লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ব্রজ সৌরভ চট্টোপাধ্যায়ের গল্প

শীতকাল কেন আসবে সুপর্ণা

ঘড়িতে রাত প্রায় তখন দুটো। গায়ের ওপর থেকে পাতলা চাদরটা সরাই আমি। পাশেই বিউটি। একটা অস্বস্তিকর গোঙানির মতো আওয়াজ। চাদরটা সরাতেই বিউটি চোখ মেলে তাকায় আমার দিকে। অবাক! ঘুমোয়নি এখনও? কী হলো হঠাৎ ওর? অন্ধকার হাতড়ে বেডসুইচটা অন করতেই, হাসি পায় আমার।

বিউটি আর আমার প্রেমটা প্রায় সাত বছরের। সাত বছর গড়ানোর পর আমাদের চারহাত এক হয়। আমার অতটা তাড়া মোটেও ছিল না। বিউটির বাড়িতে এই নিয়ে চাপাচাপি শুরু হলে আমিও ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাই। আর সম্মতি পাওয়ামাত্র কীরম হুড়োতাড়া লেগে বিয়েটা সারতে হয় প্রখর জ্যৈষ্ঠে। তারপর হানিমুন। দশদিনের মাথায়— কাশ্মীর। বেডসুইচটা টিপতেই হাসিটা পাওয়ার কারণ এখানেই। অসম্ভব শীতকাতুরে বিউটি। আমরা যখন হানিমুনে, কাশ্মীরে তখন হালকা ঠান্ডা। যে ঠান্ডা আমাদের এখানেডিসেম্বরের শুরুতে সচরাচর থাকে, সেরকম। কোথায় এঞ্জয় করবে চুটিয়ে, তা নয়। সন্ধে নামতেই বিউটি পা-মোজা, হাত-মোজা, সোয়েটার, টুপি, ইভেন কাশ্মীরে কেনা নতুন জ্যাকেট আর পুরু কম্বল জড়িয়ে হোটেলরুমে। তারপর ফায়ার প্লেস, এমনকী রাম খাইয়েও ওকে বের করতে পারিনি কোনো সন্ধেয়। হানিমুনের বেশিরভাগটা সময় আমি তাই একাই ঘুরেছি। মাঝে মাঝে এমনও মনে হয়েছে— ধুস্‌ শালার প্রেম-বিয়ে-বৌ ! তারক-সুমন্ত এদেরকেও নিয়ে আসতে হতো হানিমুনে। অন্তত ঘোরাঘুরিটুকুর জন্য।

আলোটা জ্বালতেই দেখলাম, ঠিক একটা পোঁটলার মতো জড়োসড়ো আর অসম্ভব কুঁকড়ে শুয়ে বিউটি। চোখদুটো আর কপালটুকু কোনোরকমে দেখা যাচ্ছে। গায়ের ওপর সেই কাশ্মীরি কম্বল। আমি হাসছি দেখে লেপ-কম্বলের ভেতর থেকেই ঝামটা দিয়ে উঠল বিউটি। কোনোরকমে হাসিটা সামলে শুধোলাম— জ্বর-টর এসেছে নাকি? দেখি কপালটা দেখি। হাত দিয়ে দেখি— নাঃ ! একদম নর্মাল। বরং ঘেমে গেছে বিউটি। বেশ ভালোরকমই ঘেমেছে।

একটানা কথাগুলো বলার পর থামল দিব্যেন্দু। মোবাইলের রেকর্ড ফাইলে সেভ করল পুরোটা। পকেট থেকে বের করল হেডফোন। কানে নিল। নাঃ ঠিকঠাক শোনা যাচ্ছে। আশপাশের আওয়াজ এসেছে বটে। তবে তাতে কথাগুলো অস্পষ্ট হয়নি। হেডফোন, মোবাইল পকেটে পুরে, দিব্যেন্দু বের করল সিগারেট। জ্বালল। আর তখনই শুনতে পেল সাড়ে ছটার বাসটা স্টার্ট নিচ্ছে সামনের স্ট্যান্ডটা থেকে। থাক, আজ না-হয় পরের বাসটাতেই যাবে সে। সিগারেটটা শেষ করা যাক বরং। একটু চা খেলে মন্দ হতো না। দিব্যেন্দু সামনের চায়ের দোকানটায় গিয়ে দাঁড়াল— একটা লিকার। দোকানি চেনা। হাসল একবার— বসুন। চা-টা হাত বাড়িয়ে নিল দিব্যেন্দু। দোকানে টানানো আগুনে দড়িটায় ধরালো আর একটা সিগারেট। পকেট থেকে বের করল মোবাইলটা। কানে নিল দিব্যেন্দু।

আমি কম্বলটা টেনে সরিয়ে দিই বিউটির গা থেকে। দেখতে পাই, ভেতরে একটা লেপ। বিউটি হাঁ হাঁ করে ওঠে। আমি চুমু খাই কপালে একটা— তুমি তো সাংঘাতিক ঘেমে গেছ বিহু। জ্বরও নেই একফোঁটা। এ.সিও চলছে না। কী? সমস্যাটা কী হচ্ছে? বিউটি কোনোরকমে ঠক্‌ঠক্‌ করে কাঁপতে কাঁপতে জানায়— ওর মারাত্মক শীত করছে। ওর হাতের তালু, পায়ের চেটো ঘসতে শুরু করি আমি। ঘামের ফলে সেগুলো যথেষ্ট তেলতেলে। অনেকক্ষণ, প্রায় ৪৫ মিনিট পর বিউটি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ওর শীত কমতে থাকে। ঘড়ির কাঁটা তিনটে ছুঁই ছুঁই। সকালেই আমার অফিস। আর ঘুমানোর রিস্ক নিইনি। বিউটি সামলে উঠে বসেছে ততক্ষণে। আমার কোলের ওপর লেপ কম্বল, তার ওপরে মাথা রেখে আধশোয়া বিউটি। কিছুটা অপ্রস্তুতও। আমি আমার অবস্থাটা কীরকম সেটা ছাই নিজেও বুঝতে পারছিনাকো— কফি বানাই? খাবে? বিউটি তড়িঘড়ি আমার কোল থেকে উঠে পড়ে, বলে— আমিই বানাচ্ছি। আমি থামাই ওকে। বন্ধুমহলে চা-কফি বানানোর সুখ্যাতি আমার বরাবরের। এমনকী ঠেকের চায়ের দোকানের বুদ্ধদা মাঝে মাঝে আমাকেই দোকানে বসিয়ে চলে যেত টুকিটাকি কাজে। আমি চা বানাতাম, ডিম টোস্ট, বাটার টোস্ট বানিয়ে এগিয়ে দিতাম লোকজনকে। বিনিময়ে বুদ্ধদা আমাকে একটা সিগারেট খাওয়াতো ফ্রি-তে। মানে, কিছুতেই একটা সিগারেটের দাম নিত না। আর সত্যি কথা বলতে কী, বিউটিকে সামলে তোলার পর একটা সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে আমাকে পেয়ে বসেছিল। বিউটির সামনে সিগারেট যতটা সম্ভব কমই খেতাম আমি। ওর কষ্ট হতো সিগারেটের ধোঁয়ায়। প্রেম করার সময় ব্যাপারটা কোনোরকম মেনে নিলেও বিয়ের এক সপ্তাহ আগে ও আমায় দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল— বিয়ের পর ওর সামনে সিগারেট একেবারেই না।

দেবুদা, বাড়ি ফিরবেনা ? সাতটার বাসটাও পাবেনা কিন্তু – চমক ভাঙে দিব্যেন্দুর। কোনোরকমে ফোনটা কান থেকে সরিয়ে নেয়। অডিওটা সেভ করে। ভঙ্গিটা এমন, যেন সে ফোনে কথা বলছিল কারও সঙ্গে। চায়ের দামটা মিটিয়ে উঠে পড়ে বেঞ্চটা থেকে। লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করে স্ট্যান্ডের দিকে। বাসে ওঠে। ভিড় ভালোই। একদম পিছনে গিয়ে ছ’জনের সিটের জানলার ধারটা বেছে নেয় দিব্যেন্দু। বাসটা যেন ওর অপেক্ষাতেই ছিল এতক্ষণ। দিব্যেন্দু বসতেই সেটা রাক্ষসের মতো আওয়াজ তুলে এগোতে শুরু করে। জানলাটা খুলে দেয় দিব্যেন্দু। কলারের নিচের বোতামটাও খুলে দেয় সে। হাওয়া আসছে। একটা ফুরফুরে, ঠাণ্ডা একটা হাওয়া। মুখটা জানলা দিয়ে কিছুটা বাড়ায় দিব্যেন্দু। হাওয়া এসে ঝাপটা মারে মুখে, চুলে। রাস্তার দোকানগুলো থেকে ভেসে আসে খাবারের গন্ধ। খিদে খিদে বোধটা চাঙ্গা হতে থাকে হাওয়ায়। লাল-চা খাওয়ার পর খিদে খিদে ভাবটা কি বাড়ে ? বাসের বাদামওয়ালার কাছ থেকে এক প্যাকেট সবুজ মটর কেনে দিব্যেন্দু। হেডফোন আর মোবাইলটা বের হয় পকেট থেকে। কিশোর কুমার– কোই হামদম না রাহা, কোই সাহারা না রাহা…

বাড়ি ফিরতে প্রায় আটটা বাজে। কলিংবেলটা চাপতেই ভেতরে ঘোন্টুর চিৎকার। পরিমণি এসে দরজা খুলে দেয়। কানে হেডফোন গোঁজা দেখে পরিমণি কিছুটা চিল্লিয়ে বলে— এত দেরি হলো যে! দিব্যেন্দু জবাব দেয় না কোনো। জুতোটা খুলে র্যািকে রাখে। স্লিপার গলায়… রান্না ফ্রিজে রাখা আছে। আমি চললাম। কাল আসব না। কালকের রান্নাও একেবারে করে রেখে দিয়েছি। শুধু ভাতটা… পরিমণি বোঝে দিব্যেন্দু কোনো কথাই শুনছে নাকো। ঘোন্টুকে নিয়ে শুয়ে পড়েছে সোফায় আর সারাদিন দেখতে না পাওয়ার রেশ ঘোন্টু পুষিয়ে নিচ্ছে দিব্যেন্দুর শরীর চেটে। দরজাটা লাগিয়ে দিও— বলে রান্নার মাসি পরিমণি বেরিয়ে যায়। ঘোন্টু একবার ছুটে আসে দরজা পর্যন্ত, পরিমণির এগিয়ে যাওয়া দেখে। দু’বার ভৌ ভৌ করে। তারপর দিব্যেন্দুর ডাকে ছুটে যায় তার দিকে। লাফিয়ে ওঠে শুয়ে থাকা দিব্যেন্দুর কোলে। কিছুক্ষণ পর দিব্যেন্দু ঝাঁপিয়ে নামে সোফা থেকে। ঘোন্টু ভয় পায় কিছুটা। তবুও লেজ নাড়তে থাকে আপ্রাণ। ফ্রিজ থেকে আইস-ট্রে আর জলের বোতল বের করে দিব্যেন্দু। ঘোন্টুকে পরিমণি আগেই খেতে দিয়ে দিয়েছে। তবুও ফ্রিজের ওপর রাখা বিস্কিটের কৌটো থেকে দুটো নিয়ে ছুঁড়ে দেয় ঘোন্টুর দিকে। দিব্যেন্দু আইস-ট্রে আর ঠান্ডা জলের বোতল নিয়ে এগোয় বেডরুমের দিকে। মেন গেটটা খোলা দেখে বিরক্ত হয়ে ফিরে আসে ফের। সশব্দে লাগায়। বেডরুমে ঢুকে ঘোন্টুর দিকে আঙুলে ইশারায় একটাই কথা বলে দিব্যেন্দু— গো টু হেল। ঘোন্টু নির্বিকার। লেজ নাড়াতে থাকে। জিভটা ইঞ্চিখানেক বের করে পতপত করে লেজ নাড়াতে থাকে কুকুরটা। বেডরুমের দরজাটা আস্তে আস্তে লাগায় দিব্যেন্দু।

কফি বানিয়ে আনার পর ঠিক এই জায়গাটা, এই চেয়ারটাতেই বসি আমি। একটা কাপ বিউটিকে দিয়ে আমি লাগোয়া বারান্দায় গেছিলাম। সিগারেটটা শেষ করে ঠিক এই চেয়ারটাতেই বসি আমি। বিউটি ততক্ষণে লেপ কম্বলদুটো পরিপাটি করে ভাঁজ করে সরিয়ে রেখেছে খাটটার একদিকে। গায়ে ঢাকা নেওয়ার পাতলা বেডকভারটা পর্যন্ত গায়ে নেয়নিকো। আমি চেয়ারটাতে বসতেই বলে— এ.সিটা চালাও তো। মুচকি হাসি— এই তো কাঁপছিলে, যা খেল দেখালে, আবার এখন এ.সি? বিউটি লজ্জা পায় ফের। আমি উঠে ততক্ষণে এ.সিটা চালিয়ে দিই। ভোর হতে চলল। বাইরে যদিও এখন ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। আমাদের ঘরে আলো জ্বলতে দেখে ঘোন্টু আসে। দরজার বাইরে থেকে ধাক্কা দেয়। বিউটি বলে— ছাদে যাবে? কফিটা ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছিল আমার— অ্যাই তোমার কী হয়েছে বলতো? এই সময়ে কেউ ছাদে যায়? হিম পড়ছে বাইরে।

আমাদের বাড়িটা আগে একতলা ছিল। চাকরি পাওয়ার পর এত তাড়াতাড়ি বিয়েটা করি, দোতলাটা কমপ্লিট করতে পারিনিকো। বাবা-মার দুজনেরই ইচ্ছে ছিল দোতলাটা দেখে যাবার। মাঝে মাঝে তাতে খারাপ লাগে, অফুরন্ত নয় সামান্য একটা ছোট্ট ইচ্ছাও মা-বাবার মেটাতে পারিনি আমি। দোতলাটা অর্ধেকই রয়ে গেছে এখনও। আমি আর অনর্থক হাত দিইনি ওটাতে। কলেজে পড়তে পড়তেই প্রথমে মা আর তার মাসখানেক বাদে বাবা মারা যায়। মায়ের মৃত্যুটা আমার কাছে প্রত্যাশিত। ক্যান্সার। বাবারটা মেনে নেওয়া যায় না কিছুতেই। বাড়ি থেকে বাজার যাওয়ার পথে হঠাতই একটা রাক্ষুসে লরি পিষে দিয়েছিল বাবাকে। আমার তখন লাস্ট ইয়ার চলছে। বিউটির সঙ্গে প্রেম চলছে। বিউটিকে নিয়েও এসেছি বাড়িতে কয়েকবার। বাবা আর বিউটি মিলে অনর্গল বকবক করত সমানে। আমি ক্যাম্পাসিং-এ চাকরিও পাই ঐ সময়েই। বাবা অবশ্য আমার অফিস যাওয়াটা দেখতে পেয়েছিল। বিউটির বাড়ি থেকে লোকজনের আসার কথাবার্তা চলছে আর তখনই, আমি অফিসে, স্পষ্ট মনে আছে ফোনটা এসেছিল। হাসপাতালে বাবার থেঁতলানো শরীরটা দেখে, আমার হাফ তৈরি, শিক বেরনো, অমসৃণ সিমেন্ট মাখা দোতলাটাই মনে এসেছিল ছ্যাঁৎ করে। বহুদিন আর বাড়িমুখো হইনিকো তারপর। অফিসের কাছেই একটা মেস ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করি। রীতিমতো সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারের পেশেন্ট হয়ে পড়ি আমি। গাদাগাদা নার্ভের ওষুধ খেতে শুরু করি। রাস্তাঘাট পেরোতে ভয় পেতে থাকি আমি। ইভেন মায়ের মৃত্যুটা কেমন ঝাপসা হতে শুরু করে আমার। বাবার মৃত্যুটা দু’গুণ চড়া হয়ে বুকে চেপে বসতে শুরু করে। বিয়েটা সেইসময়েই করি। বাড়িতে ঢুকি আমি আর বিউটি। আমাদের সঙ্গে আসে বিউটির আদরের কুকুর— ঘোন্টু।

নেশাটা ঝিম মেরেছে মাথার মধ্যে। বোতলটার অনেকখানি শেষ। যেটুকু আছে তাতে আর বেশিক্ষণ চলবে না। আস্তে আস্তে খাওয়া দরকার। বাথরুম পায় দিব্যেন্দুর। অ্যাটাচ্‌ড বাথরুমে ঢুকতেই গা-টা গুলিয়ে ওঠে কেমন। প্রায় খালি পেট আর তারপর অতখানি হুইস্কি। মুখ থেকে অল্প একটুখানি উঠে আসে কমোডে। মাউথ ওয়াশ নেয় দিব্যেন্দু। কিছু খাওয়া দরকার। কিছু খেলে কি আর বমি হবে না? ভাবতে ভাবতেই হড়হড় করে বমি করতে শুরু করে দিব্যেন্দু। কমোড, কমোডের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে বমি। টাল সামলাতে পারে না দিব্যেন্দু। একসঙ্গে শাওয়ার, বেসিন সমস্তকিছুর কল খুলে দেয়। ট্যাঙ্কভর্তি ঠাণ্ডা, জল ঝরঝর শব্দে নামতে থাকে। বমির মধ্যে, বমির ভেতর, জলের নিচে, জলের মধ্যে শুয়ে পড়ে দিব্যেন্দু। টান মেরে খুলে ফেলে জামাকাপড়। স্বস্তি হয়। আস্তে আস্তে একসময় উঠেও দাঁড়ায় সে। টলোমলো পায়ে ফিরে আসে বেডরুমে। খাট থেকে একটানে চাদরটা টেনে নেয়। গা মাথা মোছে। চাদরটা জড়িয়ে দরজা খোলে ঘরের। কুকুরটা পিটপিট করে দেখতে থাকে দিব্যেন্দুকে। ফ্রিজ থেকে পরিমাণমতো চিকেন নিয়ে দিব্যেন্দু এগোয় রান্নাঘরের দিকে। গরম করতে দেয়। হটপট্‌ থেকে রুটি নেয় দুটো। ফের ফ্রিজ খোলে। বরফ আর ঠান্ডা জল নিয়ে বেডরুমে ঢুকে পড়ে দিব্যেন্দু। ঘোন্টু লেজ নাড়ে একবার। দিব্যেন্দু কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেলে ঘোন্টুর দিকে তাকিয়ে। সশব্দে টেনে দেয় ঘরের দরজা।

বিউটির কথামতো সেই ভোরে আধখেঁচড়া দোতলার ছাদে গিয়ে দাঁড়াই আমরা। আলো ফুটতে শুরু করে। ছাদের আলোটা নিভিয়ে বিউটি আমার কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়ায়। বরফের মতো ঠান্ডা ওর শরীর তখন। আমার কীরম অস্বস্তি হয়। জীবিত মানুষের শরীর এত ঠান্ডা হয় কী করে ! ফের কাঁপুনি আসতে শুরু করে বিউটির। নিথর হয়ে যেতে থাকে। উফ! কোনোরকমে পাঁজাকোলা করে ওকে নিচে নামাই। তেল গরম করে ওর পায়ে, হাতে, বুকে ঘষতে থাকি পুরোদমে। আরে, বউটা তো আমার নাকি! অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নাকো। পাঁচটা বাজতেই আমি অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করি। ফোন করি বিউটির বাড়িতেও। তারপর হাসপাতাল। হাজারো টেস্ট। তিনদিন অক্লান্ত ছোটাছুটির পরেও কোনো রোগ ধরা পড়ে না বিউটির। আমি কেন, আমরা সবাই চাইছিলাম বিউটির অন্তত কোনো একটা রোগ ধরা পড়ুক। অন্তত চিকিৎসা শুরু হোক ঠিকঠাক। আমি শুধু জানতে পারি, আমি বাবা হতে চলেছি। ইয়েস, বিউটি কনসিভ করেছে। কোনোরকম রোগ না পেয়ে ওকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করে দেয়। জীবনের সবচাইতে আনন্দঘন মুহুর্তে আমি, আমরা বাড়ি ফিরি বিধ্বস্ত বিউটিকে নিয়ে। ডাক্তার বলেন— প্রথম গর্ভাবস্থায় অনেকেরই এরকম হয়। তবে এতটা? খুবই রেয়ার। আমার শ্বশুর শাশুড়ি বিউটিকে তাদের বাড়ি নিয়ে যান। আমিও যাই। ঘোন্টুও। ফের অফিসে যাতায়াত শুরু করি। কলিগ, বন্ধুবান্ধব প্রত্যেকে জানতে পারে আমি বাবা হতে চলেছি। কেউই বুঝতে পারে না আমার মুখ অত ফ্যাকাসে কেন? কেউই বুঝতে পারে না ভেতরের ঝড় ঝাপটার হিসেব।

১০

বিউটি একদম ভালো হয়ে যায়। একদম স্বাভাবিকের মতো আচরণ করে। আমি নিয়মিত অফিস থেকে ওর কাছে যাই। কথাবার্তা বলি। ওকে সাহস দি। মাঝে মাঝে সঙ্গে করে ঘুরতে বেরোই। কয়েকমাস যেতে না যেতেই আবার মাথাচাড়া দেয় অসুখটা। ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান, যার কাছে হসপিটাল থেকে ফিরে আসার পর নিয়মিত নিয়ে যাওয়া হয় বিউটিকে, তার কাছে ধর্ণা দি আবার। অভয় দেন তিনি। বিউটিকে মনের জোর বাড়াতে বলেন। যে ফুটফুটে মানুষটি পৃথিবীতে আসতে চলেছেন তাকে নিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকতে বলেন বিউটিকে। আমরা দুজনে মিলে খেলনাপাতি কিনি বাচ্চাদের। একটা ছোট্ট দোলনাও কিনে ফেলি হঠাৎ করে। সমস্তকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করে ক্রমশ। বিউটির ভারী পেটটায় রাত্তিরে আমি হাত দিয়ে শুই রোজ। কোনো কোনোদিন অফিসে থাকাকালীন হঠাৎ-ই ফোন করে ও। বলে দস্যিটা নাকি ভেতরে ফুটবল খেলছে। দস্যিটা নাকি ভেতরে টেনিস খেলছে— এইসব। তারপর আস্তে আস্তে দিনটা এগিয়ে এল। এই তো, এই তো আজ পাঁচদিন হলো…

১১

আর কথা বলতে পারছে না দিব্যেন্দু। নেশায় জড়িয়ে যাচ্ছে কথাগুলো। জিভ ভারী হয়ে উঠছে ক্রমশ। নিজের শরীর, নিজের বশে নেই আর। মোবাইলের রেকর্ড অপশনটা বন্ধ করল সে। এতক্ষণ ধরে বলতে থাকা কথাগুলো সেভ হলো ফাইলে। থালায় পড়ে রয়েছে রুটি আর চিকেন। কিচ্ছু খাওয়া যায়নি। এতদিনের জমানো ইচ্ছের মৃত্যুতে কীরকম যেন শীত নেমেছে সমস্তখানে। ছেলে হলে নাম রাখবে ভাস্কর, মেয়ে হলে সুপর্ণা এমনটা ঠিকঠাক করে এসছিল বিউটিকে লেবার সেকশনে নিয়ে যাওয়ার আগে। মেয়েই হয়েছিল। কিন্তু সে মেয়ে একটা মরা শীতকাল। জন্মের আগেই কুয়াশার চাদর টেনে নিয়েছিল সে। বিউটির অসম্ভব শীতবোধ তাকে উষ্ণ রাখতে পারেনি। মৃত সন্তান প্রসব করে বিউটি। ও.টির সামনে দাঁড়িয়ে চেনা ডাক্তার অদ্ভুত বিদেশীর মতো কাঁধ ঝাঁকিয়ে দুঃসংবাদ দেয়। সাময়িক হতভম্ব হয়ে থাকে দিব্যেন্দু। বিউটির মা-বাবা শুধোন পেশেন্ট কেমন আছে? বিউটি? বিউটি? ডাক্তার অনর্গল কথা বলে যান সবার সঙ্গে। স্টিল ইন ডেঞ্জার, শক্‌, সেভেনটি টু আওয়ার্স — ছিটকে ছিটকে এই শব্দগুলোই দিব্যেন্দুর কানে বিঁধতে থাকে। হসপিটাল থেকে বাইরে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে সামনে অন্ধকার বোধ হয় তার। সিগারেটের আগুনটা দু-আঙুলে চেপে নিভিয়ে দেয় সে। আর আশ্চর্য হয় ছ্যাঁকা লাগছে না কেন একটুও? কথা বলতে শুরু করে দিব্যেন্দু। নিজের সঙ্গে অনর্গল কথা বলে উত্তাপ ঢোকাতে চায় নিজের শরীরে।

১২

কোনোরকমে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় দিব্যেন্দু। বমির গন্ধ এসে লাগে নাকে। বাথরুমের দরজাটা টলোমলো পায়ে আটকে নেয় সে। খোলা বিছানায় গড়িয়ে দেয় নিজেকে। বেডসুইচ টিপে অন্ধকার করে ঘর। আর অন্ধকারে শীত এসে ঝাপটা দিতে থাকে শরীরে। রাত শেষ হতে বেশি বাকি নেই আর। দিব্যেন্দুর চোখ থেমে আসে ঘুমে। কাল দুপুরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবে বিউটি। দিব্যেন্দুকে যেতে হবে। কাল সকালে শহরে আছড়ে নামবে শীত। আগামীকাল তাপমাত্রা কমতে পারে আরও।

Facebook Comments

পছন্দের বই