লেখক নয় , লেখাই মূলধন

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

পঞ্চম পর্ব

ডায়েরি, আনডেটেড কয়েকটি 

১৬ অগাস্ট,…

Nothing happens while you live. The scenery changes, people come in and go out, that’s all. There are no beginnings. Days are tacked on to days without rhyme or reason, an interminable, monotonous addition… The time of a flash. After that, the procession starts again, you begin to add up hours and days: Monday, Tuesday, Wednesday. April, May, June. 1924, 1925, 1926.

সারাটা বিকেল এক র‌্যামি-বোর্ডের পাশে বসে ছিলাম। ছোট্ট ক্লাবঘরের দোতলায় হলুদ-আলো জ্বলে উঠেছে, দুটো তাসের সেট একসঙ্গে মিশিয়ে ছ-জনের গম্ভীর মুখ নিয়ে জেগে রয়েছে একটা হলুদ-বাল্ব ও ক্লাবঘর। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে, বৃষ্টির ভেতর থেকে অন্ধকার গুঁড়ি মেরে ঢুকে পড়ছিল ঘরের মধ্যে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে অন্ধকারের গন্ধ পাই প্রতিদিন, আজও পেয়েছিলাম। অন্ধকারে যেভাবে পা খুঁজে পায়, চিনতে পারে নিজের চটিকে ঠিক সেভাবে সিঁড়ির সাত-নম্বর ধাপে আমার জন্য রোজ অপেক্ষা করে সম্পূর্ণ অন্ধকার দিয়ে গড়া একটা মানুষ। কেন যে তার মুখোমুখি আমি প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকি জানি না। ওই ধাপটিতে দাঁড়ালে জাহাজের বাঁশি ভেসে আসে, গম্ভীর তিমির ডাকের মতো সেই ভোঁ। এক-একটা শব্দ আমার মধ্যে অতীত অথবা ভবিষ্যৎ হয়ে প্রবেশ করে, আজও করেছিল। আজ জাহাজের ভোঁ-এর মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে ছিল একটি কাঠবাদাম গাছ, হেমন্তের দিনে একে একে ঘুরে ঘুরে হলুদপাতারা খসে পড়ছে তার শরীর থেকে। জীবনে আমি কোনোদিন ক্লান্ত তিমির ডাক শুনিনি; না, ভুল বললাম। বহু বছর আগে একদিন বাবার পাশে শুয়ে ‘তিমি তিমিঙ্গিল’ নামে একটা বেতারনাটকে শুনেছিলাম। কম্বলের এক নির্দিষ্ট গন্ধ ও শীতের রাত… ওই একবারই তিমির ডাক শুনেছিলাম।

আজ কেন জানি না অদ্ভুতভাবে মনে হচ্ছে, আবার মনে হতে শুরু করেছে, তাসগুলি— মানে ক্লাব ডাই হার্ট স্পেড সাহেব বিবি গোলাম টেক্কারা প্রতিদিন রাতে শূন্য ক্লাবঘরে, দোতলায় ঘুরে বেড়ায়। অপেক্ষা করে কখন তারা এসব বিষণ্ণ যুবকদের টেনে নিয়ে আসবে, খেলা শুরু করবে। তাসেরাই আমাদের নিয়ে খেলা করে। আজ (…) ফোন করেছিল, বলল, ‘এটি তোমার নতুন অবসেসনে পরিণত হয়েছে…অবসেসন থেকে বের হও… অবসেসন প্রকৃত সৃষ্টির অন্তরায়।’

বরফের ছুরি তিমির ডাক কাঠবাদামগাছ অক্টোপাস আমার অবসেসন, আরও কত কত অবসেসন আছে। বরফের ছুরি দিয়ে হত্যার ব্যাপারে আমি বেশ কয়েক বছর চিন্তিত। বরফের ধারালো ছুরি দিয়ে খুন করলে হত্যাচিহ্ন থাকে না, ফলে এর থেকে সহজ একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়— বরফের কোনো স্মৃতি নেই। কিন্তু জলের তো স্মৃতি আছে, আমি নিশ্চিত জলের স্মৃতি আছে। তরল হত্যাচিহ্ন ঘুরে ঘুরে বেড়ায় কোথাও নিশ্চয়।

১৭ অগাস্ট,…

I am alone, most of the people have gone back home, they are reading the evening paper, listening to the radio. Sunday has left them with a taste of ashes and their thoughts are already turning towards Monday. But for me there is neither Monday nor Sunday: there are days which pass in disorder, and then, sudden lightning like this one. Nothing has changed and yet everything is different. I can’t describe it; it’s like the Nausea and yet it’s just the opposite: at last an adventure happens to me and when I question myself I see that it happens that I am myself and that I am here; I am the one who splits the night, I am as happy as the hero of a novel.

আজ অক্টোপাসের আবসেসন থেকে কিছুটা বের হতে চেষ্টা করেছিলাম। আজও সারাদিন বৃষ্টি, এমন বৃষ্টির দিনে শঙ্খ ঘোষের কবিতার মতো ভাবতে ইচ্ছা করে, আমার জন্মের কোনো শেষ নেই। যদি পুনর্জন্ম থাকে তবে নিশ্চিত আমি একদিন অক্টোপাস-জন্ম পাব। অনেকবার ভাবার চেষ্টা করেছি কেন আমার এই অক্টোপাস-অবসেসন এবং ধীরে ধীরে আরও বেশি করে ডুবে গেছি অক্টোপাসের দুনিয়ায়। মহাবিশ্বের কোথাও এক অতিকায় অক্টোপাস আছে, এই স্মৃষ্টির নাভির কাছে নক্ষত্রমণ্ডলী পেরিয়ে চলা আদিম ধুলোঝড়ের মাঝখানে এক অক্টোপাস অনিবার্যভাবে রয়েছে। আকর্ষগুলি দিয়ে বারবার আঁকড়ে ধরতে চেয়ে ব্যর্থ হওয়া, এক প্রাণান্তকর ট্র্যাজিক খিদে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। মহাবিশ্বের অক্টোপাস ধুলোঝড়ের মধ্যে বসে রয়েছে, একে একে মৃত সব তারাদের ধরে টপাটপ সে গিলে ফেলছে। এই দৃশ্য আমার কাছে চূড়ান্ত বাস্তব।

আজ ‘উপনিষদ’ নিয়ে বসেছিলাম সন্ধ্যাবেলায়, অনেকক্ষণ। এক জায়গায় পড়ছিলাম, ‘হন্তা চেন্মন্যতে হস্তৃং হতশ্চেশ্মন্যতে হতম
উভৌ তৌ ন বিজানীতো ন্যয়ং হস্তি ন হন্যতে।’
— এই শ্লোকের সরলার্থ হিসাবে লেখা ছিল, ‘হননকারী ব্যক্তি যদি মনে করে সে হনন করিবে, হত ব্যক্তি যদি মনে করে সে হত হইল, তবে দুইজনের কেহই আত্মার স্বরূপ জানে না। কারণ এই আত্মা হননও করে না, হত্যাও করে না।’

এই শ্লোকটি পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। আলবেয়ার কাম্যুর ‘দ্য মিথ অফ সিসিফাস’-এর কথা একেকবার মনে পড়ছিল, ‘There is but one truly serious philosophical problem, and that is suicide…what is called a reason for living is also an excellent reason for dying.’

হননকারী ব্যক্তি আর হত ব্যক্তি যখন দুই পৃথক মানুষ তখন তারা আত্মার স্বরূপ জানে না; কিন্তু হননকারী ও হত ব্যক্তি যখন এক, যখন নিজেকে নিজেই হত্যা করে মানুষ তখন কি সে আত্মার স্বরূপ চেনে? উপনিষদের শ্লোকটির মধ্যে যে দ্বিমেরু-বাস্তবতা আছে… যখন বরফের ছুরি হাতে হননকারী অনুসরণ করছে তার শিকারকে… সেই দ্বিমেরু-বাস্তবতা দুমড়েমুচড়ে যখন একটি বিন্দুতে এসে মিশে যায়, অর্থাৎ যখন নিজের ছায়াকেই ঘাতকের মতো অনুসরণ করে মানুষ তখন সম্ভবত জন্ম নেয় আলবেয়ার কামু ও জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’-এর পৃথিবী।

আত্মার স্বরূপ অধিক চিনে ফেলার ফলেই কি জন্ম নেয় আত্মহননেচ্ছা? ‘আট বছর আগের একদিন’ এক অতিজীবিতের উপাখ্যানও হতে পারে।

১৮ অগাস্ট,…

Black? The root was not black, there was no black on this piece of wood—there was . . . something else: black, like the circle, did not exist. I looked at the root: was it more than black or almost black? But I soon stopped questioning myself because I had the feeling of knowing where I was. Yes, I had already scrutinized innumerable objects, with deep uneasiness.

ট্রেনে কাঠের বাক্সের মধ্যে সাউন্ড-ট্র্যাক বাজিয়ে গান গাইত এক অন্ধ, চোখের মণি দু-টি বিস্ফোরিত, শাদা। এই দৃশ্যটি ভয়ংকর ট্র্যাজিক হয়ে উঠত কারণ লোকটিকে নিয়ে কম্পার্টমেন্ট থেকে কম্পার্টমেন্টে ছুটে যেত তার মেয়ে। ট্রেনের আওয়াজ ও চলাচল নেই বহুদিন।

আজ দেখলাম রাস্তায় বাবার হাত ধরে মেয়েটি ভিক্ষা করছে, বাক্সের ভেতর বাজছে, ‘আমার সাধ না মিটিল আশা না-পুরিল।’ ট্রেনের ভিক্ষুককে দোকানদার ও রাস্তার মানুষ ভিক্ষা দেয় কম। ভিক্ষা করবারও একটা আর্ট আছে, শিল্প কোথায় নেই!

এত শিল্পের ভার নিয়ে মানুষ যে বেঁচে আছে, স্বার্থপরের মতো বেঁচে আছে— ভাবতেই শিহরণ জাগে। বেশ ভাববাদী ও ছেঁদো একটা কথাকে সারা বিকেল চিউংগামের মতো জাবর কেটেছি… মানুষ মৃত্যুর কাছ থেকে প্রতিটা মুহূর্তে জীবনভিক্ষা চাইছে… মানুষ মৃত্যুর কাছ থেকে প্রতিটা মুহূর্তে জীবনভিক্ষা চাইছে। অবশেষে একটা সময় এই ছেঁদো চিন্তাকে ছেড়ে দিলাম, মুছে দিলাম। পরিবর্তে আরেকটি চিন্তা মাথার ভিতর জাঁকিয়ে বসতে শুরু করল, বধির বাবার সঙ্গে কীভাবে কথা বলে আহত কিশোর?

কেন আহত জানি না; হয়তো প্রেমে বা খিদেয়। কিন্তু সে কীভাবে কথা বলে বধির বাবার সঙ্গে? তিনজন হিয়ারিং-এইড ব্যবহার করা মানুষের কথা মনে পড়ল, তাদের ছেলেও আছে। কিশোর না-হলেও পুত্র আছে, কিন্তু তাদের জিজ্ঞেস করা যাবে না।

আমাদের ছোট্ট স্টেশনের গা-ঘেঁষে চলে যাওয়া রাস্তাটির পাশে ঝাঁকড়া গাছগুলির নীচে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ, প্রায় রাত আটটা থেকে ন-টা পর্যন্ত তো হবেই। আজ হঠাৎ মনে হল, গাছগুলি অদ্ভুত এক প্রাণী… আত্মহত্যাকামী। মাটির ভিতর মুখ গুঁজে দিয়ে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর।

১৯ অগাস্ট,…

I’ll keep my stockings on if you don’t mind…
Night falls. On the second floor of the Hotel Printania two windows have just lighted up. The building-yard of the New Station smells strongly of damp wood: tomorrow it will rain in Bouville.

এক-একদিন এমন হয়, একটা পুরানো গন্ধ অথবা একটা শব্দ অথবা একটা স্বাদ নিয়ে ঘুরে বেড়াই। যেমন আজ একটাই শব্দ ঘুরে-ফিরে আসছে বায়ুকুকুর বায়ুকুকুর… শব্দটা কাল রাত্রে পেয়েছিলাম জীবনানন্দের একটা কবিতায়, ‘হেমন্তের নদীর পারে।’ এই আশ্চর্য শান্ত… আপাতশান্ত শব্দটি ধীরে ধীরে পৃথিবীর হিংস্রতম কুকুরের থেকেও বেশি হিংস্র হয়ে উঠছে আমার কাছে। এই শব্দটি একটি বিমূর্ত কুকুর হয়ে তাড়া করতে শুরু করবে আজ অথবা কাল, আমার জানা। যেহেতু সে বিমূর্ত তাই তার থাবা থেকে রক্ষা পাওয়া অসম্ভব।
সিসিফাস’-কে কি এই বায়ুকুকুর তাড়া করে ফিরত? If this myth (the myth of Sisyphus) is tragic, that is because its hero is conscious…Sisyphus, proletarian of the gods, powerless and rebellious, knows the whole extent of his wretched condition: it is what he thinks of during his descent. (Camus)

পাওয়ারলেস, অথচ বিদ্রোহী… সমস্ত ফুর্তির বাইরে দাঁড়িয়ে যে ক্রমাগত আক্রমণ করে চলে। প্রতিদিন পাহাড়ে পাথর নিয়ে ওঠা আর নেমে আসাই নিয়তি যার। আমি সিসিফাসকে দেখিনি, একজনের ছবি দেখেছি। শ্রেষ্ঠ কবিতার ভারবি সংস্করণে ডানদিকের-ঠোঁট ঈষৎ চাপা একজনের ছবি… পবিত্র এক বিদ্রূপে যিনি বৃত্তের বাইরে থেকে তাকিয়ে রয়েছেন বৃত্তের দিকে। পাওয়ারলেস… ভয়ংকর পাওয়ারলেস। জীবনও ভয়ংকর পাওয়ারলেস, তাকে বায়ুকুকুরের মতো তাড়া করে বেড়ায় মৃত্যু…আয়ুক্ষয়ের এক ছিনিমিনি খেলা, ‘অসম্ভব বেদনার সঙ্গে মিশে র’য়ে গেছে অমোঘ আমোদ।’ আমোদিত শিল্পের গন্ধ নাকে এসে লাগে আজকাল, বেদনার শিল্পের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি একটি অশ্বত্থকে। বায়ুকুকুরের তাড়া খেতে খেতে একজন এগিয়ে চলেছে তার দিকে একা। বিপন্ন বিষ্ময় অন্তর্গত রক্তের ভিতর, কিন্তু সে সচেতন।

কারণ সে প্রলেতারিয়ান অফ দ্য গডস। মৃত্যু দিয়ে জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার শূন্য করে চলে যাবার অহং তারই সাজে।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

 

Facebook Comments

পছন্দের বই