লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সুপ্রিয় সাহার গল্প

টিকিট টু পাকিস্তান

তারপর লোকটা বসিরহাটের গাড়িতে যেই চেপে বসেছে অমনি গাড়িটা মাছ হয়ে গ্যাছে আর তখন যেই লোকটা বলেছে এতবড়ো মাছ অমনি মাছটা হয়ে গ্যাছে বাঁদর আর তার গা কুটকুট করছে দেখে লোকটা বলেছে গরমে উকুন বেশি হয় কিনা না জানা থাকলে তাকে তুমি ছারপোকাও ভাবতে পারো কিন্তু বাঁদরটা গরমে গলে গিয়ে হয়ে গ্যাছে কাশ্মীর আর তখন লোকটা বলছে ডাল লেকে স্নান করলে বড্ড চুলকুনি হবে অমনি ডাল লেক হয়ে গ্যাছে পাকিস্তান এখন তখন সেই লোকটা বলছে পাকিস্তানের লোকেরা নাকি হেগে ছোঁচে না আর সেই হাগাপোঙ্গাগুলো হয়ে গ্যাছে… থাক কিছু খবর চাপা থাকাই ভালো।
লোকটা আমায় বলল, আপনার পাকিস্তানে যাওয়া উচিত!
আমি নিমাইকে বললাম, এই শালা, ছোটো গোল্ডফ্লেক এখন থেকেই ছ’টাকা নিচ্ছিস ক্যানো? বাজেট হতে এখনও দিন তিনেক দেরি, প্যাকেটের গায়েও তো সেই আগের দাম, মামদোবাজি পেয়েছ!
নিমাই বলল, না পোষালে ফেরত দিন। সক্কালবেলা কেরানিদের মুখ লাগলে আমার দিন খারাপ যাবে। আর ওসব বাজেট ফাজেট আমাদের পকেটে।
দেশলাইটা ছুঁড়ে দিয়ে বললাম, ধরিয়ে ফেলেছি। ধরানোর আগে বলতে হতো।
নিমাই হটাৎ ব্রেড কাটার ছুরিটা নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, মুখ থেকে খুলে দিন, আমি পোড়া অংশটুকু কেটে নিয়ে বাকিটা প্যাকেটে ভরে রাখব।
ছুরিটা দেখে আমি একটু ঘাবড়ে গেলেও চমকাইনি। সরকারি কেরানি এত সহজে ভড়কায় না, অনেক ক্ষত বুকে নিয়ে ঘোরে! ভাগ শালা, দু’টাকার চা দোকানি!
লোকটা আবার বলল, আপনাকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত!
আমি চারপাশে একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম। চা বিক্রেতাকে অপমান করাটা কি ফৌজদারি অপরাধ!? কেউ কি শুনলো? মনে হয় না।
একে সাতসকাল, তায় আবার রোববার, রাস্তাঘাটে লোকজন কম। একটা উঠতি মেয়ে সাইকেল চালিয়ে পড়তে যাচ্ছে, সেদিকে তাকাতে তাকাতে পাড়ার ক্লাবের একটা চ্যাঙরা এদিকেই আসছিল। সাইকেলটা চলে যেতেই তার সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে গেল, কারণ, আমারও দৃষ্টি এতক্ষণ সাইকেলেই আটকে ছিল! চোখাচোখি হতেই ছোকরা দাঁত বার করে বলল, কী কেরানিদা, আবার তো ডিএ দিল পচিশ পারসেন। আর বলেই খ্যাঁকখ্যাঁক করে দাঁত কেলাতে লাগল। এমনিতেই নিমাই মাথাটা বিগড়ে দিয়েছিল, তার উপর এই ছোকরা। ভাগ শালা শুয়োরের…। কাল থেকেই মাথাফাতা খারাপ হয়ে আছে। বৌ ব্যাগরবাঁই করছে, বেড়াতে যাব, বেড়াতে যাব করে। তাও আবার কাশ্মীর! ডাল লেকে স্নান করলে তবেই নাকি একমাত্র এই গরম থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে! যতসব!
আমার আবার ওই কথাগুলো মনে পড়ল। কোথায় যেন শেষ হয়েছিল, হ্যাঁ, পোঙ্গাহাগা না, না হাগাপোঙ্গাতে। মানে ওগুলো সব পাকিস্তান হয়ে গেল আর পাকিস্তানটা ডাল লেক আর তারপর কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী আর যেই লোকটা বলেছে এটাই ভারতের শেষ ভূস্থল অমনি যোগী এসে দাঁড়িয়েছে সামনে তার ইয়া বড়ো আলখাল্লা হাতে বেলচা কিন্তু লোকটা যেই বলেছে বেলচা কী হবে অমনি যোগী হয়ে গ্যাছে যোগসর্প তার ফণা দুলিয়ে যেই দিয়েচে এক কামড় চিন্ময়কে অমনি চিন্ময় হয়ে গ্যাছে বেগুসরাই লোকটা বলছে এখানকার বেগুনগুলো সব এক-একটা অ্যালার্জির যম আর লোকটা যেই জানতে গ্যাছে যে যমটা ঠিক কে তখুনি সে হয়ে গেল একটা ইয়া বড়ো কড়াই তেল ফুটছে আর তারমধ্যে ভাজা হচ্ছে পাকিস্তানের লোকেদের কিন্তু কিন্তু লোকটা আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিল অমনি যম বলছে আরে এদের তো ফ্রাই করা যাবে না এরা ইয়ে করেনি… মানে ওই থাক সেসব কথা।
আমি ভেবে পাচ্ছি না বারবার এইসব উদ্ভট খেয়ালগুলো কাল থেকে কীভাবে ঢুকে যাচ্ছে মাথায়! আর খামোকা কোন কথাবার্তা ছাড়াই পাকিস্তান-ফাকিস্তান এসে যাচ্ছে। হলটা কী আমার!
সিগারেটটা শেষ হয়ে গেছিল। আর এক কাপ চা নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি আমার দিকে তাকিয়ে উল্টো বেঞ্চে বসে হাসছে বিল্টুদা। তা সব ভালো তো?
আমি আনমনে বলে ফেলি, এই পাকিস্তান যেমন রেখেছে।
অ্যাঁ! কী বললে?
আমি চমকে উঠে শুধরে নিই। এই উপরওয়ালা যেমন রেখেছে আরকী! কিন্তু নিজেই ঘাবড়ে যাই। কী সব বলছি! বিল্টুদা কি একটা বলতে শুরু করেছিল অমনি আমার মোবাইলটায় মেসেজ ঢুকল— টুং। হাতড়ে দেখি এই সাতসকালে হোয়াটসঅ্যাপ। কখন আবার নেটটা চাপচুপ লেগে অন হয়ে গেছে কে জানে!
বীরভূম থেকে শ্যামাপদ মালাকার। কবিতা পাঠাতে চাই। দিয়ে চারটে কবিতা।

চোখাচোখি হতেই ছোকরা দাঁত বার করে বলল, কী কেরানিদা, আবার তো ডিএ দিল পচিশ পারসেন। আর বলেই খ্যাঁকখ্যাঁক করে দাঁত কেলাতে লাগল।

একটা ভাট দামড়া বুড়ো, জ্বালিয়ে মারল। এর আগে অনেকবার বলেছি যে, পত্রিকা আমি বন্ধ করে দিয়েছি, টাকা নেই। তাও লোকটা মাঝে মাঝেই ‘কবিতা পাঠাতে চাই’ করে যায় আর বাগা বাগা খান কতক ‘মাল’ ঢুকিয়ে দেয়। না না ঘরে নয়, হোয়াট্‌সঅ্যাপে। আজ আর ধৈর্য ধরা গেল না। লিখলাম, আপনাকে তো আগেও বলেছি যে, পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলা পড়তে পারেন না, নাকি বুঝতে পারেন না! আর এইসব আল-বাল পাঠাবেন না তো। এগুলো কি কবিতা! জীবনে কখনও কবিতা পড়েছেন আপনি? যতসব ফালতু মাল। দু’কলম লিখলেই নিজেকে কবি ভাবতে শুরু করে! এরজন্য তো ফেসবুক আছে, সেখানেই লিখুন না!
…আপনার মূল্যবোধযুক্ত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
…তোমার কবিত্ব ঢোলে/ আমার কবিত্ব কলমের খোলে
…কাক কালো/ কোকিল কালো/ কালো কাকুর কেশ/ কাকু তোমাকে অভিনন্দন জানাই/ কবিতায় রাজতন্ত্র চলে না গণতন্ত্র চলে
…সমালোচনা হলে আমি জানি আমি ঠিক কবিতা লিখছি। বুঝলাম আমি ঠিক লিখছি।
ধুর বাঁড়া! আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল! মাথা হ্যাং হওয়ার জোগাড়। বেশি আর কথা বাড়ালাম না— ঠিকই যখন লিখছেন, তখন লিখুন না যত খুশি, কে বারণ করেছে! তবে আমায় আর পাঠাবেন না।
…আপনার কবিতা আমার ভালো লাগে না।
খুব ভালো কথা। আনন্দের কথা। এবার কেটে পড়ুন দেখি মানেমানে।
…আপনার মতো বস্তি এলাকায় চলবে।
…আপনার মতো পাকিস্তানে চলবে।
যাহ শালা! এখানে আবার পাকিস্তান এল কোত্থেকে!
লোকটা আবার কোথা থেকে ঘ্যানঘ্যান করে উঠল, এখুনি আপনাকে পাকিস্তানে পাঠানোর বন্দবস্ত করা দরকার।
বিরক্ত লাগছিল। উঠে পড়লাম বাজারের দিকে। রোববারের বাজার সবে জমজমাট হতে শুরু করেছে। চেনা সব্জিওয়ালার কাছে গেলাম। পটল, ঝিঙে নেওয়ার পর টমেটোর দাম জিজ্ঞাসা করাতে ও বলল, খুব সস্তা বাবু, দু’টাকা কিলো।
অ্যাঁ, দু’টাকা কিলো! এই তো গত হপ্তাতেও চল্লিশ ছিল।
হ্যাঁ তা ছিল। কিন্তু এগুলো সব বর্ডার ফেরত মাল বাবু। যে ট্রাকগুলো পাকিস্তানে ঢুকতে পারেনি, সেগুলো সব ফেরত এসেছে। বর্ডার সিল ছিল তো। তাই দামও কমে গেছে। এককিলো দিয়ে দিই বাবু, না হয় আরও আটানা কম রাখব। আমার মুখটাও কে যেন সিল করে দিল, কোনো কথা বেরুলো না।
আর লোকটা যেই বলছে টমেটোই যদি নেবে তবে এক দু’সের নয় তিন মণ নিয়ে নাও অমনি দাঁড়িপাল্লাটা রকেট হয়ে গ্যাছে আর লোকটা যেই ভেবেছে রকেটে বমি পেলে কী করবে অমনি সেটা হয়ে গ্যাছে জিম করবেটের জঙ্গল সেখানে কিছু মানুষ বাঁশ কাটছিল দেখে যেই না ভেবেছে এত বাঁশ অমনি সেটা হয়ে গ্যাছে এটিএম কার্ড কিন্তু লোকটা ট্রাঞ্জাকশন আইডি চাইতে গিয়ে দেখে চারদিকে মুখ বাঁধা জঙ্গি যেই লোকটা ভেবেছে এরা কী অমনি সবাই দুদ্দাড় পালাচ্ছে তাদের তাড়া করেছে ভীমের গদা লোকটাও ছুটছে পিছন পিছন আর ছুটতে ছুটতে হঠাৎ চারপাশে তাকিয়ে দেখে সে পাকিস্তানে চলে এসেছে কিন্তু পাকিস্তানের লোকজন তো… যাগকে বাদ দিন সেসব কথা।
লোকজন বাড়ছে বাজারে। চেনা মুখ অনেক। দেখা হলেই কথা থামে না। কিন্তু আমি সেসব কেন যে এড়িয়ে যাচ্ছি নিজেই বুঝতে পারছি না। হ্যাঁ, হু দিয়ে চালিয়ে পাশ কাটাচ্ছি। একটু মাংস নিতে হতো। মাছ আর মাংসের বাজারটা পাশেই। সেদিকে এগোতেই তীব্র আঁশটে গন্ধ নাকে ঝাপটা মারার সাথে সাথে একটা হুলস্থূল বেঁধে গেল। লোকজন যে যার মতো এদিক ওদিক ছুটে সেফ শেল্টার নিচ্ছে। আমিও মধ্যবিত্তের স্রোত যেদিকে যায় সেদিকেই দৌড়ালাম। দেখি কী একটা মুশকো ষাঁড় খেপেছে। না ঠিক যে খেপেছে তা হয়তো নয়, মনে হয় বাজারের মধ্যে ভুল করে ঢুকে পড়েছিল, এখন বেরুতে চাইছে। আর সেটাই একটা লণ্ডভণ্ড বাঁধিয়েছে। এরমধ্যেই এক লোক দেখি হঠাৎ লাফ মেরে ষাঁড়ের সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করে বলছে, স্বয়ং বাবা বিশ্বনাথ আজ পদার্পণ করেছেন বাজারে। জয় শিব স্বয়ম্ভু। আমায় একবার গুঁতিয়ে দাও বাবা, পাপ স্খলন করি।
আরে বলছে কি লোকটা! পাগল ফাগল হয়ে গেল নাকি! এসব ভাবতে ভাবতেই দেখি, ষাঁড়টা তার রাস্তায় বাঁধা পেয়ে লোকটাকে এক গুঁতোয় ছিটকে দিয়ে বেরিয়ে গেল। আর যে ভিড়টা এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল তারা সব আস্তানা থেকে বেরিয়ে এসে পড়ে থাকা লোকটাকে ঘিরে প্রণাম করছে। আমি কেমন হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার ঠিক কী করা উচিত মানে প্রণাম করা উচিত কি উচিত নয় কিছুই বুঝতে পারলাম না! মনে হল, সব লোকজন আমার দিকে কেমন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। যেন আমি এক ভিনগ্রহী।
অমনি লোকটা কোথা থেকে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, উঁহু, পাকিস্তানি!
আমি আর বাজার করতে পারলাম না। বাড়ির দিকে চললাম। দরকার নেই মাংস খেয়ে, আজ নিরামিষই হোক। খুব সাবধানে, সন্তর্পণে, রাস্তায় কাউরির সাথে কথা না বাড়িয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। টেনশনে আছি। শরীরে অসস্থি। ঘাম হচ্ছে। মাথা কাজ করছে না। পাখার তলায় বসে একটু জিরোচ্ছি, তখন আবার বউ বলল, দেখেছ এখানে কী গরম। কীভাবে ঘামছ তুমি! বেড়াতে না গেলে রেহাই মিলবে না। কী গো কিছু ভাবলে কবে যাবে কাশ্মীর?

ক লোক দেখি হঠাৎ লাফ মেরে ষাঁড়ের সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করে বলছে, স্বয়ং বাবা বিশ্বনাথ আজ পদার্পণ করেছেন বাজারে। জয় শিব স্বয়ম্ভু। আমায় একবার গুঁতিয়ে দাও বাবা, পাপ স্খলন করি।

শুনেই আমার মাথাটা চট করে আরও গরম হয়ে উঠছিল, কিন্তু একের পর এক ঘটনাগুলো মনে পড়ে যাওয়ায় একটু শান্ত হলাম। কোনো উত্তর দিলাম না দেখে বউ মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। তারপর দেখি রান্নাঘর থেকে একহাতে চা অন্যহাতে একটা খাম নিয়ে আসছে। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই সে বলল, একটু আগে একটা লোক এসে এই খামটা তোমাকে দিয়ে গেল। লোকটাকে আগে দেখিনি কখনও। বলল, খুব জরুরি ডকুমেন্টস।
আমি কৌতূহলে খামটা হাতে নিলাম। পত্রিকার জন্য এখনও মাঝে মাঝে দু-একটা লেখা এসেই যায়, হয়তো সেরকম কিছু একটা। বা হতে পারে কোনো চেক-টেক, জরুরি যখন বলেছে। কিন্তু খামটার উপরে সবটাই সাদা, লেখা কিছু নেই। দ্রুত খামটা খুলে ভিতর থেকে কাগজ টেনে বার করে দেখি, দুটো ট্রেনের টিকিট। পাকিস্তানের। কিন্তু এ কী করে সম্ভব! আমি তো টিকিট কাটিনি। তাও আবার পাকিস্তানের! আর তখুনি মনে পড়ল আরে আমার তো পাসপোর্ট-ভিসা কিছুই নেই। তাহলে! আমার কেরানি বুদ্ধি প্রায় শেষ। টিকিটের উপর আমার নাম রয়েছে পরিষ্কার। কিন্তু আমি কি অপরাধ করলাম যে, আমায় পাকিস্তানে যেতে হবে… অন্ধকার হয়ে আসছে চোখের চারধার আর তখুনি কোমড়ে খেলাম এক চরম খোঁচা। ব্যথায় টনটনিয়ে চোখটা একটু খুলে দেখি গিন্নী সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার জুড়েছে—
…বলি যে বয়স হচ্ছে, এখন আর রাতে অত লাফালাফি কোরো না। কোনো কথা শুনবে না আর রোববারে পড়ে পড়ে বেলা ন’টা পর্যন্ত ঘুমোবে!

Facebook Comments

পছন্দের বই