর। ও শুধু একা নয়, বিশু তো পাবেই; আবার এই বখরা যাবে ছোটোবাবু থেকে পুলিশের কাছেও।
দরাদরি একসময় শেষ হয়। হাতে পাওয়া টাকাটা বারমুডায় গুঁজে নেয় শঙ্কর।
—একটু দেখো, মুখটা যেন ঠিক থাকে।
—হ্যাঙ্গিং কেসে মুখে কিছু হয় না। যেমন আছে তেমনি থাকবে। বাকিটা ঠিকমতন ঢেকে সেলাই করে দেব।
—বুঝতেই তো পারছ। আসলে এখান থেকে আবার বাড়িতে…
—কোনো চিন্তা করবেন না। একটা বিড়ি ধরায় শঙ্কর। কাল পিএমের পর কাপড় আর সূঁচ-সুতো নিয়ে আসবেন।
কাপড় আর সূঁচ-সুতো যদিও সরকারিভাবে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কিন্তু স্টকের পুরোটাই বছরের প্রথমেই বিক্রি হয়ে গেছে। প্রফেশনালি কথা বলতে বলতে একেবারে বডি হয়ে যায় শঙ্কর। বাঁশের মাচাটা ধরে ডেডবডিটাকে মর্গে ঢোকায় ও আর বিশু। আর কেউ এর ভিতরে ঢুকবে না জানে ওরা। মৃতদেহের ভয় আর কাঁচা মাংসের গন্ধ এই ঘরটা আর বাকি জগতের মাঝে একটা দেওয়াল তুলে দেয়। ডেডবডিটাকে সাইড করে রাখার পর ঘরের এসিটা চালিয়ে বেরিয়ে যায় বিশু। আজ আর কাজ নেই। কাজ সেই কাল ডাক্তারবাবু পিএম করার সময়। মর্গে আর কোনো বডি নেই। ঢাকা কাপড়টা সরিয়ে নতুন আসা বডিটার দিকে তাকায় শঙ্কর। ঢাকার কাপড়টাও বিক্রি করে ও। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের একটা মেয়ে। চুড়িদার পরা। গলায় ফাঁসের দাগ। জিভটা বেড়িয়ে আছে, রক্ত জমে কালচে হয়ে গেছে জায়গাটা। অভিজ্ঞ হাতে জিভটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় শঙ্কর। এবার বডিটার দিকে তাকাতেই যেন বিদ্যুতের ঝটকা খায় ও। বাঁশের মাচাটার উপর যেন সরিতা শুয়ে আছে। অবিকল ওইরকম। মাথাটা ভালো করে ঝাঁকায় শঙ্কর। রাগের মাথায় আজ অনেকটা মদ গিলেছে ও। নেশাটকে তাড়াতে চায়। তবু একই দৃশ্য। শুয়ে আছে সরিতা। রাগটা ফিরে আসছে শঙ্করের। মানুষ-শঙ্করটা ক্রমশ চেপে বসছে বডি-শঙ্করের উপর। বডি-শঙ্করটা ক্রমশ হয়ে যাচ্ছে মানুষ-শঙ্কর।

পরের দিন সামান্য হ্যাঙ্গ কেসের পিএম করতে গিয়ে থতমত খেয়ে গেলেন সরকারি ডাক্তার। পুলিশের রিপোর্টের সাথে কিছুরই মিল পাচ্ছেন না তিনি। মৃতার পোষাক ছিন্নভিন্ন, মুখে আঁচড়ের দাগ, ঠোঁট ছিঁড়ে গিয়েছে। সবচেয়ে চিন্তায় আছেন ডাক্তার—ধর্ষণটা মৃত্যুর আগে, নাকি পরে!

Facebook Comments

পছন্দের বই