লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ধারাবাহিক।পর্ব১

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ


ধুতি-পাঞ্জাবির শক্ত কাঠামোটা মাথা হেলাল, যেন আনমনেই। সেই ছন্দেই অভ্যাসবশে পায়ের ভারী বুটজুতোজোড়া তাল ঠুকল। ঠকাস! একইসঙ্গে কালো একটা পুলিশ ভ্যান গড়গড় আওয়াজ তুলল সহসা। সেই সঙ্গেই ব্যাং-ব্যাং-ব্যাং— নিঃশব্দে আগুন ঝলসে উঠল রয়্যাল টকির ফাঁকা গেটে। রক্ত মেখে চারটে লাশ গড়িয়ে পড়ল সে-টকির গেটে! ফলে খাস সাহেব কলকাতার সে-এলাকায় হঠাত্‍ই সন্ধ্যের আঁধার জমাট হল। কিছু লোক দৌড়ে গেল। আশেপাশের ছাদের টিভি-অ্যান্টেনায় বসে থাকা কিছু কাক ঝিমুনি ভেঙে উড়াল দিল দিগ্বিদিক—আকাশে পাক মারতেই থাকল। সন্ধ্যের এই আঁধারসাজে তিনটে লোক টকির গেট ছাড়িয়ে পুলিশ ভ্যানের আড়ালে হঠাত্‍ই উবে গেল। পুলিশ ভ্যানের কালো অন্ধকারই হয়তো তাদের মুছে দিল। কেন-না সে-ক্ষণেই ভ্যানটি গড়াতে শুরু করেছিল।

রাস্তার চলন্ত মারুতি গাড়িটা হঠাত্‍ই হর্ন দেওয়ায়, আচমকাই— গাড়ির হেডলাইট আছড়ে পড়ল যেন দোকানে টাঙানো ফোটোটার ওপর। ছবির লোকটাকে ঝলকে আলোকিত করে, পরক্ষণেই আঁধার এঁকে গাড়িটা ছুটে চলে গেল তার গন্তব্যে। ফলে ফাঁকা নিস্তব্ধ দোকানে সন্ধ্যের আঁধার জমাট হল সহসা। উলটো দিকে কাউন্টারে বসা মানুষটা সে-অভিঘাতে সামনে টাঙানো ফোটোটার ওপর চোখ মেলে। পরক্ষণেই গাড়ির ছুটন্ত আলোর মুছে যাওয়া তাকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করে রাস্তায়। ততক্ষণে বাস-রিকশা-মানুষের জটলায় সে-গাড়ি হারিয়েই যায় প্রায়। তবুও চেনা গাড়ি তাই, মানুষটা বাধ্য হয় গাড়িটাকে চিনে নিতে— দীনদার গাড়ি না!

এই চকিতে চিনে নেওয়া দোকানের অন্ধকারকে আরও ঘন করে যেন। মানুষটা চেয়ার ঠেলে উঠে কাউন্টার ছেড়ে উলটো দিকে ধায়। শাড়ির খুঁট দিয়ে ফোটোটার ঝুলকালি মোছে পরম মমতায়। অভিমান চোখে নুন ছড়ায়। জলহীন কান্নায় বোবা উচ্চারণ ফোটে— কাল একটা মালা কিনতে হবে সকালে! ফলে অন্ধকার জমাট হয় আরও। আবার হয়ও না। কেন-না তক্ষুনি আঁধার ঠেলে দু-জন খদ্দের ঢোকে দোকানে। বেঞ্চিতে বসে।

— বউদি দুটো চা হবে!

— একটু বসুন, দিচ্ছি। বিস্কুট, কেক কিছু লাগবে?

— হ্যাঁ, দুটো বিস্কুটও দিন।

রূপা, দোকানের মালকিন, গ্যাস জ্বালায়। সে-ইন্ধনে সহসা চারদিকে আলো ফুটে ওঠে যেন। দোকান লোকে লোকারণ্য। চা, ঘুগনি, ভেজিটেবল-এগ চপ, টোস্ট— টেবিলে টেবিলে হারু দিয়ে উঠতে পারে না, হিমশিম খায়।

চাপা গলায় আওয়াজ ওঠে— দশকা বিশ! দশকা বিশ! ব্ল্যাকার নিমু হিসহিসিয়ে ওঠে। নব্বই পয়সার লাইনে মারামারি প্রায়। ম্যাটনি শো ভেঙে ইভনিং শো শুরু হল বলে! অমিতাভ বচ্চনের মারকাটারি সুপারহিট হিন্দি বই! মায়াময় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রূপার মুখ। সে-মায়ায় পাশের রূপশ্রী হলের জীর্ণ কঙ্কালটা জেগে ওঠে ঘুম ভেঙে। আলো মেখে সত্যিই রূপশ্রী যেন সে!

হ্যাঁ, রূপশ্রী সিনেমা হলের খাতায়-কলমে অন্য মালিক থাকলেও, বকলমায় আসল মালিক তো কৃষ্ণনাথই! দীননাথ তারই ছোটোভাই। রূপা তার দেওরকে দীনদা বলতেই অভ্যস্ত প্রথম থেকেই!


তখন সদ্য কলেজ। আঠারোর ফোটা কলি। হ্যাঁ, কৃষ্ণকলিই! যেহেতু ছিপছিপে রূপা কালোর দিকেই ঢলে ছিল। আদর করে যাকে শ্যামবর্ণ বলে। সত্যিই কি রূপা আদরের ছিল কারও তখন! সামান্য ডিমঅলা বাবার পাঁচ ভাইবোনের দ্বিতীয় সে! বস্তির গরিব ঘরে দিন আনতে পান্তা ফুরানো জীবনে আদর থাকে না, থাকতে নেই! তবুও তো কনেদেখা আলোয় সাজে আকাশ কোনো কোনো দিন। সাজায় চরাচরময় প্রকৃতিকে, যা আলো আঁকে মানুষের মনে। মন যেহেতু মানুষেরই নিজস্ব ধন— মানুষ অজান্তে রেঙে ওঠে সে-আলোয়। রাঙা মন নবীন হয় যদি, তবে লজ্জাও পায়। যেমন সে-বিকেলে কনেদেখা আলোয় রূপার নবীন মনখানি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে নীরবে লাজরাঙাই যেন। মুদিয়ালি হরিসভা পেরিয়ে, মুখার্জিদের বাড়ি ছাড়িয়ে, বাঁশঝোপের নির্জনতা যখন ফতেপুর সেকেন্ড লেনে—কোথায় যেন চ্যাংড়া সিটি বেজে উঠেছিল— টি-ই-উই! একবারই। কেন-না দ্বিতীয়বার বেজে ওঠার মুখে সে-ধ্বনি রক্তাক্ত। মুখ না তুলেই রূপা বুঝেছিল কেউ যেন গলির আধা অন্ধকারে প্রাণপণে হারিয়ে গেল। রূপার তৃতীয় নয়ন, যা নারীরই, অনুভব করেছিল তার ওপর লম্বা ছায়ার মায়া। যে-মায়া বলেছিল— যাও, বাড়ি যাও নিশ্চিন্তে। আর কেউ কোনোদিন কিছু বলবে না তোমায়!

রূপার আড় নয়নে তখন ব্রজের সে-রাখালের ছায়া! হ্যাঁ, কৃষ্ণনাথই! রূপার বুক ছোট্ট চড়ুই পাখির মতো থরথরিয়ে কেঁপে উঠেছিল। সন্ধ্যার সে-ঈশ্বরীয় আলোয় ঢেউ তুলে রূপা হেঁটে গিয়েছিল ধীরে বাড়ির পানে। বাড়ির পানেই কি? নাকি রাখালরাজার বাঁশির টানে ব্রজের পানে— পবিত্র রজ উড়িয়ে। জানেনি রূপা সেদিন। হয়তো জেনেওছিল!

কিন্তু এ যে কুরুক্ষেত্রের কৃষ্ণ! ব্রজের কানাই সে তো নয়! রূপা বুঝেছিল তা দিন গড়ালে। এখন রূপা রাস্তা দিয়ে, গলি দিয়ে হাঁটে, দিনের আলোয়, সন্ধ্যের আবছায়ায়— যেন রাজেন্দ্রানি সে। সে অনুভব করে তা। নারীর তৃতীয় নয়নে সে বোঝে যে, কেউ যেন লুকিয়ে অনুসরণ করছে তাকে। প্রথম প্রথম ভয়ই পেত সে— কৃষ্ণ যে মস্তান! গুণ্ডা! যুদ্ধবাজ! রাজা সে! তাকে ভয় পাওয়া যায়, সমীহ করা যায়, ভালোবাসা যায় কি? একদিনের ভাবনা ছিল না তা, বহু দিনের পথ চলতি ভাবনারা জড়ো হয়ে এমন মুরতিই পরিগ্রহ করেছিল তার মনে। কখনো দিনের সমারোহে, কখনো সাঁঝের মায়ায়। আর সে-মায়ার সমারোহে কৃষ্ণের যোদ্ধাসাজ মুছে একদিন রূপার মনে পীত বসন উঁকি দিয়েছিল। সে সোনালিহলুদ এক বাদল সাঁঝে যেন ময়ূরপুচ্ছের ঝলমলানি পাখনা মেলেছিল। ময়ূরের মতো নেচে উঠেছিল রূপার মন! হঠাত্‍ই সাঁঝের সে-আবছা ছায়ায় মিশে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সজলকৃষ্ণ একখণ্ড মেঘই যেন। কৃষ্ণ! ভয়ে-বিস্ময়ে ভিজে গিয়েছিল রূপা। দুরুদুরু চোখে তাকিয়ে ছিল কৃষ্ণপানে। না, না, কৃষ্ণ কেন? রাজা, রাখালরাজাই যেন। কেন-না সে সজলকৃষ্ণে নিবেদন ছিল। একটা প্যাকেট বাড়িয়ে বলেছিল সে-মায়া,

— আজ তোমার জন্মদিন। এটা নাও।

সে-নিবেদনে দূরবর্তী সন্ধ্যের ছায়ারা ঠাইনাড়া হয়েছিল যেন উল্লাসি-বিভঙ্গে। তারা যে কৃষ্ণের যাদব, বৃষ্ণীর দল! রূপা যদিও দেখেনি তা। কেন-না তখন তার চোখে ভালোবাসা-ভয়-বিস্ময় একত্রে সজল ছায়া এঁকেছিল। লোকটা জানল কী করে তার জন্মদিনের কথা? মনের কথা সে-অন্তর্যামী কৃষ্ণ পড়তে পেরেছিল। বলেছিল— কলেজে গিয়ে জেনেছি।

যদিও আসল জন্মদিবস আজ নয় তার। তখনকার নিয়ম মেনেই খাতায়কলমে তা সত্য শুধু। জন্মদিন সে পেরিয়ে এসেছে গত হেমন্তে। এমন কথা মনেই এঁকেছিল রূপা, প্রকাশ্যে কেবল এ-উচ্চারণটুকুই ফুটেছিল তার ঠোঁটে— এ আমি নিতে পারব না।

— কেন? জলদস্বর ঘন হয়েছিল শুধু।

— বাড়িতে কী বলব? তিরতির কেঁপেছিল রূপা।

— বলবে, কৃষ্ণ দিয়েছে।

— তবুও…। রূপার গলায় যেন বালির চরা, যদিও চোখে নদীর ফল্গুমায়া।

— তাহলে আমিই গিয়ে দিয়ে আসব বাড়িতে তোমার। সে-জলদ স্বরে অনুরণন ছিল যেন। রূপা আলগা হাত মেলে দিয়েছিল, যে-হাতে কৃষ্ণের বরাভয় আঁকা হয়েছিল সে-আলোক সাঁঝে।হ্যাঁ, আলোক সাঁঝই তা, কেন-না রূপার মনে প্রথম বর্ষার নূপুর ধ্বনি, কেকা রব। মেঘ চিরে বজ্রের ঝিলিক, যা সমীহ জাগিয়েছিল।

রূপা সে-উপহারটুকু বুকের কোণে লুকিয়ে হাঁটা দিয়েছিল মাথা নীচু করে নিশ্চুপে। শব্দহীন প্রতিটি পদক্ষেপে তবুও আঁকাছিল সে-নীরব ধ্বনি— কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! সে-ধ্বনিতে মহিম ছিল সন্ধ্যাখানি, যাকে ঈশ্বরীয় রূপদানে কোনো বাড়িতে শাঁখও বেজে উঠেছিল সহসা!

তবুও বাড়িতে যোদ্ধা কৃষ্ণকে লোকানো যায়নি। রূপার বাবা গর্জে উঠেছিল যেন— মস্তানের সঙ্গে পিরিত! তুই তো যাবিই, সঙ্গে আমরাও গুষ্ঠিশুদ্ধ সবাই জাহান্নমে যাব!

সে-কীর্তনে দোহারকি করেছিল রূপার মা যেন— হায়! হায়! হা আমার পোড়া কপাল!

Facebook Comments

পছন্দের বই