লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অরূপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক: জলসাঘর

আগমনী ও বিজয়া সংগীত

বাংলার ঋতুচক্রে শরৎ ঋতু তথা আশ্বিন মাস বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসবের আগমন বার্তা বয়ে আনে। বর্ষা শেষের মেঘমুক্ত আকাশ ও মাঠে মাঠে কাশ ফুলের অনাবিল সৌন্দর্য উৎসবের চিত্রকল্প সৃষ্টি করে। এই শরতের সাথেই জড়িয়ে রয়েছে বাংলা গানের এক বিশেষ ধারার যা আগমনী ও বিজয়া সংগীত নামেই খ্যাত। এই সংগীত শাক্ত পদাবলীর অন্তর্গত ও কাব্যগুণে এই পদাবলীর অন্যান্য পর্যায়ের গানের তুলনায় নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ।

আগমনী পর্যায়ের পদগুলির দু-টি স্তবক। প্রথমটিকে পূর্ব আগমনী ও অন্যটিকে উত্তর আগমনী বলা হয়। পূর্ব আগমনী পর্যায়ের পদগুলিতে শরতের আগমনে মা মেনকার অন্তর উতলা; সন্তানকে পিত্রালয়ে আনার জন্য ব্যাকুলতা; কন্যাকে পিতৃগৃহে আনার জন্য স্বামীকে উদ্যোগী হবার কাতর অনুনয়; স্বপ্নে কন্যাকে দ্যাখা ও কন্যার দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে অকারণে উদ্বেগ ইত্যাদির কথা প্রকাশ পায়। উত্তর আগমনীতে দেখা যায় মা ও মেয়ের মিলন। দীর্ঘ এক বছর প্রতীক্ষার পরে মা ও মেয়ের সাক্ষাৎ ও আনন্দাশ্রুর মাধ্যমে এই বিরহের অবসান। পূর্ব আগমনীতে দু-টি মুখ্য চরিত্র— মেনকা ও গিরিরাজ। উত্তর আগমনীতে মেনকা ও উমা বা পার্বতী। এর সাথে কিছু পার্শ্ব চরিত্রের উল্লেখ কোনো কোনো পদে আমরা পাই, যেমন হর বা শিব এবং উমার সখী জয়া বিজয়া। এই পদ বা গানগুলিকে যদি ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব হয় তবে একটা সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, আগমনী ও বিজয়ার পদগুলি সামগ্রিকভাবে একই আখ্যান অর্থাৎ, একটি নাটকের মতো। প্রথম পর্বে মায়ের অদর্শনের যন্ত্রণা, তারপরে মা ও মেয়ের মিলন, তিন দিনের জন্য পিতৃগৃহে মেয়ের অবস্থান ও শেষ পর্বে বিদায়। এই গান বা নাটক মূলত দু-টি পরিবারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে— কৈলাস ও হিমালয়। আগমনী গানে যেন বাংলার প্রতিটি পরিবারের কথা বলা আছে। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের পরিকাঠামোয় আমরা সবাইকে একসাথে নিয়ে বাস করি, শুধু কন্যাকে পরগোত্র করে দিই। সেই কন্যা সন্তানকে দ্যাখার ও ক-দিনের জন্য কাছে পাবার বাসনা যেন এই আগমনী গানে ব্যক্ত হয়েছে।

শাক্ত পদাবলীর অন্যান্য পর্যায়ের গান বা পদের মতো আগমনী ও বিজয়াতেও একটা তত্ত্ব বর্তমান। তত্ত্বটি হল শক্তিরূপিনী ও চৈতন্যরূপিনী দেবী মায়ের বিরাজস্থান থেকে লীলার টানে মর্ত্যে আগমন ও লীলাসমাপনে স্বস্থানে গমন। এই যে উমা-পার্বতীর সাথে মানবী-দেবীর সহজ সমন্বয়; সেই সমন্বয় সাধনার পটভূমিতে সৃষ্টি হয়েছে আমাদের বাংলাদেশের আগমনী-বিজয়া সংগীত।

আগমনী পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত পদ বা গানে আমরা অনেক বৈচিত্র্য খুঁজে পাই। এর কারণ, শরতের প্রথম আবির্ভাব থেকে শারদ শুক্লপক্ষের বোধন পর্যন্ত আগমনী গানের সময়সীমা। কিন্তু বিজয়ার গানের স্থায়িত্ব মাত্র দু’দিনের – নবমী নিশি থেকে দশমী অবধি। এই বৈচিত্র্য লক্ষ করা যাবে নিম্নলিখিত কিছু আগমনী গানের কলি থেকে:

প্রকৃতিতে আগমনীর সুর—

সোনালি শারদ প্রভাতেরই আলো
জানাল কাহার আগমনী
শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গলগান
বাজায় যে তার জয়ধ্বনি।।
(পদকর্তা: সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়)

মায়ের হৃদয়ের আকুতি—

বর্ষা গেল আশ্বিন এল উমা এল কই
শূন্য ঘরে কেমন করে পরান বেঁধে রই।।
(পদকর্তা: কাজী নজরুল ইসলাম)

স্বামীকে অনুনয়—

গিরি এ কী তব বিবেচনা
গেল সম্বৎসর হয় না অবসর
গৌরী আনার কথা
মনে তো হল না।।

(প্রচলিত রচনা)

আমার আনন্দিনী উমা আজও
এল না তার মায়ের কাছে
হে গিরিরাজ দেখে এসো
কৈলাসে মা কেমন আছে।।
(পদকর্তা: কাজী নজরুল ইসলাম)

গিরি কি অচল হলে আনিতে উমারে
না হেরি তনয়া মুখ হৃদয় বিদারে।
(পদকর্তা: রামনিধি গুপ্ত)

কন্যার দুর্ভাগ্যের জন্য ভাবনা—

নাই শাশুড়ী ননদ উমার
কেউ আদর করার নাই
অনাদরে কালী সেজে বেড়ায় বুঝি তাই।।
(প্রচলিত রচনা)

স্বপ্নে কন্যার স্মৃতি—

গিরিরাজ স্বপনে দেখেছি উমারে
যেন কৈলাস ছাড়িয়া উমা
এসেছে আমারই দ্বারে।।
(প্রচলিত রচনা)

কুস্বপন দেখেছি গিরি
উমা আমার শ্মশানবাসী
অসিত বরণা উমা
মুখে অট্ট অট্টহাসি।।
(পদকর্তা: গিরিশচন্দ্র ঘোষ)

কন্যার প্রতি অধিকারবোধ—

এবার আমার উমা এলে
আর উমায় পাঠাব না
বলে বলবে লোকে মন্দ
কারো কথা শুনব না।।
(পদকর্তা: রামপ্রসাদ সেন)

পত্নীর এই বিরহ যন্ত্রণা দেখে গিরিরাজ তাঁর পত্নীকে গানের মাধ্যমে এইভাবে বলছেন:

বারে বারে কহো রানি গৌরী আনিবারে
জানো তো জামাতার রীত অশেষ প্রকারে।
(প্রচলিত রচনা)

আবার মাতৃ অদর্শনে আকুল উমা স্বামীর কাছে অনুনয় করছেন মাত্র কয়েকদিন পিত্রালয়ে যাবার অনুমতি দেবার জন্য। গানটি হল:

হর করো অনুমতি যাই হিমালয়
জনক জননী বিনে বিদীর্ণ হৃদয়।।
(প্রচলিত রচনা)

প্রত্যুত্তরে হর তাঁর প্রিয়তমা পত্নী উমাকে বলছেন:

জনক ভবনে যাবে ভাবনা কী তার?
আমি তব সঙ্গে যাব কেন ভাবো আর।
আহা আহা মরি মরি বিরস বদন করি
প্রাণাধিকে প্রাণেশ্বরী কেঁদো নাকো আর।।
(পদকর্তা: ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত)

অবশেষে গিরিরাজ কন্যা উমাকে তাঁর মা মেনকার কাছে এই বলে সমর্পণ করেন:

গিরিরানি এই নাও তোমার উমারে
ধর ধর হরের জীবন ধন।
কত না মিনতি করি
তুষিয়ে ত্রিশূলধারী
প্রাণ-উমা আনিলাম নিজ-পুরে।।
(পদকর্তা: কমলাকান্ত)

এমনই নানান ভাব ও রসে সম্পৃক্ত হয়ে আছে পূর্ব আগমনী পর্যায়ের গানগুলি।

উত্তর আগমনী পর্যায়ের কিছু উল্লেখযোগ্য গান:

দ্যাখো না নয়নে গিরি গৌরী আমার সেজে এল
দ্বিভুজা ছিল যে-উমা দশভুজা কবে হল?
(পদকর্তা: দাশরথী রায়)

সপ্তমী তিথির গান:

শারদ সপ্তমী ঊষা গগনেতে প্রকাশিল
দশদিক আলো করি দশভুজা মা আসিল।।
(প্রচলিত রচনা)

অষ্টমী তিথির গান:

দেখে যা আনন্দময়ী আমার ভুবনে
ষষ্ঠী আদি কল্প হল সপ্তমীর নিশি গেল
আজিকে অষ্টমী হল পূজা প্রাঙ্গণে।।
(প্রচলিত রচনা)

নবমী নিশি থেকে মাতৃহৃদয়ে বিচ্ছেদের ব্যথা দেখা দেয়। আর মাত্র একদিন, তারপরেই কন্যা পতিগৃহে যাত্রা করবে। আবার সেই দীর্ঘ এক বছরের প্রতীক্ষা।

নবমী নিশির ব্যথা ধরা আছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা ‘বিজয়া দশমী’ সনেটে।

যেয়ো না রজনী আজি লয়ে তারাদলে
গেলে তুমি দয়াময়ী এ পরান যাবে
উদিলে নির্দয় রবি উদয় অচলে
নয়নের মণি মোর নয়নে হারাবে।।

পূর্ব আগমনী ও উত্তর আগমনী পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটে বিজয়া সংগীতের মাধ্যমে। বিজয়া সংগীতে মায়ের অন্তরের কথাগুলি যেন ব্যথা হয়ে ঝরে পড়ে। মাত্র তিন দিনের জন্য এই দেখা সারা বছরের অদর্শনের জ্বালা ঘোচাতে পারে না। তাই মেনকার বিলাপ এই সংগীতের প্রতি ছত্রে অশ্রুধার হয়ে ধরা দেয়:

সত্যি নাকি যাবি উমা
আমার পাষানপুরী শ্মশান করে?
আবার কবে দেখা হবে
দেখি বারেক নয়ন ভরে।।
(প্রচলিত রচনা)

এসো মা এসো মা উমা
বোলো না আর যাই যাই
মায়ের কাছে হৈমবতী
ও কথা তো বলতে নাই।
বৎসরান্তে আসিস আবার
ভুলিস নে মা উমা আমার
চন্দ্রাননে যেন আবার
মধুর মা ডাক শুনতে পাই।
(পদকর্তা: জ্ঞানদাস)

এ যেন শুধু মা মেনকার হৃদয়ের আর্তি নয়, প্রতি ঘরের মায়েদের তাঁদের কন্যাবিচ্ছেদের জ্বালা বিজয়ার গানে ধরা আছে। তাই দশমী সমাপনে দেবী প্রতিমা বিসর্জনের সময় বহু মায়ের চোখ অজান্তেই অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। দেবী তখন মানবী তথা ঘরের কন্যায় পর্যবসিত হন।

দু-পক্ষকাল ঘিরে এই যে লোকগাথা একটি বিশেষ ধারার সংগীতের মাধ্যমে ফুটে ওঠে, কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে সমগ্র বিশ্বের সংগীতের ইতিহাসে এমন সৃষ্টির কথা জানা যায় না। তবে আক্ষেপের কথা, শাক্ত পদাবলীর দুই বিখ্যাত পদকর্তা সাধক রামপ্রসাদ ও কমলাকান্ত রচিত আগমনী ও বিজয়া সংগীতের সংখ্যা খুব কম। অধিকাংশ গানেরই পদকর্তা এঁদের তুলনায় অখ্যাত ছিলেন। এছাড়া বাউল সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ এই ধরনের গানের সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু সঠিকভাবে তথ্য সংরক্ষিত না হওয়ার ফলে অধিকাংশ রচয়িতার নাম অজ্ঞাত। সেই কারণে এই গানগুলি পরিবেশনার সময় পদকর্তার নামের বদলে ‘প্রচলিত সংগীত’ এই কথাটা ব্যবহৃত হয়।

সবশেষে যে-কথা না বললেই নয়— এই পর্যায়ের গানগুলি পরিবেশনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো অন্তরায় হচ্ছে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় ছাড়া এই গান গাওয়া যায় না। তার উপর বর্তমান প্রজন্ম এই ধারার গানের চর্চায় আগ্রহী নয় এবং শ্রোতাদের অনুৎসাহও এই গানের ধারাকে ধীরে ধীরে সংকুচিত করে দিচ্ছে। এর সাথে আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়তো জড়িত রয়েছে। এইসব কারণেই অদূর ভবিষ্যতে এত সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী লোকগাথা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে এবং শারদোৎসবের প্রাক্কালে ও সমাপনে বাতাস মুখরিত করে আগমনী ও বিজয়ার সুর আর ধ্বনিত হবে না।

তথ্যসূত্র:

শাক্ত পদাবলী/ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায়

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

ষষ্ঠ পর্ব

সপ্তম পর্ব

Facebook Comments

পছন্দের বই