লেখক নয় , লেখাই মূলধন

জগন্নাথদেব মণ্ডলের গদ্য

নিঃসঙ্গ কথকের নিজস্ব পালা

আজকাল সকালের দিকে বাঁকানো খুরপি দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিই, বেড়ালকে ভাত খাওয়াই, গাভিন হওয়ার পর ছাগলের শিংয়ে তেলসিঁদুর লাগাই।

দেওয়ানগঞ্জে প্রথম আষাঢ়ে জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা দেখতে যাই, ছোটোবয়সে শ্বশুরঘরে চলে যাওয়া দিদি কাঁঠালবীজ পুড়িয়ে চালভাজা মেখে দেয় খাঁটি সর্ষে তেলে দিয়ে, কাঁচলঙ্কা দেয়, ভুট্টা পোড়ায়, আদারস দেওয়া চা করে।

পুকুড়পাড়ে জ্যোৎস্নায় এসব বসে বসে খাই। সেখানে পুকুরজলে পচা লতাপাতা দিয়ে অর্ধেক নৌকা ডোবানো, রাতে পাকা মাগুর মাছ আসে,গর্তে গর্তে সাপ। সাপের শিস শুনতে শুনতে ভাবি— যে-সব মানুষের কাছে গেলে পাঁজর ব্যথা করে, নিজস্ব কঙ্কাল অবধি কেঁপে ওঠে, যারা এই সেদিনও নমঃশূদ্র, নীচুজাতি বলে গাল দিয়েছিল, অপমান করেছিল গলার স্বর নরম হওয়ার জন্য, কবিতা লেখার জন্য ব্যঙ্গ করেছিল তাদের কাছে আর কখনই যাব না।

তারপর এই সমস্ত ভুলে যাই গমক্ষেতের ধারে বসে। গলায় দগদগে ঘা হওয়া উদ্বাস্তু ছোটোদাদুও ভুলে যেত। আকাশে ক্ষমারঙের চাঁদ ভাসে। হাওয়ায় নতুন রংকরা নলকূপের গন্ধ। যেন সমস্ত বিকল তাঁতযন্ত্র সেরে গ্যাছে।

যে-সব ছেলে-মেয়েদের সকাল বিকেল পড়াই তাঁদের সাথে পড়ানো শেষে পাটিতে বসে গপ্পো করি।
তারা আমার প্রশ্নের অদ্ভূত সরল উত্তর দেয়। যেমন—

(ক)বল তো, কক্ষপথ কী?

ছাত্রী—
দাদা, যে পথ দিয়ে ঘোড়া নিয়ে সৈনিক হেঁটে যায়… ঠকা ঠক ঠকা ঠক।

(খ) তাজমহল কোথায় আছে রে?

ছাত্রী—
আমার মামাবাড়িতে প্রচুর শাদা শাদা তাজমহল।

(গ) জীবনানন্দ দাশের নাম শুনেছিস?

ছাত্র—
আমাদের দাঁইহাটেই তো ওর বাড়ি, একটু বয়স হয়েছে।

আমি চুপ করে থাকি। ইচ্ছে করে না ওদের ভুল ভাঙাই তবু পড়াতে হয়। ওরা চলে যায়। হাওয়া দেয়। মা চা রেখে যায়। শীত শীত করে। ছোটোদাদুর জন্য মনখারাপ করে। মায়া জাগে।

আকাশে মুখ থেকে তুলে দেখি মরচে রং আলো। চারিদিক হয়ে আছে উলটোরথের পরের দিনের ভোর অথবা বিভূতিভূষণ! বিভূতিভূষণ!

Facebook Comments

পছন্দের বই