লেখক নয় , লেখাই মূলধন

হিন্দোল ভট্টাচার্যর গল্প

ভয়

“তুমি তো গল্প লিখতে বসে কোনও গল্পই রাখোনি। পাতার পর পাতা লিখে গেছ! একটি কাক তোমাকে লক্ষ্য করছে, এটা তোমার ব্যক্তিগত ডায়েরির বিষয়বস্তু হতে পারে, কিন্তু এটা কোনো গল্প নয়”
“কিন্তু তরুণদা, আমি সকালবেলা উঠে দেখলাম একটা পোকা হয়ে গেছি, সেটা যদি একটা…”
“আরে সব বিষয়ে যদি তোমার কাফকা এসে পড়েন, কাম্যু এসে পড়েন, তার্কোভস্কি এসে পড়েন, তাহলে তো মুশকিল হে! তুমি তো এই কলকাতায় বসে গল্পটা লিখছ একটা খবর কাগজের সাহিত্যপত্রের জন্য। বাঙালিদের জন্য। বাঙালি পামুক পড়ে, দস্তুভয়স্কি পড়ে কিন্তু চায় শরৎরচনাবলি। তোমাকে আসল পাঞ্চটা করতে হবে এখানে। শরৎ এবং জয়েসে। না হলে তো এখানে জায়গাই পাবে না। কথাটা বলবে কোথায়?”

“কিন্তু দাদা, আমার জীবনে তো গল্প নেই। আমি আর বানিয়ে বানিয়ে লিখতে পারব না”।

“আহা! লক্ষ করো। ঢুকে যাও মানুষের ভিতরে। বস্তির মানুষেরা কেমনভাবে বেঁচে আছে। সাব অলটার্ন মানুষের জীবন কেমন! তোমার জীবন সম্পর্কে কারো কোনো আগ্রহ নেই। আর কোন কাক কার দিকে ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তা বাংলা সাহিত্যের বিষয় হতে পারে না।”

“কিন্তু তরুণদা, যদি, বিষয়টা একটা রিভেঞ্জ হয়”

“ওরে বাবা, হিটলারের বার্ডস নাকি?”

গল্পটা ছাপা হয়নি। পার্থর একমাত্র এমন একটা লেখা সেই গল্প, ছাপা হয়নি। অবশ্য ছাপা যে হবে না, তা রুমেলা বলে দিয়েছিল আগেই। কারণ, গল্পের মধ্যে এমন কিছুই ছিল না, যা গল্পটাকে গল্প করে উঠতে পারে। কিন্তু পার্থর নিজের আর যে-কোনো কাহিনি নেই। আর যে গল্পও নেই। সে গল্প লিখবে কেমন করে? পার্থ শুধু জানে, সে ঠিক যেমনভাবে দেখে, তা অন্যদের চেয়ে আলাদা। আর সে যে-জীবনযাপন করে না, সেই জীবন সম্পর্কে লেখার অধিকারীও সে না।

“নিজের থেকে বেরোও পার্থ। কত চরিত্র, তাদের মধ্যে আত্মার মতো ঢুকে পড়। একজন লেখক তো আসলে একটি বিদেহী আত্মা, যে, মানুষের ভিতরে ঢুকে পড়ে। তার পর তার পোশাকগুলো পড়ে থাকে। সে থাকে না। সেই পোশাকগুলো কী? তার লেখা বিভিন্ন চরিত্র।”

“মানছি তরুণদা, কিন্তু, এত চরিত্র যার আশেপাশে কোনোদিন ছিল না, তার জীবনে গল্প নেই বলছেন? মানে, তার একটা বাগানের গাছ বা পোষা কুকুর কিংবা অপরিচিত কাক তার গল্পের চরিত্র হতে পারে না?”

এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। একটা অসম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ নিয়ে পার্থর গল্প পার্থর ব্যাগের মধ্যেই ঘুরতে থাকল। কারণ, পার্থর মতোই পার্থর গল্পেরও আর অন্য কোথাও যাওয়ার ছিল না।

কিন্তু এগুলিও পার্থর ভয়ের কারণ নয়। অবশ্য রুমেলা ঠিকই ধরেছিল, পার্থ আজকাল নিজেকেই ভয় পাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, তত যেন আরও বেশি করে এই ভয় চেপে বসছে পার্থর মনের ভিতরে। যেমন শীতকালের হালকা লাল রঙের রাস্তার আলোর সঙ্গে কুয়াশা মিলেমিশে একধরনের আলোর জন্ম দেয়। সেই আলোর চরিত্র একটাই। আর তা হল বিষাদ। পার্থ যে মানুষের চেয়ে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, এ-কথা পার্থর নিজের কাছে অজ্ঞাত ছিল না। বরং, সে ক্রমশ বুঝতে পারল মানুষের প্রতি তার একধরনের বিদ্বেষ জন্ম নিয়েছে মনের ভিতরে। কিন্তু তাকে দেখতে কাক কিংবা শেয়াল বা কুকুরের মতো হয়ে যায়নি।
“কী বলছ, তোমাকে তোমার মতো দেখতে লাগছে কিনা?”

“হ্যাঁ, মানে, আমাকে কি আমার মতোই দেখতে লাগছে রুমেলা?”

আর ঠিক সে-সময়ে ডেকে উঠবে একটি কোকিল অযাচিতভাবে, সেটা পার্থ বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারেনি বলেই সে চমকে উঠেছিল। রুমেলা উঠে পড়েছিল চেয়ার ছেড়ে আর তার পরেই তার সেই মন্তব্য, যা শুনে অস্বস্তিতে পড়ে গেছিল পার্থ। আর সেটি হল— “তুমি কি নিজেকে ভয় পাচ্ছ?”

এইটুকু পড়ার পরে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন একটা বিভ্রান্তিকর গদ্য ছাড়া আর কিছুই পড়তে পারছেন না। কারণ, লেখাটি প্রথম বাক্য ছেড়ে আদৌ কোথাও এগোয়নি। পার্থও এগোত না, যদি না সেদিন রাতেই বাড়ি ফেরার সময়ে সে বুঝতে পারবে পাড়ার কুকুরগুলো আর তাকে দেখে তেড়ে আসছে না। আর এ-কথা খেয়াল করা মাত্র, তার শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যাবে একটা অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত। দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে সব। আস্তে আস্তে পরিচিত সকলের কাছ থেকেই তার তৈরি হয়েছে এক দূরত্ব। এমনকী মানুষ দেখলে, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে তার নিজেরও অস্বস্তি হচ্ছে আজকাল। একধরনের বমি আসছে। জ্বর আসছে। বুকের মধ্যে ধুকপুক ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। তরুণদা হোক বা রুমেলা বা বাজারের শংকরদা, বা, বাসের ভিড়। মানুষের কাছ থেকে দূরে একা থাকলেই সে স্বস্তি পাচ্ছে। যদি প্রকৃতির রোষ গিয়ে পড়ে মানুষের উপর, তাহলে সেও সেই রোষের কবলে পড়বেই। হয়তো একদিন সারিবদ্ধভাবে আক্রমণ করবে সমস্ত পাখি, সব কুকুর, সব বাঘ এমনকী সব ছাগল। এমন একধরনের অবাস্তবিক বা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য কোনও রূপকথা বা কোনো গল্প বা কোনো চলচ্চিত্রও তৈরি থাকবে না নিশ্চয়। ফলে, না লিখতে পারার একাকিত্ব পার্থকে ঘিরে ধরবে। রাত একটার ফাঁকা রাস্তায় বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট দূরে দাঁড়িয়ে এ-সব কথা ভাবতে ভাবতেই তার মনে পড়ছিল রুমেলার সেই প্রশ্ন— “তুমি কি নিজেকে ভয় পাচ্ছ?”

রাস্তাটা মোটামুটি ফাঁকাই থাকে। অন্তত রাত একটায়। রাস্তার মোড়ের মাথায় ওই চার পাঁচটা কুকুরের ঠিকানা। সেখান থেকে ঠিক পাঁচশো কি এক কিলোমিটার তাদের সীমা। এই সীমার মধ্যেই তাদের জন্ম, যুদ্ধ, প্রেম, যৌনতা, মৃত্যু। রাতে যখন পার্থ ফেরে, তখন চেনা মানুষ হলেও তার দিকে তাকিয়ে একবার মুখ তোলে কুকুরগুলো। গলার ভিতর দিয়ে একটা চাপা ক্রোধের গরগর শুনতে শুনতে ঘামতে থাকে পার্থ। সেজানে, তাকে যদি আক্রমণ করে কুকুরগুলো, তাহলে, তার কিছুই করার নেই। কিন্তু প্রায় দশ বছর হয়ে গেল, কুকুরগুলো এবং তাদের সন্তানসন্ততিরা তাকে আক্রমণ করেনি কখনো। কিন্তু সেদিন ওই মোড়ের মাথা টিপে রোবার সময় যখন কুকুরগুলো একবার মুখ তুলেও তার দিকে তাকালো না, তখন পার্থ আন্দাজ করতে পারছিল কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে। আর সে-সিদ্ধান্ত বদ্ধমূল হল, যখন দূর থেকে একটা তারই উচ্চতার লোক তার দিকে এগিয়ে এল ক্রমশ। ওই ফাঁকা রাস্তায়, সাধারণত কেউ উলটো দিক থেকে আসে না। কিন্তু অবাক হওয়ার মতো বিষয়টি ছিল অন্য। লোকটিকে অবিকল তার মতোই দেখতে। আর তাকে দেখেই আবার তার বুকের মধ্যে ধুকপুকানি বেড়ে গেল পার্থর। এটা তো কোনো কাহিনি নয়, একেবারে একটি গল্প হয়ে যাচ্ছে। একটি অত্যন্ত খারাপ মাথামুণ্ডুহীন গল্প। কিন্তু ঘটনাটি ঘটছে। সেভাবে ভাবতে গেলে, আমাদের জীবনও একটা অত্যন্ত খারাপ মাথামুণ্ডুহীন গল্পের সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা হয়তো সেইসব গল্পগুলিকে নানা রঙের নানা দৈর্ঘ্যের সুতোয় বেঁধে সেগুলিকে একটা যুক্তির রূপ দিই মাত্র। ভাবতে ভালোবাসি, যে জীবনের একটা কোনো মানে আছে। কিন্তু প্রকৃতির সে-দায় নেই। পার্থর মনে হল প্রথমে, এই দেখাটা সম্পূর্ণভাবেই আজগুবি। কিন্তু তার এই মনে হওয়া পালটে গেল তখন, যখন সেই লোকটা তার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, “এটা ঠিক করছ না পার্থ। তুমি মানুষ না, ক্রমশ একটা জন্তু হয়ে যাচ্ছ। আমি তো মাকে জন্তু হতে দেব না”।

পার্থ প্রাণপণে বোঝাতে চাইল একবার, যে সে জন্তু হতে চাইছে না। পরমুহূর্তেই তার মনে হল, এই ভুলটা সে করতে পারে না। সে ফিসফিস করে বলে উঠল— আমি জন্তু। তুমিও জন্তু। তুমি আমাকে ধ্বংস করছ। আর আমি তোমার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছি।

পার্থর কথা বলা শেষ হওয়ার আগেই সে শুনতে পেল পাড়ার সমস্ত কুকুর একসঙ্গে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসছে। পার্থর মতোই দেখতে কিন্তু পার্থ নয় লোকটিকে একযোগে কুকুরগুলো আক্রমণ করল। লোকটি পালাতে পালাতে গলিটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে হারিয়ে গেল। লোকটির সঙ্গে হারিয়ে গেল কুকুরগুলোও।

পরদিন সকালে রুমেলা চা দিতে দিতে পার্থকে বলল— কাল রাতে এ-পাড়ায় নাকি চোর এসেছিল। তবে এ-পাড়ার কুকুরগুলো বাঘের বাচ্চা। লোকটাকে ছাড়েনি।

“মানে?” পার্থর বুকের ধুকপুকানি আবার বেড়ে গেল।

“লোকটার টুঁটি ছিঁড়ে নিয়েছে। ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। পুলিশ শণাক্ত করেছে দাগী চোর।

“চোর?”

“হ্যাঁ”

“কী করে শণাক্ত করল? লোকটা তো ভালো লোকও হতে পারে। একটা আস্ত মানুষকে কুকুরগুলো ছিঁড়ে ফেলল?”

“তুমিও তো রাতে ফেরো। অবশ্য কুকুরগুলো চেনা মানুষকে কিছু করে না”।

“আমি মানুষ?”

“কেন? কী যে হয় তোমার!”

“তুমি নিশ্চিত আমি মানুষ? জন্তুনই?”

‘‘তুমি কি নিজেকে ভয় পাচ্ছ?”

প্রশ্নটা শুনে, একটু মনে মনে অস্বস্তিতেই পড়ে গেল পার্থ। আসলে, রুমেলার এই এক সমস্যা। যখন তখন এমন সব প্রশ্ন করে বসে, যেগুলি সে খুব ভেবেচিন্তে করছে বলে মনে হয় না, অথচ, হয়তো ভেবেচিন্তেই করে রুমেলা। কারণ, রুমেলাকে খুব একটা বোকা ভাবার কোনো কারণ নেই। রুমেলা যে-সব বোঝে, তার প্রমাণ রাখতে একটা বাক্যাংশই যথেষ্ট। কিন্তু ও বেশিক্ষণ একবাক্য নিয়ে পড়ে থাকে না। যেমন, জামাকাপড় গোছাতে গোছাতে রুমেলা প্রসঙ্গই পালটে ফেলে বলল, “দেওয়ালের গায়ে কেমন মানুষের মুখ ফুটে ওঠে, তাই না?”

প্রথম পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই