লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সুজয় পালের গল্প

মনশোকরহিতা

সারাদিন পর ঢাকঢোল বাজিয়ে পূর্ণাহুতির মাধ্যমে শীতলাপূজা শেষ হল, ঠাকুরমশাই বেশ গর্বের সাথে বললেন, “লিন, এ বসরের মতো শেতলাষ্টমীর মায়ের পুজো নির্ভিগ্নে শেষ হোলো, আর কুনো রোগভোগ ছুঁতে পারবেনি”। এই বলে বেশ লজ্জার ভাবে হাত বাড়িয়ে দক্ষিণা চেয়েনিলেন আমার ছোটোপিসার কাছ থেকে।আমি যেন হাঁফ ছেরে বাঁচলাম, আসার পর থেকে একগাদা কাজ আর লোকের মাঝে নিজেকে একরকম পাগল পাগল লাগছিল।একে এতদূর পারি দিয়ে কলকাতা থেকে মালদা এসেছি তার পরে ছোটোগাড়ি চেপে প্রায় ১২ কি়.মি. পথে ভোলানাথপুর, সেখানে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে পিসির বাড়ি এলাম আর তার পর থেকেই চলছে মোচ্ছব। মনে মনে ভাবলাম এই পাগলাদশার নিষ্পত্তি করতে পাশেই পাগলা নদের পাড়ে বসে মনের সুখে সিগারেট টানা যাবে, ধোঁয়ার সাথে পুরুষমানুষের এক অদ্ভুত টান থাকে, সে-ধুম্রপান হোক বা ধোঁয়াটে সম্পর্ক; কিছুতেই যেন ছাড়া যায় না।এইসব সুখটানের কথা চোখ বন্ধ করে ভাবছি এমন সময়ে প্রায় কর্কশ গলায় ঠানদি চীৎকার দিয়ে কাকে যেন শোনাচ্ছে, “ধম্মে সইবে না মুখপোড়া, কাঁচাখেঁকী ঠাকুরের চন্নামিত্ত নিয়ে ছেলেখেলা…” ধরপরিয়ে অশীতিপর বৃদ্ধাকে সামলাতে এগিয়ে দেখি একটা ছোটো, ঠিক ছোটো না; মাঝবয়সী ছেলে পুজোর চরণামৃত নামক ভক্তিসুধা পান করাতে নাকোজ জানিয়েছে। মনে মনে খুশি হলাম, মানুষের স্বাভাবিক চেতনাশক্তিতে যেন সরস্বতী বাস করে ভেবে। আজ ১৬ই মার্চ ২০২০, আজকের দিনেও লোকে এতটা বিশ্বাস রাখে! চরণামৃত বা প্রসাদ সত্যিই কি রোগ সারাতে পারে? ভক্তি নিজের নিজের, এই ভেবে বাচ্ছাটাকে হাতে করে চললাম… পাগলা নদী দেখাতে। নদী নয় নদ; নদী বা নদ এই নিয়ে অনেকেরই একটা সুপ্ত জিজ্ঞাসা থাকে, আসলে দুটোই এক, জলের রেখামাত্র; ভৌগলিক কোনো পার্থক্য না থাকলেও সামাজিকভাবে মানুষ তাদের প্রয়োজনে আলাদা করেছে। নদের কোনো শাখা হয় না আর নদী সন্তানের মতো শাখাবিস্তার করে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। প্রাচীনকালে গন্ধবণিক বা সওদাগররা নদ পছন্দ করত না, কারণ, সেই পথেই তাদের ফেরত আসতে হত, এতে তাদের মুনাফা নিশ্চই কম হত, নদী পথে তারা এদিক ওদিক গিয়ে তাদের বাণিজ্যবিস্তারের ক্ষেত্রটা বাড়াতে পারত। তাই নদী মঙ্গলময়ী, আর এই কারণে আলাদা নামকরণ, সাথে স্বার্থচরিতার্থতা। এইসব ভাবতে ভাবতে যখন এসে পৌঁছালাম দেখলাম নদও না, আসলে ওটা এখন একটা প্রায় মজাখাল। মনে দুঃখ হল ছেলেবেলায় এই জলে কত দাপিয়েছি, কলার ভেলা, আম চুরি, এমনকী! মরা পোড়াতেও দেখেছি, সুখ-দুঃখ সবকিছু যেন ভাগ করত পাগলাটা। এই নদটা গঙ্গা থেকে জন্ম নিয়ে শীর্ণ কায়াতে পাগলেরই মতো এদিক ওদিক ঘুরে বাংলাদেশের মহানন্দা নামে এক শাখানদীর সাথে মিলতে গিয়েও মিলল না, এর এই অসম্পূর্ণ জীবনের দুঃখটা কাটত ওর দু-দিকের আমবাগানের শান্ত ছায়া আর তরুণ-তরুণীদের গঞ্জনা-ভঞ্জনা শুনে। কিন্তু আজ এ কী হাল এর, মানুষ তো তাকে নিঃস্ব করে ছেড়েছে। যেমন বাড়ির বড়ো ছেলেটা ছেলেবেলাতেই অজান্তে বড়ো হয়ে যায় তেমনই, সব যেন তারই দায়িত্ব। কাজের কর্মভারে আজ তার গতি মন্থর হয়েছে এভাবেই সে কোনদিন নিঃস্ব হয়ে মিলিয়ে যাবে মেদিনী গর্ভে।

ইউনিভার্সিটির একটা কাজ নিয়ে এসেছিলাম, কিছুই না ফর্মাল-ইন্টার্ভিউ; কিন্তু সেই ফর্মালিটি যে টেবিলের তলানিতে পৌঁছে গেছে সেটা অনভিজ্ঞ মগজে ঢোকেনি, পড়াশোনা, ভালো রেসাল্ট, এইসবের দামের সাথে আজকাল রেফারেন্স ও লাগে। আমরা তো আর পরাতে যাব না, পেটের দায়ে কাজ করতে যাব, এটাই যেন সিস্টেম হয়ে গেছে। সুতরাং ভবিষ্যতের ছাত্রদের কী হাল হবে সেটা খুব ভাববার বিষয়। যদিও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনাতে বর্তমানের উচ্চপদাধিকারিকগণ ভাবলেশহীন, বাংলা বর্ণমালার “লী-কার”-এর মতো যেন কঌপ্ত হয়ে আছে সমাজ। দু-দিনের ছুটি নিয়ে বেড়িয়েছিলাম তাই ওই ভাঙা মন নিয়ে বাড়ি না ফিরে পিসির বাড়ি চলে এলাম, অন্তত পিসি তো আর মায়ের মতো এক গাদা আশাভরা চোখমুখ নিয়ে জিজ্ঞেস তো করবে না… “কী রে! হোল?”

আমার মায়ের মতোই তো কত মা আছেন যাঁরা এরমভাবেই আপ্লুত হয়ে থাকেন সন্তানের মঙ্গল চিন্তায়। ঠাকুমার শ্রাদ্ধকার্যের সময়ে তিলকলারপিণ্ডি চোটকে ঠাকুরমশাইকে বলতে শুনেছিলাম “যৎ প্রাসাদাৎ জগৎ দৃষ্টাম্ পূর্ণ কামশ্চঃ যদাশীষা ৷ প্রত্যক্ষঃ দেবতায়ৈ মে তুভ্যম্ মাত্রৈ নমঃ নমঽ ৷৷” আহা! কী সুন্দর শব্দগুণ মন্ত্রের, সত্যিই তো মা ছাড়া জগৎটা কীভাবেই-বা দেখতাম? তাঁর স্নেহাশীষ ছাড়া কিছুই তো পেতাম না, তিনিই তো প্রত্যক্ষ দেবতা, যেমনটি ওই গাধায় চড়া মা; যাঁর পুজো দেখার ছুঁতোয় পিসির বাড়ি পারি দিচ্ছি আমি। কী অদ্ভুত না! একজন সিংহাসনে বসে আর একজন গাধার মতো সংসার নিয়ে খেঁটে মরছে, সিংহাসনের তেনাকে মা বলতে শিখিয়েছিলেন আমার মা, প্রথমে বুঝিনি পরে সহোদরার প্রথম গর্ভপাতের দুঃখে অনুধাবন করেছিলাম; জগতে দুই মা একজন গর্ভধারিনী আর অন্যজন গর্ভসন্তাপহারিনী।

পড়ন্ত বিকেলের অস্তরবির রক্তরাগে ধুয়ে গেছে পাগলা নদের দু-কূল, সদ্য ন্যাড়াপোড়ার কালো ছাইগুলো গরম হাওয়ার সাথে পাক খেয়ে উড়ছে যেমনটা আমার মনের তিক্ত আভিজ্ঞতাগুলো এতক্ষণ ধরে মনকে নাগপাশে বাঁধছিল, বাস্তবটা সত্যিই বিবর্ণ দোলের রংগুলো ধুয়ে দিয়েছে; শুধু পড়ে আছে একরাশি ছাই। আমার এই মৌনমুখরিত মুমুক্ষাকে বিদীর্ণ করে বেজে উঠল মোবাইলফোনটা। শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য… রিংটোন কখনো পুরো বাজার জন্য না, তাঁর জন্ম হয়েছে শুধু যেন শব্দের জন্য, মানসিক শব্দ, যেন অন্যত্র বাজলেও মনে হয় ফোন এসেছে। ফোনটা কানে দিতেই ওপাস থেকে বলে উঠল “যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে আসিস, আগামী রোববার সারা ভারতে বনধ্ ডেকেছে সরকার।” এই বলেই ফোনটা কেটে দিল বাবা। ছেলেদের সাথে বাবাদের সম্পর্ক খুব সংক্ষিপ্ত হয় যেমনটা ওই রিংটোনটার মতো, সারাক্ষণ একটা তটস্থভাব। “করুণাঘন, ধরণীতল কর’ কলঙ্কশূন্য” বাকি গানটা নিজেই মনে মনে গাইতে গাইতে পাশের বাচ্চাটাকে বললাম কিরে? তোর নাম কী? এতক্ষণ সে লজ্জা বা ভয়ে চুপচাপই ছিল; আর আমার বিরবিরানি শুনে মনে হয় নির্ঘাত পাগল ভেবেছে। যতটা সম্ভব ক্ষীণগলায় উত্তর এল “শরীফ”, নামের গুণ যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে তার থেকে। ওকে বললাম আজ তো রাত হয়ে গেল কাল দু-জনে মিলে ঘুরব, আশেপাশের সব জেয়গা ভালো করে দেখাবি কিন্তু! কোন ছেলেবেলায় এসেছি, প্রায় পঁচিশ বছর। শব্দের মাধ্যমে সবসময় কথা না বলে নিঃশব্দে তার থেকে অনেক বেশী মননভেদি বাক্যালাপ সম্ভব, শরীফ সম্মতির সুরে শুধু মাথাটুকু নাড়াল। বাড়ি ফেরার পথে গৌড় এক্সপ্রেস ক্রশ করে হাত নাড়িয়ে একে অপরকে বিদায় জানালাম।

সন্ধ্যার ধুনুচি নাচ আর আরতির প্রস্তুতি তুঙ্গে; ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই পিসি এসে প্রবল বাক্যব্যয়ে আমার আর আমার বাবার আরতি শুরু করে দিল, বুঝলাম এখানেও রিংটোন বেজেছিল। “এত দিন পর এলি আর তোর বাবা আসতে না আসতেই যাওয়ার হুকুম জারি করে দিল, কোন সুদূরে লোক মরতেছে আর এই নিয়ে আমাদের এত ভাবনার কী আছে শুনি? একদিনেরই তো বন্ধ ডেকেছে তাই নিয়ে এত ভাবার কী আছে? বাবাকে ফোন করে বলে দে একহপ্তা না কাটিয়ে যাবি না।” বুঝলাম এখানে রিংটোনেটা পুরোটাই বেজেছে আর সেটা এখন সপ্তমে গিয়ে ঠেকেছে। একটু সান্ত্বনার গলায় বুড়ি ঠানদি বললেন, “কত মড়ক পার করে গিয়েছি, মা শেতলা বাঁচাবে, থেকে যাও বাপ”।কোনো কিছু বুঝেই উঠতে পাড়লাম না আসল ঘটনাটা কী? ইতিমধ্যে টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার হচ্ছে সেই কারণটাকে নিয়ে, সম্প্রতি যে নোভেল করোনাভাইরাসের কথা আমরা কলেজে আলোচনা করছিলাম সেটা এখন চীন থেকে বিস্তার লাভ করেছে সুদূর প্রাচ্যে, লক্ষাধিক মানুষ অসুস্থ ও মৃত্যু প্রায় হাজার; একে বলে অতিমারি বা প্যান্ডেমিক। ভাইরাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কমবেশি থাকলেও একদম নেই যা তা হল যে-কোনো রকমের অতিমারিতে স্বাস্থ্য ও সামাজিক সচেতনতা। মনে মনে একটা সতর্কীকরণ চিন্তা করে ঠিক করে নিলাম পরশু কলকাতা ফিরবই। রাতে খবার টেবিলের ওপর একটা ছোটো মেঘ ঘনীভূত হতে দেখে বললাম; বেশি দিনের ছুটি পাইনি বুঝলে! পরশু ফিরে যাব, একবার মেঘ গর্জাল কিন্তু বর্ষাল না। রাতে শুয়ে শুয়ে আকাশকুসুম ভাবছিলাম বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও রোগের প্রতিষেধক সম্পর্কে, এমন কোনো রোগ দেখিনি যা আধুনিক মানব সভ্যতাকে কাবু করতে পারে, লোকজনের ভয় পাওয়াটা নিতান্তই গুজব বা ভারতীয় রাজনৈতিক খেলাও হতে পারে। এইসব চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা জানি না। ভোরবেলায় ঘুম ভাঙল কোকিলের কুহুতানে, কলকাতায় পাখীর ডাক খুবই কম শুনতে পাই। সকালের নিত্যকর্ম সেরে চা নিয়ে বারান্দায় বসেছি এমন সময় আবার কোথা থেকে হুজুক এল যে মুরগিতেও নাকি রোগ হচ্ছে সেই চিন্তায় পাশের ফার্মের ভদ্রলোক এসেছেন তার দুঃখ উজার করতে। গ্রামবাংলায় এই রীতি বহুপ্রাচীন, যেমন নিস্তরঙ্গ জলে একটা কম্পন আর একটা কম্পন দিয়ে অনুনাদ হয়ে মাত্রা বারায়, তেমনই। সরকার বাহাদুর ঢ্যাঁড়া পিটিয়েছে নাকি— যে যার ঘরে থাকবে; স্কুল, কলেজ বন্ধ করা হবে। কথাটা শোনামাত্র সে-বাড়ির সকল সদস্যগণ একসাথে আমার দিকে তাকালেন। আতসকাচে সুর্যের আলো যেমন ঘনীভূত হয়ে কাগজ পোড়ায় তেমনই এখন আমার সব আশা পুড়ছে মনে হল।

ইতিমধ্যে সেই মিষ্টি ছেলেটা হাজির, পূর্বপ্রতিশ্রুতির কথা মনে করে প্রসঙ্গ পালটিয়ে তার সাথে বেরোব এই ঘোষণা করলাম। পিসি যথারীতি সতর্ক করে দিলেন দুপুরের আগেই ফিরে আসাচাই, তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়লাম একটা সাইকেল যোগার করে, প্রথম গন্তব্য বড়োসোনা মসজিদ এই চত্বরে তাকে বারদুয়ারি বলে লোকে চেনে তার স্থাপত্য কৌশলের বাহ্যিক বিশিষ্টের জন্য। বড়োসোনা মসজিদ হোসেন শাহী বংশের নবাব আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বানিয়েছিলেন, এই কারণেই এখানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব বিভাগ রীতিমতো দখলে রেখেছে এই অমূল্য স্থাপত্য সংরক্ষনের জন্য। আমরা নিজেদের মতন করেই ঘুরলাম, ইতিমধ্যে একটা কানাভুসো শুনতে পেলাম। মসজিদের উত্তরে রামকেলীর ঝিলে নাকি একটা ঠাকুরের মূর্তি পাওয়া গেছে, শুনেই মনটা বিস্ময় আর রোমাঞ্চে ভরে উঠল, যা এতদিন দেখেনি কেউ তেমন এক ঐতিহাসিক বস্তু দেখতে পাব ভেবে। যৎপরনাস্তি দু-জনে উপস্থিত হয়ে অবাক হয়ে গেলাম, আমাদের মতোই প্রায় একশো মানুষ ভির করে আছে পুকুর চত্বরের ইস্কন মন্দিরের ঘাটে। বুঝলাম খবরটা অনেক আগেই ছড়িয়েছে আর আমরা হলাম সর্বশেষ রোমাঞ্চ অনুভবকারীদের মধ্যে। খবর ভালো হোক বা মন্দ, ঠিক বা বেঠিক আজ বিজ্ঞানের দৌলতে বিদ্যুতের মতোই ছুটে চলে খবর, আর এই পথে যেতে যেতে সে পরে নেয় অসংখ্য অলংকার, কেউ আবার হারিয়ে যায়, আবার কেউ “ভুঁয়ো” আখ্যায় ভূষিত হয়।

ঘটনা বা রটনা যাই হোক যখন কাছে গিয়ে পৌঁছালাম সেটা হাত দিয়ে দেখার মতো সৌভাগ্য হয়েছিল, এরম সবার হাতের স্পর্শে মূর্তির গায়ের কাদামাটি; মূলত পায়ের কাদামাটি একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে দেখে ভাবলাম কত না কাল এই মূর্তি মানুষের ভক্তি স্পর্শ পায়নি! অচিরে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কিছু সদস্য এসে জায়গাটা ঘিরে নিল। মূর্তিটা যে খুব ভালো সংরক্ষিত তাও না সামনের দুটো হাত ভাঙা, মাথার পাশ থেকে চালের দিকের একটা ভাগ ভাঙা, মূর্তির শিখর ভাগের কিছুটা থেকে বাকিটা ভাঙা, পায়ের দিকেও কিছুটা গেছে, ভালো করে দেখব বলে বেশ ক-টা ছবি টপাটপ তুলে নিলাম। প্রথম দর্শনে ভাঙাটাই চোখে পড়েছিল, সম্ভবত এটাই সব মানুষই দেখে। লোকজনের মধ্যে খুঁদ খুঁজে বেড়ানোটা একটা নেশা; আর তা নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা করাতে যে অনন্ত পরিতৃপ্তি পাওয়াযায় তা হয়তো স্বর্গসুখের থেকেও বেশি।

গলা খ্যাঁকানি দিয়ে বড়োবাবু বললেন, “এত ভিড় করার কী আছে সোনা উঠেছে নাকি?” খুব অবাক হয়ে গেলাম! হয়তো সোনা উঠলে বেশি খুশি হতেন; এই পাথরে কি ওনার স্যালারি বাড়বে, আর কী হবেই-বা এইসব শনাক্ত করে! তিনি তো রোজগার করতে এসেছেন। বিরক্তি মাখা তার মুখের অভিব্যাক্তি বুঝিয়ে দিল সাবজেক্ট সম্পর্কে তার ভালোবাসা একদমই নেই, নইলে এইরকম আবিষ্কারকে ভ্রূকুটি দর্শাতে লোকে একবার ভাবে। মন্দির চত্তরের এক ভক্ত প্রশ্ন করলেন, “মায়ের মূর্তি কবে থেকে জলে আছে জানিনে, এটা কি নিয়ে চলে যাবেন?” উত্তরটাও কর্কশ গলায় এল, “তবে কি তোমাদের ধান্দা বাড়ানোর জন্য চালা করে দেব এখানে? মুসলমানরাই মসজিদ করার জন্য উপরে ফেলে দিয়েছে হয়তো।” উত্তরের সাথে সামাজিক ব্যাঙ্গাত্মক প্রশ্ন আর সরাসরি অসামাজিক সিদ্ধান্ত দুটোই আমার ভালো লাগল না। ভিড় উপলক্ষে কিছু চানা আর ঝালমুড়িওয়ালা এসে হাজির, সেখান থেকে দু-জনে চানা কিনে কিছুটা ছাগলের কাঁঠাল পাতা চেবানর মতো চোয়াল নারিয়ে চেবাতে চেবাতে বাড়ি ফিরলাম। আমার ছোট্ট বন্ধুটিকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে তাকে খুব খাতির করে মধ্যাহ্ন ভোজের ব্যাবস্তা করলাম।

সন্ধ্যাবেলায় খবরে শুনলাম খুব মহামারি ছড়িয়ে পড়ছে ইতালি ও তৎসংলঘ্ন দেশগুলোতে, রোগের বিস্তার মূলত সংস্পর্সে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন ইতিমধ্যে জানিয়েছে COVID-19 ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত বেশিরভাগ মানুষ হালকা থেকে মাঝারি শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতায় পড়বেন এবং বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়াই সুস্থ হয়ে উঠবেন। বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা, ডায়াবেটিস, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং ক্যান্সারের মতো অন্তর্নিহিত চিকিৎসা সমস্যায় গুরুতর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এই মুহূর্তে, COVID-19-এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট টিকা বা চিকিৎসা নেই। তবে, সম্ভাব্য চিকিৎসার মূল্যায়ন করার জন্য অনেকগুলি চলমান ক্লিনিকাল ট্রায়াল রয়েছে। ক্লিনিকাল অনুসন্ধানগুলি উপলব্ধ হওয়ার সাথে সাথে আপডেট তথ্য সরবরাহ করা চালিয়ে যাবে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন। সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সর্বোত্তম উপায়টি হল, COVID-19 ভাইরাস কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে সে-সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে ভালোভাবে অবহিত করা। এ ছারা কিছু বিধিনিষেধ অবশ্য পালনীয় যেমন— হাত ধোয়া বা অ্যালকোহলভিত্তিক স্যানিটাইজার ঘন ঘন ব্যবহার, মাস্ক পড়া এবং নাক-মুখ স্পর্শ না করে নিজেকে এবং অন্যদের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা। হাঁচি-কাশি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিলে ও শ্বাসনিতে কষ্টহলে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে পরীক্ষা করানো।

এইসব শুনে এতক্ষণে ভয় এল আনমনে, মাইক্রোবায়োলজির শিক্ষক হওয়ার সুবাদে কিছুটা অনুমান করতে পারি ভবিষ্যতের হাল ভেবে। তার ওপর বলা হচ্ছে ভাইরসটা মিউটেশন করেছে বারবার, হ্যাঁ জিনতত্ব এমনই এক সরল কিন্তু অভাবনীয় জটিল প্রক্রিয়া। পাথর যুগেরও লক্ষাধিক বছর আগে যে-প্রাণস্পৃহা ছিল এই মিউটেশনের মাধ্যমেই তো অভিযোজিত ও অবিব্যক্তি ঘটিয়ে আজ এত রকম জীব সৃষ্টি করেছে, মানুষ আজ বুদ্ধির বিকাশের সাথে সাথে সারা পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। এই মিউটেশনের প্রভাবেই আজও আমরা এইডস-এর মতো ব্যাধিকে কাবু করতে পারছি না। যদিও-বা এই যাত্রায় বেঁচে যাই সবাই তবে কি COVID-19 ভাইরাস থেকে সারা বিশ্ব সুরক্ষিত হবে? এইসব ভাবতে ভাবতে আবার এটাও মনেহল অত দূর থেকে আমাদের দেশে এ-রোগ আসবে না আর আসলেও গরমে টিকবে না।

খুব ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে কলকাতা ফেরার তাড়া গুনলাম, মালদা স্টেশনে এসে সদ্য প্রেমে পড়া প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করার মতোই অত্যন্ত শান্ত-শীলভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। শিলঘাট টাউন-কলকাতা কাজিরাঙা এক্সপ্রেস, সপ্তাহে শুধু বুধবারে এনার সময়, ভোর ৬টা ২৫ নাগাদ আসার বদলে বাবু এলেন ৭টায়। এদিকে যত বেশি দেড়ি হবে ওদিকেও সময় তত বেশি লাগবে; যেহেতু লোটাকম্বল প্রায় নেই তাই ঠিক করলাম কলকাতা স্টেশনে নেমে মেট্রো নিয়ে নেব, স্টেশন থেকে শ্যামবাজার স্টপেজ হেঁটে যেতে প্রায় ৩০ মিনিট তো লাগবেই। এইসব ট্যাঁকের গুপ্ত আলোচনা করছিলাম নিজের সাথেই, অতঃপর ট্রেনের টিকিট পরীক্ষক পরীক্ষা নিতে হাজির হলেন। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার দৌলতে প্রিন্ট করার ঝামেলা না থাকায় চাড্ডি জ্ঞান শুনিয়ে বিদায় নিলেন। জ্ঞানের মুখ্য বিষয়টি হল ভোটার কার্ড-এর ছবি নিয়ে, তাতে মুখ স্পষ্ট নয়। আসলে গৌণ বিষয়টি হল বামা-লক্ষ্মী, বিষয়টি অনুমান করেই পাসপোর্টটা তেনার ঢুলির সামনে ধরতে কিছুটা অস্বস্তি আর স্বস্তির বিনিময় হল, একটু হেসে বললাম, ‘সরকার বাহাদুরের কাছে আমরা একটা সংখ্যা মাত্র— যেমনটা রক্তকরবীতে দেখেছি; মুখ না দেখা গেলেও মূক হয়ে থাকাটা এখনকার দেশনৈতিক অধিকার। রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে যাওয়াটাই এখন দেশদ্রোহী হওয়া’।
রেলগাড়ি ঝম্ ঝম্, সাথে ফেরিওয়ালাদের বিভিন্ন ভাষা, বুলি আর উচ্চাঙ্গ-অব্যয়গুলো শুনতে শুনতে কিছুটা সুষুপ্তি আর জাগ্রত দশার মধ্যে কাটছিল, মনে হয় ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। সংজ্ঞা পেলাম দু-জন ব্যক্তির তীব্র বাক্য বিনিময়ে, সর্বনামের সর্বনাশ করে একে-অপরকে যে-ভর্ৎসনা করছিলেন বুঝলাম ট্রেন কলকাতায় ঢুকছে; কে আগে নামবে এ তারই প্রস্তুতি— মানুষ এখন তার মান আর হুঁশ সব বিসর্জন দিয়েছে।

দ্বিতীয় পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই