লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অলোকপর্ণার ধারাবাহিক উপন্যাস: আফিম (দ্বিতীয় পর্ব)

আমাদের কোনো শাখা নেই, কোনো শাখা নেই

বড়োমেয়ে ফিরেছে আধা ঘণ্টা হল। দোরে দোরে আলো জ্বলে উঠেছে। জাহান আরা বড়ো মেয়ের সামনে মুড়ির বাটি রেখে বেরোতে গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ে। বড়ো মেয়ে জানে এই থমকে যাওয়ার মানে।
‘কত টাকা লাগবে?’ বলে মুখে মুড়ি ভরে রোশন আরা তাকিয়ে থাকে জাহান আরার দিকে।
ছোটোমেয়ে মনে মনে হিসেব করে বলে, ‘আড়াইশ,’
মুড়ি চিবোতে চিবোতে রোশন আরা অফিসের ব্যাগ খোলে। ব্যাগের ভিতরের ব্যাগ খোলে। তার ভিতর থেকে বের করে আনে পয়সার ব্যাগ। গুনে গুনে আড়াইশো টাকা ছোটোমেয়ের হাতে প্রদান করে মুড়ি চিবোতে চিবোতেই। প্রজাপতির মতো ফড় ফড় হয়ে জাহান আরা কড়কড়ে টাকাগুলো গোনে।
রোশন আরা জানতে চায়, ‘আম্মু কই?’
‘কী জানি! বিকেলে বেরইচে, কিছু কয়ে যায় নাই’
রোশন আরা মুখে আরও এক মুঠো মুড়ি ভরে দেয়। জাহান আরা প্রজাপতির বেগে ঘর ছাড়ে।
ফটকের দরজা খোলার আওয়াজ হয় ঠিক তখন। রশিদা বেগমের তন্দ্রা ছুটে যায়। ফটক খোলার আওয়াজ অনুসারে তিনি বুঝতে পারেন করিমন বিবি ফিরেছে। আট বছর ধরে বিছানায় বসে বসে রশিদা বেগম মুখস্থ করেছেন বাড়ির প্রত্যেক মানুষের ফটকের দরজা খোলার ভিন্নতর আওয়াজ। এখন তিনি আধেক ঘুমেও বুঝে যান ঘরেতে বড়োমেয়ে এল না করিমন বিবি এল নাকি কোনো ভ্রমর এল… গুনগুনিয়ে।
ফটক খোলার আওয়াজে রশিদা বেগমের তন্দ্রা টুটে গেল। উঠে ভ্রূ কুঞ্চিত আট হাত পা ওয়ালা মাকড়শার মতো বিছানায় থেবড়ে বসলেন তিনি। গত আট বছর ধরে রশিদা বেগম চেষ্টা করেন কোনোভাবে সন্ধ্যে আর রাতকে ঘুমের প্রলেপ লাগিয়ে মিলিয়ে মিশিয়ে দিতে। অফুরন্ত সময়কে ফুরিয়ে দেওয়ার এ এক প্রচেষ্টা। সকালের পর দুপুর, দুপুরের পর বিকেল, বিকেলের পর সরাসরি রাত নামে রশিদা বেগমের জীবনে প্রায় বছর আটেক হল। প্রায় বছর আটেক রশিদা বেগমের জীবনে কোনো স্বর্নালী সন্ধ্যা নেই। রশিদা বেগম মনে করেন বিকেল তৈরি হয়েছে শিশুদের জন্য। এছাড়া বিকেল কারো কোনো কাজে আসে না। আর সন্ধ্যে তৈরি হয়েছে বাড়ির মেয়েমানুষ করিমন বিবিদের তরে।
ভ্রূ কুঞ্চিত রশিদা বেগম বাজখাই কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘কই গেছিলা,’
করিমন বিবির ক্লান্ত স্বর শোনা যায়, ‘জাহান্নামে’
রশিদা বেগম আবার গুম মেরে যান।
রোশন আরা এই বাক্যালাপ শুনেও চুপ করে থাকে। ইদানীং চুপ করে থাকা তার অন্যতম এক শখ।

চিত্র: সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

যেদিন করিমন বিবি সুলেইমান রেজাকে বিয়া করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, সেদিন থেকে খাওয়ার টেবিলে কথা চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। নির্বাক মাছের টুকরোরা নির্বাক থালা থেকে উঠে নির্বাক মুখগহ্বরে চলে যায়। নির্বাক ভাতের দানা হাতের আঙুলে নিশ্চল লেগে থাকে। চুপ করে থাকতে থাকতে খাওয়ার টেবিলে বসে করিমন বিবি লক্ষ করে, ধীরে ধীরে তার গ্রীবা লম্বা হচ্ছে। স্বরহীন ভাবনারা আনাগোনা করছে তার জটিল মস্তিস্কে। গলা লম্বা হয়ে খাবার টেবিল ছাড়িয়ে বহু ঊর্ধ্বে উঠে যায় তার মাথা,— সিলিঙে গিয়ে ঠেকে। উঁচু থেকে করিমন জিরাফ দেখে বড়োমেয়ে ছোটোমেয়ে চুপচাপ ভাত খেয়ে ফেলছে। উঁচু থেকে করিমন জিরাফ দেখে বড়োমেয়ে ছোটোমেয়ে দিনের পর দিন, দিনের পর দিন কেমন বোবা হয়ে যাচ্ছে। করিমন জিরাফ উঁচু থেকে বড়োমেয়ে ছোটোমেয়ের জিরাফ হয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে দ্রুত হাতে ভাত খায়।
ভাত খাওয়া হলে করিমন জিরাফ হেঁটে হেঁটে কলপাড়ে আসে।
হাত ধোওয়া হলে করিমন জিরাফ শাড়ির আঁচলে বেঁধে রাখা কাগজের মোড়ক খোলে।
কাগজের মোড়ক খোলা হলে করিমন জিরাফ নিজের তলপেটে একহাত রাখে।
তলপেটে হাত রাখা হলে করিমন জিরাফ নিজের মুখে মোড়ক থেকে বের করা আতর ও সিঁদুর মাখানো পুষ্প পুরে দেয়।
করিমন জিরাফ কচ কচ করে আতর-সিঁদুরভেজা পুষ্প খেয়ে চলে আর দুপুরের কাকের কথা ভাবে… নিজের পেটের মধ্যে বারংবার তীক্ষ্ণ চঞ্চু ভরে দেওয়া কাক!

স্বপ্নের ভিতর রোশন আরা আব্বুকে দেখতে পেল। সাদা কুর্তা পাঞ্জাবি পরে বৃত্তাকার পথে সাইকেল চালিয়ে রোশন আরাকে পাক খেয়ে বেরানো আব্বু। ঠোঁটে দরাজ হাসি ঝুলিয়ে রাখা আব্বু। তেলে চকচকে কালো চুলের আব্বু। এ-সব স্বপ্নে রোশন আরার ঘুম ভাঙে না আর। কারণ সে অনেক আগেই জেনে গেছে সে যা দেখছে তা স্বপ্নই। আব্বুর স্বপ্ন। স্বপ্ন ছাড়া তার আব্বুকে এখন আর কোথাও দেখা যায় না।
তবু আজ তার ঘুম ভাঙে। কলপাড় থেকে বমি করার আওয়াজ আসছে। শয্যা ছেড়ে টলতে টলতে সেদিকে হেঁটে যায় রোশন আরা। দেখে রান্নাঘরের দরজা খোলা আর কলপাড়ে টিউবওয়েলের গায়ে একহাতে ভর রেখে করিমন বিবি নিজেকে উগড়ে দিচ্ছে।
স্খলিত পায়ে করিমন বিবির দিকে এগিয়ে যায় রোশন আরা। তাকে দেখে করিমন বিবি আরেক হাত উঁচিয়ে ইশারায় কাছে আসতে মানা করে। করিমন বিবির বমি করা দেখতে দেখতে রোশন আরা বুকের কাছ থেকে নাইটিটা তুলে ধরে নাকে চাপা দেয় আর কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করে,— করিমন বিবির বমিতে সুবহানআল্লা আতরের খুশবু! করিমন বিবি টক টক আতরগন্ধী সিঁদুর মাখানো রাতের মাছভাত, ফুলপুষ্প পৃথিবীর মাটিতে বৃষ্টি করে দিচ্ছে।
বমির আওয়াজের মাঝে দাঁড়িয়ে রোশন আরা আকাশপানে চায়। আব্বুর কথা আবার মনে আসে তার। রোশন আরা অনুভব করে, আজ আব্বু থাকলে সুলেইমান রেজা;— না আসত তাদের জীবনে, না আসত করিমন বিবির গর্ভে। রোশন আরার গায়ের পশম খাঁড়া হয়ে যায়। বমির আওয়াজের মাঝে দাঁড়িয়ে, আতরের গন্ধের মাঝে দাঁড়িয়ে, রোশন আরা আবিষ্কার করে,— করিমন বিবির গর্ভে সুলেইমান রেজা আসতেছে!
রোশন আরার মনের কথা ঘরের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়। আধেক ঘুমে রশিদা বেগম বিড়বিড় করেন, ‘ইন্না লিল্লা…’

টমি বাদে বাড়ির সকলে চুপ। করিমন বিবি গড়িয়ে গড়িয়ে দিন কাটায়। রশিদা বেগম ঘোরের মধ্যে চেয়ে থাকেন। জাহান আরা রান্না ঘরের হাঁড়ি পাতিল নাড়াচাড়া করতে করতে লুবোর কথা ভাবে চুপচাপ। রোশন আরা অফিসে যায় আর আসে। আসে আর যায়। সবাই সবার থেকে যোজন খানেক দূরে সরে থাকে, পাছে কেউ কাউকে ছুঁয়ে এঁটো করে দেয়!
হিজল গাছের পাতা নড়ে। করিমন বিবির মাথা নড়ে। মাথা নাড়তে নাড়তে করিমন হাতি টের পায় এমাসেও মাসিক হল না। সুলেইমান রেজা গত তিন মাস হল ফোনে ফোনে ভালোবাসা পাঠাচ্ছে, টাকা পাঠাচ্ছে না। করিমন হাতি শুঁড় তুলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। রশিদা বেগম আট হাত পা নিয়ে থেবড়ে বসে খেয়াল করেন, আজকাল এবাড়িতে হাওয়ার চেয়েও বেশি বয় দীর্ঘশ্বাস। মানুষের শাশ্বত দীর্ঘশ্বাস। রশিদা বেগম ঠাহরায়,— সব কথা ফুরিয়ে গেলে পড়ে থাকে খালি দীর্ঘশ্বাস।
করিমন হাতি বাইরের ঘরে বসে বসে মাথা নাড়ায় আর সারাদিনব্যাপী তার মস্তকে গুনগুনিয়ে চলে হরেক গান, যথা,— ‘তু তু তু/তুতু তারা/তোড়ো না/দিলহামারা’ অথবা ‘ইলু ইলু/ইলু ইলু…’
কোথা থেকে যে আসে এ-সব গান, তা কেউ জানে না।

প্রথম পর্ব:

অলোকপর্ণার ধারাবাহিক উপন্যাস: আফিম

Facebook Comments

পছন্দের বই