লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সঞ্জীব নিয়োগীর গল্প

পাঠান্তর বিষয়ক প্রস্তাব ও অনুমোদিত ক্রীড়াসমূহ

।। প্রস্তাবনা।।

হাত রেখে দ্যাখো, যেভাবে অনুবাদের আগে হাত রাখো শিল্পটির গায়ে। মমতা কিনা সে পরের কথা, তবে সেটা যে বোঝাপড়ার একটা প্রাথমিক শর্ত, প্রয়াস, এ-কথা ঠিক।
বোঝাপড়া অভিপ্রেত গভীরতায় না গেলে পাঠান্তর ঘটে যায়। আর এখন তো, এইখানে, দুটি মাত্র পক্ষ। পক্ষ থেকে পাখা জন্ম নিক, যা, কাঙ্ক্ষিত; জেনে রেখো এখানে বিপক্ষের কোনো সদর্থক ভূমিকা নেই।

।। কর্মশালার বিবরণ।।

একদা হেথায় নদী ছিলেন, উত্তরবাহিনী। বহু বৎসর পূর্বের এক ভয়ংকরী প্লাবন নদীটির গতিপথে হৃদয়বিদারক পরিবর্তন অনিয়াছে। মূল ধারা হইতে বিচ্ছিন্না, ইনি দীর্ঘদিন গগনাম্বু নির্ভরা।
এই প্রায় হেজে যাওয়া বিলের পাশে প্রদীপ হাজরার কর্মশালা। প্রদীপের বয়স এখন সত্তর ছুঁয়েছে, কিন্তু তার কর্মশালার বয়স খুব বেশি নয়। আট বছরে পা দেবে আসছে বর্ষায়। নাম, ‘কর্মবিমুখ কর্মশালা’। এখানে কবিতার দেহ মনে হুলুস্থুল বাধিয়ে দিতে মরিয়া নবীন-নবীনাগণ রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিতে আসেন। অবশ্য, প্রশিক্ষণ শব্দটা এখানে পরিত্যাগ করার কথা সর্বদাই বলা হয়ে থাকে। আসলে কর্মশালাটি কবির স্বাধীনতা বিষয়ে আদতে অত্যন্ত উদার ও কোনো রূপ বন্ধনের ওকালতি করে না। আর, প্রদীপের কিন্তু, যেটা আশঙ্কা করা হয়ে থাকে, তেমন কোনো দাড়ি টারি নেই। অর্থাৎ প্রচলিত বাঁধন নাকি ছেঁড়াই আছে।

।। দার্শনিক অভিপ্রায়।।

চিত্র: মাতিস

নিন্দুকেরা বলে, অভিসন্ধি। প্রদীপ মনে করে, আসলে ‘অভিসন্ধিহীন অভিপ্রায় হয় না’ বলে বাংলা কবিতায় তাত্ত্বিক হামাগুড়ির প্রচলন করার একরোখা চেষ্টা চালাচ্ছে যে-দলছুট মিনিট-বিয়ানী কবিটি, সে-ই প্রদীপের অভিপ্রায়কে অভিসন্ধি হিসেবে প্রচার চালাচ্ছে তলে তলে।
কচুরিপানা আচ্ছাদিত একদা নদীটির শরীরের দিকে চেয়ে থাকে ‘নির্জনতা প্রিয় কবি’ প্রদীপ হাজরা। ভাগ্যিস বাঁড়া বে-থা করা হয়নি, নইলে সমাজ তো সমাজ বউও শান্তিতে নদীর পেট দেখতে দিত না। হেজে যাওয়া নদী যখন বিল হয়ে দয়া ভিক্ষায় বাঁচে, তাকেও না!
তুমি কেন বিলের পেট দেখ?
কই পেট, সে তো কচুরিপানার চাষ!
তোমার তো হতে মুখে কচুরিপানা লেগে!
আহা, মায়া হল তাই একটু সাফ-সুফ করে দিচ্ছিলাম গো, হাজার হোক একদিন কত জল বয়ে গেছে…
ও রে ঢেমনা চোদা বুড়ো, এই বয়সেও রস চুইছে, না? উনি কিনা কো-এড কর্মশালা খুলেছেন! কেন, দিনরাত্তির মেয়েছেলের গা না শুঁকলে কি কাব্যি ঝরে না?
আহা, শোনো না, মেয়েরাও তো লেখে গো, কবিতা…
লিখবেই তো, কবিতা লেখে না ছাই, ওসব ছেলে চেটে বেড়ানোর অছিলা, সব্বাই বোঝে!
প্রদীপ যারপরনাই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করত, ছেলে চেটে মানে? চেটে?
তাহার স্ত্রী থাকিলে মুখে ঝামটা দিয়া কহিত, ন্যাকা! মরণ নাই!

।। ফ্যাকাল্টি আউটসোর্সিং।।

কর্মশালায় এ-যুগের হেস্তনেস্ত করে দেওয়া কবির পদধূলি, আজ। ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রবল ধড়কন। এই ধুন্ধুমার প্রতীকী কবির প্রেরণায় বেশ কিছু ছাপা ও ইম্যাগ ভূমিষ্ঠ হয়। এইভাবে কবি বগলাচরণ মিত্র আরও লোফালুফি পেয়ে যান নবীন হওয়ার প্রাণাধিক সম্বলে। মাইরি এমন সাহুসে ভাষার পকড় কতজনের থাকে বে?
বলেন, কবিতা নিজেই একটা আস্ত এক্সট্যাসি রে পাগলা। পুরিয়া চলছে চালা, চুমু চলছে চলুক। কিন্তু লাগে না, বুঝলি তোরা, কবিতার ভিতরে বাঁড়া একবার ঢুকতে পারলে রস ই রস! নেশা ই নেশা! তিনি আরও বলেন, বানান নিয়ে ভাবে বোকা*দারা আর কবিতার শৌখিন গাল আঁচড়ে বর্বাদ করাই তোমাদের মিশন।
অতঃপর কর্মশালায় আজ সবাই মিলে সারাবেলা একটা কবিতা লেখে। যৌথ কবিতা।…
“মালার পোকার গর্ত
ভেবে নিয়ো সারকাজাম উট উঠে আসে
বারির ভিতরে বসে তুমি শুধু কাক বলে ফাঁকা
ঐখানে যারা চুষে খায়
হরিবল গোবরের শনি
মগডালে সাজানো সুন্দরী কথাবলা বাটি।…”

।। ক্যান্ট টক, টেক্সট ওনলি।।

এদিকে তো গুপ্তচর ঢুকে বসে আছে দলে। তার আবার ফেসবুক প্রোফাইল ‘মাটির মানুষের ভৌমজল’। সে শুয়ে শুয়ে গুরুকে মেসেজ পাঠায়, ‘অনুবাদ না ছাই। শেখাচ্ছে তো কবিতা লেখা’। ওদিক থেকে গুরুর রিপ্লাই আসে, ‘বটে? তবে যে নাকি অনুবাদ শেখায় মেইনলি?’
^ এখনও তাই তো বলছে
^ কেমন?
^ নাকি আমরা যা করি সবই অনুবাদ
^ বটে?
^ হুঁ
^ আচ্ছা। লেগে থাক। পারলে ফাটল ধরা।
^ ফিফথ কলাম জিন্দাবাদ!
^ জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ!!
^ ওকে। ওভার।
^ বিজয়ী ভবঃ। ওভার।

।। Creation of Core Group।।

নিশিকালে বগলাচরণ মিত্র বুস্টার কোর্স শুরু করে। এখানে সবার এন্ট্রি নেই। একেকটা ব্যাচের মাত্র চার পাঁচজন নির্বাচিত পার্টিসিপেন্ট এই উদ্যোগের ভাগ্যশালী টিকিট পায়। আর এখান থেকে অনেক দূরের রাস্তা চিনিয়ে দেওয়া হয়। এই চার পাঁচজনকে নিজে হাতে বেছে দেয় স্বয়ং প্রদীপ হাজরা। মানদণ্ড গুপ্ত রাখা হয়।
গগনবিদারী কবি বগলাচরণ মিত্র আজকের মন্ত্রগুপ্ত অনাবিল বিহ্বল রাতের প্রতীক্ষিত অমৃতবচন এগিয়ে নিয়ে চলেন।…
“উত্থান বিষয়ে উদ্বেগের হেতু নেই। সঙ্গীর সহিত ক্রীড়া কালে শুধু আকার প্রাপ্ত ও স্থায়িত্ব অনুসারী প্রত্যঙ্গ তোমার একমাত্র সম্বল হয় কেন! এটা তো অত্যন্ত দীনতার বহিঃপ্রকাশ। প্রমাণ করে যে, সম্পূর্ণ, বিশদ ও গভীর পাঠানুশীলন পাওয়া হয়নি। তথাপি, অগণিত মানব শৃঙ্খলার আরেকটি শৃঙ্খল হয়ে, আবদ্ধ হয়েছ যৌথ জীবনে। আর, মাথার তবে কী কাজ! আঙুলের? জিভের? হা হা হা! পাগলা পাগলির দল রে, থৈ থৈ করে ভরে দে তোরা বাংলা কবিতার মুখে ফিডিং বোতল!”
রাত শেষে গগনে আলোকরেখা ফুটিয়া উঠিলে ছাত্রগণ আহ্লাদ করে, স্যার আপনার লেখা একটা কামনা-বিহ্বল সিরিজ শোনাতে হবে স্যার। তারপর আমরা যে যার মতো বিদেয় নেব স্যার। স্যার প্লিজ স্যার।
ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী রূপসী দলুইয়ের অন্তর্বাসের ফিতে স্পর্শ করিয়া পিঠে বাম হস্ত স্থাপন করে আর ডান হাত দিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া স্বপন খান্নার পাছার পেছন ছুঁয়ে বগলাচরণ উদাসী আবেগে শুরু করে:

“কুম্ভীর উম্ভির চলে সাতরঙা পা
মায়াসুতো পিছুটান গোপনীয় খা
আজি কিছু নড়ে নাই উহ্য লেখাপাতি
কান্দারে উঠিছে বসি লোল জজাতি
পুত্র হেতু ঝম্প হয় কাঁপে সুতানুটি
হারাইল বাহ্যজ্ঞান অপরূপ জুটি

দোলাচলে লাগে হিহি নাচিছে বিরোধ
প্রতি পত্রে লেখা হয় শোধ প্রতিশোধ
ব্যাঘ্ররূপী গুল্ম ঘটে লাফানোর কালে
উচাটন যুগ্ম কান্দে নানাবিধ জালে
উভচর বেঘাটায় নিদ্রা খুলে বসি
নাচিতে নাচিতে সাধু সঙ্গদোষে দোষি

হেথা হয় হয় আরও হয় ও ঘোটকী
লাগে তরী তড়িঘড়ি হাসি চোখা-চোখি
ছিদ্র ঘিরে অন্বেষণ দূর্বা দূর্বা বলি
লণ্ডভণ্ড গণ্ডদেশ পণ্ডশ্রমে কলি
আবারও আসিছে খ্যাপা বিবিধ বাহানা
পরমেঘে দুষ্ট প্রেম অবিকারী কানা

সতী সতী মুখভাব ভিজে থাকে গলি
শামুকের সাথে চলে গেঁড়ি ও গুগলি
ধরাধরি মুখে চাপে বেড়ে ওঠা দেহ
ঘুঘু ডাকে ফিরে যায় এসেছিল কেহ
একা খাই একা সুতি জীবিত কামনা
ঋতু আসে ঋতু যায় শরীর যাতনা

।। খেলিছ, এ বিশ্ব লয়ে…।।

প্রদীপ হাজরা প্রভাতের ঝিল দর্শনে মগ্ন। কেউ বলে ডোবা, কেউ বলে বিল। হাজরা কিন্তু সমস্ত সম্ভাবনা খোলা রেখে দেয়। নদীর রূপরেখা, খাত, সে তো আজও বর্তমান। শুধু কচুরিপানা সরিয়ে চলাচল দেখে নিতে হয়, জলের। মজে যাওয়া নদীর গতরে নেশা হয়। তার তো দেওয়া ছাড়া কিছু নেই, চাওয়া নেই। যেরূপ প্রদীপ হাজরার নিজেরও। দিতে চাওয়া শুধু।
আর ক্ষীণ এক টিকে থাকার বেদনা। পাঠান্তরে যা বাসনায় বদলে যায়। উপরের দিকে টিকে থাকা যায় না। নীচের দিকে হাত বাড়াতে হয়। উপরে আশীর্বাদ, নীচে মুহব্বত। সমীহ, লোভ। একটু তো টোপ দিতেই হয়।
আরও আছে। ভাতের জোগাড় বলে কথা। বাপের দেওয়া ব্যাংক ব্যালান্স সুদে পুষিয়ে উঠতে পারছে না। বয়স থাকতে একটা চাকরি না ধরার জন্য আজকাল দুঃখ হয়। চাকরি থাকলে বুজরুকি করার দরকার হত না। একটা বিপ্লব বিপ্লব হওয়া বজায় রেখে বাচ্চাগুলোর মাথা চিবিয়ে পত্রিকা, প্রকাশনী চলে। ওই থেকে কিছু ভাতের খরচও। এতে কোনো ইয়ে নেই। ভেক সকলেই ধরে নানা বিষয়ে।
তাহার সমাহিত ঝিল দর্শন নৈঃশব্দ্য ছিন্ন করিয়া মোবাইল ফোন বাজিয়া উঠিল। ‘খেলিছ, এ বিশ্ব লয়ে…’। হাজরা এরূপ ক্ষিপ্রতায় ফোন ধরিল যে তাহা হইতে অনুমান হয়, ইহার জন্যই সন্ধ্যাটি ছিল প্রতীক্ষিত।
ফোন করেছে ‘তাত্বিক হামাগুড়ির’ প্রবক্তা লীলানন্দ নীলু।
বলো, নীলু…
শুনুন, দাদা, পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনাকে রক্তাক্ত করে গালিগালাজ দিয়ে একটা পোস্ট করছি। কেমন?
হা হা হা। চালিয়ে যাও! আমি তো সাধুসন্ত ভেক ধরেছি। মাধুকরি করি। নিজে প্রতিক্রিয়া দেখাব না। ছেলেপুলের যা করার করবে।
দাদা, আপনার ছেলে মেয়েদের একটু উস্কে দিয়েন, কেমন?
সেটা এজ ইউজুয়ালই হবে, চিন্তা কি, তোমার বাপান্ত করে ছিঁড়ে খাবেখন দেখে নিয়ো!
ওকে, ডান!
ডান!

এদিকে ‘মাটির মানুষের ভৌমজল’ ফেসবুক প্রোফাইলের অধিকারী চুপি চুপি এসে পেছন থেকে সব শুনছিল।
প্রদীপ হাজরা পেছন ঘুরে সাধকের নির্লিপ্তি ও স্মিত হাসি মুখে মেখে বললেন, লুকোতে হবে না পাগলা, কাছে যায়। দেখলি তো? নীলু কেমন বেহায়া ঠগবাজ? একে তোরা গুরু বলিস? আচ্ছা শোন, আর যেতে না চাইলে এখানেই থেকে যা। তুই কাজের ছেলে।

Facebook Comments

পছন্দের বই