লেখক নয় , লেখাই মূলধন

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের গল্প

প্রত্যাশা নিরোধক

ধ্রুবর কোনোদিনও প্রত্যাশা ছিল না। আমার মনে প্রত্যাশা জন্মাক— তাও চায়নি। অথচ আমি অসাবধানে প্রত্যাশাধারণ করে ফেললাম। রাতে একা ছাদে বসে বসে নিজেকে বোঝাতাম, “আসলে কেউ কাউকে ভালোবাসিস না। প্রথম প্রথম, তাই ঘোর লাগছে। নেশা… অ্যাডিক্ট হয়ে গেছিস। বেরিয়ে আয়… না হলে এরপর বাংলা সিরিয়ালের মতো হবে। আজ গিফটের কথায় ইমোশনাল হয়েছিস, কাল অন্য কোনো কারণে হবি। ঠিক ততটাই সময়ে চেয়ে বসবি যতটা ধ্রুব ওর পরিবারকে দেয়… ন্যাকামো এবং শয়তানী একসাথে করা হবে সেটা!”

আসলে, আজকাল ধ্রুবকে সত্যিই খুব চালাক মনে হয়। ওর ইমোশনাল উইকনেস নেই। নিজের জীবনের স্বাদ বদলাতেই আমাকে এভাবে অ্যাপ্রোচ করেছিল— অসমবয়সী বন্ধু, হেলদি রিলেশনশিপ। আর পরিণত বয়সের ইন্টেলেকচুয়াল, ইমপ্রেসিভ ব্যক্তিত্বদের প্রতি আমার দুর্বলতা আমাকে মারল। ধ্রুব আমার কাছে অবশ্যই এমন কিছু… যা সমবয়সী কোনো পুরুষ-বন্ধু কোনোদিন হতে পারেনি।

“You who suffer because you love, love still more. To die of love, is to live by it.”

— তুমি আমার কাছে ফাদার-ফিগার নও… আর আমিও তোমার মেয়ের মতো নই। তাহলে সমস্যাটা কোথায় বলো তো?

— বাবার মতো, মেয়ের মতো… এ-সব লেবেলিং না থাকলে কনসার্ন ফুরিয়ে যায় না।

— ও… কনসার্ন?! কেমন কনসার্ন শুনি? পেশেন্টের জন্য ডাক্তারের? না… কনসার্নটা ঠিক কেমন… হেল্প মি?

— তোকে এখন যা-ই বলব… ভুল মানে করবি। তিক্ততা বাড়বে।

— না, তুমিই তো বলছ কনসার্নের কথা। কোনোভাবে আমি কনসিভ করলে এই কনসার্নটা থাকত তো? আর আমি অ্যাবর্ট করতে না চাইলে?

আসতে আসতে অনেক কিছুই অপছন্দ হচ্ছিল মানুষটার। জড়াতে চাইছিলাম না… অথচ প্রত্যাশাটা ঘন হচ্ছিল। অনেকদিন পর দেখা হলে লম্বা একটা ইন্টারকোর্স… দু-তরফে কাঙ্ক্ষিত অর্গ্যাজম। তারপরেই ও উঠে বসে সিগারেট ধরাত, অথবা মোবাইলে ম্যাসেজ দেখতে শুরু করত। যেন ক্লায়েন্ট, মিটে গেছে… এবার আমি চাইলে কিছুক্ষণ থাকতে পারি, না হলে আসতে পারি। নিজেকে ডিট্যাচ করার চেষ্টাও করছিলাম… ভাবতে পারিনি এভাবে একটা ধাক্কা আসবে। দু-তিন দিন কনডম না ব্যবহার করার জন্য ওকে দোষ দিইনি… ইচ্ছে আমারও ছিল। কিন্তু যখন কাঁধে মাথা রেখে জানতে চাইলাম, “টেস্ট পজিটিভ এলে কী করবে?”… নিরাসক্ত ভাবে বলল, “কেন? অ্যাবর্ট করে দেবে?”

কোনো সংকোচ নেই… দ্বিধা নেই… রাস্তার ধারে গাছের ডাল ছেঁটে দেওয়ার মতো কোল্ড অ্যান্ড ইজি সলিউশন।

তুমি তো জানতে আমার ওভারিয়াল সিস্টের কথা? তুমি তো জানতে আমাকে ডিপ্রেশনের জন্য ওষুধ খেতে হয়? ডাক্তার ধ্রুব… তখন কোথায় ছিল তোমার কনসার্ন?

একটা আপাত উষ্ণ মনের মানুষকে এমন বেনিয়া ক্লায়েন্টের মতো ঠান্ডা মাপা উত্তর দিতে দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। ডাক্তারি করতে করতে কি সবরকম কাটা-ছেঁড়াতেই এরা সাবলীল হয়ে যায়?

সেদিন ফিরে এসে দুটো ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলাম… প্রায় এক সপ্তাহ রোজ ঘুমের ওষুধ খেতে হত। বাবা আলাদা থাকা শুরু করার পর বাড়িতে লুকিয়ে যার কাছে কাউনসেলিং করতে যেতাম… আবার তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলাম। আবার অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট, নার্ভের ওষুধ— এ-সব দিল। তাকে সব কথা ভেঙে বলতে পারিনি… একটা কাল্পনিক বয়ফ্রেন্ডের নামে দোষ চাপিয়ে দিলাম। দুঃস্বপ্ন দেখা, হাত কাঁপা, ইনসিকিওরিটি— এ-সব বললাম।

ধ্রুবর মতো কারো জন্য নিজের জীবনের স্বাভাবিকতা নষ্ট করছি— এটা ভেবে সব থেকে বেশি রাগ হত নিজের ওপর।

কলকাতার বাইরে পিএইচডি করতে যাচ্ছি— জানিয়েছিলাম ধ্রুবকে। আমার এই স্পেসটা দরকার ছিল… শুধু ধ্রুব না, চেনা জানা সবার থেকে… সবকিছুর থেকে। ইচ্ছে করেই কলকাতার বাইরে অ্যাপ্লাই করলাম। খুব সাফোকেটিং লাগছিল চারপাশের সবকিছু। একরকম মোনোটোনাস মানুষগুলোকে। অসহ্য লাগছিল বোনকে, মাকে। মনে-প্রাণে চাইছিলাম পালিয়ে যেতে।

ধ্রুব বারণ করল না। শুধু বলল— তুই বুঝবি না, জানি। বাট আই রিয়েলি ফিল ওরিড ফর ইয়ু। দূরে থাকবি, একা থাকবি… দুশ্চিন্তা হবে— কেউ না কেউ তোকে এক্সপ্লয়েট করছে। কোনো না কোনোভাবে তুই ব্যথা পাচ্ছিস।

“এক্সপ্লয়েট তুমিও করেছ ধ্রুব। ব্যথাও দিয়েছ… ব্যথা দিতে ভালোই লাগত তোমার।”— এ-সব চেপে রেখে বললাম, “ও সব ফালতু চিন্তা ছাড়ো। হাজারটা ছেলেমেয়ে পড়তে যাচ্ছে। নো বিগ ডিল। যাদের চিন্তা করার তাদের জন্য করো।”

ধ্রুব কথা বাড়াল না। যোগাযোগ রাখার জন্যে জোরও করল না। শুধু বলল, “খোঁজখবর রাখিস… এলে জানাস। কিছুই তো তোর অজানা নয়।”

ফর আ চেঞ্জ… সেদিন আমরা ক্লিনিকে না, দেখা করতে গেছিলাম বাগ বাজার ঘাটের ওদিকে। পিএইচডি-তে চান্স পেয়েছি বলে ট্রিট দিয়েছিল… খেয়েওছিলাম নির্লজ্জের মতো।

“‎And yet I have had the weakness, and have still the weakness, to wish you to know with what a sudden mastery you kindled me, heap of ashes that I am, into fire.”

বাসন মাঝতে মাঝতেই আমার রুম-মেট দিশারীর লাউড মোনিং শুনতাম। এত কাছ থেকে অন্য কাউকে এভাবে গোঙাতে শুনিনি। নিজে মোন করা আর অন্যরটা শোনা এক নয়। তবে এ-সব সয়ে গেছিল। আমার প্রয়োজনটা ছিল অন্যরকম। খুব ইচ্ছে করত পুরোনোদের কাবার্ডে বন্ধ রেখে বেশ কিছু নতুন বন্ধুদের মাঝে বাঁচতে। অ্যাডিকশন ছাড়াতে অনেক সময়ে যেমন বিকল্প কিছু ধরিয়ে দেওয়া হয়… হয়তো সেরকম। ধ্রুবকে ভোলার চেষ্টা করলে ভেতরে একটা চাপা কষ্ট হত। সেক্স স্টার্ভড মনে হত নিজেকে। কাউকে বলতে পারতাম না। হয়তো মিডল এজ ক্রাইসিসের মতো শোনাত… লোকে হাসত শুনে, আলোচনা করত আড়ালে।

অরিঘ্ন ছিল এক চমৎকার থেরাপি। বিন্দাস… গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে। নিজের ফ্ল্যাটে ঘর অন্ধকার করে, নীল-লাল এলইডি-চেইন জ্বালিয়ে ট্রান্স মিউজিক শোনে। শখের গিটার বাজায়। চাকরি করে… কিন্তু দায় নেই উন্নতি করার। কমিটমেন্টের ধারে কাছেও যাবে না… ঠিক করে রেখেছে। ওর ঘরে বসে হুঁকো টানতাম… রেট্রো মিউজিক শুনতাম… বাইরে থেকে যা হোক আনিয়ে খেতাম… সঙ্গে রাম। অরিঘ্নও আসত আমাদের ফ্ল্যাটে। রুম-মেট বুঝত আমারও কেউ আছে… শুধু আমিই একতরফা মোনিং শুনতে বসে নেই। ভালো জেল করত আমাদের মধ্যে। এমনকী আমার টপ ওর গায়ে হত, আর ওর পাঞ্জাবী আমি পরে বসে থাকতাম। ওই আমাকে অ্যাডভাইস দিত— তুই চুল ছোটো করে ফেল… আমি লম্বা করি। তুই কালার্ড লেন্স নে, আমি কাজল পরি। তুই ট্যাটু কর… আমি পিয়ার্সিং করি। ধ্রুবর ছায়া থেকে আমাকে টেনে সরিয়ে আনছিল ছেলেটা। অরিঘ্নকে আমি থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করেছিলাম, কিন্তু ঠকাতে চাইনি। নিশ্চিন্ত ছিলাম, ওর কমিটমেন্ট নেই… ও আমার ওপর মানসিকভাবে নির্ভর করে না। অবাক হতাম… বন্ধুত্বর থেকে শারীরিক সম্পর্কের এই কেমিস্ট্রিটা এত ম্যাচিওরভাবে সামলাতে দেখে।

ওই দিনগুলোতে অরিঘ্ন পাশে না থাকলে হয়তো ম্যানিক ফেজটা আবার জাঁকিয়ে বসত, স্ট্রেসটা আমাকে পিষে ফেলছিল।

দু-তিন সপ্তাহর গ্যাপ হলে অ্যাডিক্টদের মতোই একটা কষ্ট হত। ধ্রুবকে তত বেশি ঘেন্না করতাম। বেসিনে গিয়ে থুতু ফেলতাম ধ্রুবর মুখটা মনে করে… দায়ী করতাম সব কিছুর জন্য। অরিঘ্নকে ডেকে পাঠাতাম, বা ওর ফ্ল্যাটে চলে যেতাম… হয়তো না জানিয়েই। দরজায় তালা থাকলে সিঁড়িতে কিংবা রাস্তায় বসে অপেক্ষা করতাম। কিছুক্ষণ ফোরপ্লের পরেই মাথাটা একদম খালি হয়ে যেত। ধ্রুব যেমন পছন্দ করত, সেভাবেই এক্সপার্ট হয়ে উঠেছিলাম। ধ্রুব নিজেকে বাঘ ভাবত, আর পরাজিত শিকারের মতো অসার হয়ে যেত শেষের দিকে। অরিঘ্নকে পেয়ে মাঝে মাঝে আমার বাঘ-নখ বেরিয়ে আসত। ও সামলাতে পারত না। মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে নিত, নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার ভান করত। ধ্রুব বলত, “তোকে অন্য কেউ ফোর্স করবে, তোর কষ্ট হবে— ভাবলে আমারও কষ্ট হয়, বিশ্বাস কর?”… এগুলো মনে পড়লে আরও বেশি জোর করতাম অরিঘ্নকে, ডমিনেট করতাম ভীষণ রকম। “ব্লোজব পেলে তো এনজয় করিস! চাটার সময় হেজিটেট করছিস কেন? চাট?!” দু-তিনবার চড়ও মেরে দিয়েছি, মৃদু আপত্তি করছিল বলে। সরি বলেছি পরে। মুড ঠিক করতে নিজের এল শরীরে এলইডি চেইন জড়িয়ে বলেছি— চল ফটোশুট কর!

ও ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে পারত… বা সোজা বলে দিতে পারত— পোষাচ্ছে না। তার বদলে শুধু জল খাওয়া, সিগারেট খাওয়া, জয়েন্ট বানানো… এসবের নামে পালিয়ে বাঁচত। একবার শুধু গায়ের দাগগুলো দেখিয়ে বলেছিল, “এরপর অ্যান্টিসেপ্টিকটাও নিজেই আনবি। কলকাতা গেলে মা-র সামনে জামা খোলা চাপ হয়ে যায়!”

সহ্য, কিংবা সাহায্য… কেন অরিঘ্ন এটা করত, জানি না। ওর পক্ষে সম্ভব ছিল আমাকে বিছানা, ফ্ল্যাট কিংবা জীবন থেকে লাথি মেরে সরিয়ে দেওয়ার। কিন্তু ও ধ্রুব নয়। তাই, সচেতনভাবেই পারতাম না ওকে আঘাত দিতে। আবার ভয়ও হত… আর একটা ডুবো নির্ভরতায় ধাক্কা খাব।

কলকাতায় যিনি কাউনসেলিং করতেন, তাঁকে ফোন করলাম… ভিডিয়ো-কলে কাউনসেলিং শুরু করলেন। এছাড়া আর উপায় ছিল না।

“If you loved someone, you loved him, and when you had nothing else to give, you still gave him love.”

বোনের গায়ে হাত তুললে বোনও আমাকে ছেড়ে দেবে না। আর, মা মানসিকভাবে অভিভাবক নেই আর। কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। এভাবেই কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাবে মেয়েটা। এটাই ওর ভবিষ্যৎ।

একবার কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম ঠাট্টার ছলে— “আয়নায় গিয়ে নিজের মুখটা দেখ আগে!” তারপরই মনে পড়ল— একবার তিন দিন স্কুলে যায়নি ও… একজন টিচার ক্লাসে এই কথাটা ওকে বলেছিলেন বলে। ও মুখে কিছু বলল না, দেওয়ালে ঝোলানো আয়নাটা নিয়ে ছাদ থেকে নীচে ফেলে দিল।

অথচ বোনকে কিছুটা হলেও আমি ধ্রুবর কথা বলেছি। প্রফেসর আর কলেজের বন্ধুদের কথা বলেছি। অরিঘ্নর কথা বলেছি।

যদি আমি দুটো কথা বললে, ও একটা কথা বলে। এতে শুধু আমার সিক্রেট জেনেছে, আমি তেমন কিছুই পাইনি ওর থেকে ব্ল্যাকমেল করার মতো। তাও ছোটো বোন… আত্মকেন্দ্রিক আর ঢ্যাঁটা হলেও কিছুটা ভরসার জায়গা। মা-বাবার থেকে বেশিই ভরসার জায়গা। দিদিমা চলে যাওয়ার পর আর কেউই নেই কথা শেয়ার করার মতো।

এইরকম একটা ঢ্যাঁটা, অকৃতজ্ঞ এবং আত্মকেন্দ্রিক ভরসার কথা উপেক্ষা করেই ধ্রুবর কাছে গেলাম। বেড়ালের নখ লেগেছে— এটা মিথ্যে নয়।

দুপুর নয়, সন্ধ্যেবেলা… পাঁচজন পেশেন্টের পর। মানিকদা জিজ্ঞেস করল কেমন আছি। ভাগ্যিস বলেনি— কদ্দিন পর এলে!

ধ্রুবর মধ্যেও তেমন পরিবর্তন লক্ষ করলাম না আমাকে দেখার পর। হাতে আঁচড়টা দেখে বলল, “এমন কিছু না। এর থেকে বেশি আঁচড় লাগে মানুষের।”

— জন্তুর আঁচড়।

— হ্যাঁ জন্তুর আঁচড়… মানুষের আঁচড়… চিন্তা করার মতো কিছু না।

— ইনজেকশন লাগবে না? সিরিয়াসলি বেড়ালের নখ লেগেছে!

— নিয়ে রাখো তাহলে… সেফটি। মানিককে বলে দিচ্ছি। আর একটা অ্যান্টিসেপ্টিক লিখে দিলাম। এনাফ।

— ইচ্ছে করে আঁচড়ায়নি, লেগে গেছে অ্যাক্সিডেন্টালি।

— হুম, অ্যাক্সেন্ডান্টালিও আঘাত লাগে… নাম?

‘নাম’ জিজ্ঞেস করতে থমকে গেলাম। প্রায় এক বছর কোনো যোগাযোগ নেই, রাখতেও চাই না। কিন্তু এতটা?!

চুপ থাকতে পারলাম না, বলে ফেললাম, “কিছুই মনে পড়ছে না?”

প্যাডে আমার নামটা লিখল, পদবিটা লিখল না। লিখতে লিখতেই বলল, “কিছুই ভুলিনি।”

চুপচাপ দেখলাম… প্রেসক্রিপশন লিখে গেল ভাবলেশহীন মুখে। ফ্যানের হাওয়ায় কপালের সামনে এসে পড়া চুলগুলো উড়ছিল। আগে হলে সরিয়ে নিয়ে কপালে একটা চুমু খেতাম। প্রেসক্রিপশনটা হাতে দেওয়ার আগে আবার নামের কাছে নিয়ে গেল কলমটা, জিজ্ঞেস করল— “পদবিটা যেন কী?”

— ডু ইয়ু ইভেন নো মি?!

— পদবি মনে থাকে না… মানুষ থেকে যায়।

কোনো রকমে ফিজটা দিয়েই প্রেসক্রিপশনটা হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমার ভুল, পুরোপুরি আমার ভুল। ধ্রুব অনুতপ্ত হওয়ার কোনো কারণই খুঁজে পায়নি এই এক বছরে।

ঘরে ফিরতেই বোনকে দেখলাম থমথমে মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলে উঠল, “আমায় তো কিছু বলিসনি!” টপ-টা চেঞ্জ করতে করতে নিতান্ত বিরক্তি নিয়েই জানতে চাইলাম— কীসের কথা, কী জানানো হয়নি। তখনও ইঞ্জেকশনের জন্য হাতটা ব্যথা করছিল। নখের আঁচড়ের থেকে ছুঁচ ফোটানোর ব্যথা বেশি। “অরিঘ্নদাকে ফোন করেছিলাম।” কথাটা শুনেই বোনের দিকে ঘুরে চেঁচিয়ে উঠলাম, “কী?!”

— চিল! নম্বর ছিল… কল করেছিলাম।

— আমার ফোন ঘেঁটে ওর নম্বর নিয়েছিস?

— সো হোয়াট?

— ঠিক করিসনি। আই অ্যাম নট ওকে উইথ ইট। এখনই স্ক্রিনলক মারব…

— সে তোর প্রাইভেসি নিয়ে তুই চাট… বাট ইয়ু শুড হ্যাভ টোল্ড মি! এক্সপেক্ট করেছিলাম জানাবি যে ইয়ু হ্যাভ মুভ্ড অন।

কথাটা মনের ভেতর থিতিয়ে নিতে কিছুটা সময় চলে গেল। অরিঘ্নর ব্যাপারে বোনকে হালকাভাবে বলেছিলাম। প্রোফাইল ঘেঁটে পোস্ট-কমেন্ট এ-সব দেখে ও-ই ধরে নিয়েছিল আমরা রিলেশনে আছি। আমিও বলে দিয়েছিলাম ফার্স্ট স্টেজ… কেমন এগোয়ে দেখি।

অরিঘ্নর সঙ্গে বোনের কতদিন ধরে কথা চলছে কিছুই জানি না… আজ জানলাম ওদের মধ্যে কথা হয়। অরিঘ্ন আমাকে জানায়নি, অথচ বোনকে জানিয়েছে— ও বিদিশার সঙ্গে রিলেশনে আছে; আমাদের মধ্যে আর কিছু নেই। অথচ আমি জানলাম না… আমারই ব্যাচমেট বিদিশার সঙ্গে ও রিলেশনে আছে!

একবার মনে হল— বোনকে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য পুরোটাই ব্লাফ দিয়েছে অরিঘ্ন। বা আমাদের দু-জনকেই কাটিয়ে দেওয়ার জন্য…

বিদিশা বা অরিঘ্নর প্রোফাইলে ওদের দু-জনের সম্পর্কে এমন কিছুই পাইনি… যার থেকে আন্দাজ করা যায় ওদের মধ্যে কিছু brew করছে।

আমার এই ফ্যান্টম রিলেশনের শেষ হয়ে যাওয়ার খবরটা আমার একেবারেই পাত্তা দেওয়ার কথা না। অরিঘ্ন আর বিদিশা দু-জনকেই চিনি… জিজ্ঞেস করলেই হয়। তাও কেমন বারবার মনে হচ্ছিল— বিদিশার জন্য অরিঘ্ন আমাকে ডিচ করল। লুকিয়েছে আমার থেকে ইচ্ছে করেই। বিদিশাও নিশ্চয়ই জানে না— আমি ওর ফ্ল্যাটে যাই, ও আমার ফ্ল্যাটে আসে।

অরিঘ্নও যেন কীভাবে ধ্রুব হয়ে উঠল হঠাৎ… শুধু বোনের মুখ থেকে শোনা একটা কথায়…

বুকের ভেতর থেকে একটা কান্না ঠেলে আসছিল। পারলাম না। অরিঘ্নর ম্যাসেজ দেখতে বা ওকে ফোন করতেও ইচ্ছে হল না। ফোনটা সুইচ অফ করে ছাদে বসে একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছিলাম। বোন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল… বিচ্ছেদের সান্ত্বনা। লুকিয়ে কেনা রামের বোতলটা ব্যাগ থেকে বার করে রাখল। যেমন স্নেহময়ী মা সন্তানের সামনে মন খারাপের সময়ে প্রিয় খাবার এনে রাখে।

রামের বোতলটা শেষ করতে করতেই মনে পড়ল… কাল আমার কাউন্সেলিং-এর শেষ দিন। উনিই বলেছিলেন ধ্রুবকে একবার ফেস করে দেখতে… ওভারকাম করতে পারছি কি না। ফেস করতে বলেছিলেন, আমি বাঁশ নিয়ে এলাম। কাল দিদিমার কথা বলব। মাঝে মাঝে দিদিমাকে স্বপ্নে দেখি। দিদিমার মৃতদেহ ফুল-দিয়ে সাজানো, শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইলেকট্রিক চুল্লি না, নিমকাঠে দাহ হচ্ছে। দাহ হওয়ার মাঝে যখন সবাই অন্য দিকে… দিদিমা আমার হাত ধরে মন্দিরের সিঁড়িতে বসে আছে। কেউ ওভাবে আমার হাত ধরেনি। ধরে না। আমাদের কথা হয় না। আগুনের শিখা অন্ধকার আকাশের দিকে ভেসে ভেসে যায়। ঝিঁঝিঁ ডাকে একটানা, আর দূরে শেয়াল… মাঝে মাঝে। দিদিমা নিজের সৎকার দেখে চশমা না পরেই… এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে। যেভাবে দশমীর দিন মায়ের বরণ দেখত তাকিয়ে তাকিয়ে।

ছ্যাঁকা লাগতেই সিগারেটটা আঙুলের ফাঁক থেকে পড়ে গেল। বোন ছাদে চিৎ হয়ে পড়ে আছে আউট হয়ে… বিড় বিড় করছে। ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোর দিদুনকে মনে পড়ে?” চোখ খুলে তাকাল, তারপর আকাশের চাঁদের দিকে দেখিয়ে হাতটা ফেলে দিল আবার।

দিদুন বলেছিল—

“ব্যথার নিজস্ব স্মৃতি থাকে। যে ব্যথা দিয়েছিল, যে ব্যথা ভুলিয়েছিল, অথবা সারিয়েছিল— তাদের স্মৃতি। তোর দাদু আমার গায়ে দু-একবার হাত তুলেছিল, সে-ব্যথার দাগ নেই। কিন্তু একবার একজন হাতটা পিছমোড়া করে এমন মুচড়ে দিলে!… মনে করলেই কবজিটা এখনও টনটন করে। এখন কেমন দেখতে হয়েছে কে জানে!”

প্রথম পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই