লেখক নয় , লেখাই মূলধন

রঙ্গন রায়ের গল্প

স্বর্গের চেয়ে বড়ো

নাক বরাবর স্বর্গ।

কামারপাড়ার রাস্তা ধরে সোজা হাঁটলেই পৌঁছনো যায়। ডায়ে বাঁয়ে না তাকিয়ে সোজা হাঁটা লাগাল গণেশ। সবাই বলে স্বর্গে পৌঁছনো সোজা কথা নয়। অনেক পুণ্যি করতে হয়। গণেশও আজ সাত দিন ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে যে, সত্যিই স্বর্গে পৌঁছনো সোজা কথা নয়, তার জন্য শুধু পুণ্যি না, বুকের পাটা আর ট্যাকের জোরও লাগে। তবে আজ খবর পাকা আছে। সিন্টুদার সাথে কথা বলে সব কিছু আগে থেকেই সাট করা। পুণ্যিই সে পাবে। মেয়েটা নাকি খাসা মাল, নাম পূর্নিমা।

পুণ্যি করলে স্বর্গে যাওয়া যায়। অথচ গণেশ স্বর্গে যাচ্ছেই পূন্যিকে করতে, মানে…

হাতঘড়ি গণেশ পরে না। পকেটে আস্ত একটা চায়না মোবাইল থাকতে কে আর ঘড়িটড়ির ধার ধারে। পকেট হাতড়ে মোবাইল বের করে টাইমটা একটু দেখে নিল সে। ৯:৪৪ বাজে। এদিককার দোকানগুলো প্রায় সবই সাড়ে ন-টা থেকে দশটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তা অনেকটা ফাঁকা। বুকের মধ্যে অন্যরকম উত্তেজনা অনুভব করছে গণেশ। জীবনে প্রথমবার তো, একটু হবেই।

রওনা দেওয়ার সময় ফ্যাঁকড়া বাঁধিয়েছিল রাজু। বারবার বলেছিল আজ টানবে না। কিন্তু ছাঁড়ল না। বলে, “কাকা তুমি হলে স্বয়ং গণেশ ঠাকুর। তোমাকে বাদ দিয়ে আমরা কী আর কিসু করতে পারি! বলো?” এত ভালোবাসলে বড্ড মুশকিল হয়। রেলগুমটির ওই অন্ধকার বস্তি বস্তি এলাকাতেই যত রাজ্যের গাঁজার ঠেক। তাকে ওইদিক দিয়েই যেতে হয়েছে কেন-না ওই দিক দিয়েই শর্টকাট মেরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন রোডে ওঠা যায়। আর তারপর ডানদিক নিয়ে কামার পাড়ায় ঢুকলেই নাক বরাবর—

অনেকদিন টানা হয় না বলে আজ ব্যোমকে গেছে মাথা। ছোঁড়াগুলো ভালো পাতা জোগাড় করেছিল। শুটেড বুটেড বাবুরা এটাকে আবার স্টাইল করে ‘স্টাফ’ বলে। একবার শুনেছিল গণেশ। তার গ্যারাজের পাশে যে-পানবিড়ির দোকান, লুকিয়ে গাঁজাও বিক্রি হয়, সেখানে একটা বেশ ভালো ঘরের ইয়ং ছেলে এসে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “স্টাফ হবে?” এই একটা ব্যাপারে উঁচু শ্রেণি নীচু শ্রেণি সবাই সমান হয়ে যায়। সবাইকে একটাই পৃথিবীতে নামিয়ে আনেন স্বয়ং ভোলেবাবা।

গলা শুকিয়ে আসছে। জল চাই গণেশের। পা-টা একটু বেসামাল হতেই সামলে নিল সে। তাকে এখন যেতেই হবে। দালালী ভালোই নিয়েছে সিন্টুদা। এখন পয়সা উশুলের অপেক্ষা। আর তর সইছে না। কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন জলের। মুৎসুদ্দীর পানের দোকান প্রায় বন্ধ হবে হবে। গণেশ মরুভূমির মাঝে মরূদ্যান পাওয়ার মতো ছুটে গেল সেদিকে।

জল খেয়ে আবার হাঁটা দিল সে। সিন্টুদার বর্ণনা অনুযায়ী পূন্যি যথেষ্ট স্বাস্থ্যবতী মেয়ে। ওর শরীরটা কল্পনা করতে করতে হঠাৎ মালতীর মুখটা ভেসে এল সামনে। সাথে সাথে শরীরটা কেমন করে উঠল তার। খুব গরম লাগছে। বুকটা চেপে আসছে যেন। ডিগ্ ডিগ্ করে টাকরাটা গলায় ঘণ্টার মতো দোল খাচ্ছে। শুধু গাঁজা খেলেই এটা হয়। শুষ্ক মরুভূমির মতো মনে হয়। ঘামে জামাটা ভিজে গেছে। চপচপ করছে পিঠের দিকটা। শরীরটা হঠাৎ পাঁক দিয়ে উঠল। যেন তলপেট মুচড়ে ব্যথা জেগে উঠছে। লিঙ্গ আর অণ্ডকোষের মাঝামাঝি জায়গায় একটা ভয়ংকর টান।

নালার কাছে বসে পড়ল গণেশ। অনেক জন্মের টান দিয়ে পেটের ভেতর থেকে পেঁচিয়ে বের হচ্ছে বমি। নালায় না পড়ে অধিকাংশই নালার পাশের পাকায় পড়ছে। ঠিকমতো বসতে পারেনি সে। হলুদ হলুদ ভাতের দানা-পালংশাকের টুকরো-জল— হড়হড় করে বেশ কিছুটা হওয়ার পর গণেশ সেখানেই ছেতড়ে বসে পড়ল। কী ভয়ংকর টান উঠছে অণ্ডকোষের তলা থেকে! কাঁপিয়ে দিচ্ছে পুরো শরীর। সে এখন বেশ কিছুক্ষণ বসে না থাকলে যেতে পারবে না। রাস্তার কুকুরগুলো কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁত খিঁচিয়ে ঘেউঘেউ করছে। রাত বাড়ছে। গণেশকে কি কানাহুলোয় পেল আজকে? পথ এগোতে পারছে না কেন? একটার পর একটা বাঁধা!

— “আহ!” আপন মনেই গণেশ আরামের শব্দ করে উঠল। এতক্ষণে একটু ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। এরপরও কিছুক্ষণ গণেশ বসে বসে কুকুরের চিৎকার শুনল। ঢিল ছুঁড়ে ওগুলোকে তাড়াবার মতো ইচ্ছেও তার হচ্ছে না। হঠাৎ গণেশের ভয় হল। পেটের ভেতর গুলিয়ে উঠল দুর্দান্ত ভয়! সে পূন্যিকে করতে পারবে তো? শক্তিই পাচ্ছে না তো সে? কয়েকটা কুকুরকে তাড়াতে পারছে না—

তড়াক করে উঠে দাঁড়াতে গেল। মাথা টাল খেয়ে গেলো তার। ল্যাম্পপোস্টটা ধরে সামলাল সে। হাওয়াটা তাকে অনেকটা সুস্থ করেছে। সুস্থ লাগছে এখন। যেতে পারবে। মোবাইলটা বের করে আবার সময় দেখল। সাড়ে দশটা পার। সর্বনাশ! এখন তো প্রায় ছুটতে হবে!

কুকুরগুলো এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে এসেছে। তাদের গণেশের সাথে একফোঁটা শত্রুতা নেই। তারা ছুটে গেছে নালার পাশে পড়ে থাকা বমিগুলো খাওয়ার জন্য। গণেশ এ-সব কিছু দেখল না। সে জানে তাকে এখন স্বর্গে পৌঁছতে হবে। হবেই। দালালীর টাকাগুলোর কথা ভাবতেই তার মনটা কচকচিয়ে উঠল। পুরো সাত দিন মাল না টেনে সে টাকা জমিয়েছে। আজকের জন্য। স্বর্গের জন্য এটুকু স্যাক্রিফাইজ তো করতেই হবে। চোরা পকেটে টাকাটা ঠিকঠাকমতো আছে কি না একবার দেখে নিল সে। পূন্যিকেও তো কিছু দিতে হবে। টাকা থাকলেই যত অস্বস্তি লাগে তার। এতটা বয়স হল, মালতী ছেড়ে চলে গেল ‘অজ্জিনাল স্বর্গে’ আর এখনও তার টাকা রাখতে ভয়!

তেরে হি স্বপ্নে লেকর ম্যা শোয়া
তেরে হি ইয়াদো মে জাগা
তেরে খেয়ালো মে উলঝা রাহা ইউ
য্যায়সে কি মালা মিধাগা
এ বাদল বিজলী-চন্দন পানী
অ্যায়সা আপনা পেয়ার
লেনা হোগা জনম হামে কয়ি কয়ি বার

কিশোর কুমারের এই গানটা মালতীর খুব প্রিয় ছিল। বিয়ের পর প্রথম দিন বিছানায় মালতী এই গানটা গণেশকে শুনিয়েছিল। আহা! সে-সব দিন কী সুন্দর যে ছিল! তখন গণেশ একটা গ্যারেজে সদ্য ঢুকেছে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর কালিঝুলি মেখে বাড়ি ফিরে মালতীর মুখ দেখার একটা আলাদা আনন্দ। মালতী কী সুন্দর করে চুলগুলো বেঁধে বসে থাকত। চা আর মুড়ি খেতো দু-জনে গল্প করতে করতে। তারপর স্নান করতে যেত বিয়েতে পাওয়া টেপটা চালিয়ে দিয়ে। মাঝে মাঝে মালতী তার চুলে শ্যাম্পু দিয়ে দিত। ওকে কারোর বাড়িতে কাজ করতে পাঠায়নি গণেশ। যতই হোক বউ হবে ‘হাউস ওয়াইফ’।

বড়োলোকদের যেমন হয়। নরম হাতের আঙুলগুলো চুলের মধ্যে চলত আর কিশোর কুমার চলতে থাকত টেপে। ফিতের ক্যাসেটে শুধুই কিশোর কুমারের গান। মালতী ভালোবাসত বলে বেছে বেছে ওগুলোই কিনে আনত গণেশ। কুয়োপাড়ের শ্যাওলা পড়া মেঝেয় হঠাৎ একদিন পড়ে গেল মালতী। তখন নমাসের পেট। কেউ বাঁচল না। শালা গ্যারেজের কালো রং ধুয়ে যায়। এই কালো রংটা ধুয়ে গেল না গণেশের জীবন থেকে। ক্যাসেটের ফিতেগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলেছিল সে। গান থেমে গেল। মালতী আর কিশোর কুমার একসাথেই চলে গেল জীবন থেকে। এখনও গভীর রাতে বিয়েতে পাওয়া ‘টেপ’টা গণেশকে দেখে। কাঠের তাকের ওপর থেকে দেখে। ইঁদুর দৌড়ায়। শিশি ফেলে। গণেশ স্নান না করেই মাল টেনে শুয়ে থাকে। মালতী এখন আর স্বপ্নেও আসে না।

কামারপাড়া শেষ হয়ে আসছে। রাস্তা পেরোলেই গন্তব্যস্থল। স্বর্গ। তার পায়ের গতি বেড়ে গেল। আহ! কতদিন পর আবার ফুলসজ্জার সুখ ফিরে আসবে! মালতীর বুকে একটা লালচে তিল ছিল। পূন্যির কি সেটা থাকবে? ধুস! কোথায় মালতী আর কোথায় পূন্যি!

একটা সিনেমায় দেখেছিল গণেশ, স্বর্গে পৌঁছতে হলে একটা সিঁড়ি ধরে উঠে যেতে হয়। মেঘের ওপর দিয়ে সিঁড়িটার শেষ দেখা যায় না। শেষ দেখা যায় না বলেই মনে হয় সেটা স্বর্গে গেছে। আসলে শেষ বলে কিছু নেই। অনন্ত যাওয়াই স্বর্গীয় সুখ। তার গ্যারেজের পাশে রাতুলদার মুদি দোকানে টিভি আছে। একটা সাধু সাধু দেখতে লোক সেখানে অনেক কথা বলে। ধর্মের কথা। সেখানেই শুনেছিল গণেশ এই কথাগুলো। স্বর্গের সিঁড়ির কোনো শেষ থাকে না। কিন্তু এখানে ‘শেষ’ কেন সিঁড়িই নেই। গলিটার বাইরে কিছু লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে। একটা হলদে বাল্বের আলো ছড়িয়ে আছে জায়গাটায়। এতটা পথ ঠেঙিয়ে আসতে আসতে তার দম ফুরিয়ে গেছে রাস্তার মতো। গণেশ একটা বন্ধ দোকানের স্ল্যাবের ওপরে বসল। আর একটু রেস্ট নিতে হবে। বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। সস্তার চোলাইয়ের পর আজ গাঁজাটা না টানলেই হত!

বসে বসেই মোবাইলটা বের করল গণেশ। ‘স্বর্গদ্বার’-এ এসে সিন্টুদা ফোন করতে বলেছিল। সবুজ বোতামটা টিপে কলহিস্ট্রিতে গেল সে। সিন্টুদার নম্বর বেরিয়ে আসতেই আর একবার সবুজ বোতামটা টিপল। মোবাইল চালানোটা তাকে রাজু শিখিয়েছে। এখন অবিশ্যি সবাই মোবাইল চালায় বলেই কেনা। তাছাড়া তার মোবাইলের অত দরকার নেই। সবাই গাঁক গাঁক করে মোবাইলে ফুল ভলিউমে ভোজপুরি গান শোনে। গণেশের একবার ইচ্ছে হয়েছিল রাজুকে বলতে ‘কিশোর কুমারের’ গান ভরে দেওয়ার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বলেনি। কিশোর কুমারের সাথে তার মালতীর মতই বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।

“যে-ব্যাক্তিকে আপনি ফোন করেছেন তার নম্বর অন্য একটা নম্বরে ডাইভার্ট করা আছে। অনুগ্রহ করে—”

স্বর্গের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এই নম্বরটা কি তবে নরকের সাথে ডাইভার্ট করা? বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবছে গণেশ। এত কাছে এসেও ঢুকতে বারণ করেছিল সিন্টুদা। বলেছিল, “আমি না আসা অবধি ঢুকবি না। এসে নিয়ে ফোন করবি। ঠিক জায়গায় নিয়ে যাব। না হলে অন্য মাগীদের টানা হেঁচড়ায় তোর মতো নতুন মুরগি জবাই হয়ে যাবি। ঠিক আছে?”

গণেশকে দেখলে জোয়ান মদ্দা মনে হলেও পঁয়ত্রিশ বছরটা তো আর হেসে খেলে আসেনি। কাজেই এখন নেশা ভাঙের শরীরটা বড্ড দুর্বল। গলির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তার ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়া শুরু হল। একটু পরে আবার ফোনে ট্রাই করতে হবে। আকাশে চাঁদটা মাঝে মাঝে মেঘের আড়ালে যাচ্ছে, আবার বেরিয়ে আসছে। মালতী ঠিক এমনভাবে চাদরের আড়ালে মুখ ঢাকত আর বের করত। সাথে কী খিলখিল হাসি। গণেশ জাপটে ধরে ঘামের গন্ধওয়ালা ব্লাউজে মুখ গুজে দিত। একটা অদ্ভুত সুন্দর ঘামের গন্ধ ছিল মালতীর।
ভাবতে ভাবতে এক এক সময় ঘুম এসে যাচ্ছে গণেশের। টাকা আর স্বর্গের কথা ভেবে চোখ টেনে টেনে খুলে রাখছে সে। চোখের আশে পাশে যেন একটা ভারী সর জমেছে। আর একবার রিং করল গণেশ।

“আপনি যে-নম্বরে ফোন করেছেন সেটি একটি ভুল নম্বর। অনুগ্রহ করে—”

ভুল নম্বর! প্রচণ্ড অবাক হয়ে মোবাইলে চোখ ডুবিয়ে দিল সে। রাগ-দুঃখ-হতাশা মেশানো একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার। পৌরুষ তাকে ভীষণভাবে জানান দিচ্ছে , “একটা শরীর চাই”। খিদে পেয়েছে তার। পেটের খিদে শরীরের খিদে দুটোই। বমি হওয়াতে দুপুরের সব কিছু বেরিয়ে গেছে। সিন্টুদাকে খিস্তি করতে করতে গণেশ হাতড়াচ্ছে কল লিস্ট…

“আরে তুই এখানে?”

সিন্টুদার ডাকে সম্বিত ফিরল গণেশের। স্ল্যাবের ওপর বসে থেকে একটু ঝিমুনি মতো এসে গেছিল তার।

“চল। আমার একটু দেরি হয়ে গেল যদিও। আসলে আরেকটা পার্টির সাথে ডিল নিয়ে হালকা বাওয়াল হল তো। যাকগে। ওঠ।”

গণেশ বলল, “তোমার নাম্বার ভুল কেন বলছিল?”

“আরে নেটওয়ার্কের প্রবলেম হবে হয়তো। চল চল। তোর ব্যবস্থা করে দিয়ে আমাকে আবার রিকো আনতে যেতে হবে।”

“রিকো? সেটা আবার কী?”

“এক পার্টি চেয়েছে। সিরাপ। এক বোতল খেলে হেব্বি নেশা হয়। খাবি নাকি? ১৫০ টাকা নেব তোর থেকে।”

“না লাগবে না। তুমি আগে পূন্যির কাছে নিয়ে চলো।”

“ইসসসস! পুরো নাল ঝড়ছে না?”

গণেশ কিছু বলল না। এমনিতেই তার শরীরটা ভালো লাগছে না। বমি হবার পর থেকে খালি মনে হচ্ছে সে হয়তো আজ পারবে না।

সিন্টুদার সাথে স্বর্গে ঢুকে পড়ল গণেশ। নোংরা রাস্তা। কাদা আর জল জমে আছে। প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ, তোবড়ানো বোতল, চিপসের প্যাকেট উড়ছে এদিক ওদিক। সরু নালাটার পাশে দুটো ব্যবহৃত কন্ডোম হিলহিলে সাপের মত পড়ে আছে। দু-পাশের বাড়ি থেকে অনেক কটা মেয়ে গণেশকে তাকিয়ে দেখছে। একটা মোটকামতো মহিলা হঠাৎ একটা বাড়ির দরজা থেকে নেমে এসে গণেশের রাস্তা জুড়ে দাঁড়াল, “এদিকে এসো, এসো না! ভালো মেয়ে আছে আমার কাছে।” মহিলাটাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল সিন্টুদা। পিছন থেকে গজগজ করতে লাগল সে, “হুহ! একবার শুনে গেলে কী এমন হয়ে যেত!”

সবাই দোকানপাট খুলে বসে আছে। স্বর্গীয় ব্যবসা চলছে। দুটো মাতাল একটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় টলতে টলতে হাঁটতে লাগল। কেমন যেন একটা শব্দ আছে এই গলিতে। আশেপাশের বাড়ি থেকে মেয়েদের হাসির আওয়াজ, সমবেত গুঞ্জন। কিশোর কুমারের গান বাজছে কাছেই কোথাও। গনেশের কেমন যেন লাগছে। কেমন একটা। গা গুলোচ্ছে। যেন আবার বমি হবে। কত কত মেয়ে তাকে করার জন্য ডাকছে। এ-সব সময়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ পুরুষ মনে হওয়া উচিত। কিন্তু কোনো ফিলিংসই হচ্ছে না তার। আশ্চর্য তো! স্বর্গে কি সব অনুভূতি হারিয়ে যায় মানুষের?

পূন্যির ঘরে যখন সিন্টুদা ঢুকিয়ে দিল তখন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে গণেশ। সাদা চুনকাম করা ঘর। টিউবলাইট জ্বলছে। আর বিছানায় শাড়ি পরে একটা মেয়ে বসে আছে। গনেশ কয়েক মুহূর্ত পূন্যির দিকে তাকিয়ে থাকল। ওহ্ মালতী! ভীষণ ভীষণ মনে পড়ছে মালতীর কথা। এতগুলো টাকা তাহলে জলে যায়নি…

পূন্যি একটু হাসল। মেয়েটার গজ দাঁত আছে। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ওর বুক। এত সুন্দর বুকের গড়ন গণেশ কোনো মেয়ের দেখেনি। মেয়েটা শাড়ি খুলতে শুরু করেছে। এক এক করে শাড়ি শায়া ব্লাউজ খুলে যখন ব্রাটাও খুলে ফেলল তখন অবাক হয়ে গণেশ লক্ষ করল পূন্যির বুকেও সেই একইরকম মালতীর মতো লাল রঙের তিল। আর সবচেয়ে বিস্ময়কর যেটা সেটা হল ওর বুক থেকে অঝোরধারায় মাতৃত্ব বইছে। একটা আর্ত চিৎকার করে গণেশ মেঝেতে বসে পড়ল। প্রবল বমির মতো অনেক অনেক পুরোনো দিনের কান্না বেরিয়ে আসতে লাগল তার দু-চোখ দিয়ে। বুক ফেটে যাচ্ছে। গলায় একটা কীসের যেন কষ্ট। গণেশের শক্ত হয়ে ওঠা প্যান্টটা ঝড়াম করে নরম হয়ে গেল।

ঠিক তখনই একটি শিশুর স্বর্গীয় কান্না ভেসে এল পাশের ঘর থেকে। খিদের কান্না।

Facebook Comments

পছন্দের বই