লেখক নয় , লেখাই মূলধন

পঙ্কজ চক্রবর্তীর গদ্য

স্মৃতি বিস্মৃতির চেয়ে কিছু বেশি

দূর থেকে দেখি বিস্মৃত লেখককে সামনে রেখে পুনরুদ্ধার প্রকল্প। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। সাফল্যের একটা অস্ত্র হিসেবেই কি বিস্মৃতির এতখানি গ্রহণযোগ‍্যতা? পাঠক কি মৌলিক সাহিত্যের বদলে কেবলই বিস্মৃত লেখককে নিয়ে সংরক্ষণযোগ্য একটি ছোটোপত্রিকার সংখ‍্যা কিনে নিয়ে সমৃদ্ধ হতে চাইছে? গবেষণার ছদ্মবেশে নির্বিচার সংকলনকে অজান্তেই ভেবে নিচ্ছে ছোটোপত্রিকার সত্যিকারের দায় ও দায়িত্ব। সন্দেহ হয়।
আজ অজস্র বিস্মৃত কবির কঙ্কালের উপর দাঁড়িয়ে অনেকক্ষেত্রে পাঠকের অহেতুক মুগ্ধতা আসলে একধরনের আত্মপ্রতারণা। হেজে মজে গেছেন যে কথাকার তাঁকে আবিষ্কার করে আমরা পেতে চাইছি আত্মসুখের গৌরব। শুধুমাত্র বিস্মৃত এই অনিবার্য অনুকম্পা দিয়ে চিনে নিতে চাইছি একজন লেখককে কোনোরকম গভীর মূল‍্যায়ন ছাড়াই। জনপ্রিয়তাকে দেখছি একটি স্থুল পরিচর্যা হিসেবে, খ‍্যাতিকে ভাবছি ক্ষমতার রোগ। বিস্মৃতির পেছনে যে একটি অনিবার্য ইতিহাস আছে, আছে জরুরি প্রয়োজন উপেক্ষা করে চলেছি সেই নিভৃত সত‍্যকে। সব বিস্মৃতি পাঠকের উপেক্ষা নয়, নয় শিল্পের পথে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত; এ-কথা ভেবে দেখবার সব প্রয়োজন আজ অবলুপ্ত।
মনে পড়ে নব্বইয়ের শুরুর দিনগুলির কথা। আমরা তখন স্কুলের ছাত্র। সেই সময় মফসসলের ছোটোখাটো বইয়ের দোকানে স্কুলপাঠ‍্য বইয়ের বাইরে দু-একটা গল্পের বইও থাকত। জনপ্রিয় অথবা পুরস্কার প্রাপ্ত বই ছাড়াও পাওয়া যেত বুদ্ধদেব গুহর ‘একটু উষ্ণতার জন‍্য’ বা বিতর্কিত ‘চান ঘরে গান’ অথবা খুবই গোপনে পাওয়া যেত তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’। এখনও কি এইসব বই একইরকম পাঠকের মনোযোগ পায়! যদি না পায় তাহলে এই বিস্মৃতি নিয়ে মায়াকান্নার সুযোগ কি আমরা নেব? সেই সময় নিমাই ভট্টাচার্যের ‘মেমসাহেব’ উপন‍্যাসের ডজনখানেক বিক্রি বাঁধা ছিল প্রতি সপ্তাহে মফসসলের ছোটো দোকানে। আজ পাঠকের সেই মনোযোগ বা অবিস্মরণীয় খিদে নেই এই বইটির প্রতি। এই বিস্মৃতির সুযোগ নিয়ে যদি বলি একটি যুগান্তকারী উপন‍্যাসের অপমৃত্যু হল তাহলে ইতিহাসের চাকা উলটোদিকে ঘোরানোর হাস‍্যকর অপচেষ্টা হবে নাকি? আর একবার ভেবে দেখতে হবে আমাদের। একদা সদর-মফসসলের লাইব্রেরিতে পাঠকের চাহিদা ছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নারায়ণ সান‍্যাল, বিমল মিত্র, প্রফুল্ল রায়, নিমাই ভট্টাচার্য, জরাসন্ধ, শক্তিপদ রাজগুরু, নীহাররঞ্জন গুপ্ত প্রমুখ লেখকের বইয়ের প্রতি। লৌহকপাট, পরকপালে রাজারাণী, নগরপারে রূপনগর, আমাকে দেখুন, এলোকেশী আশ্রম, তুমি সন্ধ‍্যার মেঘ, লৌহকপাট, সাহেব বিবি গোলাম, কড়ি দিয়ে কিনলাম, বিশ্বাসঘাতক, তিমি তিমিঙ্গিল , কীরিটি অমনিবাস আরও নানা উপন‍্যাস গোগ্রাসে পড়তেন পাঠক। সত্তরের লেখকদের ভিন্ন ধরনের লেখার চাহিদা তখনও তৈরি হয়নি। আজকের পাঠকও কি একই রকম গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন এইসব লেখাকে? যদি নাই হয় তবে জোর করে এই বিস্মৃতিকে মহিমান্বিত করার অপরাধ নাই বা করলাম। পুরোনো ‘দেশ’ পত্রিকার বইয়ের বিজ্ঞাপনগুলি ধারাবাহিক দেখলেই বোঝা যাবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা কত নাম, কত বই হারিয়ে গেছে। আজ তার সার্বিক মহিমা ফিরে পাবার সারবত্তা নেই। তবু দায় আছে আমাদের। পরখ করে নিয়ে সত‍্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ বিস্মৃত লেখকের জন্য আমাদের আরও একবার চেষ্টা করতে হবে। যে-স্বীকৃতি তাঁরা যথাযথ পাননি তার জন‍্য আর একবার পাঠকের দরবারে তার আবির্ভাব জরুরি। সেখানে অহেতুক মত্ততা বা ছলনার সুযোগ যেন আমরা না নিই।
তবুও এ-কথা আজ মানতেই হবে প্রযুক্তি এবং স্মৃতি-বিস্মৃতির এই প্রবণতার হাত ধরে অনেক বিস্মৃত লেখক উঠৈ এসেছেন পাঠকের দ‍রবারে। অতীতের অনেক উপেক্ষা সরিয়ে আবার যথাযথ স্বীকৃতির কথা ভেবেছি আমরা। মূলত ছোটোপত্রিকা এবং প্রকাশনার হাত ধরে অনেক বিস্মৃত লেখক উঠে আসছেন পাদপ্রদীপের আলোয়। হয়তো এই সুদিনের অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। মণীন্দ্র গুপ্ত, শম্ভূনাথ চট্টোপাধ্যায়, নিত‍্য মালাকার, ফল্গু বসু, ফাল্গুনী রায়, তুষার চৌধুরী, অনন্য রায়, প্রবীর দাশগুপ্ত, প্রসূন বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি আবার পাঠকের কাছে অনিবার্য হয়ে উঠেছেন। দিনেশচন্দ্র রায়, বরেন বসু, মানিক চক্রবর্তী, অরূপরতন বসু, অরুণেশ ঘোষ, উদয়ন ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রমুখ কথাকারকে বিস্মৃতি উপেক্ষা করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে ছোটো প্রকাশনাগুলি। এই উদ‍্যোগের প্রয়োজন ছিল‌। ফেসবুকের নানা পাঠপ্রতিক্রিয়া এইসব বই বিক্রির অনুকূল হয়েছে। বিস্মৃতিকে একপ্রকার চ‍্যালেঞ্জ জানিয়েছি আমরা। পাশাপাশি এটাও হয়তো ঠিক একপ্রকার অতিশয়োক্তির কুয়াশাচ্ছন্ন বলয়ও তৈরি হয়েছে। অনেক পাঠক না পড়েই, না বুঝেই মুগ্ধতায় সামিল হয়েছেন। অনেকক্ষেত্রে সত‍্যিকারের পাঠপ্রতিক্রিয়া গোপন করছেন। অনেকে দুর্বল লেখাকে বিস্মৃতির ভাবপ্রবণতায় মহৎ করে তুলতে চাইছেন। সংশয় আছে অথচ সন্দেহ নেই। সংকোচ যদি বা থাকে মুগ্ধতার মৌলবাদী স্রোতে তার কোনো গুরুত্ব নেই।
মিডিয়ার যশ খ‍্যাতির পাশা আজ উল্টে গেছে। পাক্ষিক পত্রিকার একমাত্রিক সিদ্ধান্তের আত্মপ্রচারের বাইরে জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছেন অনেক বিস্মৃত লেখক। প্রযুক্তি এসে প্রকাশনার মনোপলি ভেঙে দিয়েছে এ-কথা সত‍্যি। এটাই হয়তো সময়ের দাবি। তবু সুদিন এসেছে এ-কথা ভেবেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কেন-না বিস্মৃতি শেষ কথা নয়। স্মৃতি-বিস্মৃতির চরাচর প্রতিমুহূর্তে বদলাচ্ছে। ধরা যাক রবীন্দ্রনাথের কথা। তিনি বাংলাসাহিত‍্যে বিস্মৃত লেখক নিশ্চয়ই নন। কিন্তু এ-কথা কি আজও আমরা বলতে পারব তাঁর সব রচনা স্মৃতিধন‍্য হয়ে আছে! ‘পোস্টমাস্টার’ যতখানি পাঠকধন‍্য ‘পয়লা নম্বর’ও কি তাই? ‘রক্তকরবী’-র কথা বললে যতগুলি হাত ওঠে ‘বাঁশরি’-র কথা বললেও কি তাই? ‘চোখের বালি’ সিনেমা এবং সিলেবাসের ধাক্কায় যতখানি পাঠকপ্রিয়তা পায় ‘যোগাযোগ’ ততখানি বিস্মৃত হয়ে থাকে। আর তাই আমাদের ভাষার সবচেয়ে অনিবার্য লেখকের সাহিত‍্যকীর্তির একটা বড়ো অংশই নানাভাবে বিস্মৃতির ধুলোয় পড়ে আছে। কয়েকটি সুনির্বাচিত গানের বাইরে আমাদের ‘গীতবিতান’ বেসুরো এবং বোবা। স্মৃতিধার্য একটি পছন্দমাফিক ছোটো রবীন্দ্রনাথের মালা নিয়ে আমরা বিস্মৃতির বিরুদ্ধে শৌখিন যুদ্ধ করে চলেছি। যেমন অবিস্মরণীয় জীবনানন্দের ক্ষমতা। সম্প্রতি সুধীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দের অপ্রীতিকর সম্পর্ককে উপলক্ষ করে জীবনানন্দের পক্ষ নিয়ে একজন পাঠক জানালেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আজ আর অনিবার্য কবি নন। এই কথার সপক্ষে বাঙালির চিরাচরিত ভাবালুতা যতখানি আছে যুক্তি ততখানি নেই। সমসাময়িক যে অপমান আর উপেক্ষা জীবনানন্দ পেয়েছেন তার জন‍্য আজ মুগ্ধতা আর অতিশয়োক্তি দিয়ে তার ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করছি অনেকক্ষেত্রে। আজ অধিকাংশ পাঠকের মুগ্ধতার স্বরূপ দেখে মনে হয় তাঁরা জীবনানন্দ গভীরভাবে পড়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তো! নাকি জীবন যাকে বারেবারে পরাজিত করেছে সেই মানুষটিকে অবশ‍্যম্ভাবী স্নেহে বেঁধে রাখবার মূল্য দিচ্ছি। শুধুমাত্র জীবনানন্দ ট্রমায় আমরা একবারও বিষ্ণু দে-কে মূল‍্য দিলাম না। খুব কি ক্ষতি হত আরও একবার বিষ্ণু দে-কে যথাযথ ভালোবেসে পড়লে?
প্রকাশকের সহযোগিতা, পাঠকের মূল্য, পুরস্কার, মিডিয়া, অগ্রজ কবির আশীর্বাদ, ক্ষমতাবান কবির অপ্রত্যাশিত প্রশ্রয় সাময়িক খ‍্যাতির একটি বলয় তৈরি করতে পারে তবুও বিস্মৃতির হাত থেকে রেহাই নেই। বিস্মৃতি-স্মৃতি-পুনশ্চ বিস্মৃতির মধ‍্যেই প্রতিমুহূর্তে জেগে ওঠে অনিশ্চয়তা, উদাসীন সংশয়। সংশয় নিয়ে বিভূতিভূষণ উদভ্রান্তের মতো ছুটে যান কালিদাস রায়ের কাছে। একটি সভায় প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছে খানিকটা উপেক্ষা পেয়ে দিনের শেষে বিভূতিভূষণ কিছুটা সংশয়ে নীচু স্বরে জানতে চান ‘আচ্ছা গজেন, প্রেমেন কি আমার চেয়েও বড়ো লেখক?’ স্মৃতি-বিস্মৃতির এই মেধাবী খেলায় স্মৃতিধার্য অনেক লেখকের যজমানি আজ বন্ধ, অনেক বিস্মৃত লেখক অতিশয়োক্তির মহিমায় কিছুদিনের জন্য রাজত্ব ফিরে পেয়েছেন। এখনই উপযুক্ত সময়।উল্লাসের বদলে ইতিহাসের হাতে সমস্ত ভার দিয়ে আমরা পারস্পরিক চর্চা জারি রাখতে পারি এইমাত্র, আর কিছু নয়। আসুন এবার মনে করা যাক সেই দৃশ‍্য। ‘শতভিষা’ পত্রিকার জন্য জীবনানন্দের কাছে লেখা চাইতে গিয়েছেন সম্পাদক আলোক সরকার। সব শুনে জীবনানন্দ বললেন, আর কে কে লিখছে? প্রেমেন লিখছে? আলোক সরকার বললেন, উনি তো কবিতা তেমন লেখেন না, গান লেখেন। উত্তর শুনে জীবনানন্দ দেড় মিনিট ধরে এক অলৌকিক হাসি হাসতে থাকলেন, সে হাসিতে সমস্ত শরীর কাঁপে, দাঁত দেখা যায় না। এই নৈঃশব্দ্যের হাসির আড়ালে আছে এক অদৃশ্য সুতোর পুতুল নাচ। এরপর স্মৃতি বিস্মৃতি সংক্রান্ত যে-কোনো আলোচনার আগে প্রতিমুহূর্তে আমাদের এই অলৌকিক হাসির চৌকাঠ পেরোতে হবে।

Facebook Comments

পছন্দের বই