লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শতদল মিত্রের গল্প

সেইসব গল্প, যা অন্ধকারের

রাত গড়িয়ে যে-কোনো মুহূর্তে ভোর ফুটে উঠবে, এমন সময়ই অসীমের মনে কথাটা উদয় হল। যদিও অসীম রাত চেনে— সকাল, দুপুর, সন্ধ্যে কেমন দেখতে তাও জানে সে, কিন্তু ভোরের রূপ একেবারেই অচেনা তার কাছে। কেন-না ভোর কী বস্তু তা কোনোদিনই দেখা হয় নাই তার। ছোটোবেলায় দেখেছিল কি? মনে পড়ে না তার। ছোট্ট ফালি ব্যালকনিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে সিগারেটে টান দিতে দিতে কখন পাঁচটা বাজবে— এ হেন উদগ্রীব প্রতীক্ষায় কথাটা হঠাত্‍ই মনে এল তার। কলকাতা শহরটাকে চেনা হল না তার আদৌ, চল্লিশ বছর কলকাতায় টানা বাস করেও! হ্যাঁ, টানাই তো! সেই দশ বছর বয়সে বাবা তাকে গ্রাম থেকে শহরে গেঁথে দিয়েছিল, তারপর থেকে মাঝে মধ্যে দু-একবার গ্রামের বাড়ি পুজো-পার্বণে বা বত্‍সরান্তে পাহাড় কিংবা সমুদ্র ছাড়া আজ পঞ্চাশ বছর বয়সের প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছানো তক সে তো কলকাতারই বাসিন্দা। এবং মৃত্যুর আগে অবধি তার কলকাতাবাস অবধারিত। এ সময় হঠাৎই অচেনা একটা পাখির উত্কট কাকলি অসীমের চিন্তাকে চলকে দেয়। সে সিগারেটে লাস্ট টান দিতে দিতে পাখিটাকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু সামনের রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে, পোস্টের ঝোলা তারে, কিংবা তারদৃষ্টির পরিধির মধ্যে থাকা নস্করবাবুর বাড়ির পাঁচিল ঘেঁষা নারকেল গাছের ঝাঁকড়া মাথায় গুনে গুনে দুটো কাক ও চকিত একটা ফিঙে ছাড়া আর কোনো খেচর নজরে আসে না। আবারও সে-কলরব ফুটে ওঠে আচমকাই। অসীম চমকে উঠে খেয়াল করে যে, রাতের আকাশটা একটু ফরসা হল যেন, আর দুটো কাকের একটা গম্ভীর স্বরে ডেকে ওঠে— ক্ব! তারপরেই ডানা ঝেড়ে দুটোই উড়ে যায়। ফিঙেটাও ইলেক্ট্রিকের একটা তার থেকে আর একটায় চকিতে লাফ দেয়। অসীম ভাবে একেই কি তবে ভোর বলে? জানে না সে। কিন্তু রাতের আঁধার চেরা এ-সব ঘটনাক্রমে সে সহসা আবিষ্কার করে যে উত্কট পক্ষীকাকলিটা এক জোড়া বদরি পাখির, কেন-না পাখি দুটি কিংবা একটাই আবারও ডেকে উঠেছিল। সেই ডাক অনুসরণ করেই পাখি দুটোর খোঁজ পায় সে। যাদের আস্তানা রাস্তার ওপারের আপার্টমেণ্টের চারতলায় বিকাশদের ফ্ল্যাটের ব্যালকানিতে টিভির ডিটুএইচ ডিশের আড়ালে তেমন বড়ো নয় একটা খাঁচায়। এবং এর পরপরই অদৃশ্য অনেকানেক কাক পক্ষী ডেকে উঠতে থাকে। সে-ডাকাডাকিতে সামনের ফালি আকাশটা আরও ফর্সা হয়। রাত নিভিয়ে আকাশের এমন আলোকিত ফুটে ওঠাকে যে ভোর বলে— জীবনে প্রথম এটা জেনে অসীম স্বস্তি পায়। টুসকি মেরে সিগারেটের শেষটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে সে।

আস্তে আস্তে ভোরের ফুটে ওঠাকে দেখতে দেখতে অসীম ভাবে যে তার কলকাতা মানে তো বাবার আমলে কলকাতার একদম পশ্চিমপ্রান্তে যে না-কলকাতায় তারা ভাড়া থাকত সেই ডক এরিয়া, বর্তমানে তারই লাগোয়া দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের এই তথাকথিত নগর কলকাতা, যেখানে সে নিজস্ব এক টুকরো ফ্ল্যাটের অধিকারি— আর বড়ো জোর চাকরির দৈনন্দিতায় ডালহৌসি অঞ্চল, কিংবা মাঝে মধ্যে ভবানীপুর বা চৌরঙ্গির দু-একটা সিনেমা, আথবা গড়িয়াহাটের পুজোর বাজার। ছাত্রজীবনের বছর দুয়েকের কলেজ স্ট্রিট, ছেলেবেলার চিড়িয়াখানা, জাদুঘর এবং বাবা, কাকা, দিদিমার কল্যাণে গুনে গুনে তিনবারের কেওড়াতলা শ্মশান— ব্যস, এইটুকুই তার কলকাতা! সেখানে জোড়াসাঁকো, পার্শ্বনাথের মন্দির দূরে থাক কালীঘাটের মন্দিরও দেখেনি সে আজও। যে-কালীঘাট মিছিলে ঘুরতে আসা গ্রামের মানুষজন, কিংবা গঙ্গাসাগরের ভিনদেশিতীর্থযাত্রী, আর সে-দিন আসা বাংলাদেশিরাও দেখতে ভোলে না— সে, অসীম একবারের জন্যও কালীঘাটের মা কালীকে দর্শন দিল না, অথচ তিন-তিনবার সে কালীঘাটের কেওড়াতলা শ্মশানে গেছে। নাহ, এ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ! সে এখনও কলকাত্তাইয়াই নয়, নয়-ই! এবারে শীত পড়লে সে অবশ্যই যাবে, একটা গাড়ি ভাড়া করে গোটা কলকাতা চক্কর মারবে, এমনকী সল্টলেক, রাজারহাট-নিউ টাউনের ক্যালকাটাও যাবে। কেউ সঙ্গ না দিলে একা একাই!

অবশ্য এমন চিন্তা, এবং সে চিন্তাপ্রসূত এমন প্রতিজ্ঞা প্রতি বছর গ্রীষ্মে যখন খুব গরমের কারণে রাত্রে ঘুম আসে না তার, অসীম করেই থাকে। আর প্রতি শীতে ঠান্ডার ওমে ভালো ঘুম হওয়ার কারণে সে-চিন্তা বা প্রতিজ্ঞা অবধারিত উবে যায়। যদিও আজকের কারণটা একটু হলেও আলাদা।

রাত্রি ঠিক দুটোর সময় অসীমের মাথার পাশে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠতেই সজাগ অসীম একটুও না চমকে ফোন তুলে বলেছিল— হ্যালো!

— আমি হসপিটাল থেকে বলছি…

একটু পজ। তারপরেই সে-মহিলা কণ্ঠ রিনরিন বেজেছিল আবার।

— অনেক চেষ্টা করেছিলাম আমরা… কিন্তু পারলাম না… আপনার মা…

একটুও ঢোক না গিলে অসীম শান্তস্বরে বলেছিল– মা মারা গেছেন! কখন?

— এই আধ ঘণ্টা আগে।

— তা আমাকে কী করতে হবে?

— এত রাতে এসে আপনি আর কী করবেন? যা করার আমরাই করেছি। আর এমনিতেও তো ছ-ঘণ্টার আগে ডেডবডি আমরা হ্যান্ডওভার করতে পারব না। আপনি পারলে সকাল ছ-টায় চলে আসুন। আসলে নাইটের আর. এম.ও. সাতটায় চলে যাবেন। উনি থাকতে ডেথ সার্টিফিকেটটা দেখে নেওয়া ভালো। যদি ভুলচুক কিছু থাকে! তারপরে আটটায় ক্যাশ কাউন্টার খুললে ডিউ পেমেন্টটা…

— ঠিক আছে, আমি ছ-টার মধ্যেই হসপিটালে পৌঁছে যাব।

ততক্ষণে পাশের ঘর থেকে রিমাও এসে গেছে অসীমের ঘরে। রিমা আলতো হাত রাখে অসীমের কাঁধে। সে-মমতায় কিংবা যতই প্রত্যাশিত হোক, তবুও মায়ের এ হেন মৃত্যু সংবাদে সে বিন্দুমাত্র না চমকানোর পাপবোধ— যে-কারণেই হোক, অসীম এ মুহূর্তে শোকমগ্ন হবার ফুরসত পায় যেন। তার চোখের কোণ দুটো চিকচিক করে ওঠে। কিন্তু লহমা মাত্রই। পরক্ষণেই দীর্ঘশ্বাস ঝেড়ে ফেলে সে বলে ওঠে রিমার মুখের দিকে তাকিয়ে— যাহ, কত টাকা ডিউ জানতে ভুল হয়ে গেল!

অবশ্য পরক্ষণেই এ ভাবনা নিশ্চিন্ততা আনে তার মনে যে একদিন আগেই সে মোটামুটি একটা পেমেন্ট করে রেখেছে হাসপাতালে এবং তার পাতালস্থিত ওষুধের দোকানেরও। এবং এই পাতাল কথাটা অসীমের মনে উদয় হওয়ায় সে মনে মনে নিজেকে তারিফ করে। ফলে শোক তার ধার ঘেঁষে না আপাতত। সত্যিই, প্রাইভেট হাসপাতাল যেন পাতালজীবীই। আর এ হাসপাতলের ওষুধের দোকানটাও আক্ষরিক অর্থেই পাতালে, অগুন্তি ডাক্তারদের চেম্বারের সঙ্গে ঝাঁ চকচকে আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরেই। এরই মধ্যে সাতদিনে এক লাখ বিশ ঢুকে গেছে পাতালের গহ্বরে— এ দু-দিনে কত বিল করবে কে জানে? অথচ নেহাতই সাতাশি বছরের এক বৃদ্ধার বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা। রোজই একটা না একটা দামী টেস্ট! হার্ট-লাং-লিভার সবই নাকি খারাপ! গতকালই কিডনির কী একটা দশ হাজারি টেস্ট করিয়েছে এবং অবধারিত নিদান এই যে, কিডনিও ঠিকঠাক কাজ করছে না। সে হেসে ডাক্তারবাবুটিকে বলেছিল— এই বয়সে আপনি কি আশা করেন যে কোনো মানুষের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই ঠিকঠাক কাজ করবে? অত যন্ত্রণা না দিয়ে মানুষটাকে একটু শান্তিতে মরতে দিন না! উত্তরে পাঁচতারা হাসপাতালের ভৃত্য ডাক্তারটি কর্পোরেট স্টাইলে ইংরেজি ধাঁচের বাংলায় বলে যে— দেখুন আমাদের হসপিটালের একটা সুনাম আছে, আমাদের মোটোই হচ্ছে যতদূর সম্ভব রোগীকে সুস্থ করে তোলা। বর্তমানে এত মেসিনারিজের সুবিধা যখন আছে তখন নেব না-ই-বা কেন? মৃত মায়ের দিব্যি গেলে অসীম বলতে পারে যে সেই মুহূর্তে উজ্জ্বল আলোকশোভিত বাতানুকুল পাতালচেম্বারে ডাক্তারটির পেছনে দামী ও দুর্লভ জার্মান শেফার্ডমার্কা অদৃশ্য একটি লেজকে নড়ে উঠতে দেখেছিল সে।

যাইহোক সে-মুহূর্তে অর্থচিন্তা চমত্কার হেতু মাতৃশোক থিতু হতে পারে না অসীমের মনে। সে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মাথাটা নির্ভার হলে অসীম ভাবে যে, এ সময়ে দিল্লিতে ঘুম ভাঙিয়ে তার দিদিকে খবরটা না জানানোই উচিত হবে বোধহয়। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভালো। আর বাঙ্গালোরে সদ্য চাকরিতে জয়েন করা মেয়েকে খবরটা কখন জানানো ভালো হবে— এ সিদ্ধান্তের জন্য অসীম তার বউ-এর সঙ্গে পরামর্শের উদ্দেশ্যে আবারও ঘরে ঢোকে।

তখন রাত আড়াইটা। অসীম বাথরুমে যায়। জল খায়। সে-মুহূর্তে ভোরের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার না থাকায় সে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। আর আশ্চর্যের এই যে প্রায় এক যুগ বাদে রিমাও ও-ঘর থেকে এ-ঘরে এসে অসীমের পাশে শোয়। বোধহয় শোকগ্রস্ত তাকে সঙ্গ দিতেই! ফলে এতক্ষণে অসীমের মনে একটু হলেও শোক জাগে যেন। আনমনে বলে ওঠে সে— আজ সন্ধ্যেতেও মা-কে তো বেশ ফ্রেশ দেখাচ্ছিল।

— অত মেশিন, অত নল… যন্ত্রণাও তো পাচ্ছিল মানুষটা। বয়স হয়েছিল। শান্তিতে চলে গেলেন। ভালোই হয়েছে। এই বলে রিমা অসীমের মাথাটা নিজের বুকে টেনে নেয়। সে নিরাপদ আশ্রয়ে অসীমের গলার কাছটায় কেমন যেন একটা কাচ-কাচ ব্যথা জেগে ওঠে।

তাদের ফ্ল্যাটের সামনের গলিটা দিয়ে আচমকা একটা মোটরবাইক ছুটে গেলে চমক ভাঙে অসীমের। নিথর রাত গড়িয়ে দিনের চাঞ্চল্যে ঢুকে পড়েছে তবে! উলটো দিকের বিকাশদের অ্যাপার্টমেন্ট আর নস্করবাবুদের বাড়ির ফাঁকে ঝুলে থাকা আকাশটা ততক্ষণে খুনখারাবি লাল। মোবাইল টিপে সময় দেখে অসীম— সাড়ে চারটে। পাঁচটা বাজলে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেবে সে। আপাতত জ্ঞানত তার জীবনে প্রথম ভোরের হয়ে ওঠা দেখতে থাকে অসীম। পাঁচটার মধ্যে সূর্য কি উঁকি দেবে আকাশে? জানে না অসীম। যেমন জানে না বাবা, না মা— কার অন্তিম সময়ে মোহনদাস করমচাঁদ স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হয়েছিল যেন! অসীমের মস্তিষ্কের ধূসর পটে কোনো ছবিই আঁকা হয় না এ মুহূর্তে। শুধু রাত ভেঙে দিন ক্রমে ফুটে উঠতে থাকে— যেমন ফুটেছিল গতকাল, যেমন ফুটে উঠবে আগামীকালও।

Facebook Comments

পছন্দের বই