লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

বনমালী মাল

পাথুরে আঁধার

— ভাতারছাড়ি তোর ক-টা ভাতার লাগে রে? ভাতার ছেড়ে এখানে বাপের ঘরে এসে পড়ে আছু!

টালি আর টিন দিয়ে ছাওয়া আটচালা ঘর থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ দাঁত কড়মড় করতে করতে বেরিয়ে আসে। স্বর শুনে মনে হয়, গলার শিরা ফুলিয়ে, স্বর সপ্তমে চড়িয়ে না বলতে পারার জন্য বক্তার রাগ-বিরক্তি দানা বাঁধতে বাঁধতে দুঃখ-কষ্টে পাথর হয়ে যাচ্ছে। চেঁচিয়ে বললে পাড়ার লোক, রাস্তার লোকও মুখ চাপা দিয়ে হাসবে। শুকনো মুখে পরামর্শ দিয়ে কিংবা হা হুতাশ করে মনে মনে ঘাই দেবে—

— এত দ্যামাক ভালো নয়, আগেই বলছিলাম।

— ভাতারের ঘর ছেড়ে কতদিন পড়ে আছে!

বলে কেউ কেউ বাতাসের দিকে একটা সাজানো নাটকের সূত্রধরকে ছুঁড়ে দেয়।

বছর সাতেকের একটা ছেলে খালি গায়ে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ভোটের আগে আগেই নতুন রাস্তা তৈরির মহড়া চলছে যেন। এই ক-দিন আগে পর্যন্ত যে-রাস্তাটার ওপর দিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে এগিয়ে যেত গোটা কয়েক গাড়ি, বাসসমেত, যাত্রীদের বিরক্তি অগ্রাহ্য করে, প্রায় রাতারাতি রাস্তাটা হয়ে গেছে তকতকে ঝকঝকে। ছেলেটার পেছন পেছন তার মা।

— মরবে…

দরজা পেরিয়ে রাস্তার দু-দিক দায়সাড়াভাবে দেখেই কুশি বিকৃত গলা ফুঁসতে ফুঁসতে এগিয়ে যায় সজনে গাছটার দিকে—

— এরকম করেই একদিন মরবি গাড়ির তলায় চাপা হয়ে।

শীতের সকালের একঝাঁক দাগী কুয়াশা হনহন করে ঢুকে যাচ্ছে খোলা দরজা দিয়ে ঘরের মধ্যে। ভেতরের সেই চাপা গলার শিরা তখনও ফুলে ফুলে ফুঁসছে।

— কতবার তো আনতে আসছিল, যাওনি কেন?

— ছ্যানাটা বড়ো হইছে, লজ্জা করেনি তোর!

ছেলেটা ততক্ষণে কয়েকটা কুয়াশা আর ধুলামাখা সজনে ফুল হাতে নিয়ে গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে। কুশি প্রথমে একটু থমকে যায়। হাতখানেক দূরত্বের জিনিসও অস্পষ্ট। একটু ঝুঁকে দৃষ্টি পরিষ্কার করে সে। সদ্য মৃত সজনে ফুলগুলো তার কাছে কত স্পষ্ট! গাছের দিকে তাকিয়ে কুয়াশার ঝরনায় অন্ধ হয়ে গেল সে। ফুল ফুটে আছে নিশ্চিত। অথচ এখন তারা মৃত। শুধু আলোর দুর্বলতায় কত নরম জীবনও ফ্যাকাশে।

কুয়াশা কেটে কেটে একটা লরি উত্তর থেকে দক্ষিণে মিলিয়ে গেল। অজান্তেই জোর করে ছেলেটার সেই হাত ধরে কুশি, যে-হাতে ফুলগুলো কাফনের স্বপ্ন দেখছিল, চটকে দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল তারা।

— মরলে দেখতে পাই… সবাই খাক করে দিল মোর জানটাকে…

এখন আরও একটু সচেতন কুশি। তার গলা নিয়ে। গলার জোর নিয়ে।

কুয়াশার আবরণে তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু তার গলা যে-কেউ শুনতে পারে!

তাকে নিয়ে আবার কেউ ভাবনার একটা ফাঁদ পাততে পারে এখুনি!

জোড়া জোড়া চোখ মায়া মিশিয়ে দেখতে দেখতে কুশির শরীর আর চরিত্র ভেদ করবে!

এখুনি চটকে যাওয়া ফুলগুলোর মতন তার গলা ভিজে ভ্যাপসে নেতিয়ে গেল, কিন্তু একটা জলজ্যান্ত বিরক্তি তাকে দমাতে পারল না। একটা শিশু হাতটানা খেতে খেতে সেঁধিয়ে গেল ঘরের ভেতর। ভেতর থেকে আসতে থাকা সেই বাখান গোঙানি থেকে এখন বোঁটায় কুয়াশা লাগা সজনে ফুল হয়ে ঝুলে আছে। এখুনি খসে পড়বে নিস্তব্ধ অসহায় খাদে।

আলো আর তাপ ক্রমে তাদের রূপ ছড়িয়ে দিচ্ছে কুয়াশা উবিয়ে। দিনের প্রথম আলো পড়ে কুশির মায়ের ঘরে। দরজা পেরিয়ে আলো ছাড়িয়ে আলোর আভা ঘরের দুয়ার মাতিয়ে তোলে। আলোর পিঠে আলো চাপতে শুরু করলে কুশি বিন্দু থেকে বিন্দু হতে হতে মিলিয়ে যায় ঘরের এককোণ অন্ধকারে। আলো মুখে নিয়ে বাইরে বের হওয়ার সময় পেরিয়ে এসেছে কুশি… রাতদিন নিজের বানানো একটা নৌকায় চড়ে বসে থাকে সে। পালহীন। দাঁড় নেই। স্থির কালো জল বা স্রোতের দৃশ্য তাকে ভাবিয়ে ভাবিয়ে ক্লান্ত করে, তারপর নিশ্চল পড়ে থাকে সেও ওই নৌকোটার মতন।

জানালার আলো পেরিয়ে বসে থাকে কুশি। দিনের বেশিরভাগ সময় এখানে বসে থেকে ভাবে আর ভাবে সে। দেখতে পায়, রাস্তার অপর প্রান্তের ঢাল নেমে গেছে নিরীহ সমতল জমির বুকে। সবুজ ঘাস কিংবা ধানখেত ভরা চোখ কুশির মধ্যে স্থায়ী একটা প্রভাব ফেলে রেখেছে। স্বামীর বাড়ি থেকে যেদিন প্রথম চলে আসে সে, সেদিনের সেই সবুজ আর আজকের সবুজে কোনো তফাত নেই। সেদিনের কুয়াশাবিহীন সকাল চরাচরে যে-গোপন মুখরোচক কথার বীজ বুনেছিল, আজ তারা কিছু সময় আগে অবধি কুয়াশায় ঢাকা ছিল, রোদে রোদে তারা জ্বলে পুড়ে গন্ধ তুলছে। ঘাস আর ধানের গা থেকে কুয়াশা উবে গিয়ে কাঠখোট্টা বাদামি কিংবা বিবর্ণ করে তুলছে তাদের।

একটা দোমড়ানো টেলিগ্রাফ পোস্টের দেহ পড়ে আছে। তারবিহীন। মুচড়ে যাওয়া সাইকেলের টায়ার জাপটে ধরে আছে মুথা ঘাস। এইসব স্থির চিত্রকণা কুশির গা সওয়া হয়ে গেছে। আগে এক-একটা সময় স্থির দাঁড়িয়ে থেকে কুশিকে শৈশব মনে করাত এরা। মুখ থুবড়ে পড়ার পরও দল বেঁধে থাকা যায়!

কুশির মুখ বেয়ে একটা গলায় দড়ি দেওয়া গোরুর ছায়া রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেল।

তিনজন সন্ন্যাসী একহাতে উত্তরীয় গলায় তুলতে তুলতে আর অন্য হাতে পোক্ত একটা লাঠি ঠুঁকতে ঠুঁকতে—

“গৃহস্থের কল্যাণ হোক…”

অন্যমনা হয়েও কুশি যেন সহজাতভাবেই তার নিজের আবছায়াকে চিতায় তুলে অপেক্ষা করতে থাকল লাঠির শব্দ মরে যাওয়া অবধি। এখন সে আরও আরও অন্ধকার আঁকড়ে ধরতে চায়।

একটা সাদা পাখি আটচালার টঙে এক টুকরো হাসি আর ছেনালিই বোধহয়, ফেলে দিয়ে উড়ে গেল দূর মাঠের বাবলা গাছটাতে।

প্রতিদিন নতুন করে রোদ ভূমিষ্ঠ হলে একটা কুয়াশার যেন অগস্ত্য যাত্রা শুরু হয়। প্রতিদিন কুশির স্বপ্নের আর যাপনের বয়স বাড়ে। শরীর এগিয়ে যায় মৃত্যুর কাছে। ভাবনার সঙ্গে। হাঁক দিতে দিতে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসে একটা বাঁক কাঁধে লোক। জানালা দিয়ে রাশি রাশি মন টানা শব্দ কুশির কানে আসে।

পাথর বাটি বিক্রির সোনালি চিৎকার দোল দোল ভাসা খাচ্ছে ছন্দে।

নকশা কাটা
কালা পাথর
পূজায় দেবেন যজ্ঞে দেবেন

কুশির জানালার সামনে এসে সেই সুর হুমড়ি খেয়ে খেয়ে পাথর হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা ভ্রূকুটি সত্ত্বেও বেরিয়ে যায়। কুশির মা দরজার বাইরে পা রাখলেই আগন্তুক বিক্রেতা গতি থামিয়ে শূন্য হয়ে গেল। পাহাড়ি চেহারায় একটা রুক্ষ হাসি খেলিয়ে বিক্রেতা এই সকালেও কপাল থেকে একআঙুল ঘাম টেনে এনে ফেলল রাস্তার উপর। পায়ে পায়ে হাঁটা পথ আর ক্লান্তি সরিয়ে জনপদে প্রথম খরিদ্দার পাওয়ার আশায় পসরা বিছিয়ে দিল রাস্তার মরে যাওয়া জায়গাটায়।

— নিজের হাতে গড়া মা…

— পাহাড় থেকে নিজে হাতে কেটে ছেনি মারিছি…

— এই ফুল ফুল নকশাগুলানকে চোখের সামনে বড়ো হতে দেখিছি আর তেমন করেই তুলিছি এখ্নে…

বড়ো থেকে ছোটো সাতটা মাপের পাথরবাটি একে-অপরের ভেতর সাজানো আছে। কাঠ-হাতে বের করে করে দেখায় সে। যেন হাতে করেই সে জানালার ওপাশে অদেখা একটা উঁকি দেওয়া মুখের ভাব পালটে দিচ্ছে। লোকটার কথার টুকরো টুকরো শুনতে শুনতে কুশি ভাবনার ছায়ায় ডুবে যাচ্ছে। তার খেয়াল নেই, রোদের আলো এসে পড়েছে তার মুখে। স্পষ্ট।

পাহাড়ের বুক চিরে পাথরের একটা একটা টুকরো গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে! লাল দগদগে ছিন্ন একটা নাড়ি নিয়ে সে হয়তো রাতদিন স্বপ্ন দেখে গর্ভবতী হওয়ার! ছবির পর ছবির গয়না সাজিয়ে… কী সুখ আর স্বপ্ন! এরপর হয়তো ঘরের অন্ধকারে কিংবা কুয়াশা ঘেরা একান্তে পড়ে থাকবে দিনের পর দিন! সবার আড়ালে। একটা পুজোর প্রয়োজনে সাজো সাজো গন্ধ তুলে, পেটে ধরবে কত কত প্রসাদ। খালাস করবে… আবার রাতভোর অপেক্ষা করবে আরও একটা প্রসাদ চড়ানোর!

কুশির চোখ নির্বাক ভাষায় মায়া ছড়াচ্ছে।

কুশির মা পাথরবাটি নাড়াচাড়া করে দেখছে। পরখ করে নিচ্ছে, বাটির মুড়ি বা অন্য কোথাও কোনো খুঁত আছে কিনা।

—ঢাঙ্গিকুসুমের বিল পাহাড়ের নিজের কোল থিকে চিরে আনা মা…

—লিয়ে লিন। ঠইকবেননি মা…

কুশি ভাবে, পাহাড় তার অসহায়তা বিলিয়ে দিয়েছে যেন। পাহাড় জানে, এভাবেই সবাই পাথর নিয়ে যায়, এতে কোনো শঠতা নেই। না নিয়ে গেলেই যত অনিয়ম।

ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে একআকাশ স্তব্ধতা আর স্থিরতা নিয়ে। কেনা বেচার মাঝে সামান্য এক দর্শক, যার কাছে পাথর মানে খেলনা, কুয়াশা মানে সজনে ফুল-খেলা।

সন্ধ্যা নামে। রাতের ভেতর দিয়ে গভীর ভাবনাগুলো হেঁটে যায়। কুশির শোবার ঘরের এক টুকরো বিছানার পাশে ঠাকুর পুজোর বাসন। পাথর বাটিগুলো সাজানো আছে কোলে কোলে। জীবনের অনেকটা সময় সে পেরিয়ে এসেছে সকল দেবতার পথ এড়িয়ে। ইদানীং তাকে সেঁধিয়ে যেতে হচ্ছে কুয়াশার মতো ঘন আবছায়ার একটা দুর্ভেদ্য কোটরে। মায়ের কথার বাণ থেকে মুক্তি পেতে সে বেশিরভাগ সময় কাটায় দেবতার কাছে। মাকে দোষ দিতেও পারে না কুশি। কতগুলো রক্তহীন সাদা মুখ দাঁত খিঁচিয়ে গাছের সবুজ পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলছে। ছেলেটার মুখ আর আদুড় গায়ে চোখ বোলাতে বোলাতে কুশির চোখে অতীত ঝাঁক বেঁধে ভিড় করে।

ছোটোবেলার কত কথা আর খেলা মনে পড়ে কুশির। শুধু একটু ভয় ছাড়া অন্য কোনো বাধা ছিল না যেখানে। কাঁচা আম ছাড়ানোর জন্য ঝিনুক ঘষে ঘষে ধারালো করে নেওয়া, কলসি কাখে কলতলায় জল আনতে গিয়ে পাড়ার সবার সঙ্গে হাসি ঠাট্টা কিংবা যত্ন করে মাটি তৈরি করে নিজে হাতে একটা চারাগাছ পুঁতে দেওয়া— এখনও কুশির মনে অমলিন হয়ে আছে।

বাইরে রাতের থমথমে নীরবতা ভেঙে একটু বাতাস শিরশিরিয়ে বয়ে গেল। এই সময়েই সজনে ফুলগুলো তাদের জীবনের চরম প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘুম নেই কুশির চোখে। আজ কয়েকমাস সে বাপের বাড়িতে পড়ে আছে। কত বছর আগের কথা…

—আমরা মৃত্যু অব্দি কালপুরুষ আর লুব্ধক হয়ে থাকব…

বিছানার রাত উষ্ণ হয়ে উঠত এমনভাবে। কুশি আর তার স্বামীর দাম্পত্য রাতে রাতে একটা বীজ বোনে। স্বামীর বাড়ির পাশ দিয়ে রেল চলে যায় নৈঃশব্দ্য ভেদ করে। ঘুমেল রাত টের পায় না, কতখানি যন্ত্রণা পেল চরাচর, বাঁশির তীক্ষ্ম বাণে। কুশির সংসার পুরোনো হয় দিন দিন। সম্পর্কে শ্যাওলা পড়ে। একদিন একটা মেঘ এসে ঢেকে গেল লুব্ধক। কোনোদিন আবার কালপুরুষ গোটা ঢাকা পড়ে যায়। সমস্ত নিয়ম অগ্রাহ্য করে ঝাঁক ঝাঁক তারা ছোটাছুটি করতে করতে স্থির জমাট বাঁধা কথাগুলোকে ধাক্কা দিতে শুরু করে। একদিন স্পষ্ট চেয়ে দেখল কুশি, কালপুরুষের নীল কোমর বন্ধনী খুলে পড়েছে। তির আর ধনুক, যা এতদিন আগলে এসেছে উজ্বল লুব্ধককে, একটার পর একটা তির ছুটে যাচ্ছে আর সব তারার দিকে। মোলায়েম গতিতে।

এখন কুশি একা। বিছানা আর বালিশে লেগে আছে ঘরে জ্বলা মৃদু আলোর আদর। অস্থির কুশি বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। আজও কালপুরুষ আছে নিশ্চয় ভেবে। আছে। বিলম্বিত চাঁদ তখনও লজ্জায় তেজী হয়ে ওঠেনি। ওই তো… কালপুরুষ দাঁড়িয়ে আছে দুই পা উন্মুক্ত করে। পায়ের মাঝে এক অমোঘ কৃষ্ণগহ্বর যেন শুষে নিচ্ছে অগণিত তারাকে। তারাগুলোর দিগশূন্য গতি মাড়িয়ে দিচ্ছে লুব্ধকের আলো। রাস্তার দিকে তাকায় কুশি। শিহরণে টান পড়েছে চামড়ায়। এই রাস্তায়ই আজ সকালে একজন হয়তো ভুলিয়ে ভালিয়েই বিকিয়ে গেছে পাথর বাটিগুলো। সাজানো। প্রকৃতির মায়া আঁকা আলপনা গায়ে।

বিছানায় আবার কুশি। কালো কালো পাথর বাটিগুলো ঘরের আলোটুকু শুষে নিচ্ছে। কেবল সাদা রঙের আলপনাগুলোই চোখ মেলে জেগে আছে গর্বে। হয়তো থাকবে না বেশিদিন। ব্যবহৃত হতে হতে কোণ ভাঙবে। মেটে রঙের বিষণ্ণতা ধুয়ে মুছে দেবে নতুনের ঝলমলে ভাবকে।

—ফিরে কি যাবে কুশি? ওর কাছে? নিজের ঘরে?

—ভাঙা পাথরের টুকরোগুলো আর ফিরতে পারবে না কোনোদিন।

—যদি যায়ও, এখানের হাতের ছোঁয়া আর প্রসাদ মুছে চিরতরে, সেখানে পাহাড়ের কোল ওকে আর চাইবে না আগের মতন!

—পড়ে থাকবে এখানেই। কানাচে। ঢাঙ্গিকুসুমের মায়া মাখা স্বপ্ন জড়িয়ে।

কখন পাতা লেগে যায়, জানতে পারে না কুশি। একটা আলতো ঘুম গড়িয়ে গিয়ে খুব অল্প সময়ে ধাক্কা খায় সকালের সঙ্গে।

আবার সকাল। আবার কুয়াশা। সজনে ফুল ঝরে পড়ার মতন নিঃশব্দে গুমরে যাচ্ছে কতগুলো অকথন। এখনও কিছু সজনে ফুল পড়ছে। বাতাসে উড়ে গিয়ে কেউ পড়েছে রাস্তায়। থ্যাঁতলানো। ঠায় দরজার বাইরে ঘন কুয়াশার পেটে দাঁড়িয়ে আছে কুশি। প্রায় রাতজাগা চোখ মুদে আসছে কুয়াশার খাতিরে।

কী ভাবছে সে!

একটু পরই রোদ উঠবে…

প্রতিদিনের মতন সে গিয়ে বসবে ঘরের ভেতর, জানালার পাশে। জানালা থেকে যতটুকু বাহির দেখা যায়, দেখবে। ফল্গুস্রোতের মতন অন্তর ফেঁড়ে চিরে যাবে মায়ের কথাগুলো। মাঝে মাঝে আগুন উসকে যাবে স্বামীর ঘরের আটটা বছর।

তারপর কুশির চোখ গিয়ে পড়বে রাস্তা পেরিয়ে একটা চৌকো মতন বাঁজা জমির উপর। বাঁশের বাতা দিয়ে ঘেরা। একটা গামছা কাঁধে প্রৌঢ় লাঠি উঁচিয়ে গবাদিপশু ঠেসে দিয়ে যাবে সীমানার ভেতর। এ-সব পেরিয়েও কুশি দেখবে, একটা কোকিল আর একটা কোকিলের ঠোঁটে পালক গুঁজে বুঝে নিচ্ছে বসন্ত আসার সঠিক দিনক্ষণ।

আজ মুমূর্ষু কুয়াশার ওপর রোদের জন্ম হলেও, কুশি ঘরে গেল না। স্থির চোখে সে দেখছে ওই প্রৌঢ়ের দিকে। কোকিলগুলো আজ সেখানে নেই। বিচলিত নয় কুশি। ছেলেটা ততক্ষণে সজনে ফুলে মশগুল। যন্ত্রচালিতের মতন ছেলেটার এক হাত ধরে কুশি। আর এক হাতে একটা পাথর বাটি।

বাস আর পুরুষের অপেক্ষা না করেই রাস্তা বরাবর মিলিয়ে যাচ্ছে কুশি।

Facebook Comments

পছন্দের বই