লেখক নয় , লেখাই মূলধন

পল নিহাগীর গদ্য।। অনুবাদ: প্রলয় মুখার্জী

প্রবঞ্চকর

আমি প্রবঞ্চক, এ কথাই বলছিলাম নিজেকে। গভীর রাতে প্রশ্ন করি, আমি কে? বলি ও! তুমি প্রবঞ্চক মাত্র। মাদাগাস্কার জঙ্গল এ কথাই তো শেখায় প্রতিদিন। একটি নীল লেমুর তন্দ্রাচ্ছন্ন কুয়াশার ভিতর আড়াআড়ি ছুটে যায় যখন, চেরি ফলের চেয়ে লাল টকটকে ক্যামিলিয়ন দু’টি বাওয়াবের নিদ্রাকাতর শাখায় ক্ষণকাল সঙ্গমরত, এই পৃথিবী সুন্দর লাগে। সুন্দর এমনই, আন্তানানারিভোর সমুদ্র তীরে ফরাসি অধ্যাপিকা, সোনালি পাটের চুল বুকের অর্ধেক আর নোনা হাওয়া অর্ধেক ঢেকে রাখা তার কলরব, তবু এ সুন্দর তথা জীবনও প্রবঞ্চক। আমি দেখেছি নীল শিয়ালকে পাখির সাথে প্রবঞ্চনা করতে। হলুদ মানুষকে মুরগি আর ভেড়ার সাথে প্রবঞ্চনা করতে। অপরিপক্ক ফল আর গাছের সাথে প্রবঞ্চনা করেই আমাদের ভালবেসে যেতে হয় যে যার স্ত্রী। এক পরজীবী বৃক্ষও শাঁসালো গাছের সাথে প্রবঞ্চনা করে। আমি নিজেকে সৎ ভাবতেই পারি না। আমি মিথ্যুক। এই পৃথিবীতে একমাত্র বোকা কাজ হল সততার ধারণা। মানুষ ছাড়া কোনো নীল পাখি, শ্যাম গিরগিটি অস্ট্রিচ নিজেকে সৎ মনে করে না। যেহেতু আমিও ওই সরীসৃপের বংশধর, নিজেকে প্রবঞ্চক বলেই মনে করি। আমরা অহরহ এই পৃথিবীর ভেড়া, লেমুর, গণ্ডার, হাতি শীল ও তিমির সাথে প্রবঞ্চনা করছি। নিজেদের সাথেও করছি। একমাত্র যৌন আচরণই মৌলিক প্রবঞ্চক। এই আচরণ দিয়েই একজন পুরুষ নারীর সাথে প্রবঞ্চনা করে। প্রবঞ্চনার উদ্দেশ্য যখন অনেক গভীর হয় অনেক ব্যাপ্তি আর বোধের হয়, আমাদের ধারণা জন্মায় একে অপরকে কতই না ভালোবাসি। কিন্তু আমি আমার যৌন অভ্যাস থেকে জানতে পারি, তুমিও পারো। বীর্য স্খলনের মুহূর্তে কোনো নারীকে কোনো পুরুষ ভালোবাসতে পারে না। ওই কয়েক সেকেন্ড আমরা উন্মাদ হয়ে পড়ি। এই সময় শরীরের প্রতি কোনো আবেগের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। শরীর নিজেই এক আচরণ হয়ে পড়ে। আমরা ভয়ানক যৌন লাভবান প্রবঞ্চক। এই প্রবঞ্চনার ফলেই প্রাণী আর উদ্ভিদের জগতে মাতৃত্ব সঞ্চার হয়। গাছে গাছে ফুলের হিল্লোল জাগে। ভ্রমরের পাছায় ভ্রমর চেপে বসে। এমনকী শিশুও সরলতার সুযোগে এই জগতের সাথে সরল প্রবঞ্চনা করে। প্রবঞ্চনার ব্যাপ্তি বোধ এতই মধুর, একে অপরের জন্ম আর মৃত্যুর সাথে এতই জটিল যে আমরা স্নেহ বলে ডেকেছি, আড়ালে ডেকেছি ও আমার পরকীয়া।

আমি দেখেছি নীল শিয়ালকে পাখির সাথে প্রবঞ্চনা করতে। হলুদ মানুষকে মুরগি আর ভেড়ার সাথে প্রবঞ্চনা করতে। অপরিপক্ক ফল আর গাছের সাথে প্রবঞ্চনা করেই আমাদের ভালবেসে যেতে হয় যে যার স্ত্রী। এক পরজীবী বৃক্ষও শাঁসালো গাছের সাথে প্রবঞ্চনা করে।

এই যে ভালবাসার সাথে যৌনতার প্রবঞ্চনা তুমি অস্বীকার করতে পারো ক্যারোলিন? ধরো তোমার মোমের মতো মসৃণ জঙ্ঘা নেই। গোলা পায়রার মতো টান টান স্তন নেই। তুমি যোনীহীন, পাছাহীন এক কিম্ভুতাকার প্রাণী। তুমি কি বাবাতুনদের ভালোবাসা পেতে? ধরো তোমার শরীরের আকৃতি চৌকো টিভির মতো।

চিত্র: পোলাক জ্যাকসন

বাবাতুনদে কি টিভি কল্পনা করে মৈথুন করতো? নিশ্চই না ক্যারলিন। এমনকী তোমার বয়স নব্বই হলে তুমি কোনো যুবক পুরুষের ভালোবাসা অর্জন করতে পারো না। যৌনতা তোমায় সেই প্রবঞ্চনার সুযোগ এনে দেয়। প্রবঞ্চনা কোনো ক্ষতিকর বস্তু না। বরং সততার ধারণা ক্ষতিকর। আমি মনে করি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর মধুর সম্পর্ক হল প্রবঞ্চনা। এক শিয়াল অস্ট্রিচ পাখির ডিম চুরি করে যখন, সে প্রবঞ্চনা করেই টিকে থাকল আর এক দিন। পাখি অন্যান্য কীট পতঙ্গের সাথে প্রবঞ্চনা করে টিকে রইল। এই জীব জগৎ বাস্তুতন্ত্র খাদ্যশৃঙ্খল নয়, বিশাল প্রবঞ্চক শৃঙ্খলের মাধ্যমে টিকে থাকে। একে অপরের সাথে নানারকম জটিল আর সরল প্রবঞ্চনার আদান প্রদানের মাধ্যমেই সবুজ শস্য ভরা অরণ্য জঙ্গল ভরা পৃথিবী টিকে আছে। ঠিক এখানেই আমরা নিজেদের সততার প্রবাদ গিলে সত্য আর জয়ের ভ্রম গিলে জগতের প্রবঞ্চনার ক্ষতি করছি। আমি বলি জগৎকে সততার হাত থেকে রেহাই দিতে হবে। একটি কোকিলকে কাকের সাথে প্রবঞ্চনার সুযোগ দিতে হবে। তবেই বসন্ত আসবে। সবুজ অরণ্য আর নীল সমুদ্র তবেই টিকে থাকবে। তোমরা যদি স্বীকার না করো তবুও আমি নিজেকে প্রবঞ্চক বলব। ক্যারোলিনের জন্য যে-কোনো পুরুষের সাথে আমি প্রবঞ্চনা করতে পারি। পারি না? (গোটা ক্লাস হাসছে, এক মানববিদ্যার ছাত্রী চক ছুঁড়ে নিহাগীর মাথায় মারতেই সমস্ত ক্লাস বলল প্রবঞ্চক দূর হটো। নিহাগীর হাতের আঙুল মুড়ে থুতু দিল ক্যারোলিনের বন্ধু। আরও কিছু হতে পারতো, নিহাগী এক আত্মতৃপ্তি নিয়ে ক্লাস ছাড়ল সেদিন। এই আনন্দ তার ফের কবে হবে সে জানে না।)

Facebook Comments

পছন্দের বই