লেখক নয় , লেখাই মূলধন

দীপ্তেন্দু জানার গল্প

ইমলি টোটো

এই নিয়ে কম টিটকিরি তো শুনতে হয়নি! এমনকী পাড়া-প্রতিবেশীরা চরিত্র নিয়ে কথা বলতেও ছাড়েনি! আর বলবে না-ই-বা কেন? নিজের আত্মীয়-স্বজনরাই যখন বিষয়টাকে ভালো চোখে দ্যাখেনি, তখন বাইরের লোকেরা তো দু-পাঁচ কথা বলবেই। ইমলি অবশ্য প্রথম থেকেই তার নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে। বাইরের লোকের কথায় কান দিলে তার চলবে কেন? শুধু মনের ভেতরটা তখনই কালো মেঘে ছেয়ে আসে বৌদি যখন বলে, “শেষ পর্যন্ত বি. এ. পাস করেও তুমি এমন একটা কাজ বেছে নিলে, কী করে তোমার বিয়ে দিই বলো তো? সবই তোমার দাদার জন্য, নইলে কি আজ আমাদের এই দিন দেখতে হত?” তবে ড্রাইভারের সিটে ইমলির মন থেকে কালো মেঘগুলো মুহূর্তেই মুছে যায়। দাদার গন্ধটা তখন সে বেশ টের পায়। বারবার বুক ভরে শ্বাস নেয় সে। টোটোটা তখন রূপকথার কোনো পাখি হয়ে যায়। দু-ডানা মেলে উড়তে থাকে আকাশে।

ইমলি টোটো। বহু কষ্টে ধার-দেনা করে দাদাই টোটোটা কিনেছিল। আর নামও দিয়েছিল নিজের বোনের নামে। আজ দু-বছর হল দাদা ক্যান্সারে মারা গেছে। দাদার শ্বশুরবাড়ির অবস্থাও ভালো নয়। তাই বৌদি চার বছরের পিকলুকে নিয়ে এই সংসারেই রয়ে গিয়েছিল দাদার স্মৃতিকে সম্বল করে। সংসার চালানো যখন দুষ্কর হয়ে উঠেছিল, কলেজের পাঠ চুকিয়ে তখন ইমলিই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল সংসারের যাবতীয় ভার। তাছাড়া দাদাও তো মৃত্যুশয্যায় বলে গিয়েছিল ইমলির হাত ধরে, “তোর বৌদি আর পিকলুকে দেখিস।” সে-সব কথা ভাবলে আজও চোখের কোল ভিজে যায় ইমলির।

বৌদি চা দিয়ে গেছে। সকালবেলা চা খেতে খেতে টিভিতে খবর দেখছিল ইমলি। করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। কোথায় গিয়ে যে থামবে এই মহামারি তা কারোরই জানা নেই। দু-মাস হল ঘরবন্দী গোটা দেশ। মানুষই যখন ঘর থেকে বার হচ্ছে না, তখন টোটোতেই-বা চাপবে কে? তাই দু-মাস আজ রোজগার নেই। হাতে যেটুকু জমানো পুঁজি ছিল তা ভাঙিয়েই এই দু-মাস সংসার চালিয়েছে ইমলি। চা খেতে খেতে ইমলি ভাবছিল, এইরকম পরিস্থিতি চললে চা-বিস্কুট খাওয়ার পাঠটাও চুকিয়ে দিতে হবে। যেটুকু সাশ্রয় হয়!

দশ বারো দিন হয়ে গেল ইমলি বাড়ি থেকে বের হয়নি। আজ একটু বাজারে না গেলেই নয়। এই লকডাউনে সব থেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছে পিকলুটা। বেচারা মাছ ছাড়া ভাত খেতেই পারে না। অথচ কিচ্ছু করার নেই। তার ওপর না পারছে স্কুলে যেতে, না পারছে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করতে যেতে।

টিভিটা বন্ধ করে ইমলি বাজারে যাবার জন্য তৈরি হতে লাগল। ব্যাগ নিয়ে ইমলিকে বেরোতে দেখে বৌদি বলল, “বাজারে যাচ্ছ? এই নাও বাজারের ফর্দ। আর মনে করে মাস্ক পরে যেয়ো। বেশি ভিড়ভাট্টায় যেয়ো না। আমাদের এলাকাতেও তো করোনা রোগী ধরা পড়েছে। কবে যে করোনার ওষুধ তৈরি হবে কে জানে!”

বাড়ি থেকে বাজার বেশি দূর নয়। তাই পায়ে হেঁটেই এসেছে ইমলি। রাস্তায় দু-একজন মুখোশ পরা লোকজন ছাড়া তেমন কাউকেই চোখে পড়েনি। বাজারে পৌঁছে প্রথমেই ওর চোখ গেল টোটো স্ট্যান্ডের দিকে। চারিদিক শুনশান। সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। যেটুকু ভিড় তা ওই মুদি দোকানে, সবজি আর মাছের বাজারে।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাজার সেরে ফেলল ইমলি। ন-টা পঁয়তাল্লিশ। ইমলি মোবাইলে টাইমটা দেখল। লকডাউনের আগে যে-বাজার সব সময় লোকে গমগম করত সেই বাজার এখন খাঁ খাঁ করছে। ইমলির মোটেও ভালো লাগছিল না। সে আবার মোবাইলের দিকে তাকালো। ন-টা বেজে পঞ্চাশ। না, ফোনটা আজও এল না। যে-ফোনটা লক ডাউনের আগে ন-টা পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ নাগাদ একবার বেজে উঠতই সেও আজ বোবা। এখন তো স্কুল-কলেজ সব ছুটি। ফোনটা আসবেই-বা কেন! নিজের অস্থির মনটাকে শান্ত করার চেষ্টা করল ইমলি।

বাড়ি ফিরেই ভালো করে সাবান দিয়ে হাত পা ধুয়ে ফ্যানের তলায় এসে বসল ইমলি। এই সকালেই রোদের যা তেজ! উঠোনে পড়ে আছে টোটোটা। প্লাস্টিকের চাদরে ঢাকা। ইমলির মনে হল টোটোটা যেন অযত্নে পড়ে আছে কতদিন। আজ একটু ধোয়ামোছা করতে মন চাইছে তার। টোটো ধোয়ামোছা করতে দেখে বৌদি ঘর থেকে বেরিয়ে ইমলিকে বলল, “আরে এই ক-দিন আগেই তো তুমি টোটোটাকে ধুয়ে-মুছে প্লাস্টিকের চাদরে মুড়ে রাখলে। আজ আবার ধোয়ামোছা কেন? রাস্তায় তো বেরও হয়নি গাড়িটা।” বৌদির কথায় ইমলি বলল, “ও তুমি বুঝবে না বৌদি।” “আমি সব বুঝি ইমলি। যা পারো করো!”— কিছুটা যেন বিরক্ত হয়ে বৌদি ঘরে সেঁধিয়ে গেল। ধোয়ামোছা করতে করতেই ইমলি শুনতে পেল বৌদি হেঁসেলে গজ গজ করছে, “দু-মাস হল এক টাকাও রোজগার নেই, বিলাসিতা করে অত মাছ আনার কী দরকার আছে বাবু? মাছ না খেলে কি বাবুদের চলছিল না?”

ইমলি বোঝে বৌদির এই গজ গজ করার কারণ। বৌদি ভালো করেই জানে মাছটা কার জন্য আনা হয়েছে। তবুও গজ গজ করছে। অল্প বয়সে স্বামীকে হারালে একটা স্ত্রী যে কতখানি অসহায় হয়ে পড়ে, তা ভালোই বোঝে ইমলি। তার ওপর ননদের টোটো চালিয়ে রোজগার করা টাকায় নিজের সংসার চালানো— এটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারে না বৌদি। বৌদি চায় ইমলি বিয়ে-থা করে সংসারী হোক। এদিকে মেয়ে টোটো চালায় শুনে একটার পর একটা ভালো সম্বন্ধ ভেস্তে যাচ্ছে। বৌদির এই অসহায় অবস্থার কথা ভাবলেই ইমলি মনে মনে কষ্ট পায়। তাই তো সে আরও আঁকড়ে ধরে টোটোটাকে।

টোটো ধোয়ামোছা শেষ। টোটোটাকে একবার স্টার্ট দিয়ে দেখার জন্য ইমলি ড্রাইভারের সিটে চড়ে বসল। কিন্তু কী আশ্চর্য! আজ তো ইমলি দাদার গায়ের গন্ধটা পাচ্ছে না। ড্রাইভারের সিটে বসলেই যে-গন্ধটা ও সব সময় পায়। গন্ধটা না পেয়ে ইমলির মনটা খারাপ হয়ে গেল। টোটোটাকে আর স্টার্ট দিতে ইচ্ছে করল না। টোটো থেকে নামতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে ইমলির নাকে এল একটা অন্য গন্ধ। এরকমটা তো আগে কখনো হয়নি। কিন্তু এই গন্ধটাও তার খুব চেনা চেনা লাগছে। মনে করার চেষ্টা করল গন্ধটা এর আগে কোথায় পেয়েছিল সে। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। এ তো সেই দশটা পাঁচের প্যাসেঞ্জারের গায়ের গন্ধ। প্রতিদিন টোটো ভাড়া নেওয়ার সময় এই গন্ধটা তার কাছ থেকে পেত সে।

সুমন এখানকার একটা স্কুলে শিক্ষকতা করে। প্রতিদিন বাস থেকে নেমে দশটা পাঁচে ইমলির টোটোয় চড়ে স্কুলে যাতায়াত করে গত দেড় বছর ধরে। টোটোয় একটা সিট রাখার জন্য সুমন প্রতিদিন ন-টা পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ নাগাদ ইমলিকে ফোন করে জানায়। ইমলি কতবার বলেছে রোজ রোজ ফোন করার দরকার নেই। ফোন না করলেও ইমলি তার জন্য একটা সিট ঠিক রেখে দেবে। তবুও সুমন ফোনটা করে নিয়মিত। ইমলিও ফোনটার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। ওদের মধ্যে একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এই ক-দিনে। সুমন ইমলিকে টোটো ম্যাডাম বলে ডাকে। আর ইমলিও সুমনকে দশটা পাঁচের প্যাসেঞ্জার বলে ডাকে। সুমনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ এই সহজ সম্পর্কটুকুই তো ছিল ইমলির জীবনে একটা খোলা জানালার মতো। যে-জানালা দিয়ে আসত তাজা বাতাস। করোনা মহামারি সেই জানালাটাকেও বন্ধ করে দিতে বাধ্য করেছে।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ইমলি একটা গল্পের বই পড়ছিল এমন সময় বৌদি এসে কাঁধে হাত রাখতেই ইমলি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, “কিছু বলবে বৌদি?”

— বলছিলাম কি মেয়েদের রূপ আর যৌবন চিরকাল থাকে না…

— কী বলতে চাইছ বলো তো?

— বলছি এটাই তোমার বিয়ের উপযুক্ত বয়স। তুমি শিক্ষিতা। সুন্দরী। ঠিকঠাক খোঁজ করলে একটা না একটা ভালো পাত্র ঠিক জুটেই যাবে। তাই বলি কি নিজের ভবিষ্যৎটাকে এভাবে মাটি কোরো না।

— উফ্‌ বৌদি! একই ঘ্যান ঘ্যান সব সময় ভালো লাগে না।

— বিয়েতে তোমার এত আপত্তি কীসের বলো তো?

ইমলি মনে মনে ভাবল, আমি বিয়ে করে নিলে এই সংসারটার কী হবে? কিন্তু সে-কথা মুখ ফুটে বলতে পারল না। হাসতে হাসতে বৌদিকে বলল, “আমি বিয়ে করে নিলে আমার টোটোর কী হবে বৌদি?”

“টোটো। টোটো। টোটো। টোটোটাই হয়েছে যত আপদ।”— বৌদি গজ গজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বৌদি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই আবার সেই গন্ধটা নাকে এল। দশটা পাঁচের প্যাসেঞ্জারের গায়ের মিষ্টি গন্ধটা। ইমলি বুক ভরে শ্বাস নিল কয়েকবার। আর তখনই ফোনের রিংটোনটা বেজে উঠল। ফোনটা আসায় ইমলি যারপরনাই খুশি হলেও কোনোরকম উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করেই বলল, “হ্যালো… আপনি!”

— হ্যাঁ আমি। চিনতে পেরেছেন তাহলে। কেমন আছেন?

— ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

— এমনিতে সবই ঠিক আছে। তবে গৃহবন্দী অবস্থায় হাঁপিয়ে উঠছি। যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি?

— বলুন…

— আপনার জন্য ছেলে দেখেছি। বিয়ে করবেন?

— এ তো মহা জ্বালা হল দেখছি! বাড়িতে বৌদির হাত থেকে নিস্তার নেই। তারপর আবার আপনিও আমার বিয়ে নিয়ে পড়েছেন। কেন বলুন তো?

— বিয়ে তো সবাই করে। আপনি কি বিয়ে করবেন না?

— না। না। না। আমি কোনোদিন বিয়ে করব না। বুঝেছেন?

— যে-ছেলেটা আপনাকে পছন্দ করে… আই মিন… ভালোবাসে, তাকেও বিয়ে করবেন না? আপনি না বিয়ে করলে সেও কিন্তু চিরকাল ব্যাচেলার থেকে যাবে।

— আমাকে পছন্দ করে… আমাকে ভালোবাসে… কে সেই ব্যক্তি শুনি?

— যদি বলি আমি।

— অসম্ভব!

— অসম্ভব কেন? বাধা কোথায়?

— কেন আপনি বোঝেন না? আপনার-আমার মাঝখানে আস্ত একটা টোটো বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

— আমার দিক থেকে বা আমার বাড়ির লোকজনের দিক থেকে টোটোটা কোনো বাধাই নয়…

ফোনের উলটো প্রান্ত থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরকে থামিয়ে দিয়ে ইমলি বলে উঠল, “শুনুন। আমি আপনার টোটো ম্যাডাম। আপনি আমার দশটা পাঁচের প্যাসেঞ্জার। এটুকুই আমি জানি। এই মহামারির পরেও যদি বেঁচে থাকি আমি আপনার টোটো ম্যাডামই থাকব। আপনি আমার দশটা পাঁচের প্যাসেঞ্জার থাকবেন তো? কথাটা শেষ করেই উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোনটা টুক করে কেটে দিল ইমলি।

ফোনটা কেটে দিয়ে ইমলি বুক ভরে শ্বাস নিল। মিষ্টি গন্ধটা এখনও ঘর থেকে যায়নি।

Facebook Comments

পছন্দের বই