লেখক নয় , লেখাই মূলধন

তন্বী হালদারের গল্প

নদীর সঙ্গে দেখা


এপার থেকে ওপারটা দেখলে কেমন যেন রহস্যময় ছবির ক্যানভাসের মতো মনে হয়। গাছগাছালি, পাখপাখালি, মানুষজন, রাস্তাঘাট সবই দেখা যায়। তবে সবকিছুই আকারে ছোটো আর ধোঁয়া ধোঁয়া। মায়াবী। মন টানে। এপারের সঙ্গে ওপারের বিস্তর ফারাক আছে। এপারটা যেন সবসময় ছোটো খোকার খলবলানিতে উচ্ছ্বল। আর ওপারটা যেন অবসরপ্রাপ্ত দর্শনের অধ্যাপকের গুরুগম্ভীর চিন্তার ভ্রূকুটি। দু-পারের সেতুই বলো আর বন্ধনই বলো, যোগাযোগের একমাত্র উপায় নৌকা। কখনো খেয়া, কখনো ডিঙি। গহনা নৌকোর দেখা মাঝেমধ্যে মিললেও বজরা কচিৎ কখনো। ডিঙিগুলোয় পনেরোজনের বেশি লোক তোলা নিষেধ। কিন্তু কে শোনে কার কথা। পেটের দায়ে পাঁচ-সাতটা লোক সবাই অন্তত বেশি তুলবেই। আর খেয়াগুলো যেন রাক্ষস। খিদে আর মিটতেই চায় না। গত বছরে সাঁড়ির গোণে শ্মশানঘাটের কাছে ঘোলাটার মধ্যে নৌকো পড়লে দু-জন মাঝি দাঁড়-হাল কোনোটায়ই সামাল দিতে পারল না। নৌকোডুবি অবশ্য এ অঞ্চলে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা না। প্রায়ই ঘটে। তবে গত সনের নৌকোডুবিটায় বিশেষত্ব ছিল এই জন্য— ইলেকট্রিক সাপ্লাই অফিসের রতন কাকু মারা গেল। রতন কাকু যখন মারা গেল তখন দেড় বছরের ছেলে আর তিন বছরের বিবাহিত জীবনের স্ত্রীকে রেখে গেল। দু-দিন বাদে সোলাদানার চরে রতন কাকুর দেহটা পাওয়া যায়। হাতে ঘড়ি। গায়ে জামাটা নেই। ফুলে ফেঁপে কলাগাছ। রমা কাকিমা বহু হাঁটাহাঁটির পরে কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরিটা পায়। নদী তখন খুব ছোটো।


ওপার থেকে নৌকোগুলো ভরা মাসের গর্ভবতী নারীর মতো টালমাটাল অবস্থায় আসে। ঘাটে নোঙর দিয়ে হাঁফ ছাড়ে। তখন দেখলে মনে হবে, এদের যেন প্রসবেই সুখ। ওপারের মানুষজন দেখলেই বোঝা যায় তারা এপারের নয়। শরীর জুড়ে মেঠো গন্ধ— কথায় ইছামতীর টান। তবুও দু-পারের মানুষের মধ্যে মিল আছে। সেটি হল ইছামতী নদীকে তারা রানি মৌমাছির মতো সকলে মিলে ভোগ করছে। উভয় পক্ষই দাবি রাখে— নদী আমাদের। শুধু নদী জানে নদী কারো হয় না। সে শুধু সাগরে মিশবে বলে আবহমান কাল ধরে ঘুরে ঘুরে মরে।

নদীর নাম ‘নদী’ কে রেখেছিল তা নদী জানে না। তবুও একটা মেয়ের নাম ‘নদী’ বলেই বোধ হয় ইছামতীর উপর টান তার দুর্বার। কারণে বিনা-কারণে ওই ঘোলা জল তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে, যেন বলতে চায়— আয় নদী, আমি তোর সখী হব।

জোয়ারের টইটম্বুর জলে যুবতী নারীর মতো ইছামতী যখন নাকের নথ, কানের ঝুমকো নাড়ে; নদীর তখন ভয় করে— এই বুঝি মিলনী সিনেমা হলটা গেল জলের তলায়।

ইছামতী বুঝি নদীর মনের ভাষা বোঝে। উপচে পড়া যৌবনেও তাই সংযত থাকে। এ-সব কত বছর আগের কথা। তবু এখনও তো মিলনী সিনেমা হল আছে। তার পাশে বরফ কল আছে। আছে পাঠাগার। এপারের এই শহরটাতে নেই শুধু নদী। নদী চলে গেছে— অনেক-অনেক দূরের শুকনো খটখটে পাহাড়ের কাছাকাছি। পুরুলিয়ায়। হয়তো এ জীবনে আর তার সাগরে মেশা হবে না। ইছামতীও তার নাব্যতা হারিয়েছে। অনেক জায়গাতেই তার হেজেমজে চড়া পড়েছে। তার উপরে দোর্দণ্ডপ্রতাপে দাঁড়িয়ে আছে ইট-পাথর-সিমেন্টের সেতু। রাতে সারি সারি স্ট্রিট ল্যাম্পগুলোর প্রতিবিম্ব জলে পড়লে খুব সুন্দর দেখায়। তবু নদীর মনে হয়— তুমি যতই খোলস বদলাও না ইছামতী, আর যা-ই হোক— তোমার ওই হেজেমজে যাওয়া কাঙালপানা বুকে নদীর দেমাক মানায় না। বর্ষায় ভরা গাঙে এপার-ওপার করতে মানুষের বুকের ভিতর ঢিপ-ঢিপ করবে না এ কেমনধারা কথা। শেষ ট্রেনের ফিরতি মানুষ এপার থেকে ওপার যেতে গলা ছেড়ে হাঁক দেবে— ও মা-ঝি ভাই… আছ নাকি কেউ?

এ-সব যদি না-ই থাকল তবে আর নদীর মজা কোথায়!


সেতুর উপর দাঁড়িয়ে নদী ঝুঁকে পড়ে কী যেন দ্যাখে। ঘোলা জলে ঠিক দেখা যায় না। তখন নদী ভাবে, অনেক বদলে গেছে এই শহরটা। এখন আর এপার-ওপার বলে কিছু নেই। সবটা মিলে একটা শহর বা শহরতলি। বদলে গেছে নদী নিজেও। বারো বছর আগে সে এই শহর, এই জনপদ, মাঠ-খাল-বিল, জেলখানা মোড়, লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের অসাধারণ ছোলার ডাল আর পরোটা, জলযোগের কালাকাঁদ, টাউন হল, রবীন্দ্র ভবন, ট্যাঙ্কের পুকুর… সব— সব ছেড়ে চলে গেছে। ছেড়ে গেছে দোয়াবকে। মাছের ঘাঁই দেওয়ার মতো আজকাল অবিরাম কী যেন বুকের কাছে ঘাঁই দেয়। মনে মনে বলে—

ইছামতী তোকে এত ভালোবাসতাম! আজও শুধু তোর জন্যই বারবার ছুটে ছুটে আসি এখানে! তুইও আমাকে বাঁধলি না কেন— বললি না কেন— আয় নদী আমরা জীবনভোর বিন্তি খেলে যাই!

সেতুর উপর দাঁড়িয়ে নদী যেন শুনতে পায় ঢাকের বাজনা। বিসর্জনের বাজনা।
দশমীতে মা দুর্গা চলে যাচ্ছেন এই ইছামতীর ভিতর দিয়ে। রাশি রাশি নৌকো, বেলুন, প্রতিমা, আলো আর প্যাণ্ডেলে ভরে আছে ইছামতীর বুক। সেদিন ইছামতীর জোয়ারের টান যতই দশ ফুট উঁচু দিয়ে বয়ে যাক না কেন, ওই দিন মানুষের বশে তাকে থাকতেই হয়। হাসনাবাদ, টাকি, গোসাবা থেকে মাঝিরা সব নৌকো নিয়ে আসে দুটো বেশি রোজগারের আশায়।
সেতুর ওপর থেকে ঝুঁকে ইছামতীর ঘোলা জলে নদী যেন সেই ছবিটাই দেখতে পায়— ‘দুর্গা মাঈকি জয়, আসছে বছর আবার হবে’। সেতুটার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে নদীর ছোটোবেলাকার একটা খেলার কথা খুব মনে পড়ে যায়। নদীর মা যখন নদীকে শম্পাদিদের বাড়িতে রেখে স্কুলে যেতো, তখন শম্পাদিরা তিন ভাইবোন আর নদী মিলে একটা খেলা করত— সবাই মিলেজুলে সুর করে একটা ছড়া বলত—

ঝাপটা পুটি পানের পুটি পা ধুইয়ে দে
ওপার নিবি না এপার নিবি তা বলে দে।

দমকা হওয়ায় নদীর গায়ের আঁচল সরে যায়। কুড়ি-বাইশের একটা ছেলে ওপার থেকে এপারে সাইকেল নিয়ে হুঁশ করে যেতে গিয়ে সেদিকে অনিচ্ছাকৃত একটা দৃষ্টি দিয়ে ফ্যালে। নদী নিজেকে গুছিয়ে নিতে নিতে হঠাৎ মনে হয় তাকে যদি এখন কেউ জিজ্ঞাসা করে— এই নদী এপার নিবি না ওপার নিবি?

নদী জানে এখন আর এপার-ওপার বলে কিছু নেই। দুই পার মিলে এক শহর, এক শহরতলি, এক গ্রাম।

ইছামতীর এপারের পাড় ঘিরে যখন পুরোনো পার্কটা ছিল, রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো নিজেদের মরশুমে লাল-হলুদ ফুলে আলো ক’রে রাখতো, তখন যেন… এই তো ক-দিন আগের ঘটনা। তবু কেমন যেন সব অতীতকাল হয়ে গেছে। কত বার নদীর আর দোয়াবের দেখা হয়েছিল এই পার ঘেঁষে ওই একটু দূরে রাধাচূড়া গাছটা থেকে হাতখানেক দূরত্বে বকুল গাছটার তলায়। নদী ইছামতীর ঘোলা জলে আরেকবার তাকায়, তাকিয়ে তাকিয়ে বিড়বিড় করে— কেন ইছামতী নিজের বুকে সিমেন্ট-ইটের এই মালা গলায় পরলি? কেন আপত্তি করলি না? বিদ্রোহ করলি না? ফেটে পড়লি না হাজার কালনাগিনীর ফণায় ফেনিল হয়ে?

আমি পারিনি, তুইও পারলি না— আমরা দু-জনেই হেরো।


যে-শহরে ছুঁয়েছিল আমার অলিগলি জীবন
সে-শহরকে আমি কখনো ভুলতে পারি?

খুব কান্না পায় নদীর। ইছামতীর ওপারের দিকে তাকিয়ে কয়েক পা হেঁটে এসে বাতাসের কাছে ফিসফিস করে বলে— দোয়াব, আমি নদী। দ্যাখ, আমি ফিরে এসেছি। তোরা কেউ একজন অন্তত একবার বল— নদী, এই শহর এই ইছামতীকে ছেড়ে আর কোনোদিন চলে যাবি না অনেক অনেক দূরের খটখটে পাহাড়ের কাছে।

সেবার যখন স্টিমার চালু হল ইছামতীর বুক— শহর জুড়ে সে কী তিরতিরানি উত্তেজনা! সব মানুষ এবার দু-মিনিটে এপার থেকে ওপার আর ওপার থেকে এপারে পৌঁছে যাবে।

প্রথম দিন নদীকে সঙ্গে নিয়ে দোয়াবের স্টিমারে ওঠার অসম্ভব একটা উত্তেজনা ছিল। সার বেঁধে মানুষজনের সঙ্গে কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে দোয়াবের পিছু পিছু যন্ত্রদানবের উপর এসে দাঁড়ায় নদী। স্টিমারের পাখা জলের সঙ্গে মন্থনে অদ্ভুত ফেনার সৃষ্টি করছিল। স্টিমারের গোঁ গোঁ গর্জন শুনেছিল নদী। দোয়াবের আঙুলে আঙুল জড়িয়ে বলেছিল— দোয়াব, নৌকোগুলো আর চলবে না? খেয়া পারাপার তো তাহলে বন্ধ হয়ে যাবে?

দোয়াব তখন তার নতুন কেনা ক্যামেরাটায় নদীকে স্টিমারের ওপর কোন‌ জায়গায় দাঁড় করিয়ে ফটো তুলবে তার চিন্তায় মশগুল। সে-রাতে নদী একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দ্যাখে। স্টিমারের ভোঁ, জলের শরীর কেটে ঘূর্ণায়মান চাকার পিষ্টানি, খেয়া পারাপারের জলজ শব্দ— সব মিলিয়ে অদ্ভুত একটা সুরের সৃষ্টি করেছে। সুরটা কান্নার নয়, আবার ঠিক হাসিরও নয়। পুরোনো হাসপাতালের ডান দিকের বারান্দার একমাত্র দাবিদার সুন্দরী পাগলীর খ্যাপাটে বিলাপ ‘ঝুমকা গিরা রে’-র সঙ্গে সাদৃশ্য আছে। কিন্তু সবটাই আসছে ইছামতীর ভিতর থেকে। স্বপ্নটার কথা আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে পারেনি নদী। নদী জানে, বললেও কেউ বিশ্বাস করত না।


যে-শহর ছুঁয়েছিল আমার নাভিতট
আমি কী তাকে কখনো ভুলতে পারি!

একদিন স্টিমারে ওপারে গিয়ে, নদীপাড়-বরাবর মিনিট-দশেক হাঁটবার পর দোয়াবকে নদী বলে— জানিস দোয়াব, জোয়ারের জল নেমে গেলে ভাটার সময় ইছামতীর পাড়ের পলিকাদাগুলো দেখলেই কেমন যেন ভালোবাসতে ইচ্ছা করে।
দোয়াব চোখ কপালে তুলে বলে— সে কী রে, আমি জলজ্যান্ত তোর পাশে থাকতে তোর কাদামাটি ভালোবাসতে ইচ্ছা করে?

কত বার ইছামতীর নরম পলিমাটিতে পা রেখে অদ্ভুত শিরশিরানি অনুভূতিতে কেঁপে উঠেছে নদী। তার বিবাহিত জীবনে সরিতের নরম-কঠিন আলিঙ্গনের কত রকম মুদ্রায় ভালোবাসায় গহনাপাতি খুলতে এবং পরতেও এমনটা মনে হয়নি কখনো। এমনকি সেই কম বয়সে দোয়াবের কানের লতি কামড়ে দেওয়ার দিনেও না। নরম পলির শরীরে পায়ের পাতা ডুবিয়ে যখন ছোট তেলিকাঁকড়া আর তে-চোখা মাছগুলো সুড়সুড়ি দিতো— সেই অনুভূতির কথা নদী কখনো কাউকে বলেনি। দূর থেকে দেখা যেতো জলঢোঁড়া সাপগুলো জল কেটে কেটে সর্পিল গতিতে এগিয়ে আসছে। তখন নদীর শরীর-মনে কী যেন কী হয়েছিল— কাকে যেন কাছে পেতে চাইতো নদী— কে সে? পুঁটি মাঝির শক্তপোক্ত, জোয়ান মেজো ছেলেটা পেশি ফুলিয়ে দাঁড় টানত, ওকে দেখে নদীর বারবার ছবির বইতে দেখা হারকিউলিসকে মনে পড়ে যেত।


যে-শহরে নদী বহে যায়— পাড় ভাঙে, ভাঙে মন
সে শহর ছুঁয়ে থাকে আমার এ জীবন…।

ক্ষমতার দম্ভে একটু একটু করে স্টিমারটা ইছামতীর সমস্ত জলটুকুই দখল করে নিল। খেয়া নৌকোগুলো ইটভাটার ইট বওয়া ছাড়া অন্য সময় বেকার। ডিঙি নৌকোগুলো বেশিরভাগই সুন্দরবনের খাঁড়িতে মাছ ধরার জন্য চলে গেছে। দু-চারটে যারা আছে তারাও খুব করুণ দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকে। মিলনী সিনেমা হলের খেয়াঘাটের ঔজ্জ্বল্য যেন এক মাসের মধ্যে নিভু নিভু সন্ধ্যায় পরিণত হয়। ঘাট-কর্তা যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ব্রিজ কোম্পানির সঙ্গে ভিড়ে গেছেন। নদী একদিন পায়ে পায়ে এসেছিল এখানে। লাইব্রেরিতে। বই পালটানোর জন্য। পুঁটি মাঝির মেজো ছেলে সেদিনও নদীকে দেখে বলেছিল— যাবে নাকি মেমসাহেব সংগ্রামপুর ঘাট? অবশ্য আমার নৌকো আর সেই আগের মতো সুপার ফাস্ট মেল ট্রেন নেই। স্টিমার তাকে হারিয়ে দিয়েছে।
শেষ উক্তিটার মধ্যে এমন কিছু ছিল যার জন্য নদী আর সেখানে দাঁড়াতে পারে না। নদী যেন সেদিন থেকে খুব বেশি করে বুঝতে পারে— ইছামতীকে ভালোবাসলে দুঃখ পেতে হবে। এক ধরনের নিরাকার জলজ দুঃখ। যা জীবনভর মোমবাতির ভীরু আলোর মতো তিরতির করে কাঁপতেই থাকবে।

এরপর থেকে সম্পূর্ণ বিনা-কারণেই নদীর সঙ্গে দোয়াবের বাঁধনটা আলগা হতে থাকে। দোয়াব বলত— যুগটা যত লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তুই তত পিছিয়ে যাচ্ছিস!

নদী তর্ক করেনি কোনোদিন; কারণ নদী জানত, দোয়াব যা বলছে— সবটাই সত্যি। তবু নদী পারেনি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বড় হয়ে যেতে।

মনসামঙ্গলের পুঁথিতে বেহুলা ভেসে গিয়েও জিতে গিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। নদী হেরে গেছে। হেরে গেছে ইছামতী। দু-জনের জীবনেরই নাব্যতা হারিয়ে গেছে। শুধু এখন মরা মাছের দৃষ্টি নিয়ে স্থবির জেগে থাকা ইছামতী গলায় পরে আছে সেতুবন্ধনের বরমাল্য। নদীর সঙ্গে দোয়াবের সম্পর্কটা ভেঙে গেল। কেন গেল, নদী জানে না। দোয়াব এই শহরে থাকলেও সে যেন ঠিক এই শহরের বাসিন্দা ছিল না। ইছামতীকে নিয়ে বিরক্তির শেষ ছিল না। কারণ, দোয়াব তখন ওপারে শায়েস্তানগর আর আশপাশের অনেকগুলো মাছের ভেড়ির মালিক। মোটরবাইক নিয়ে রোজ স্টিমার চেপে শায়েস্তানগর যেতে হয়। ফিরতে রাত হলে সমস্যা হয়ে যায়। ইছামতী নদীর মতো আস্তে আস্তে দোয়াবও যেন তার গভীরতা হারিয়ে ফ্যালে। বড় বেশি আবর্জনায় ভরে যাচ্ছিল দোয়াবের জীবন। নদীর ভিতরেও অপেক্ষার পারদটা ওঠা-নামা করতে করতে এক সময় স্থির হয়ে যায়। এরপর একদিন নদীর সংস্কৃত মাস্টারমশাই ছাতা মাথায় দিয়ে নদীর জন্য ‘ভালো ছেলে’-র সম্বন্ধ আনে। হেনা ফুলের গন্ধের মতো কী এক তীব্র অভিমানে নদী যেন আপত্তি করতেও ভুলে যায়। আর এখানেই ইছামতীর সঙ্গে তার মিল। দু-জনেই প্রতিবাদের ভাষা জানে না। বাড়ির গুরুজনেরা বোঝায়, ‘এম. এ. পড়তেই হবে এমন কী মানে আছে? ছোটোবেলায় বাবাকে হারিয়েছিস। তোর মায়েরও বয়স হচ্ছে। সরিৎ খুব ভালো ছেলে, দেখিস তুই সুখি হবি’।

ছোটকা চুপি চুপি জানিয়েছিল— ‘ওদের বাড়ি তো পানিহাটি। সেখানেও নদী আছে। মা গঙ্গা। তোর মন খারাপ হবে না দেখিস!’

কিন্তু কেউ জানত না পূণ্যসলিলা গঙ্গা আকার-আয়তনে যতই মহৎ আর বৃহৎ হোক না কেন, পানিহাটির শ্মশান লাগোয়া ওই অঞ্চলের গঙ্গার জলে শুধু দূষণ আর দূষণ। মানুষ পোড়ার গন্ধ, মাথার খুলি, হাত-পায়ের হাড় ভাঙার ফট ফট শব্দ… গরম ঘিলু গড়িয়ে পড়ার মতো ঘিনঘিনে ব্যাপার। তাই বুঝি নদী অষ্টমঙ্গলায় এসে দু-লিটার মিনারেল ওয়াটার বোতলে ভরে ইছামতীর জল নিয়ে গিয়ে শাশুড়ির পুজোর ঘরে গঙ্গাজলের বোতলের জায়গায় রেখে দিয়েছিল।


শহরে শহরে শুরু হয় রেষারেষি—

জাগে চর। নদী খোঁজে, খুঁজে মরে জলজ জীবন।

নদী চলে গেল। নতুন সংসার, নতুন জীবন। দোয়াবরা সপরিবারেই নিমন্ত্রিত ছিল। দধিমঙ্গল থেকে কণকাঞ্জলি— সব অনুষ্ঠানেই দোয়াবের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বিয়ের পরের দিন যখন নদী আর সরিৎকে নিয়ে নানারকম আচার-অনুষ্ঠান চলছে তখন নদীর ছোটকা খবরের কাগজ হাতে লাফাতে লাফাতে এসে বলে— সেজো বৌদি, কাগজে কী লিখেছে দ্যাখো, আগামী ছ-মাসের মধ্যে ব্রিজ শেষ হবে। তোমাকে আর গাং পেরিয়ে স্কুলে যেতে হবে না। হেঁটে হেঁটে যেতে পারবে। ছোটকার বলার মধ্যে এমন কিছু ছিল যে মনে হচ্ছিল সবাই যেন এখুনি মিছিল করে হেঁটেই এপার থেকে ওপারে চলে যাচ্ছে। সবাই নদী আর সরিৎকে ছেড়ে খবরের কাগজের উপর ঝুঁকে পড়ে। এমনকী সেজো বৌদি, মানে নদীর মা-ও।

অনেক দিন পরে নদী তার বন্ধু তটিনীর কাছে শুনেছিল, দোয়াব নাকি নদীর সঙ্গে সরিতের বিয়েতে বাস্তবিক খুশিই হয়েছিল কারণ সরিতের সঙ্গে কথা বলে সরিৎকে দোয়াবের খুব ভালো ছেলে মনে হয়েছিল। নদী শুধু মনে মনে হেসেছিল। একদিন কথা বলেই সরিৎকে বুঝতে পারলো দোয়াব! অথচ এতদিন নদীর সঙ্গে মিশেও নদীর কান্না শুনতে পেলো না!

একটু একটু করে ইছামতীর উপর ইট, বালি, সিমেন্ট, পাথর, লোহা দিয়ে সেতু গড়ে উঠতে থাকে আর নদীও একটু একটু করে তার সংসার-সেতুকে গড়ে তুলতে থাকে। শুধু মাঝেমধ্যে যখন সে একা একা থাকে তখন যেন শুনতে পায় ইছামতীর গভীর থেকে উঠে আসা খ্যাপাটে এক বিলাপের সুর, যা ঠিক হাসিও না আবার কান্নাও না। পুঁটি মাঝির মেজো ছেলেও বুঝে গেছে, মেমসাহেবের খেয়া করে সংগ্রামপুরের ঘাটে যাওয়ার দিন ফুরিয়ে গেছে; তাই সে এখন রিকশা চালায়।

দিন যায়, রাত যায়, বাঁধা ছকে জীবন চলে। জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে নদী গর্ভবতী হয়। একটু একটু করে গর্ভভারে টালমাটাল হয়ে ওঠে তার জীবন। এমন এক সময় নদীর মা ফোন করে বলে— হ্যালো নদী, আমি মা বলছি, শুনতে পাচ্ছিস তুই? কেমন আছিস তোরা? সরিৎ এ সপ্তাহে বাড়ি ফিরছে? এসময়ে সাবধানে থাকিস মা। আমাদের এখানে দারুণ খবর আছে— কাল ইছামতীর ওপর ব্রিজ উদ্বোধন হবে। তিনজন মন্ত্রী আসবে।

মা-র শেষের দিককার কথাগুলো নদী যেন আর শুনতে পায় না। সে-রাতে নদী ঘুমের মাঝে আবার সেই অদ্ভুত সুরটাকে শুনতে পায়— যা ঠিক কান্নাও না আবার হাসিও না। ভোর রাতের ছেঁড়া-ছেঁড়া ঘুমের ভিতর থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে ব’সে নদী বাথরুমে যেতে গিয়ে আছড়ে পড়ে নদীর গর্ভপাত হয়। নদীকে নিয়ে যখন নার্সিংহোমে যমে-মানুষে টানাটানি চলছে তখন ইছামতীর বুকের উপর মন্ত্রীসান্ত্রীর দল রমরমিয়ে রীতিমতো উৎসবের আয়োজন করে সেতু উদ্বোধন করে যায়। এরপর সরিৎ এসে নদীকে নিয়ে চলে যায় নিজের কর্মস্থল শিলিগুড়িতে। হিমালয়ের কাছাকাছি। নদী শুধু যাওয়ার সময় মিনারেল ওয়াটারের বোতলে ভরা ইছামতীর জলটুকু সঙ্গে নিয়ে যায়।


এই খুকি তোর নাম কী?
ইছামতী।
এই খুকি তোর নাম কী?
ইছামতী।

তারপরের গল্প সবটাই আমাদের জানা। বছর-তিনেক বাদে নদী নতুন করে মা হয়। নদীর কোল আলো করে মোহনা এল। তটিনী এখন বারাসাত গার্লস স্কুলে পড়ায়। এক অধ্যাপকের বউ। দুই ছেলের মা। দোয়াব দু-দুটো মাছের ভেড়ি আর ইটভাটার মালিক। মস্ত তিনতলা বাড়ি করেছে। বিয়েও করেছে। কোলকাতার মেয়ে। নদীর মা-র আর দু-বছর চাকরি আছে। নদীর শ্বশুরবাড়িটা প্রমোটারের হাতে তুলে দেওয়া হবে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সেতুর রেলিংয়ে হেলান দিয়ে পিছন ফিরে দাঁড়ায় নদী। অনেক রিকশা যাত্রী নিয়ে এদিক-ওদিক করছে। সেখানে কোনো চেনা মুখ ভেসে ওঠে না। এমন সময় আগে-পিছে কনভয় নিয়ে কোনো এক মন্ত্রীর গাড়ি হুঁশ করে বেরিয়ে যায়। তেঁতুলিয়াতেও নদীর উপর শিলান্যাস হবে। সেই উপলক্ষ্যে আসা ওদের। নদী পা টেনে-টেনে বাড়িমুখো হাঁটতে চেষ্টা করে। ঠিক সেই সময় অনেক বছর আগের স্বপ্নে দেখা সেই সুরটা ইছামতীর বুকের ভিতর থেকে উঠে আসে। নদীর সুরটাকে চিনতে আর একটুও ভুল হয় না তার। এতে তার মোহনা গায়। ভীমপলশ্রী রাগ। ঝির ঝির বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে নদী দ্রুত লয়ে হাঁটতে থাকে। ইস মেয়েটা যা দুরন্ত হয়েছে, মা একা সামলাতে গিয়ে এতক্ষণে নিশ্চয়ই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।

Facebook Comments

পছন্দের বই