লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শুভদীপ ঘোষের গল্প

নিরুদ্দেশ

সারা গা চেটে দিচ্ছে কেউ এরকম একটা কিছু দেখতে দেখতে অনিমেষ শুনতে পায় রুপা জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে ‘অনি ওকে পাওয়া যাচ্ছে না, অনি’। ঘুম ভাঙার সময় ধাতস্ত হতে একটু সময় লাগে, অনিমেষ একটু উঠে রুপার দিকে ধীরে ধীরে তাকানোর চেষ্টা করে, রুপার মুখে মাস্ক পরা, ‘কী ব্যাপার?’। ‘আরে পনেরো মিনিট ধরে তোমায় ডাকছি, বাড়ির চারপাশটাও ঘোরা হয়ে গেছে কোথাও নেই’, রুপা বলে। অনিমেষ এতক্ষণে পুরো তাকিয়ে হাত দিয়ে চোখের পিচুটি যথাসাধ্য মুছে আধখোলা সদর দরজাটার দিকে তাকায়। খবরের কাগজটা পর্দার তলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে পরে রয়েছে, কাগজ দিতে তো না করা হয়েছে, কী আশ্চর্য! রুপা গজগজ করতে করতে পাশের ঘরে চলে যায়। অনিমেষ সোজা হয়ে উঠে বসে দেওয়াল ঘড়ির দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে জোড়ে শ্বাস নেয়, এই এক ঝামেলা হয়েছে, সপ্তাহ দুয়েক আগের কথা, সন্ধ্যে হওয়ার একটু আগে, রুপা এসে সজোরে ধাক্কা মেরে খবর দেয় ‘পাওয়া যাচ্ছে না, প্রায় আধ ঘণ্টা হল!’। অনিমেষ বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে টের পায়, প্রাতঃক্রিয়ার চাপ, পাশের ঘরে রুপা যথারীতি মোবাইলে ব্যাস্ত, রান্নাঘরে গ্যাসের উপর কিছু একটা বসানো।

অনিমেষের ঘাড়ের পিছনে এসে হালকা আলো পড়ছে বাথরুমের স্কাইলাইট থেকে, টিউবটা কাল রাতেও তো জ্বলছিল, আজ বিগড়ে গেছে। ‘তাড়াতাড়ি করবে তুমি’ রুপার গলা। ‘আরে এরম আবার হয় নাকি!, তুমিতো খুঁজেছ বললে, ও ঠিক চলে আসবে, না হলে আমি বেরিয়ে দেখছি’, অনিমেষ ভাবতে থাকে রুপার সাথে প্রথম আলাপের কথা। আজ থেকে তেরো চোদ্দো বছর আগে, তখন প্রেম দুরস্থান, বন্ধুত্বও তেমন ছিল বলা যাবে না, এক কলেজে এক ক্লাসে পড়া ওই পর্যন্ত। এ সেই সময়ের কথা, যখন উন্নততর দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে প্রথমে সিঙ্গুর ও কিছু পরে নন্দীগ্রাম আন্দোলন চরমে উঠেছে। অনিমেষ রুপাদের ক্লাস মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যেত বিচ্ছিন্ন গণ্ডগোলের আশঙ্কায়। রোজ সন্ধ্যেবেলা টিভিতে শোনা যেত গোলাগুলির শব্দ। তদুপরি চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে লাইফ হেল করে দেওয়ার সেই বিখ্যাত হুমকি। অনিমেষের বাবা বলেছিলেন, ‘সেই ষাটের দশকের শেষ থেকে দেখে চলেছি, আন্তর্জাতিকতাবাদের দামামা, এ শোধনবাদী তো ও প্রতিক্রিয়াশীল, এ মার্ক্সবাদী তো ও ট্রটস্কিপন্থী’। অনিমেষ ওর বাবার মুখে এক বন্ধুর কথা শুনেছিল। নিবিড় বন্ধুত্ত ছিল দলের যে-ছেলেটির সঙ্গে একদিন সন্ধ্যার জমায়েতে গিয়ে জানতে পারেন সেই ছেলেটি খুন হয়ে গেছে। এবং এও জানা যায় একেবারেই অপ্রমাণিত অথচ শুধুমাত্র সন্দেহের বশে তাকে খুন করেন ওই দলেরই যিনি মাথা তিনি, খবর পাচার করার অভিযোগে। যার সঙ্গে গলায় গলায়, আচমকা তাঁর একেবারে নেই হয়ে যাওয়া ও পরিশেষে পাওয়া এই খবর প্রবল ধাক্কা দেয় ওই বন্ধুটিকে। তিনি দলত্যাগ করেন এবং তার কিছুদিন পর থেকে তারও আর কোনো খবর পাওয়া যায় না। ওই সময় থেকেই পৃথিবীর মানচিত্রে আইডিয়োলজির নামে কত মানুষ যে হারিয়ে গেল তার কোনো ইয়াত্তা নেই। লাতিন ভূখণ্ডে গুপ্তহত্যা, চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে বিশাল মন্বন্তর, দক্ষিণ ভিয়েতনামে হচিমিন, কম্বোডিয়ায় পলপট এই নিয়ে প্রচুর কথা হত অনিমেষের মনে পড়ে নন্দীগ্রামের সময় জুড়ে। দরজার বাইরে রুপার গলা শুনতে পায় আবার অনিমেষ, ‘অরুনাচলের মাঠটা আগের দিনের মতো একবার দেখে এলে হত না, অনি!’। অনিমেষ বুজতে পারে আজ এত সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনিমেষ কোনো উত্তর দেয় না, উপরের পাটির বাঁ-দিকের শেষ দুটো দাঁত, ব্যথা শুরু হয়েছে আবার, টুথপেস্ট ব্রাশে নিয়ে বাথরুমের আয়নার দিকে তাকিয়ে দাঁত মাজতে শুরু করে উলঙ্গ অবস্থাতেই। ক্যাসিয়াস ক্লে-কে মনে আছে? মহম্মদ আলি বললে সবাই লাফিয়ে উঠবে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধীতা করার জন্য তদানীন্তন মার্কিন সরকার বাম মুষ্টির ঔদ্ধত্যকে হওয়ায় উড়িয়ে গ্রেপ্তার করেছিল তাকেও। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় অনিমেষের বাবা প্রবল প্রতিবাদ করেছিলেন অনিমেষের কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করার বিষয়টা নিয়ে। অনিমেষ জোর করে দু-একদিন গেছিল এই যুক্তিতে যে, শিল্পের সরকার বা সরকারের শিল্প বলে কিছু হয় না। মনে আছে সেইবারের উৎসবে এসেছিলেন বিখ্যাত আর্জেন্টিনিও পরিচালক ও রাজনীতিবিদ ফার্নান্দো সোলানাস। গোটা লাতিন ভূখণ্ড জুড়ে পরিযায়ী মানুষের জমির অধিকারের লড়াই নিয়ে তাঁর দি আওয়ার অফ দি ফার্নেসেস তথ্যচিত্রটি সে-বছর অনেকের মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। উৎসব শুরুর তিনদিনের মাথায় সরকারের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও এই অতি সংবেদনশীল মানুষটি যখন কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে নীরবে কলকাতা ত্যাগ করলেন, অনিমেষও তার পর থেকে আর ওই উৎসবে যায়নি। বরং বাড়িতে ভিয়েতনামের প্রেক্ষাপটে ফ্রান্সিস ফোর্ড কাপোলার একটি ছবি দেখা হয়। ক্যাসিয়াস ক্লে-র অনুষঙ্গ আজ এইখানেই হয়তো লুকিয়ে ছিল! কিন্তু কেন হঠাৎ মনে এল এইসব! কোনো অভূতপূর্ব সংকটের সময় বিশেষত তা যদি সামাজিক হয়, তাহলে কি, এরকম সামাজিক সংকটময় সময় আর কখনো এসেছে কিনা এই চিন্তা মাথায় আসে! রুপার সাথে তারপর বহুদিন কোনো যোগাযোগই ছিল না। আজ থেকে বছর সাত আট আগে আবার যোগাযোগ হয় হাজরার কাছে সিগাল বলে একটি বইয়ের দোকানে, এখানে বই কেনা যেত না, ডেলি, মন্থলি ও ইয়ারলি সাবস্ক্রিপশনের ব্যবস্থা ছিল, বিভিন্ন ধরনের বই পড়া ও সিনেমা দেখার সুবিধে ছিল। ওইখানে পর পর বেশ কয়েকদিন ওদের দেখা সাক্ষাৎ হয়, পুরানো বন্ধুত্ত প্রেম কীভাবে কী ছিল বলা মুশকিল, কিন্তু তা সম্পর্কে বাড়ে।

ভালো করে সাবান দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে গেঞ্জি পাজামা পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে অনিমেষ শোনে রুপা ফোনে কাউকে উঁচু গলায় কী একটা বলছে। নির্ঘাত অজয়। অজয় মাঝে মাঝে এসে থাকত এখানে, রুপা প্রথম দিকে তেমন আপত্তি করেনি। অনিমেষের আত্মীয়, কলকাতায় আসত কী একটা কাজে। এক-দু-দিন তারপর চলে যেত। টাকাও দিতে হয়েছে বেশ কয়েকবার, বিভিন্ন প্রয়োজনে। একবার গোল টেবিলে রাতের খাওয়ার মাঝপথে অজয়ের প্রবল বমি, সঙ্গে মদের গন্ধ, অনিমেষ কোনোরকমে অজয়কে ধরে শুইয়ে দিয়ে ফিরে এসে দেখে রুপা গালে হাত দিয়ে বসে আছে অজয়ের ফেলে যাওয়া মোবাইলটা হাতে নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, অনড়। প্রায় পনেরো মিনিট চুপচাপ বসে থাকার মাঝখানে অনিমেষ দুটো সিগেরেট শেষ করে এবং শেষমেশ রুপা কোনো কথা না বলে ঘরে চলে যায়।

‘অজয় টাকা চাইছিল, এখন হবে না বলে দিয়েছি’, রুপা গিয়ে বেসিনে ভালো করে হাত ধোয়। ‘বাথরুমের টিউবটা খারাপ হয়ে গেছে’, অনিমেষ বলে। রুপা কথাটা শুনতে পায়নি এরকম একটা ভাব করে বাড়ি থেকে বেরুবে বলে দরজার দিকে এগোয়। ‘কী ব্যাপার, কোথায়?’, অনিমেষের কথা শেষ হওয়ার আগেই রুপা বলে, ‘ব্লিচিং দিতে হবে বাড়ির চারপাশে! চা খাবে পরে, অরুনাচলের মাঠটা একবার দেখে এসো আগে’, রুপা সেই জেদ ধরে আছে। অনিমেষ বুঝতে পারে ওকে বাড়ি থেকে বেরোতেই হবে, হপ্তা খানেক আগে অনেক বুঝিয়েও কোনো কাজ হয়নি, এই অবস্থাতেও বেরোতেই হয়েছিল অগত্যা। অনিমেষ ফ্রিজটা খুলে দুটো স্লাইস কেক মুখে দেয়, মাস্কটা মুখে বাঁধে, মানিবেগ ও মোবাইলটা পকেটে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। ওদের বাড়ির পিছন দিক দিয়ে যে-রাস্তাটা মোড়ের মাথায় চলে গেছে, আগেরবারের সন্ধ্যাবেলার মতো এখন এই সকালেও পাবলিক টিউবওয়েলটার সামনে বেশ জটলা। এই জিনিস আজকাল আর বেশি দেখা যায় না, করপোরেশন থেকে প্রায় অধিকাংশই বন্ধ করে দিয়েছে। অনিদের রাস্তার এটা কীভাবে যেন এখনও রয়ে গেছে। অনি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়। কমিউনিটি হালটার কাছে যে-সিগারেটের দোকানটা সেটা আগেরবারে বন্ধ ছিল, এখন অর্ধেক দরজা বন্ধ, এখানে দাড়িয়ে একটা দুটো সিগেরেট শেষ করে বাড়ি ফেরা যায়, অনি মাথার চুলে একবার হাত বোলায়। বিশ্বের তাবৎ পণ্ডিত, আগুনখেকো আঁতেল থেকে শুরু করে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সব থেকে বড়ো ডন যে-দোকানে গিয়ে নিজের মাথাটা বিকিয়ে দিতে বাধ্য হয়, সেই সেলুনগুলো যে কবে আবার খুলবে সেইটা সবচেয়ে অনিশ্চিত। লক্ষ্মীকান্তর সেলুনের দোকানটা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ওই বাঁকটা ঘুরলেই, গলির ভেতরের দোকান, অনি অনেক সময় অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে বেশ রাতের দিকে ওর সেলুনে যেত দাড়ি কাটার জন্য। তিনটে পর পর সিট, সামনেরটার উপর আলো জ্বলছে একমাত্র, বাকি দুটো সিটসমেত ভিতরটা অন্ধকারে ঢাকা। ‘দাদা!, বসেন’ বলে লক্ষ্মী অন্ধকার থেকে মাঝেমাঝেই বেরিয়ে আসত, গ্লাস রাখার শব্দ, ঢেকুর তোলার সঙ্গে মুখে গন্ধ, এসে গলাটা দু-হাতে চেপে ধরত গামছাটা বুকের উপর বিছিয়ে দেওয়ার আগে, অনি গোড়ার দিকে দুয়েকবার একটু দোনোমনো করে বুঝেছে যে, যে-কোনো অবস্থাতেই কেনা মাথার উপর লক্ষ্মীর নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নাতীত। অনি সিগেরেট না কিনে মোড়ের মাথার দিকেই এগোয়। ‘কী ব্যাপার এই রাস্তায় তো তোমায় তেমন দেখি না!’, ফ্ল্যাটের মুখার্জীকাকু, চোখে কৌতূহলী চাহনি। অনি কোনো কথা না বলে মুচকি হেসে এগিয়ে যেতেই, উনি নিজেই বলে ওঠেন, ‘দীপ্তির পাইলসের সমস্যা, সকাল থেকে প্যান জুড়ে রক্তারক্তি কাণ্ড, তাই ওষুধের দোকানে গিয়েছিলাম প্র্যাক্টসিডল কিনতে, প্রেসক্রিপশন নিয়ে বেরোতে হবে তো, সেটা খুঁজে পেতে গলদঘর্ম অবস্থা’। অনি এই না জানতে চাওয়া কৈফিয়তের কোনো উত্তর না দিয়ে পুনরায় মুচকি হেসে ‘আচ্ছা’ বলে চলে যায়। সবগুলো দোকান বন্ধ, লোক প্রায় রাস্তায় নেই বললেই চলে, এক প্যাকেট সিগারেটও কেনা যাবে না তাহলে। ডান হাতে অরুনাচলের মাঠটা শনিবারের এই সকালে ধূ ধূ ফাঁকা, হপ্তাখানেক আগে এই মোড়ে পুলিশ ছিল না, আজও নেই। অনি মোড়ের মাথা থেকে বাঁ-দিকে তাকিয়ে দেখে না আজ গাঙ্গুলিবাগানের মোড়েও পুলিশ পোস্টিং নেই, গতবার ছিল। অনি রাস্তাটা ক্রস করে উলটো দিকের গলিটার মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। আগেরবার এই গলির মুখটায় দাঁড়িয়ে অনি একটা অদ্ভুত জিনিস দেখেছিল। সকাল থেকে টানা বৃষ্টির পর বিকেলের দিকে বৃষ্টি থেমে যায়। আদ্র ধূলিকণা ফ্লুরেসেন্ট স্ট্রিটলাম্পগুলোর আলোয় ধোঁয়া ধোঁয়া পরিবেশ তৈরি করেছে। সন্ধ্যার সেই আবছায়ায় অনির মনে হয়েছিল জনমানবশূন্য ওই গলিতে কেবল একজন মাত্র মহিলা মুখে মাস্ক ও মাথায় স্কার্ফ বাঁধা, দূরে জঞ্জালের মাঠটার ধারে যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরে শুধু মুখটা ফিরিয়ে অনির দিকেই তাকিয়ে আছে যেন! অনির বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করে উঠেছিল, কিন্তু এগোনোর ভরসা পায়নি। গাঙ্গুলিবাগানের মোড়ের দিকে এগোতে এগোতে দু-চারবার মুখ ফিরিয়ে অনি কাউকে দেখতে পায়নি। দুটো পুলিশকে এগিয়ে আসতে দেখে ফেরার সময় অনি অনেক আগে রাস্তা পার হয়ে উলটো ফুটে চলে যায়, গলিটা ক্রস করার সময়ও ভালো করে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায়নি। অরুনাচলের মাঠটার কাছে একটা ফুচকাওলা বসত, সকালে ঘুগনি আলুরদম, রাতে ফুচকা। আভরণহীন মধ্যচল্লিশ একজনকে অনি বহুবার দেখেছে এই ফুচকার দোকানটার আসে পাশে ঘুরে বেড়াতে, ইতিহাস জানা নেই, ফুচকাওয়ালা ছেলেটি একদিন অনিসমেত আসে পাশের সবাইকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলেছিল ‘ও কিছু না, সকালে দেদার দেনা করে আর রাতে ছেলেধরার কাজ করে!’। রুপা দু-দিন আগে জানাল ওই ফুচকাওয়ালা ছেলেটা নাকি ঝুড়িতে করে সবজি নিয়ে বিক্রি করতে এসেছিল পাড়ায়। অনি রাস্তা পেরোয়, অরুনাচলের মাঠটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, বাঁ-পাটির দাঁতটা আবার চিনচিন চিনচিন করছে, সামনে একটা ফাঁকা রিকশা আসছে, ওঠার কথা ভাবে না, বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

কলিং বেল বাজাতে হয়নি। রুপা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, অনিকে দেখে গেট খুলে দেয়। অনি মানিব্যাগ মোবাইল টেবিলে রেখে সোজা বাথরুমে চলে যায়। রডে নতুন জামাকাপড় রেখে গেছে রুপা, সেগুলো পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে একটা ঘর মোছার কাপড় হাতে বাথরুমের দরজার সামনে রুপা দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনি বেরোতেই বলে, ‘ছাদটা একবার দেখে এসো, সামনের দরজায় এখনও তালা দেইনি’, চোখে মুখে তীব্র উৎকণ্ঠা। অনি বোঝে এটা রুপার নতুন গন্তব্য, নিজে যাবে না। রুপা ঘর মোছার বালতিটায় জল ঢালে বাথরুমে ঢুকে, মাস্কটা আবার মুখে পরে ছাদের দরজার দিকে পা বাড়ায় অনি। আজ থেকে আট বছর আগে অনিমেষ এই ফ্ল্যাটটা যখন কিনেছিল তখন অনিমেষরা ছাড়া আরও তিনটে ফ্ল্যাটে লোক ছিল, এখন সব গুলি বিক্রি হয়ে গেছে এবং পুরানো লোকের জায়গায় নতুন লোক এসেছে। গত এক মাস ধরে কেউ কারো মুখ দেখে না অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই। মুখার্জী কাকুদের ফ্ল্যাটের বাইরের দেওয়ালে টাঙানো এক বৃদ্ধের ছবি দেখে অনিমেষ ভেবেছিল বোধহয় মুখার্জীকাকুর কোনো পূর্বপুরুষের ছবি, বাপ ঠাকুরদার ছবি কেউ এইভাবে বাড়ির বাইরে টানিয়ে রাখে! ওনার কোনো গুরুটুরুর কথাও তো জানা নেই। একদিন অনিমেষের কৌতূহলী পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা কীভাবে যেন টের পেয়ে কাকু হঠাৎ দরজা খুলে মুখ বার করে বলেন, ‘গিরিন্দ্রশেখর বোস, তোমাদের মতো সেলফ প্রোক্লেইমেড ইন্টেলেকচুয়ালদের জানা উচিত ইনি ইন্ডিয়ান সাইকোঅ্যানালিটিক সোসাইটির প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন, এবং সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সঙ্গে ইডিপাস কমপ্লেক্স নিয়ে, ভাবো ইডিপাস কমপ্লেক্সের নন-ওয়েস্টার্ন আর্গুমেন্ট নিয়ে দীর্ঘ কুড়ি বছর পত্রালাপ করেছিলেন! তা গেঁয়ো যোগীদের কথাও একটু জানার চেষ্টা করো’, মারের মুখে অনিমেষের মনে পড়েছিল মুখার্জীকাকু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। মানুষ অনেকের বাড়িতে অনেকের ছবি দেখতে পায়, পরিবারের স্বর্গত কারো কিংবা দেবদেবী ইত্যাদি, কিন্তু ইনি এক্কেবারে মৌলিক! রুপাকে একবার বলেছিলেন, ‘নীল রংটা তুমি সবসময় এভয়েড করবে।’ অনিমেষ দোতলায় উঠে দেখে বিপুলদের কলাপসিবল গেট খোলা, তার মানে ওরা এখন এখানেই আছে, কবে এল আবার কে জানে। কাকতালীয়ভাবে অজয়কে একমাত্র এই বিপুলের সঙ্গেই দুয়েকবার কথা বলতে দেখেছে অনিমেষ। বিপুলের সঙ্গে যে-মেয়েটি থাকে সে একজন প্রথিতযশা ডাক্তারের সেক্রেটারি। ওদের লেক গার্ডেনসের ওদিকে নাকি আরেকটা আস্তানা আছে। এই ফ্ল্যাটে মাঝে মাঝে আসে, যখন আসে ওই মেয়েটিকে নিয়ে আসে এবং টানা বেশ কিছুদিন থাকে। নানান কানাঘুষো আছে এই ফ্ল্যাটবাড়িতে ওদের পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। মেয়েটির সঙ্গে কথাও হয়েছে কালেভদ্রে। একবার মনে আছে ওদের ফ্ল্যাটের বাইরে মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়, বিভিন্ন গাছের পরিচর্যা নিয়ে অকারণে কিছুক্ষণ কথা বলার পর নিশ্চুপ অনি বাধ্য হয়ে একটু পরে যখন জানায় এ-ব্যাপারে ওর কোনো আগ্রহ নেই, মেয়েটি তখন ‘আচ্ছা তাহলে’ বলে দ্রুত পায়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে যায়। অনিমেষের মনে হয়েছিল ভিতরে বিপুল ছাড়াও আরও লোক আছে।

ভিতর থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে, শীৎকার! এই সকালে! অনিমেষ জিভকাটে। কিংবা বাইরে বেরোতে না পারা মানুষের হোমওয়ার্ক, পর্ন সাইটগুলোতে ট্রাফিক নব্বই শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, ক-দিন আগে মোবাইলে দেখেছে এই স্টেটিসটিক্স। অনিমেষ দ্রুত পায়ে উঠে যেতে থাকে ছাদের দিকে। ছাদের দরজা অল্প খোলা দেখতে পায়, ঠেলে ঢোকে ছাদে। এই সকালে শেষ কবে ছাদে এসেছে মনে পরে না। উলটো দিকের বাড়ির বাগানের নারকেল গাছটা এখনও প্রায় ছাদ ছুঁয়ে রয়েছে। পুরো ছাদটা একবার ঘুরে উকি মেরে নীচে সেফটি ট্যাংকের দিকটা দেখে। চারপাশ থেকে নীচে তাকিয়ে যেদিকে দু-চোখ যায় কোথাও কাউকে দেখতে পায় না। মাথার উপর ওভারহেড জলের ট্যাংক। নীচের কলটা খুলে জল দিয়ে হাতটা ধোয় অনিমেষ। জলের মধ্যে পাথর পড়ার মতো একটা শব্দ হচ্ছে না? কোনো মানে হয় না ওভেরহেড ট্যাংকটা দেখার, একটা শব্দ কিন্তু হচ্ছে জলের মধ্যে! অনি হাঁটু মুড়ে নীচু হয়ে ট্যাঙ্কের স্লাবের নীচের দিকে তাকায়, কয়েক সেকেন্ড কান পেতে থাকার পর শব্দটা আবার শুনতে পায়, উপর দিকে তাকায়, উঁহু কিছু একটা! অনিমেষের উপরের পাটির ডান দিকের শেষের দুটো দাঁতের এক্সরে প্লেটটা চোখে ভেসে ওঠে, যাদবপুর স্টেশনরোডের শেষ মাথার পক্ককেশ সেই ডাক্তার, ‘খুব ব্যথা করছে, করবেই তো, কত দিনের জমা মাল, হঠাৎ ব্যথা শুরু হয়, রুট ক্যানেল করতে হবে অনেস্থেসিয়া করে’। অনি শুনেছে কলকাতায় নাকি একজন ডাক্তার ছিলেন যিনি চীন থেকে আকুপাংচার শিখে এসেছিলেন, সে অনেককাল আগের কথা। উনি সূঁচ ফুটিয়ে লোকাল এবং ফুল বডি অনেস্থেসিয়া দুটোই করতে পারতেন। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় সূঁচ ফোটানোর পরে মোক্ষম সেই নিউরাল পয়েন্টটায় শেষ সূঁচটা ফোটাতেন যার পরে রোগীর আর কোনো জ্ঞান থাকত না। সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং এবং রিস্কি ছিল জ্ঞান ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি। কিন্তু এখানে যা হয়, কোনো উত্তরসুরি রেখে যেতে পারেননি।

ওভারহেড ট্যাংকের শব্দটা, অনি জানে দাঁতের ব্যথাটার মতোই সত্যি। উঁচু স্ল্যাবটায় পা দিয়ে উপরে ট্যাংকের দিকে ওঠে, এত উপরে ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ আসতে পারে কী! অনিমেষ যেন দেখতে পায়, রুপা সারা বাড়ি ধুয়ে বেড়াচ্ছে, হাত ধুচ্ছে মাঝে মাঝে, মুখ থেকে মাস্কটা একবার খুলে রাখছে আবার পরছে, ছাদের সিঁড়ির কাছে এসে উঁকি মেরে দেখছে উপরের দিকে। দাঁতের উপরের পাটি, শেষ দুটো দাঁত বেশ ব্যথা করছে, পক্ককেশ অজস্র সূঁচ হাতে এগিয়ে আসছে, ট্যাংকের শব্দ, অনিমেষ জানে কোনো মানেই হয় না, তবুও একদম মাথায় উঠে পরে, দু-হাত দিয়ে ট্যাংকের মুখের ঢাকনাটা আস্তে আস্তে টানতে শুরু করে।

Facebook Comments

পছন্দের বই