লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সুজন ভট্টাচার্যের গল্প

ধরিত্রী

– কিচ্ছু খাবার নাই ঘরে? মেঝেতে বসে সুবল একবার মিনমিন করে মিনতির দিকে তাকিয়ে বলে। মিনতি ফিরেও তাকায় না ওর দিকে। তার মানে নেই। নেই মানে তো নেই। কেন নেই, সে গল্প আর নতুন করে পেড়ে কী হবে! কাজেই সুবলকে বেরোতেই হবে। যদি না বেরোয়, দুপুরেও নেই, রাতেও। কিন্তু বেরোতে পারবে কী? এমনিতে বৃষ্টি ধরার নামগন্ধ নেই। তার উপর আজ যেন কেমন খিমচে খিমচে ধরছে বুক আর পেটের ভিতরে। শেষ খেয়েছিল কাল দুপুরে। দুটো পাউরুটি। তার থেকে আবার খানিকটা দিতে হয়েছিল মিনতিকে। বড়ো ছেলেটা ওর ভাগের থেকে খাবলা মেরে পালিয়েছিল। কাজেই খিদের আর দোষ কী!

এমনিতেই সকাল হলেই বড্ড খিদে পায় সুবলের। সে অবশ্য সবারই পায়। গোরু-ছাগলও তো ভোর হতে না হতেই মাঠে নেমে চবর চবর করে ঘাস চিবোতে শুরু করে দেয়। কি মজা বলো দেখি ওদের! কেরোসিন কি কাঠকুটোর ঝামেলা নেই, রান্নাবাড়ির বালাই নেই। ইচ্ছে হলেই মুখ চালাও। কখনও কখনও সুবলের খুব রাগ হয় ভগবানের উপর। কেন, ওকেও কি একটা গোরু বা ছাগল করে পাঠাতে পারতো না! তাহলেই তো আর হা খাবার, হা খাবার করে ঘুরে বেড়াতে হতো না ওকে। মজাসে ঘাস চিবিয়ে দিব্যি দিন কাটিয়ে দিতে পারতো। তা না, শালার ব্যাটা পাঠালো কিনা মানুষ করে। ধুর পেচ্ছাপ করি তোর অমন মানুষ-জন্মের মুখে, সুবল বিড়বিড় করে।

না, সুবলকে নেহাত দোষ দেওয়া যাবে না। আবার ভগবানকেও দেওয়া যাবে কিনা, সেটাও বলা খুব মুশকিল। তার বিলিবন্দোবস্তে কোনো একচোখোমি নেই। যাকে ডানদিকে মেরেছেন, তার জন্য বাঁদিক রেখেছেন খোলা। আবার যাকে ডানদিকে দিয়েছেন ঢেলে, তার আবার বাঁদিকে মস্ত বড়ো তালা। ডানদিকের বাড়তি দিয়ে কি আর সেই তালা খোলা যায়? না বাপু, সে হয়নি কক্ষনো। এই দ্যাখো না, পেটে যাদের ভাত নেই, সন্ধ্যে হলে একচিলতে ঘরে আলো জ্বালানোর মতো কেরোসিনের কুপি নেই, তাদের জন্য দিব্যি এক বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। সে কেমন বলো দেখি!

হু হু বাবা, ভগবান আসলে সবজান্তা। যে মানুষের ঘরে আলো নেই, সে তাহলে সন্ধে থেকে কী করবে? হাত চুলকে আর মশা মেরে তো কারো চলতে পারে না। তাই দিব্যি এক বন্দোবস্ত করে দিলেন। মানুষের চোখ অন্ধকারে অন্য কাজের জিনিস খুঁজে না পেলেও আসল কাজের জিনিস যাতে একটু হাতড়েই খুঁজে পায়, সেই ক্ষমতা ঢেলে দিয়ে দিলেন। দ্যাখো দেখি কাণ্ড। সন্ধ্যে হলেই ঝুপড়ির বাইরেটাই বরং খানিক ফর্সাফর্সা; নজর চলে ভালো। আর ভিতরে সে এক রাজ্যের অন্ধকার; পা চালাতে গেলেই কার না কার সঙ্গে ঠোক্কর লেগে যায়। ঠোক্কর যখন লাগবেই, তালে লেগে যা শালা ভালো করে। পাশে থেকেও কেউ দেখারও নেই; শুধু যারা লেগে গেল, তারাই বুঝল কাণ্ড একখানা হল বটে।

আর যাদের রাত হলেই দু-চারটে লণ্ঠনের আলো কি ইলেকট্রি, তাদের সে সুখের গোড়া যে একদম মারা। হাত-পা চালাতে গেলেই ধরা পড়ে যাবে। সেই কখন আলো নিভবে, তারপর। ততক্ষণে ঝুপড়ির সবাই মুখ হাঁ করে ঘুমোতে লেগে গেছে। অন্ধকারে যদি ঠিকঠাক খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে ঘুমটাও বড্ড ভালো হয় গো। খিদেফিদে সব মাথায় ওঠে। কাজেই ঝুপড়িওয়ালারা সেই রাতের ভরসাতেই দিনগুলো কোনোরকমে পার করে দেয়। আলো ফুটলেই খিদেটাও যে বেড়ে যায়, সে সব্বাই জানে। আর খিদে পেলেই যত ঝঞ্ঝাট। কে শালা তোমায় কেরদানি মেরে দিন বানাতে বলেছিল হে, সুবল ভগবানকে খিস্তি মারে।

রাতে কি আর কারো মুখ চেনা যায়, বিশেষ করে ঝুপড়ির ঘরে? আর তাই সেই ঠোক্করের রাস্তা ধরে একটার পর একটা মুখ চলে আসতেই থাকে ঝুপড়িতে। সুবলও সেভাবেই এসেছিল। তবে সুবলের বাপ অনাদি একেবারে হাভাতে ছিল না গো, মাইরি বলছি। খগেন চাটুজ্জেদের একফালি জমি ছিল তার ভাগে। তা, বছরে মাসদেড়েকের চাল তো আসতোই। বাকিটা এপাশ-ওপাশ করে সামলে নেওয়া। আর এই সামলাতে সামলাতে অনাদির আর খেয়াল হয়নি যে জমিটা গাঙের গায়ে গিয়ে ঠেকেছে। আরে ধুর! জমি সাইজে বাড়ে তো শুধু দালানের বাবুদের। গরিবের জমি কি আর সে ক্ষমতা রাখে? আসলে গাঙ আর অনাদির ভাগে নেওয়া জমির মাঝখানের ভূগোলটা আস্তে আস্তে দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে ভগবানের কোলে চলে গেল।

আহা, ওদেরও কী কম কষ্ট নাকি! এই একবার লাঙলচেরা করছে তো আবার খ্যাসাখ্যাস কাস্তের কোপ মেরে নাঙ্গা করে দিচ্ছে। তাই বলে কি সে বলতে পারে নাকি, এবারে আর পেট চিতিয়ে ফলন দিতে পারব না গো বাপু। উঁহু, ভগবানের রাজত্বে সে আবার হয় নাকি? মাটি আর মেয়েছেলে মানেই হোল ফলানির জাত। খালি লাঙল দিলেই হল। দ্যাখো না, কিছুই করতে পারলে না, তবু দিব্যি লকলকে ঘাসের দঙ্গলে ভরে গেল। মেয়েছেলেকেও তাই ফেলে রাখতে নেই। অন্ধকারে ঠোকাঠুকির মজা বাদই দাও; ফাঁকা রাখলেই আবার ঘাসের বন হয়ে যাবে। কার ঘাস এসে তোমারে বাপ বলে ধুতির খোটা ধরে টান মারবে, কে জানে। তার থেকে ফলনে লাগিয়ে দেওয়াই ভালো। সবথেকে বড়ো কথা, সন্ধের মুখে পেটে কড়া পাক মেরে যে খিদের ধোঁয়াগুলো উড়ে বেড়ায়, তাদেরও মুখে থাবরা মেরে শুইয়ে দেওয়া যায়।

অনাদি ভুঁইমালীর জমি ক্রমশ নদীর সঙ্গে সাঁট করে একদিন পালিয়ে যাবে বলে ধান্দা করে যাচ্ছিল। অন্যদিকে অনাদিও প্রতিদিন রাতে বৌকে লাঙল দিয়ে ফলনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল চোখ বুজে। কেউ কিছু বললেই বলতো– ভগমান চাইলি তেমনটাই হবেখনে। বেশি ভাবলি কি আর ঠ্যাকাতি পারব? সে কি আর ঠ্যাকানো যায়? পালদের অত্তো বড়ো বাগান যখন একটু একটু করে গাঙের জলে শুয়ে পড়ল, পালরা কি ঠ্যাকাতে পেরেছিল? হোঃ, বাধ দেবে! তো সে শালার গাঙ পাড়াঢলানির মতো শালবল্লাগুলোকে লাগাল এমন টান যে তারা কতক্ষণে তার সঙ্গে শুয়ে পড়বে ভেবে হুড়মুড়িয়ে পড়ল একসঙ্গে। ঠ্যাকাও তোমার সাধের বাগান।

পালেদের বাগানটা মুছে যেতে আর যার যাই হোক, সুবলের খুব কষ্ট হয়েছিল। বাগানের গাছগুলোতে হানাদারি করলে সবরে-অবসরে পেটটা ভরতো ভালোই। হ্যাঁ, পালেরা চৌকি রাখত ঠিকই; কিন্তু পেটে যার খিদে দিবারাত্র টগবগ করে ফুটছে, তাকে আবার কোন চৌকিদার ল্যাং মারতে পেরেছে কবে? ঘরে মায়ের আশকারা খানিকটা ছিলই। ভাইবোনগুলোও ওর মুখ চেয়ে থাকত। বাগানটা গাঙের গর্ভে চলে যেতে খাবারের সুন্দর বন্দোবস্তটা বন্ধ হয়ে গেল। আর সেই কচি বয়েসেই সুবল শিখে ফেলল, পৃথিবীর সবথেকে কঠিন কাজ হল পেটের চুল্লিটার আগুন নেভানো।

সুবল অবশ্য তখন আর ঠিক কচি নেই; নাকের তলায় গুঁড়িগুঁড়ি কালো রেখার ছানাপোনারা জানান দিচ্ছে একটা মরদের জন্ম হচ্ছে বটে। মরদ মানে কি শুধু চেহারাটাই বাড়া? না হে, তার খিদেও বাড়তে থাকে; বাড়তে বাড়তে একসময় গোটা দুনিয়াকেই গিলে ফেলতে চায়। খিদের এই লাগাতার ভালোবাসা থাকে বলেই তো সুবল একদিন মাঠঘাট ছেড়ে সুন্দরপুরের হাটে হাজিরা লাগায়। এর ওর মোট বওয়া দিয়ে শুরু। তবে শরীরটা নেহাত পলকা বলে আলু কি চালের বস্তাওয়ালারা পাত্তাই দিত না ওকে। ছোটোমতো ভাড়া হলে তবেই ওর ডাক পড়ত। কিন্তু তাতে আর কামাই কোথায়? সে তো মালিক নিজেই টেনে নিতে পারত; নেহাত দেরি হয়ে যাচ্ছে বলেই জন লাগানো।

এই করতে করতেই মাখন মণ্ডলের ভাতের হোটেলে কাজ জুটে গেল। আহা, সে এক সোনার দিন ছিল বটে। হাতে টাকা দিত না বটে, কিন্তু খাবারের অঢেল ব্যবস্থা। সকালে-দুপুরে-রাতে খেয়ে পেট একেবারে ঢাক হয়ে যেত। সেই ভারি পেট নিয়ে কোনো কোনোদিন আর তিন ক্রোশ পথ ডিঙিয়ে ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হতো না। বটতলার শানেই ঘুমিয়ে পড়ত সুবল। আর এইভাবেই একদিন ও টের পেয়ে গিয়েছিল, আরেকটা খিদে আছে, যা জাগাতে পারলে পেটের খিদেও ভোম্বা মেরে যায়। হ্যাঁ, মাখন মণ্ডলের হোটেলের ঝাঁপ বন্ধ হলেও দরমার ফুটো দিয়ে আলো চলকে আসছে দেখেই উৎসাহী হয়ে ও ঘুমঘুম চোখটা রেখেছিল সেই ফুটোটার উপর।

আরিব্বাস! মণ্ডল ন্যাংটা হয়ে এ কী করে গো! সুবলের চোখদুটো গোলগোল হয়ে যায়। ও বাবা, মন্দিরে কাজ করে যে শেফালির মা, সেই বা ন্যাংটা হয়ে মণ্ডলের সঙ্গে এমন ল্যাটামাছ-জড়াজড়ি খেলে কেন? খানিক দেখতে দেখতে সুবল টের পায় ওর শরীরের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। তার রকমটা ঠিক বুঝতে পারছে না; কী করলে যে সেই অস্বস্তির হাত থেকে রেহাই মিলবে, তাও বুঝতে পারে না। ভালো করে দেখতে গিয়ে দরমার গায়ে বোধহয় চাপ পড়ে গিয়েছিল; মণ্ডল চেঁচিয়ে উঠল– কে? তড়িঘড়ি ও দৌড় লাগাল মন্দিরের পাশ কাটিয়ে সোজা পুকুরঘাটে। ওখানেও চাতাল আছে।

চোখ বুজলেই শেফালির মায়ের দড়ি পাকানো শরীরটা যেন ভেসে ভেসে উঠছে। আর সেই ল্যাঠামাছের মতো সড়াৎসড়াৎ করে ছিটকে যাওয়ার খেলা। সেই রাতটা সুবল যেন আর ঘুমোতেই পারল না। সকালে হোটেলে যাবার সময় চোখে পড়ল শেফালির মা মন্দিরের সামনে ঝাঁট দিচ্ছে। দেখে সুবল দাঁড়িয়ে গেল। মাথা নীচু করে ঝাঁট দিতে দিতেই শেফালির মা খেয়াল করেছিল ওকে। তাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল– কী দেখিস?

সুবল কোনো উত্তর দেয় না। ওর ভঙ্গি দেখেই শেফালির মার সন্দেহ হয়। ঝাঁটা তুলে ওর দিকে দু পা এগিয়ে আসে। তারপর বলে– ঝাঁটার বারি মেরে তোমার খোমা আমি বদলে দেব হারামির বাচ্চা। নিজের মায়েরে গিয়ে দ্যাখ গে যা।

কথা না বাড়িয়ে সুবল হাঁটা লাগায়। ব্যাপারটার মধ্যে একটা রহস্য কিছু আছে, সেটুকু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। নাঃ, দেখতে হবে, ভাবতে ভাবতে সুবল হোটেলে পৌঁছে যায়। ততক্ষণে স্নান সেরে এসে মাখন মণ্ডল হোটেলে উনুন ধরিয়ে ফেলেছে। কাল রাতে মণ্ডলের হোঁৎকা পাছাটা নাঙ্গা দেখে ফেলেছে ভাবতেই সুবল ফিক করে হেসে ফেলে। মণ্ডল আচমকা ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে– কাল রাতে ঘরে গেছিলি? নাকি এখেনেই ছিলি?

সুবল মিথ্যে বলতেই পারত। কিন্তু আচমকা ওর মনে পড়ে গেল শেফালির মা ওকে দেখেছে পুকুরধার থেকে আসতে। তাই উত্তর দেয়– পুকুরির শানে ঘুমোয়েছিলাম।

–রাত্তিরে এদিকপানে এয়েছিলি নাকি? মণ্ডল কড়া চোখে ওর দিকে তাকায়।

সুবল টের পায় বিষয়টা খুব হাল্কা কিছু নয়। রাত্তিরে আসার কথা তো ওঠে চোর আসলে। সুবল কী পাগল নাকি যে চুরি করতে আসবে? যে হোটেলে ইচ্ছেমতো ডালভাত পাওয়া যায়, সেখানে চুরি করে কোন হতভাগা?

–রাত্তিরে কেউ এয়েছিল নাকি? সুবল চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করে। তুমি কী ছিলা তখন? ওর চোখমুখ দেখে যে মণ্ডল ঠিক আন্দাজ করতে পারছে না বুঝে সুবলের বড়ো উল্লাস জাগে।

–যা, কাজে লাগ। মাঝ-দুপুর বাজিয়ে বাবু কাজে এয়েছেন। দেবখনে এক লাথ মেরে ভাগিয়ে।

সুবলের মন উশখুশ করতে থাকে কখন আবার সেই নিকুষি রাত হবে। দরমার বেড়ার ফাঁক দিয়ে যা চোখে পড়েছিল, তার মর্ম না বুঝলেও একটা রহস্য যে আছে, সেটা ধরতে পেরেছিল। নইলে শেফালির মা বা মণ্ডল দুজনেই এমন ব্যবহার করে কেন?

হোটেলের দরজা বন্ধ হতেই সুবল গাছতলায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। না, আজ আর চোখ বন্ধ করে না। শেফালিরা থাকে মন্দিরের পিছনের চালায়। ওর মাকে আসতে হলে বটতলার ডানদিক ঘুরে আসতে হবে। ও নিজে থাকবে ঝুরিগুলোর আড়ালে। কাজেই শেফালির মা ওকে দেখতেই পাবে না। সুবল চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে। হ্যাঁ, ওই তো আসছে। শেফালির মা এদিকওদিক দেখে সুড়ুৎ করে হোটেলে ঢুকে গেল। যাবে? না, একটু দেরি করা যাক। সবে ঢুকেছে।

খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে যেই সুবল উঠতে যাবে অমনি চোখে পড়ল শেফালির মা বেরিয়ে আসছে। যাব্বাবা, আজকের পালা শেষ হয়ে গেল? এত জলদি? সুবল তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে থাকে শেফালির মায়ের হাতে একটা পোটলা। বটতলার পাশ দিয়ে হন হন করে মন্দিরের পিছনের দিকে চলে গেল। চালার মধ্যে ঢুকে গেছে আন্দাজ করে সুবলও ঝোপঝাড়ের আড়াল টেনে সেইদিকে হাঁটতে শুরু করল। চালাটার পিছনদিকটা অনেকটাই ভাঙা। গাবগাছটার পিছন থেকে সুবল কুপির আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল মা-বেটিতে গবগব করে ভাত খাচ্ছে।

সুবল একটু অবাক হয়ে যায়। কাল রাতে ল্যাঠামাছ খেলছিল; আর আজ কি ভাতের গামলাতেই হামলা করে দিল! পরক্ষণেই ওর মনে পড়ে যায়, রাতে মণ্ডল প্রথমেই খানিকটা ভাত আর ডাল সরিয়ে রেখে দেয়। ওর নাকি রাতে খিদে বেশি পায়। শেফালির মা কি সেটাই চুরি করে আনল? সুবল আবার সাবধানে বটতলায় ফিরে এসে রাস্তাটার উপর নজর রাখে। যেই শেফালির মা হোটেলে ঢুকে গেল, অমনি এক দৌড়ে এসে চোখ পাতল আবার সেই দরমার গায়ের ফুটোয় ।

বোঝো কাণ্ড! মণ্ডল আর শেফালির মা সেই কালকের মতই বাচ্চাপনা করতে শুরু করে দিল। বর্ষাকালে গাঁয়ের বাচ্চারা মাঠের কাদার মধ্যে যেমন পাকড়াপাকড়ি খেলে, মণ্ডল আর শেফালির মা ঠিক তেমন ঢঙেই খেলতে শুরু করে দিল। আগেরদিন সুবল প্রথম থেকে দেখতে পায়নি; আবার মাঝপথেই ভাগতে হয়েছিল। কিন্তু দেখতে দেখতেই ওর শরীরে আবার সেই কালকের মতো জ্বালা কুটকুট করে কামড় দিতে শুরু করল। কেমন একটা অজানা খিদে যেন সুবলকে গ্রাস করে ফেলছে। তার চেহারা সুবল চেনে না; কিন্তু সে যে আছে, খুব ভালোভাবেই টের পাচ্ছে। সুবল নিতান্ত অসহায়ের মতো দরমার ওপাশের ছায়া ছায়া দুটো শরীরের ল্যাপ্টালেপ্টি দেখতে দেখতেই ভাবতে থাকে, কী করলে এই কামড়ের হাত থেকে রেহাই পাবে।

অজানা খিদের কামড়ে জ্বালাপোড়া হতে হতে সুবল টের পায়নি ওর পিছনে আরেকজন কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।

–কী দেখিস? কানের কাছে ফিসফিস করে শব্দটা হতেই সুবল চমকে ওঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখে, পাগলা নগা মাঝি। নগা মাঝি কোনোকালে হয়তো নাও টানতো। সে নদীও খাত বদলে সরে গেছে অন্য কোনো দেশে, নগার নাও আর ভিটেও টেনে নিয়ে গেছে সেইসঙ্গে। পাগল হলেও লোকে ওকে মাঝিই বলে।

–দ্যাখো দিকিনি ভিতরের কাণ্ড। সুবল ইঙ্গিতে ওকে চোখ রাখতে বলে ফুটোটায়।

একঝলক দেখেই নগা হা হা করে হেসে ওঠে। তারপর গম্ভীর হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে – অন্যলোকের রাতের কাজ দেখতি নাই রে। দেখলে নিজের কাজে ভাটা লেগে যায়। যা, তোর কাজে যা।

নগার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সুবল টের পায় সেই খিদেটা খানিক নেমেছে বটে। তাই নিশ্চিন্ত হয়ে ও নগাকে আজ রাতে দ্যাখা সমস্ত কাহিনি বলে যায়। নগা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হেসে ওঠে। তারপর সুবলের হাত ধরে বলে– ওদের খাবার নাই বলিই তো শেফালির মা মণ্ডলের কাছে গে ন্যাংটা হয়ি খাবারের যোগান করি আনে।

সুবল অবাক হয়ে যায়। ন্যাংটা হলেই যদি খাবার মেলে, তাহলে রাজ্যের লোকের এত খিদে কেন? ওর ছোটো ভাইবোন দুটো তো জন্মের ন্যাংটা। তাহলে ওগুলোর খাবারের অভাব কেন?

–আরে ধুর পাগল। ন্যাংটা হলিই হয় নাকি? জায়গামতো ন্যাংটা হতি হয়। নগা মাঝি এমন ঢঙে বলে যেন বটতলার কথকতার আসরের নাড়ু মহারাজ।

–আমি যদি মণ্ডলের সামনে ন্যাংটা হয়ে থাকি, তালে আমারেও এমনিএমনি ভাত দে দেবে? সুবল ভালো করে বোঝবার চেষ্টা করে। – এই এমন রাত্তিরকালে?

নগা মাঝি ওর সর্বাঙ্গে চোখ বুলিয়ে বলে– তাতে এট্টু সমস্যা হতি পারে। তুই বরং যদি এক গামলা ভাতের জোগান করতি পারিস, তালে তোর সামনে ন্যাংটা হবারে লোক মিলতি পারে।

–ধরো, আমি যদি মণ্ডলের ভাত সরায়ে শেফালির মায়ের সামনে রাখি দি?

–কী আপদ! নগা মাঝি যেন এইবার বিরক্ত হয়। – অন্য লোকের খাবার নে আবার টানাটানি করিস কেন? তোর হাতে যদি খাবার থাকে, তালে নাখাকি আরেকজনরে খুঁজে নেগে যা।

–শেফালিরে দেব?

–তা দিতি পারিস; তবে সামলাতে পারবি কিনা, সে হল গে কথা। ধর, শেফালির এমনিই যদি জুটি যায় তার মায়ের খাতিরি, তালে তোরে আর পাত্তা নাও দিতি পারে। নাখাকির তো আর অভাব নাই দেশে। খুঁজি দ্যাখ। নগা মাঝি আবার হাঁটা লাগায়। সুবল তখনই তাল কষে ফেলে। কাল রাতে যেই মণ্ডল ভাত সরাবে অমনি ফাঁক বুঝে সেটা হাপিস করে দেবে। তারপর শেফালির মা হোটেলে চলে গেলেই ও নিজেই সেই ভাত নিয়ে শেফালির কাছে যাবে। দ্যাখাই যাক না।

পরদিন মণ্ডলের সরিয়ে রাখা ভাত হাতসাফাই করতে সময় লাগল না। এমনিতেই হোটেল থেকে ওকে বিদায় দিতে মণ্ডলের খুব তাগিদ যে থাকে, সেটা সুবল আগেই খেয়াল করেছে। বেরিয়ে আসার মুখে হঠাৎ একবার পিছন ফিরে মণ্ডলের মুখের দিকে তাকাল ও।

–কী চাই? মণ্ডল খেঁকিয়ে উঠল।

উত্তর না দিয়ে সুবল হাঁটা লাগাল বটতলার দিকে। হ্যাঁ, ঝাঁপটা বন্ধ হতেই দৌড়ে হোটেলের পিছনের ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হাঁড়িটা তুলে নিল। বটতলার অন্ধকারে মিশে লক্ষ রাখল শেফালির মা কখন আবার হাজির হয়।

যথারীতি হল। হোটেলের ঝাঁপ একবার উঠেই আবার নেমে গেল। কী হল ব্যাপারটা? কাল তো হাঁড়িটা নিয়ে সঙ্গেসঙ্গেই চলে এসেছিল। উৎসুক সুবল আবার গিয়ে দরমার গায়ে দাঁড়ায়। হুম, দুজনে মিলে হাঁড়িটা খুঁজছে।

–কোন হারামির বাচ্চা লুকোল বল দিকিনি। মণ্ডল হতাশ হয়ে বলে।

–ভাত যখন নাই, তখন চলি যাই, শেফালির মা উঠে দাঁড়িয়েছে।

–ছিছিছি, অমন করতি নাই গো। রোজ তোমারে ভাত দিই না?

–যেদিন দাও, সেদিন আমিও দিই না? শেফালির মায়ের গলাটা বেশ কটকট করে ওঠে। আহা, ভাতের শোক বলে কথা। কত আশা করে এসেছে, মা-বেটিতে পেটপুরে খাবে, তারপর ল্যাঠামাছ সেজে খেলা দ্যাখাবে।

–আস্তে বলো; লোকে শুনতি পাবে, মণ্ডল ফিসফিস করে ওঠে।

–লোকে কি আমারে ভাত দেয় যে শুনলি আমার মাথাকাটা যাবে? শেফালির মা ঝাঁপটা খুলতে যায়। দেখেই সুবল একদৌড়ে বটতলায় চলে আসে। অন্ধকারে মিশে খেয়াল করে শেফালির মা গজগজ করতে করতে চালার দিকে যাচ্ছে। হোটেলের বাইরে খানিকক্ষণ হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মণ্ডল ভিতরে চলে গেল। ল্যাঠামাছের খেলাটা বোধহয় একা একা খেলা যায় না। নইলে মণ্ডলকে এমন দেখায় কেন? ভাবতে ভাবতে সুবল সেই হাঁড়িটা নিয়ে চালার দিকে যায়।

–ও মা, আমার নাড়িভুঁড়ি চিবোয়ে নেয় যে, শেফালির গলাটা শোনা যায়।

–আমার মাথা চিবোয়ে খা। এত বড়ো মেয়ে, নিজির খাবার যোগাড় করতি পারো না? মা সেই কোনরাতে ভাত যোগাড় করি আনবে; আর উনি পায়ের উপর পা তুলি দে খাবেন। মরতি পারিস না তুই? আমার হাড় জুড়োয় তালে।

এমনধারা কথা শুনে শুনে সুবল অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মাকেও বলতে শুনতো। আর কথা বাড়াতে না দিয়ে ও হাঁড়িটা নিয়ে ও চালায় ওঠে।

–কোন হারামির বাচ্চা রে? শেফালির মা চিল্লিয়ে ওঠে।

–আমি সুবল। নাও ভাত নাও।

শেফালির মায়ের গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোনোর আগেই শেফালি দৌড়ে এসে হাড়িটা ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। আর তৎক্ষণাৎ গবগব করে খেতে আরম্ভ করে।

শেফালির মা সুবলের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলে– ভাত তুই পেলি কোথায়?

সুবল ঘাবড়ে যায়। ভাত না পেলে মণ্ডলের উপর যে শেফালির মা চোটপাট করে সে তো ও একটু আগেই দেখেছে। কিন্তু এখন ভাত পেয়েও করে কেন?

–হোটেল থেকে ঝেড়ি এনেছিস, না?

সুবল বাধ্যের মতো ঘাড় নাড়ে। শেফালির মা খানিকক্ষণ ওর দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর ফিসফিস করে বলে– হোটেলে তুই কি কিছু দেখতি পেয়েছিস?

সুবল এবারও ঘাড় নাড়ে। শেফালির মায়ের মুখটা যে বেশ অন্ধকার হয়ে গেল, ওই টিমটিমে আলোতেও বোঝা গেল।

–তুমি কী খাবা? নাকি আমি একাই খেয়ে নেব? শেফালির খিদেটা যে বেশ চাগার দিয়ে উঠেছিল, সুবল টের পায়। শেফালির মা হাঁড়ির দিকে এগোতে গিয়ে আবার ওর দিকে ফিরে তাকায়। তারপর বলে– যাস নে। কথা আছে। হাঁড়িটাকে ঘিরে তিনজন বসে। সামনে ভাতের আশ্চর্য সুন্দর কান্তি দেখে মা-বেটি যে আর কোনো হুঁশ নেই। সুবল চুপ করে বসে সেই দৃশ্য দেখে।

–তুই খাবি? শেফালি বলে।

–আমি খেয়িই তো তোদের জন্যি আনলাম। সুবলের নিজেকে যেন মাখন মণ্ডল বলে মনে হয়। দ্যাখো কাণ্ড! সুবল আজ কেমন রাজাবাদশার মতো লোকরে খাবার দিচ্ছে।

খাওয়া শেষ হতেই শেফালির মা সুবলের হাত ধরে বলে– এট্টু বাইরে চল।

পেট ভরে যেতেই শেফালির বোধহয় ঘুম পেয়ে গেছে। মাটিতে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। গাঢ় অন্ধকারে সেই দৃশ্য দেখেই আবার সেই অজানা খিদেটা যেন সুবলের শরীরে ভর করল। ও হাঁ করে শেফালির দিকে তাকিয়ে আছে দেখে শেফালির মা একটানে ওকে বাইরে নিয়ে এল।

–তুই ভাত ঝেড়ি নিয়ে এয়েছিস কেন, আগে বল।

সুবল জানে, একসময় না এক সময় কাজের কথা পাড়তেই হবে। তাই ও বলে– ভাত খাবার পরে তুমি আর মণ্ডল ন্যাংটা হও তো। তা নগা মাঝি বলল, ভাত দিতি পারলে ন্যাংটা হওয়া যায়। তাই ভাত নে এলাম।

শেফালির মা ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে দেখে সুবল বোঝে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে। তাই ও মাথা নীচু করে থাকে।

–তুই নগারে এনেও দেখোইছিস?

–আমি ডাকি নাই গো; মায়ের কিরে। সে তো নিজিই চলি এল। উলটে আমারে বললে অন্যলোকির ন্যাংটা হওয়া দেখলি নিজিরটা বন্ধ হয়ি যায়। তাই তো চলি আলাম।

–তুই ন্যাংটা করতি ভাত নিয়ি এয়েছিস? শেফালির মা অবাক হয়ে যায়। – ন্যাংটা করি কী করতি হয়, জানা আছে তোর?

–ওই তো, মাটিতে শুয়ি খাবলিস খাবলিস করতি হয়, সুবল উত্তর দেয়।

শেফালির মা হেসে ফেলে। তারপর বলে– ভাত যখন নে এইছিস, তখন আয়। খবরদার। কাকপক্ষীও যেন টের না পেতি পারে। তালেই তোর ঘাড়ে আর মাথা থাকবে নি।

চালার একপাশে শেফালি মুখ হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। শেফালির মা মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলে – নে, জলদি কর। বলেই এক ফুঁয়ে কুপিটা নিভিয়ে দেয়।

ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে প্রথমে সুবল ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে ও বুঝে ফেলল অন্ধকারে ল্যাঠামাছ হবার খেলাটা বেশ মজাদার। নিজের শরীরটাও যেন ধীরে ধীরে কেমন অজানা-অচেনা হয়ে উঠতে লাগল। আর একসময় সেই জোয়ারভাটার মতো নিশ্বাসের ডাকটাকে ও চিনেও ফেলতে পারল। হ্যাঁ, ঘরেও অন্ধকারে এমন আওয়াজ আসতো বটে। চোখ বন্ধ করে ও শুধু বোকার মতো ভাবত, বাইরে জটাবুড়ি দাঁড়িয়ে আছে কচিছেলের কলজে খাবে বলে।

না, সেই একরাতের পরে হোটেলের ভাত বাগানোর সুযোগ আর সুবল পায়নি। ভাতচুরির কিস্যাটা মণ্ডল ধরতে পেরেছিল কিনা কে জানে, কিন্তু ওকে ভাগিয়ে দিল। সারাদিনের খিদে সামলে ও শুধু শেফালির মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। আজ ওরই ভাত চাই। হ্যাঁ, যেখানে খুশি ন্যাংটা হতে ও রাজি।

–হারামির বাচ্চা! খুব নোলা বেড়ে গেছে তোর না!

–আমারে এট্টু ভাত দেবা! আজ সারাদিন খাবার জোটে নাই গো। কথাটা শুনে শেফালির মায়ের বোধহয় দয়া হয়, পৃথিবীর কি বিচিত্র লীলা দ্যাখো দেখি। কাল রাতে যে ছোঁড়াটা এক হাঁড়ি ভাত এনে ওর উপর চিত হয়ে পড়েছিল, আজ সেই কিনা ভাত চায়! তাই মৃদুস্বরে বলে – আয়।

–শেফালি আর আমি পুরো খাব, তারপর তুই। শেফালির মা প্রথমেই কড়ার করে দেয়। তা হোক, তবু জুটবে তো। ওদের পালা শেষ হবার পর যেটুকু পড়েছিল, তাতে সারাদিনের খিদে মেটা সম্ভব নয়। আর হোটেলে কাজ করতে করতে খিদে ব্যাপারটা সুবল আসলে ভুলেই গিয়েছিল।

–খাওয়া হলিই চলি যাবি কিন্তু, বলে শেফালির মা আবার অন্ধকারে মিশে যায়। কিন্তু খাওয়া শেষ হতেই সুবল এক ধর্মসঙ্কটে পড়ে। খাবার দিলে ন্যাংটা হয়ে হয়, এতো সব্বাই জানে। আজ যেহেতু মণ্ডল ভাত দিয়েছে, তাই শেফালির মা তার সামনে ন্যাংটা হতে গেছে। কিন্তু সুবলকে যে ভাত দিল; তাহলে ও ন্যাংটা হবে কোথায়? শেফালির মা তো সেই হোটেলে। কী করবে বুঝে না পেয়ে ও শেফালিকেই জিজ্ঞেস করে – ভাত তো দিলি; আমারে কি ন্যাংটা হতি হবে?

–অসব্য, শেফালি মুচকি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

–না রে, ভাত দিলিই বদলি হিসাবে ন্যাংটা হতি হয়। দেখ না, তোর মা তো মণ্ডলের হোটেলে তাই চলি গেল।

–তোর সাধ জাগলি হগা যা, আমারে বলিস কেন? বলেই শেফালি কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। আমি হতি পারব না। পারলি ন্যাংটা করি নে।

কুপিটা টিমটিম করে জ্বলছিল। অন্ধকারের সঙ্গে জাপটাজাপটি করে চলা সেই আলোটার নাচ বুঝতে বুঝতেই সুবল টের পেয়ে গেল, ভাত দিলে যেমন ন্যাংটা হতে হয়, ঠিক তেমনি ন্যাংটা হতে পারলে ভাতের খিদেও মারা যায়। এই নতুন শিক্ষা সম্বল করেই পরদিন সুবল সুন্দরপুর থেকে পালাতে বাধ্য হয়। ওদের ল্যাঠামাছের খেলাটা শেষ হবার আগেই শেফালির মা ফিরে এসেছিল। তার চিৎকারের বহরেই সুবল বুঝতে পেরেছিল, নগা মাঝির কথাটাই সত্যি। এ কেস সামলানো যাবে না।

গরিব মানুষ সবকিছু সামলাতে না পারলেও ঠিক সামলে যায়। তাই ফার্স্ট ট্রেনে ঠিকিট না কেটে সেই যে সুবল উঠে পড়েছিল, কলকাতার স্থায়ী ভোটার হিসাবে নাম তুলে তবে ছাড়ল। চালপট্টির বস্তিতে একটা ঘরও জুটিয়ে ফেলল। কাগজকুড়ুনি হয়ে ওর কলকাতা বাসের সূচনা। তারপর নানান ঘাটের জল খেয়ে ঠ্যালাওলার মেয়ে মিনতিকে বৌ করে এনে তুলল ঘরে। বর্তমানে সুবল রাজমিস্ত্রির যোগাড়ে। কিন্তু বর্ষাকালে সেই কাজেও টান আসে। কাজেই সুবলকেও পেটে টান দিয়ে পড়ে থাকতে হয়।

তিনদিন কাজ জোটেনি। যেটুকু পয়সা হাতে ছিল, পরশুদিন অবধি চলেছে। তারপর হরিমটর। সুবল টের পায় খিদের দাপটটা গলার কাছে পৌঁছে গেছে। বুকটা কেমন যেন খিমচে ধরছে।

মিনতি ওর দিকে পিছন ফিরে ছোটোটাকে দুধ খাওয়াচ্ছিল। দেখতে দেখতে সুবলের মনে হয়, এটা নেহাতই ভগবানের চরম অন্যায়। কচি বাচ্চা দুধ খাচ্ছে, খাক। কিন্তু ধাড়িদের জন্যও এমন একটা ব্যবস্থা রাখলে কি পৃথিবী উলটে যেত?

সুবল জানে কোনোকিছুই পৃথিবীতে এমনিএমনি পাওয়া যায় না। পাছা ঘঁষে ঘঁষে ও মিনতির সামনে যায়। বাচ্চাটা বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে দুধ খেয়ে যাচ্ছে। দেখেই সুবলের যেন প্রচণ্ড রাগ হয়ে যায়। শালা ভগবান, তোমার শালা সব একচোখোমি। বড়োদের খিদে পায় বলেই তো কচিগুলো আসে। তাদের খিদে মেটাতে পারো, আর সুবলের বেলায় তোমার মাথা চলে না?

মিনতি ওর দিকে তাকিয়ে বলে– দ্যাখো কী?

সুবল মিনতির মুখোমুখি বসে। চুপ করে বাচ্চাটার দুধ খাওয়া দেখতে থাকে। মিনতি হঠাৎ ওত হাতটা ধরে বলে– খুব খিদা পাইছে, না?

সুবল কোনো উত্তর দেয় না। এক চিরন্তন ভিখিরির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিনতির বুকের দিকে।

–দুধ খাবা?

সুবলের আর উত্তর দেবার তর সইল না। মিনতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণপণে দুধ খেতে শুরু করল। আঃ, এমন বন্দোবস্ত হাতের কাছে থাকতে সুবল কিনা হাবুডুবু খাচ্ছিল!

স্বামী আর সন্তানকে একসঙ্গে স্তন্যপান করাতে করাতে মিনতি শুধু অসহায় ধরিত্রীর মতো দুজনকেই দুই হাতে আগলে রাখে। বাইরে তখনও অঝোরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে।

আরও পড়ুন: সুজন ভট্টাচার্য

Facebook Comments

পছন্দের বই