লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কথাসাহত্যিক সুবোধ ঘোষকে নিয়ে অরিন্দম গোস্বামীর ধারাবাহিক প্রবন্ধ

প্রথম পর্ব

এক লেখকের জন্মকথা

গত শতাব্দীর দুইয়ের দশক। বাবা সতীশচন্দ্র ও মা কনকলতার সাতটি সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় এই কিশোর। হাজারিবাগ জেলা স্কুলের ছাত্র। মেধাবী।
ছোটোবেলা থেকেই শালবন, পাহাড় আর জংলী-ঝরনা-নদীর সঙ্গে বন্ধুত্ব। ওয়ার্ডসোয়ার্থের কবিতা পড়ার অনেক আগে থেকেই কিশোরের মনে হতো— ঐ শালবনের বাতাস আর ঝরনার শব্দ যেন কথা বলছে।

সুবোধ ঘোষ

 পিতামহের বন্ধু— রায়বাহাদুর পার্বতীনাথ দত্ত— ভারতের জিয়োলজিক‍্যাল সার্ভের প্রথম ভারতীয় ডিরেক্টর। একদিন কথায় কথায় ঐ কিশোরকে বলেছিলেন— বড়ো বড়ো প্রাণীর হাড় মাটি— পাথরচাপা পড়ে ফসিল হয়ে যায়। খুব মনোযোগ দিয়ে সে শুনেছিল কথাটি।
কবি কামিনী রায় পারিবারিক বন্ধুত্বের সূত্রে প্রায়ই বাড়িতে আসতেন। কিশোরকে উপহার দিয়েছিলেন তার কবিতার বই— ‘গুঞ্জন’ আর ‘অশোকসঙ্গীত’। অর্থ পুরো বুঝতে না-পারলেও তা ঝঙ্কার তুলেছিল কিশোরের মনে। আর ভালো লাগত ব্রহ্মসঙ্গীত।
স্কুলের সহ-প্রধানশিক্ষক ও ‘প্রবাসী’-র নিয়মিত লেখক দার্শনিক মহেশচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে ছিল বিরাট গ্রন্থাগার। সেখানে কিশোরের ছিল অবাধ বিচরণ। আগ্রহ ছিল— ইতিহাস-ধর্ম-দর্শনে।
স্কুলের পাঠ শেষ করে হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজ— বিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ হল কই? বাড়িতে অনটন। তাই নিতে হল কলেরা-প্রবণ বস্তিতে টীকা দেবার কাজ। মাস ছয়েকের চাকরি।
এরপর নাইট-সার্ভিসের বাসের কন্ডাক্টর। চলল যান্ত্রিক কলকব্জা শেখার হাতেকলমে পাঠগ্রহণ। রাতের এই অরণ্যপথেই একদিন কুড়িয়ে পান এক বাঘের বাচ্চাকে। বাড়িতে এনে বড়োও করেন, কিন্তু শেষে আবার তাকে জঙ্গলেই ছেড়ে আসতে হয়।
এরপর কাজ করেছেন সার্কাসের পার্টিতে, সন্ন্যাসীর বেশ ধরে বাড়িও ছেড়েছেন একবার। আবার বেকারির ব‍্যাবসা করতে মুম্বাইয়ের কষ্টের জীবনেও অন্বেষণ করেছেন জীবিকা।
অবশেষে যুবকের বড়দার অনুরোধে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর কর্ণধার সুরেশচন্দ্র মজুমদারের আনুকূল্যে পত্রিকা অফিসে না-হলেও গৌরাঙ্গপ্রেসে প্রুফদেখার চাকরি। কর্মক্ষেত্রে এই প্রথম কলম ব‍্যবহারের সুযোগ। পরে, আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগে।
ঐ সময়েই বন্ধুদের একটা গোষ্ঠীর সদস্য হন ঐ যুবক। গোষ্ঠীর নাম— অনামী সংঘ। যদিও সদস্যরা পরবর্তীতে সাহিত্য জগতের দিকপাল— স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, পুলকেশ দে সরকার, সাগরময় ঘোষ, বিজন ভট্টাচার্য, বিনয় ঘোষ প্রমুখ। আড্ডায় এঁরা স্বরচিত সাহিত্য পড়ে একে অপরকে শোনাতেন। এঁদের চাপে পড়েই ঐ যুবককে পড়ে শোনাতে হল পরপর দুই বৈঠকে দুটি গল্প। জীবনের পাঠ আর অভিজ্ঞতা একত্রিত করে লিখলেন যুবক— তারপর শোনালেন দুরুদুরু বক্ষে। বন্ধুরা উচ্ছ্বসিত। প্রথম গল্পটি প্রকাশিত হল ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র বার্ষিক সংখ্যায়— নাম ‘অযান্ত্রিক’। আর দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হল ‘অগ্রনী’ নামের মাসিক পত্রিকায়— নাম ‘ফসিল’।
তারপর যা হল— সেটা ইতিহাস ।

আর ঐ সংগ্রামী যুবকের নাম? —সুবোধ ঘোষ!

লেখক পরিচিতি:

সহযোগী অধ্যাপক
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
গভর্ণমেন্ট জেনারেল ডিগ্রি কলেজ , সিঙ্গুর।

Facebook Comments

পছন্দের বই