লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শুভদীপ ঘোষের প্রবন্ধ

পরজীবীর শৃঙ্খল: দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র

“Banjiha is a space with a peculiar connotation. …It’s undeniably underground, and yet you want to believe it’s above ground, there’s also the fear that if you sink any lower, you may go completely underground.” দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, ‘Memories of murder’ (2003) খ্যাত ‘Bong Joon-ho’ (1969), 2019 সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর সাম্প্রতিকতম ছবি ‘Parasite’ দেখানোর সময় এই মন্তব্যটি করেছিলেন। ‘Parasite’ ছবিতে Kim পরিবারের বসবাস দক্ষিণ কোরিয়ার এই বিশেষ ধরনের গৃহব্যবস্থা Banjiha-তে। চারজনের পরিবার, গৃহকর্তা Ki-taek, স্ত্রী Chung-sook, মেয়ে Ki-jung এবং ছেলে Ki-woo. এই সেমি-বেসমেন্ট বাড়িগুলির অবস্থান রাস্তার সঙ্গে এমন যে, কোনো সহৃদয় ব্যক্তি যদি মূত্র ত্যাগের জন্য তাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটিকে বেছে নেন তাহলে সেটা প্রায় তাদের জানালায় গিয়ে পড়ে। অত্যন্ত টানাপোড়েনের সংসারে একমাত্র রোজগেরে গৃহকর্তা Ki-taek পরিবার প্রতিপালনের চেষ্টা করেন পিৎজার বাক্স বানিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও Ki-woo-এর বন্ধু Min-hyuk, প্রচণ্ড ধনী Park পরিবারের মেয়েকে ইংরেজি পড়ানোর জন্য Ki-wooকে বলে। মালভূমি অঞ্চলের মতো উপরে উঠে যাওয়া রাস্তার ধারে উঁচু জমিতে এই Park পরিবারের বাড়ি, সদস্য মূলত পাঁচ জন, গৃহস্বামী Mr. Park, গৃহকর্ত্রী Mrs. Park, এছাড়াও তাদের মেয়ে Da-hye, ছেলে Da-song এবং তাদের পরিবারের প্রায় সদস্যের মতোই, পরিচারিকা Moon-gwang. Ki-woo নিজের নাম পালটে Kevin নাম নিয়ে, সার্টিফিকেট জাল করে Park পরিবারে গিয়ে উপস্থিত হয়। এরপর বিভিন্ন প্রকার চাতুরী ও মিথ্যে দোষারোপের মাধ্যমে নাম ও পরিচয় ভাঙিয়ে একে একে এসে ঢোকে Ki-jung, ছেলে Da-song–এর art therapist হিসেবে, Ki-taek নিজে, গৃহস্বামী Mr. Park–এর গাড়ির চালক হিসেবে এবং পরিশেষে Chung-sook পরিচারিকা Moon-gwang-এর পরিবর্তে। ঘটনাক্রম এগোতে থাকে, ছবির মোটামুটি যখন মাঝ বয়স সেই সময় আমরা নাটকীয়ভাবে আবিষ্কার করি Park পরিবারের গোপন ষষ্ঠ সদস্যটিকে, বাড়ির পাতালে অবস্থিত বাঙ্কারটির মধ্যে। এই বাঙ্কারটি বাড়ির আগের যিনি মালিক ছিলেন তিনি বানিয়েছিলেন। দেনার দায়ে জর্জরিত Moon-gwang-এর স্বামী Geun-sae এখানে, এই প্রায়ান্ধকার পাতালে লুকিয়ে আছেন গত চার বছর ধরে। এই আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারটির স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ, অস্পষ্ট আলো, টানেলের মতো রাস্তা পরভাগ্যোপজীবী প্রাণীর থাকার অস্বস্তিকর অথচ বাস্তব পরিবেশ রচনা করে।

এখানে এসে সুধী দর্শক বুঝতে পারেন পরিচালক কী অবলীলায় পরজীবী প্রাণীর একটি বেড়ি বা শৃঙ্খল রচনা করেছেন ইতিমধ্যেই। kim পরিবার তাদের অবধারিত পরিণতি আসলে যে চোখের সামনে Geun-saeদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছে তা ছবির একেবারে শেষে গিয়ে আমরা বুঝতে পারি। নিম্নতম জীবন (Moon-gwang, Geun-sae) ও ক্রম-নিম্নগামী জীবন (kim পরিবার) ওই বাঙ্কারের পাতালে একে-অপরের মুখোমুখি হয়, তাদের মাথার উপর দাঁড়িয়ে থাকে বুর্জোয়া আধিপত্য নিয়ে প্রাসাদোপম বাড়িটি। লক্ষণীয় বিষয় হল Bong Joon-ho এই তিনটি শ্রেণির আর্থসামাজিক অবস্থানটি নির্দিষ্ট করতে গিয়ে প্রায় সবার অলক্ষ্যে অনায়াস দক্ষতায় Seol শহরের ভূগোলকে, অর্থাৎ, জমির উঁচুনীচু চরিত্রকে আর্থসামাজিক অবস্থানের সমান্তরালে রূপকের মতো ব্যবহার করেছেন। Organisation for Economic Co-operation and Development বা OCDE-র Development Assistance Committee-র, G20-র ও অভিজাত Paris ক্লাবের সদস্য দক্ষিণ কোরিয়া, এই দেশটির একটি অন্য দিক এই ছবি তুলে ধরে। আজকের তথাকথিত উত্তর আধুনিক পৃথিবীতে, সে উন্নতই হোক উন্নয়নশীলই হোক আর গরিব দেশই হোক, মূলত বিদ্যমান নয়া ক্লাসিকাল অর্থনীতি বা বাজার অর্থনীতি যে শ্রেণি-বৈষম্যকে বিবদমান রেখেছে এই ছবি দেশ কাল নির্বিশেষে তা আরেকবার মনে করিয়ে দেয়। বস্তুত kim পরিবার পিৎজার বাক্স বানাতে গিয়ে যে-বাজারে তাঁর শ্রম বিক্রি করে, কিংবা Park-দের পরিবারে Moon-gwang, বা অনুমেয় যে-কারণে Geun-sae ঋণ বা দেনাগ্রস্ত এবং এমনকী Mr. Park তাঁর শ্রেণিগত অবস্থান থেকে যে-বাজারে শ্রম বিক্রি করেন, কথা ছিল সেই বাজার যদি আদর্শ বাজার হয় তাহলে প্রতিযোগিতার যাবতীয় বাধা সে-শ্রেণি স্বার্থ গতই হোক বা রাজনৈতিকই হোক, তা কার্যকরী হবে না। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তা হয় না, ‘Parasite’ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তার কারণ বাজার অর্থনীতি দাড়িয়ে আছে বারমেসে অসাম্যকে বিদ্যমান রাখার উপর। তাই kim পরিবারের ভবিতব্য পাতালমুখীই হবে যতই তারা ছলচাতুরী করুক। সম্পত্তি বন্টনে যে-অসাম্য থাকে তা দূর করে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার যে-ভাবনা এই ছবি দেখতে দেখতে চিন্তাশীল ও সংবেদনশীল মনে জেগে ওঠে, আসলে বাজার অর্থনীতিতে তার কোনো স্থান নেই। উপরন্তু, বাজারি ভারসাম্যের আলোচনায় বাঞ্ছিত পরিস্থিতি হিসেবে এমন এক পরিস্থিতির কথা ভাবা হয়, যেখানে পুনর্বন্টন কোনো মতেই একজনের ক্ষতি করে অন্যের লাভের ব্যবস্থা করবে না। তাই পুনর্বন্টনের নামে বুর্জোয়ার সম্পত্তিতে হাত দেওয়াও তার ক্ষতি করা, তাই এই নীতি অনুযায়ী তা অনুচিত। এই নীতির জন্মদাতা ইতালির প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভেলফ্রেড প্যারেতো। পরিচালক এই ছবিতে প্রত্যেকটি শ্রেণির প্রতি এক ধরনের অবজেকটিভ নির্লিপ্ততা রাখেন, অর্থাৎ, কারুর প্রতি তাঁর আলাদা সহমর্মিতা বা আলাদা তাচ্ছিল্য প্রকাশ পায় না। তাই এ ছবি দেখতে দেখতে আনুষাঙ্গিক অনেক ভাবনা চলে আসতে থাকে। ক্রমবর্ধমান অসাম্য, আর্থসামাজিক পরিবেশই কি আসলে অসহায় মানুষকে বাধ্য করে চাতুরি, মিথ্যে ছলনার আশ্রয় নিতে, না কি কু-প্রবৃত্তি, অলসতা, তঞ্চকতা মানুষের অন্তর্গত এবং তা সময় পেলেই তার স্বরূপ ধরে, নাকি বিবদমান শ্রেণি-বৈষম্যেই এর পিছনের অনিবার্য কারণ! এইগুলি মিলে মিশে অদ্ভুত মানবচরিত্র নির্মাণ করে বোধ করি। অলীক সুখের স্বাদ পাওয়া kim পরিবার তাই Moon-gwang, Geun-saeদের প্রতিও কোনো প্রকার সহমর্মিতা দেখায় না এবং বিপরীত ক্রমে Moon-gwang পাতালে kim পরিবারের সদস্যদের দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বমূর্তি ধারণ করে। উভয়েরই ধরা পরে যাওয়ায়, ভয় পাওয়ার সঙ্গে কাজ করে অবমানবের জীবনের থেকে আরেকটু ভালো করে থাকার অদম্য স্পৃহা। এদের দৈনন্দিন বাস্তবতা এবং এদের চাতুরিকে শ্রেণির নিগড়ে পরিচালক এমনভাবে বাঁধেন যে, আমাদের মনে এদের প্রতি নির্দিষ্ট করে সহানুভূতি বা দ্বেষ কোনোটাই জন্মায় না। যেন পুরোটাই matter of fact, এই ভঙ্গিতে ছবিটি বিধৃত হতে থাকে এবং এর অভিঘাত এমনই হয়ে দাড়ায় যে, কাহিনির বাস্তবতা-অবাস্তবতার প্রশ্নের চাইতেও, দর্শক তাঁর মনের বিচিত্র ভাবটিকে নিয়ে নিমজ্জিত থাকেন নিজের অজান্তে।

নান্দনিক সৌন্দর্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রে মন্তাজ নামক নির্মাণশৈলীর অনায়াস ব্যাবহার দেখি এই ছবিতে। রাশিয়ার প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক সের্গেই আইজেনস্টাইন কৃত পাঁচ রকম মন্তাজের (মেট্রিক মন্তাজ, রিদেমিক মন্তাজ, ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজ, টোনাল মন্তাজ এবং ওভারটোনাল মন্তাজ) অনেকগুলি ধারাকে এখানে প্রবাহিত হতে দেখি উত্তম দক্ষতায়। মন্তাজগুলির কিঞ্চিৎ রূপরেখা দেওয়া যেতে পারে এ-প্রসঙ্গে। বলা বাহুল্য সম্পাদনা বা editing এখানে মূল ভূমিকা পালন করে। মেট্রিক মন্তাজে প্রত্যেকটি cutকে হতে হয় মোটামুটি একই দৈর্ঘ্যের অর্থাৎ cut-এর ফলে তৈরি হওয়া দৃশ্যগুলিকে হতে হয় মোটামুটি একই দৈর্ঘ্যের, রিদেমিক মন্তাজে cut-এর সংখ্যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বারে বা কমে অর্থাৎ, cut-এর ফলে তৈরি হওয়া দৃশ্যগুলির দৈর্ঘ্য বাড়ে বা কমে, ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজে cut-এর ফলে তৈরি হওয়া দৃশ্যগুলি সবসময় সম্পর্কিত থাকে না কিন্তু সব মিলিয়ে একটা অর্থ বহন করে, টোনাল মন্তাজে cut-এর ফলে তৈরি হওয়া দৃশ্যগুলি নির্ভরশীল থাকে দৈর্ঘ্যের চাইতেও মূলত আবেগের উপর এবং ওভারটোনাল মন্তাজ মূলত উক্ত একাধিক মন্তাজের যোগসাজশে তৈরি হওয়া আরও জটিল প্রভাব। বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতার ধারায় আইজেনস্টাইন cut-এর ভেতর দিয়ে তৈরি হওয়া দৃশ্যগুলির (A, B, C…) মধ্যে একধরনের সংঘাত (AXBXC…) দেখতে পেয়েছিলেন, সংযোগ (A+B+C…) নয় এবং এর ফলে যা (AXBXC…=Z’) তৈরি হয় তা (Z’) অস্তিত্বে, অর্থে ও তাৎপর্যে A, B, C… অতিরিক্ত এক সত্তা। অবশ্যই এই মিথস্ক্রিয়া ঘটে দর্শকের মস্তিষ্কে বা মননে। প্রসঙ্গে পুনরায় ফিরে বলা যায়, যে-সকল দৃশ্যাবলীর ভেতর দিয়ে আমরা চাতুরির শিকার হওয়া পরিচারিকা Moon-gwang-এর জায়গায় Chung-sookকে স্থলাভিষিক্ত হতে দেখি উপরিউক্ত ওভারটোনাল মন্তাজের ব্যবহারে তা সমৃদ্ধ হয়ে আছে। টুকরো টুকরো দৃশ্যে intercut-এর ভেতর দিয়ে সমান্তরালে আমরা দেখতে থাকি Moon-gwangকে কীভাবে টিউবারকিউলোসিস আক্রান্ত প্রতিপন্ন করা হল এবং সেই চক্রান্তের পটভূমি রচিত হল kim পরিবারের সমবেত উদ্যোগে। kim পরিবার তাদের ক্রমান্বয়ে চলতে থাকা চাতুরির ভেতর দিয়ে শেষ যে-চাতুরিটিতে এসে আর্থসামাজিক নিরাপত্তা পেতে চাইছে, ওই দৃশ্যগুলিতে ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্যবহৃত পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের মনোরম মূর্ছনা আমাদের অর্থাৎ দর্শকদের মধ্যেও ওই মিথ্যে নিরাপত্তার অনুভূতিটিকে এনে দেয়। মন্তাজ ব্যবহারের সঙ্গে ক্যামেরার রৈখিক চলার গতি, সংগীতের ব্যবহার, একইসঙ্গে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায়, মিথ্যে নিরাপত্তার অনুভূতি এনে দেয় এবং কোন ধারার ছবি এটা হতে চলেছে সে-ব্যাপারে একটা ধারণা তৈরি করে দেয়, যার পরিসমাপ্তি ঘটে এবং অর্ন্তবয়ান (চলচ্চিত্রকে একটি দৃশ্য-শ্রাব্য পাঠ (audio-visual text) হিসেবে বিবেচনা করে) পরির্বতনের উত্তেজনাসূচক হয়ে ওঠে ডোরবেলের শব্দটি। ছবির এক জায়গায় প্রবল বৃষ্টির কারণে Park পরিবার তাদের বেড়াতে যাওয়া অসমাপ্ত রেখে বাড়ি ফিরে আসে এবং এখানেও মেট্রিক ও রিদেমিক মন্তাজের প্রয়োগ কৌশলে Park পরিবারের বাড়ি ফিরে আসা থেকে kim পরিবারের ঘরের মধ্যে অন্তর্ধানের দৃশ্যটি ফুটিয়ে তোলেন পরিচালক। বাচ্চা ছেলেটি প্রবল বৃষ্টির মধ্যে সামনের লনে তাঁবু খাটিয়ে খেলা করে, এ এমন এক শ্রেণির আলেখ্য যেখানে শিশুর কাছেও যেন বৃষ্টি প্লাবন আসলে মনোরঞ্জনের নামান্তর, প্রতিদিনের অঢেল সুখ ও বৈভবের যে-একঘেয়েমি তার থেকে মুক্তির আদিখ্যেতা। অথচ এই সন্দর্ভ রচনা করতে পরিচালককে কোনো কষ্ট কল্পনারও আশ্রয় নিতে হয় না। Bong Joon-ho, Sight & Soundকে দেওয়া তাঁর মনোনীত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ১০টি ছবির তালিকায় Alfred Hitchcock (1899-1980)-এর ‘Psycho’-কে স্থান দেন। উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের বস্তুকে বয়ানের প্রাণকেন্দ্রে স্থাপন করার যে-Hitchcock-ইয় পদ্ধতি তা ব্যবহৃত হতে দেখি এই ছবিতেও। সেই দৃশ্যটির কথা ভাবুন যেখানে Mr. Park ও Mrs. Park ঘরে না গিয়ে তাদের সন্তানকে পাহারা দেওয়ার জন্য ড্রয়িং রুমের সোফাটিকেই তাদের অভিসারের সজ্জা হিসেবে বেছে নেন, যার সামনেই টেবিলের নীচে লুকিয়ে আছে নতুন পরিচারিকা একমাত্র Chung-sook ছাড়া, kim পরিবারের বাকি সদস্যরা। Alfred Hitchcock-এর Roop (1948) ছবিটির কথা এই মর্মে মনে পরে যায়। দু-জন শিল্প বোদ্ধা যাদের এক কালে aesthetes বলা হত, তাঁরা গলায় ফাঁস দিয়ে তাদেরই একজন পুরানো বন্ধুকে হত্যা করে শুধুমাত্র এটা প্রমাণ করার জন্য যে, এই নির্ভুল হত্যাকর্মটি আসলে একটি শিল্পকলা যা তাদের শ্রেষ্ঠতর বলে প্রতিপন্ন করে। পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধি এই দু-টি মানুষ, মৃতদেহটিকে এরপর একটি বড়ো টেবিল সদৃশ ড্রয়ায়ের নীচে লুকিয়ে রাখেন এবং তার উপরই এক নৈশভোজের আয়োজন করেন। বিষয়বস্তুর দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই ছবিতেও আমরা একইভাবে উদ্বেগ ও আতঙ্কের বস্তুকে বয়ানের প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত হতে দেখি। Roop–এ ছবিটির দর্শকের সঙ্গে আতঙ্ক ভাগ করে নেয় পেটি বুর্জোয়া মূল চরিত্র দু-টিও, আর ‘Parasite’-এ দর্শকের সঙ্গে আতঙ্ক ভাগ করে নেয় টেবিলের তলার মানুষগুলি যাদের অবস্থাও মৃতদেহবৎ। kim পরিবারের গৃহকর্তা Ki-taek তাঁর ছেলে মেয়ের সামনে চরম অপদস্থ হন, শৃঙ্গার-রত Mr. ও Mrs. Park তা জানতেও পারেন না, এরপর পরজীবী প্রাণীর পলায়ন পর্বটি মেরুদণ্ডহীনই করে রাখেন পরিচালক ঘটনা প্রবাহের উত্তেজক ও অদ্ভুত পরিবেশনায়। বর্ষণসিক্ত Ki-taek অতঃপর তার ছেলের প্রশ্নের উত্তরে জানায় সে বাঙ্কারে Moon-gwang, Geun-saeদের বেঁধে রেখে এসেছে এবং পরিকল্পনাও করে ফেলেছে এর পর কী করতে হবে, কিন্তু তার আগে বাড়ি গিয়ে স্নান করে একটু স্থিতধী হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু হায়, পৃথিবী জুড়ে বৃষ্টি হয়, প্লাবন আসে, তা কারো জীবনে যেমন বিলাস, বৃষ্টি-বাসর (Park পরিবার) আবার সমাজের এক বৃহৎ অংশের জীবনে (Kim পরিবার) হয়ে যায় দেশ কাল নির্বিশেষে এক লহমায় ভেসে যাওয়া মানুষের নিদারুণ জলছবি।

পরিচালক ছবির এই গোটা পর্বটি জুড়ে শ্রেণি বিভক্ত সমাজের চিরকালীন বৈপরীত্যগুলিকে অসামান্য মুনশিয়ানার সঙ্গে খোদাই করে গেছেন। Ki-taekরা জানতই না পৃথিবীজোড়া বানভাসি মানুষের দলে সমবেত হয়ে তাদেরও গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে একটি ত্রাণশিবিরে। Mrs. Park ছেলের জন্মদিনের তোড়জোড় করতে থাকেন, বিলাসবহুল অঢেল উৎবৃত্ত পোশাক আশাকের পাশে ত্রাণশিবিরের ছবি, Park পরিবাররে পারিবারিক বন্ধন, তাদের প্রত্যেকের সামাজিক মর্যাদার পাশে Kim পরিবারের ক্রম-অধোগতি (Moon-gwang, Geun-saeদের দিকে) বড়ো বেদনার মতো বাজতে থাকে আমাদের মনে। Ki-taek তাঁর জীবন দর্শনের এক ক্রান্তিকালে উপনীত হন, বলেন, সবথেকে ভালো হল জীবনে কোনো পরিকল্পনা না করা, বিশেষত তাদের মতো শ্রেণির মানুষদের কারণ, মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক, ব্যক্তিজীবনে অকস্মাৎ বিপর্যয় আসে, রাষ্ট্র বিশ্বাসঘাতকতা করে। বস্তুত প্রথাসিধ্য অবস্থান থেকে কখনই বুর্জোয়া বা পেটি বুর্জোয়া প্রতিনিধি হিসেবে Mr. Park ও তাঁর পরিবারকে খুব অথরেটেরিয়ান হিসেবে এ ছবিতে আমরা দেখতে পাই না। যদিও Mr. Park-এর উচ্চশ্রেণি চেতনার ইঙ্গিত আমরা মাঝে মাঝে পেয়েছি তাঁর শরীরী ভাষায় কিংবা স্ত্রীর সস্তা অন্তর্বাস পরিধানের প্রতি কটাক্ষে, তথাপি Park পরিবার সব কিছুকে সরল বিশ্বাসেই যেন মেনে নিয়েছে বলে মনে হয়, তাদের মধ্যে কোনো কিছু নিয়েই সন্দেহের উদ্রেক হয় না। তলায় তলায় কি দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত তা তাদের কাছে অজানাই থেকে যায়। গরিব নিম্নবিত্ত মানুষের অন্তর্ঘাত ঘটানোর নিষ্ফল প্রচেষ্টার প্রতিই মনোনিবেশ থাকে পরিচালকের এ-ছবিতে। ফলত ছবিটি কোনো শ্রেণির পক্ষেরই প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে না। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশবিদ ই. এফ. শুমেকার শিল্পায়ন/পুঁজি রাষ্ট্রের যে-চারটি মূল বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছিলেন তার মধ্যে একটি হল ‘এর সংগঠন অত্যধিক বৃহৎ হওয়ায় এর চরিত্রের মধ্যে স্বৈরাচারী প্রবৃত্তি নিহিত থাকে’। শ্রেণি, শ্রেণির সংঘাত, বাজার পুঁজির চলন, বলবৎ ও ক্রমবর্ধমান অসমতা সব মিলিয়ে এ, ওই এমন এক বৃহৎ স্বৈরাচারী ব্যবস্থা তৈরি করে যে, সেখানে Parkদের আর আলাদা করে শোষকের প্রতিনিধিত্য করতে হয় না, কিন্তু kimদের অসহায়তা, ইচ্ছে-অনিচ্ছার ঘেরাটোপের মধ্যেকার সামাজিক অবস্থান, শোষিতের রূপটিকে নতুনভাবে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে। কিঞ্চিৎ প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলা যায়, ৪৮ খ্রিস্টাব্দে নথিভুক্ত Samguk Yusa নামক প্রাচীন গ্রন্থ থেকে জানা যায় Heo Hwang-ok নামে এক রানি Geumgwan Gaya অঞ্চলের Suro নামের এক রাজাকে বিবাহ করেন ‘অয়ুদা’ থেকে কোরিয়া যাওয়ার সময়। তাঁরা যে ১০ সন্তানের জন্ম দেন সেই থেকেই এই Kim বংশের সূত্রপাত। এই ‘অয়ুদা’ সম্ভবত ভারতবর্ষের আজকের অযোধ্যা। উত্তর কোরিয়ার প্রতাপশালী শাসক নেতা kim jong unও এই বংশের উত্তরাধিকার বহন করছেন। ২০১৫ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় ২১.৫% মানুষ এই বিখ্যাত Kim বংশের। পুনরায় প্রসঙ্গে ফিরে বলা যায় Ki-woo-এর বন্ধু ছবির শুরুতে তার দাদুর সংগ্রহের যে-পাথরের স্মারকটি Ki-wooকে দিয়ে যায় এই বিশ্বাসে যে, এটা ওদের পরিবারে আর্থিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে, Ki-woo সেটিকেই বেছে নেয় বাঙ্কারে Moon-gwang, Geun-saeদের পরিণতি নিয়ে তার নিজস্ব পরিকল্পনার রূপায়ণে। এই অংশে একটি দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই Mr. Park এবং Ki-taek দু-জনেই রেড ইন্ডিয়ান সেজে বসে আছেন জন্মদিনের পার্টিতে অনুষ্ঠিত নাটকে অংশগ্রহণ করার জন্য। আমরা জানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ হিসেবে তথাকথিত প্রথম বিশ্বের দেশগুলির তালিকায় দক্ষিণ কোরিয়াও একটি। খোদ মার্কিন ভূখণ্ডে রেড ইন্ডিয়ানদের এথনিক ক্লিনসিং-এর যে-পৈশাচিক ইতিহাস আছে, জাতি রাষ্ট্র হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার মার্কিন-দেশের সাথে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সখ্যতা, পরনির্ভরতার প্রতি এ কি পরিচালকের কটাক্ষ, না কি আরও বড়ো কোনো পুঁজির চলন ও তার নিয়ন্ত্রণের স্মারক এটি এ-প্রশ্ন মনে জাগে (এই ছবিটি প্রথম অ-ইংরেজি ছবি হিসেবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের আকাদেমি এ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়)! Ki-woo যে-বিপত্তির সূত্রপাত করে নিজে সাঙ্ঘাতিকভাবে আহত হয়, সেই বীভৎসতা চরম আকার ধারণ করে, সামুহিক রক্তপাত ও খুনোখুনির ভেতর দিয়ে ছবিটি অন্তিম পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। লেনিন বলেছিলেন একজন মানুষের মৃত্যু ট্রাজেডি হয়, কিন্তু অনেক মানুষের মৃত্যু কখনো ট্রাজেডি হয় না। যদিও ছবির শেষে Ki-taekকে মাটির তলার বাঙ্কারে স্থলাভিসিক্ত হতে দেখি Geun-sae-এর ইহলীলা সাঙ্গ হলে, তথাপি আমরা এই ছবির পরিণতিকেও ট্রাজেডির ব্যক্তিগত পরিসরে নিয়ে গিয়ে ভাবি না, বরং হত্যালীলার মধ্যে যে, একধরনের উন্মাদগ্রস্থতা আছে তাই অবশ্যম্ভাবী ছিল বলে যেন মনে হয়। গল্পের মনোরঞ্জনের দিকটির বাইরে গিয়েও এ ছবি অর্থনৈতিক অসাম্যকে, তাকে বলবৎ রাখা কায়েমি স্বার্থকে ও তদুপরি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের জটিল দিকটিকে অদ্ভুত মুনশিয়ানায় তুলে ধরে আমাদের হৃদয়ের মর্মমূল ধরে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে যায়। আপাত ধনী দেশ, আপাত কল্যাণমূলক সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা ক্ষতস্থানটিকে চিনিয়ে দিতে দিতে এ ছবি সমস্ত দেশের মানুষের ছবি হয়ে ওঠে।

Facebook Comments

পছন্দের বই