লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সুজয় পালের গল্প

মনশোকরহিতা

“প্রত্নকীর্তিমপাবৃনু” এটি আমাদের ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের মোটো বা নীতিবাক্য; আপাবৃনু অর্থে উন্মোচন বোঝায়, আর আমি ঘরে বসে বসে এইসব ‘আগডুম বাগডুম’ ভাবছি। এই শব্দটার সাথে মনে পরে গেলো ছেলে ভোলানো ছড়াটার কথা— “আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে, ঢাল মৃদঙ্গ ঘাগর বাজে। বাজতে বাজতে চলল ঢুলি, ঢুলি গেল ওই কমলাফুলি”… তারপর কিছু একটা ‘বিয়েটা’ ছিল মনে পরছিল না, আর সাথে সাথে মনে পড়ল ভারতীয় জাদুঘরের গ্রন্থ বিভাগের গ্রন্থাগারিক সচিব ডঃ দেবনাথ স্যারের কথা। তিনি আমাকে এই ছড়াটার ব্যাখ্যা করেছিলেন।
শাশাঙ্কের পরে গৌড়ের দায়িত্ব নেন পুষ্যভূতি বংশীয় রাজা হর্ষবর্ধন ও কামরূপের বর্মনরাজ শ্রীকুমার ভাস্করবর্মন কিন্তু রাজধানী কর্ণসুবর্ণ থেকে তাঁদের নিজস্ব রাজধানী অনেক দূরে থাকায় সম্পূর্ণ শাসন ব্যাবস্থা শিথিল হয়ে পড়ে, এই মাৎস্যন্যায় কালে প্রথমে বঙ্গ অধিকার করে খর্গরাজারা তারপর শক্তভাবে সিংহাসনে বসেন পালরাজা গোপাল আনুমানিক ৭৫০ সালে, ধর্মপাল ও দেবপালের সময় কীভাবে কনৌজ অধিকার করে পাল রাজারা সেটা আমরা সবাই খুব ভালো মতোই জানি। পরবর্তী সময়ে বংশ গৌরব ক্রমশ শিথিল হয় আর অন্তর্দ্বন্দ্ব তুমুলে ওঠে দ্বিতীয় মহীপালের সময় আনুমানিক ১০৭২ সালে। পশ্চিমের বারেন্দ্রভূমী দখলের সাথে মল্ল রাজাদের চাপ ও বাড়তে থাকে তাই রাজধানী কানসোনা থেকে কামরূপের কাছে আত্রেয়ী ও তিস্তা নিদী ঘেরা দোয়াব অঞ্চলে ডোমনে স্থানান্তরিত করেন, ইতিমধ্যে কামরূপে বর্মণ রাজাদের সরিয়ে রাজত্ব চালাচ্ছে পৌরাণিক নরকাসুর বংশভূত ম্লেচ্ছ বংশীয় রাজারা অর্থাৎ এই অঞ্চলে রাজধানী অনেক বেশি সুরক্ষিত। বর্তমান বাংলাদেশের আসাম লাগোয়া উত্তরের জেলায় নীলফামারীর একটি উপজেলার নাম ডোমার, এরই আগের নাম ছিল ডোমন নগর। সন্ধাকর নন্দীর ‘রামচরিতম’ গ্রন্থে দেখতে পাই কীভাবে দ্বিতীয় মহীপাল সামরিক গৌরবে স্বল্পকালীন রাজত্ব করেছিলেন; ডোমন রাজ্যের সৈন্যদের বলা হতে ডোম সৈন্য যার বলে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন নিজেরই ভাই রামপালের বিরুদ্ধে, কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। সমগ্র পালবংশের রাজা হন রামপাল। এই ডোম সৈন্যদের সাহায্যে তিনি মল্লরাজ প্রকাশমল্ল ও সেনরাজ বিজয়সেনকে বহুবার পরাজিত করেছিলেন। কোনো কোনো গবেষক অনুমান করেন ছড়াটিতে ওই ডোম সৈন্যদের শোভাযাত্রা বা যুদ্ধযাত্রার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ‘আগডুম’ অর্থাৎ যে ডোমসৈন্য বাহিনী সবার আগে যায়, ‘বাগডুম’ হল যুদ্ধ কৌশলে সহজে বাগ মানাতে পারা সৈন্যদল, আর ‘ঘোড়াডুম’ হলে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার ডোমসৈন্য। সঙ্গে বাজে তিন ধরনের যুদ্ধবাদ্য—ঢাক, মৃদঙ্গ এবং ঘাগর বা ঝাঁঝর। মধ্যযুগের ধর্মমঙ্গলেও ডোম সৈন্যদের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।

ছেলে ভোলানো ছড়াতে প্রথম ছত্র দু-টিতে বেশ একটা বীরত্বের ছোঁয়া লেগে আছে, কিন্তু পরের ছত্রগুলো কিছু উৎসবমুখর পরিবেশ। মনে হয় দুটো পৃথক ছবিকে কেটে একসঙ্গে জোড়া দেওয়া হয়েছে ছায়াচ্ছন্ন মোহময় এক পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যে, তবেই না ছেলে ভুলবে। পালরাজাদের কীর্তির কথা চিন্তা করতে গিয়ে মনে পড়ল; পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ আর তাঁদের সুবর্নযুগে তৈরিহয়েছিল অসংখ্য বৌদ্ধবিহার ও মঠ। রাজা ধর্মপাল বৌদ্ধধর্মের এক মহান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং ওদন্তপুরী মঠ ও বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মের একটি মহান শিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে বিকশিত হয়েছিল। তাঁর সময়েই প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বিখ্যাত সোমপুরা মহাবিহার যা ভারত ভূখণ্ডের সর্ব বৃহৎ বিহার হিসাবে আজও অধুনা বাংলাদেশের নওগাঁ জেলা পাহাড়পুরে বর্তমান। এই সময়ে আমরা পেয়েছিলাম বিখ্যাত বৌদ্ধ মহাগুরু চুরাশী-মাহাসিদ্ধগণকে যাঁদের সান্ধ্য ভাষায় লেখা চর্যাচর্যবিনিশ্চয় ও ডাকার্ণব আমরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পড়েছিলাম। আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে বঙ্গপ্রদেশে মাহাসিদ্ধ মহাগুরু সরহ পা নালন্দা থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করে এক অভিনব বৌদ্ধদর্শন মতবাদ প্রবর্তন করেন যা বর্তমানে বজ্রযানদের মাহামুদ্রা হিসাবে বহুল প্রসিদ্ধ।

ইত্যাদি চিন্তনের মাধ্যমে বজ্রের ন্যায় প্রত্যুৎপন্নমতিতে মাথায় এল দেবী মূর্তির মুকুটে ওই যোগীমূর্তির কথা, একহাত কোলে রেখে অন্য হাতে তিনি বরমুদ্রা প্রদর্শন করছেন, তিনি যে কোন সাধারণ যোগী নন; স্বয়ং ধ্যানীবুদ্ধ আমোঘসিদ্ধি। কথাটা মনে পড়তেই আমার মানসপটে এক এক করে সব পরিষ্কার হতে থাকল। দেবী মূর্তির সামনের মুখ্য দুই হাতে বজ্রহুংকার মুদ্রায় অবশ্যই ছিল বজ্র ও পাশ, আর অন্য ভগ্ন হাতে ছিল মন ও দেহ শোক হরণকারী অশোকমঞ্জরী, দেবীর পোষাকের ওইগুলো ময়ূরের পালক নয় বরং গভীর শিরাবিন্যাসযুক্ত পাতা, দেবীর পদতলে থাকা ওই মানুষের অবয়ব হল বিঘ্ন-মারি, তিনি বহুল প্রসিদ্ধ আমোঘসিদ্ধি কুলজাত দেবী পর্ণশবরী।
তৎকালীন সময়ে দুরারোগ্য ব্যাধি হতে মুক্তিপেতে সঙ্ঘে দেবীর উচ্চাঙ্গ মন্ত্রপাঠ ও বহুল ভেষজ সমিধ-সহ হোম করা হত, মনে করা হয় মন্ত্রের কম্পাঙ্ক ও হোমের ধোঁয়াতে পরিশুদ্ধ হত বায়ুমণ্ডল। বয্রযানের গঠনমূলক সময়ে বহু বৌদ্ধতান্ত্রিক দেবতার বিকাশ হয় বঙ্গভুমে সাথে অজস্রও মূর্তিও খোদাই হয় বিভিন্ন বিহারের উপাসনা ও সৌন্দর্যায়নের নিমিত্তে। আর সাথে এটাও সিদ্ধান্তে এলাম ওই লিপি কূটাক্ষর না বরং বৌদ্ধআদি লিপি-সিদ্ধমাতৃকা, যার প্রচলন সুদূর সময়ে চলেছিল শুধু জ্ঞানসিদ্ধ সংরক্ষণের জন্য। অচিরেই মানচিত্র দেখে বুঝলাম প্রাপ্তিস্থল থেকে খুব কাছে আছে সেই বিখ্যাত সোমপুর মহাবিহার। নির্বিঘ্নে পায় হেঁটে দু-দিনেই চলে আসার মতো পথ, তৎকালীন যুগে খুব একটা অসুবিধার ছিল বলে মনে হয় না। তবে কি সেখান থেকেই দেবিমূর্তিকে কেউ নিয়ে এসেছে? যা অতি গোপনে পূজিতা হয়েছিলেন কোনো গুপ্তসিদ্ধগণ দ্বারা। অনুমান করতে দ্বিধা হয় না যে আনুমানিক ১১৬০ সালের দিকে বল্লাল সেন পালরাজাদের সম্পূর্ণ পরাস্ত করেছিলেন হিন্দুদের সাহায্যে, আর সাথে চলেছিল বৌদ্ধবিহারের সাথে অসহিস্নুতা, সম্ভবত এরম কোন সময়ে ওই মূর্তি কালের গ্রাসে চলে যায়। অনেক বিশেষজ্ঞ হিন্দু শীতলা দেবীর সাথে দেবী পর্ণশবরীর সামঞ্জস্যতা খুঁজে পান, মহামারির কালে শীতলাপুজার লগ্নে অপ্সরা রূপে দেবীর আগমন কি শুভ হেতু?

আজ এই অতিমারির দিনে যখন মানুষ তাঁর স্বাবাবিক সত্তাকে অস্বীকার করে ক্রমশ নিম্নপথে সমাজস্রোতের বিপক্ষে ছুটে চলেছে, শিক্ষার তকমা অশিক্ষিতদের কাছে হার মানছে, বিজ্ঞান যখন অজ্ঞতার বশীভূত, অযোগ্য যখন যোগ্যপদে আভিষিক্ত, সামাজিক দায়িত্ব যাঁদের হাতে তাঁরা নাট্যমঞ্চের কুশীলব সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের কি? উচিত না নতুন করে পৃথিবীটাকে নতুন চিন্তায় সুন্দর করে তুলি! কিন্তু সেই আমি নির্বিকার— ক্রমশ নিজের অস্তিত্বকে আলোকভেদী জলের মতো মনে করি; প্রদত্তপাত্রের আধারের আকৃতি ধারণ করি, আর বিশেষ আধারের অনুপস্থিতিতে ঘনীভূত হয়ে আত্মকেন্দ্রিক গোলক রচনা করি।

প্রথম পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই