লেখক নয় , লেখাই মূলধন

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

নবম পর্ব

ব্যাবেলের লাইব্রেরি অথবা নাথিংনেস

‘অসংখ্য ষড়ভুজাকার গ্যালারি, প্রতিটির মাঝখানে নিচু-রেলিঙে ঘেরা এক একটা ঘুলঘুলি। যে কোনও ঘুলঘুলি থেকে নীচে ও উপরের ফ্লোরগুলি দেখা যায়। একের পর এক ফ্লোর…অনন্ত ফ্লোরের সমাহার। গ্যালারিগুলির গঠন একই রকম— প্রতিটিতে কুড়িটি করে বুক-সেলফ। ষড়ভুজের ছয়টি দিকের মধ্যে চারটিতে পাঁচটি করে মোট কুড়িটি বুক-সেলফ। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত এক একটি বুক-সেলফের উচ্চতা গড়পড়তা লাইব্রেরিয়ানের উচ্চতার থেকে বেশি নয় খুব একটা। ষড়ভুজের বাকি দুটি দিক ক্রমশ সংকীর্ণ হতে হতে রূপান্তরিত হয় এক প্রকোষ্ঠে, এই প্রকোষ্ঠ আবার প্রবেশ করে অপর এক ষড়ভুজের মধ্যে’।

লুই বোর্হেসের ‘ব্যাবেলের লাইব্রেরি’ এমনই অদ্ভুত, সেন্স ও নন-সেন্সের মধ্যে গড়ে ওঠা এক লাইব্রেরি। এই সেন্স ও নন-সেন্স, অর্ডার ও ডিজঅর্ডারের সীমারেখাটি আরও ধূসর হয়ে ওঠে টেক্সটির শেষ অংশে এসে। বোর্হেস এক কূট ও জটিল প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন আমাদের। বোর্হেসের লাইব্রেরি ‘এক অনন্ত লাইব্রেরি, পর্যায়ক্রমিক আবর্তিত হওয়ার মতো অনন্ত। যদি কোনো চিরন্তন পথিক কোনো একদিকে একবার যাত্রা শুরু করে, তা হলে সে হয়তো বহু শতাব্দী পর আবিষ্কার করবে লাইব্রেরির বইগুলির প্রতিটি খণ্ড একইভাবে এক বিশৃঙ্খলার পথ ধরে ফিরে ফিরে আসছে। এই আবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা সৃষ্টি করে চলেছে এক শৃঙ্খলার। এই সেই মহাশৃঙ্খলা। আমার নির্জনতার সাধনা সেই আশায় উদ্বেলিত হয়ে উঠছে একটু একটু করে।’

বোর্হেস অতি-শান্ত স্বরে একটি বাক্য লিখে রাখলেন, ‘The Library is unlimited but periodic’. এই প্যারাডক্সের সামনে দাঁড়িয়ে, এই একটি বাক্যের দিকে তাকিয়ে অনন্ত প্রহর কেটে যেতে পারে। ‘আনলিমিটেড’ অথচ ‘পিরিয়ডিক’— এই অসম্ভবের সম্ভব ‘হয়ে ওঠা’ কি তা হলে সম্ভব? না কি সমস্ত রহস্য ও তার সমাধানের শেষেও পড়ে থাকবে সমাধানহীন এক মহা-রহস্য?

কলেজের প্রথম সেমেস্টারের দিনগুলিতে এমনই রহস্যের সামনে ব্রায়ান গ্রিন-কে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন অধ্যাপক রবার্ট নজিক। গ্রিন ও নজিকের মধ্যে কথোপকথনটি এমন হতে পারত,

‘গ্রিন, তোমার আগ্রহের বিষয় কী’?

‘স্যার, আমি কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি ও ইউনিফায়েড থিয়োরিজ নিয়ে কাজ করতে চাই।’

‘বেশ, কিন্তু তোমার এই আগ্রহ তৈরি হওয়ার পিছনে নিশ্চয় কোনো নির্দিষ্ট কারণ আছে… সে-কারণটি কি আমাকে বলা যাবে?’

‘অবশ্যই স্যার… আমি চিরায়ত ও শাশ্বত সত্যের সন্ধান পেতে চাই… জানতে চাই বস্তুর স্বরূপ ও তাদের কার্যপদ্ধতি।’

‘খুব আকর্ষণীয় বিষয়… বেশ, ধরে নেওয়া গেল, তুমি যার সন্ধানে ব্যাপৃত সেটি পেয়েও গেলে… অর্থাৎ, কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি ও ইউনিফায়েড থিয়োরিজের রহস্য উন্মোচন করতে সমর্থ হলে। কিন্তু তারপরেও কি তুমি যার সন্ধানে ব্যাপৃত সে-রহস্যের উন্মোচন করতে পারবে?’

‘অবশ্যই, কারণ, ইউনিফায়েড থিয়োরিজের পর আর কোনো প্রশ্ন বা রহস্যের অবশেষ থাকার সম্ভাবনা থাকতে পারে না।’

‘পারে, গ্রিন… কারণ, ইউনিফায়েড থিরোরিজের সন্ধান পাবার পর আরেকটি প্রশ্ন ঘনিয়ে উঠবে… কেন এই থিয়োরিজ? কেন অন্য কোনো থিয়োরি বা সূত্রের বদলে এই থিয়োরিজ দিয়েই ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হল? এই সূত্রের অনিবার্যতাই আরও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে, গ্রিন…’

— এই গূঢ় রহস্য ও প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাবেলের লাইব্রেরিটিই ভেসে ওঠে বারংবার। ‘নাথিংনেস’ নিয়ে বেশ কয়েকটি বিভ্রান্তিকর ধারণার পরিসমাপ্তি হওয়া জরুরি। যেখান থেকে আনলিমিটেড, অথচ পিরিয়ডিক অবস্থার শুরু সেখানে নাথিংনেস রীতিমতো এক বাস্তবতা হয়ে উঠতে পারে। ‘বাস্তবতা’ নামক শব্দটির মাধ্যমে আমরা আসলে ‘সামথিং’-এর নির্মাণ করতে সচেষ্ট হয়ে পড়ি। নাথিংনেস এই সামথিং-এর ধারণার মূলে সজোরে কুঠারাঘাত করে। গ্রিন তাঁর ‘দ্য হিডেন রিয়েলিটি’ গ্রন্থে এ-সম্পর্কে, নজিকের ধারণাটিকে সমর্থন করে এক গুরুত্বপূর্ণ অবজারভেশন রেখে গেছেন। চরম মাল্টিভার্সে সামথিং এবং নাথিং-এর মধ্যে কোনো অসামঞ্জস্য নেই। সামথিং ও নাথিং— উভয় ধরনের ইউনিভার্স নিয়েই মেটাভার্স বা মাল্টিভার্স গঠিত হতে পারে। একটি নাথিং-ইউনিভার্স আসলে সব প্রশ্নের অন্তে পড়ে থাকা, সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে এক নাথিংনেস দিয়ে তৈরি হয়ে ওঠা বিশ্ব।

— In the Ultimate Multiverse, a universe consisting of nothing does exist. As far as we can tell, nothingness is a perfectly logical possibility and so must be included in a multiverse that embraces all universes. Nozick’s answer to Leibniz, then, is that in the Ultimate Multiverse there is no imbalance between something and nothing that calls out for explanation. Universes of both types are part of this multiverse. A nothing universe is nothing to get exercised about. It’s only because we humans are something that the nothing universe eludes us.

গ্রিনের শেষ বাক্যটির দিকে তাকিয়ে শিহরণ খেলে যায়, এই নাথিংনেসের ব্রহ্মাণ্ডে আমরা, মানুষই একমাত্র সামথিং এবং এই কারণেই নাথিংনেসের ব্রহ্মাণ্ড আমাদের কাছে আপাত-প্রতারণাময়।

কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি ইউনিফায়েড থিয়োরিজের দিকে ছুটে চলা বিজ্ঞান ও নানা হাইপোথিসিসের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মনে হয় এই নাথিংনেস-কে আমাদের চৈতন্য-কাঠামো দিয়ে কি আদৌ ছোঁয়া সম্ভব?

গ্রিন ও নজিকের ডিসকোর্সের মধ্যে লুকিয়ে থাকে আরেকটি বিষয়, আমাদের চৈতন্য-কাঠামোর অনেকটাই জুড়ে রয়েছে সংখ্যা ও গাণিতিক পদ্ধতি। গণিত সংখ্যার খেলা এবং এই প্রশ্ন ক্রমাগত দখল করে নিচ্ছে মননবিশ্বের এক বড়ো অংশ— গণিত কি ইনভেনশন? না কি ডিসকভারি?

ইনভেনশন ও ডিসকভারির মধ্যে যে মহাদেশসম দূরত্ব… আদপে ইনভেনশন ও ডিসকভারি যে মননবিশ্বের গূঢ়লোকে দু-টি আলাদা বিষয়, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

দর্শনগত অবস্থান থেকে ডিসকভারির সঙ্গে আমাদের মেধা ও মননের যোগ সেকেন্ডারি… অর্থাৎ, প্রকৃতিতে যে-সূত্র নিহিত রয়েছে সেটিকেই আমরা আবিষ্কার করে চলেছি কেবল। এই ক্ষেত্র থেকে বিচার করলে, নাথিংনেসের বিষয়টি প্রকৃতির মধ্যে খোদিত হয়ে থাকা, হায়ারোগ্লিফিক লিপির মতো এক জটিল বিষয়। এই বিষয়টিকে অন্ধের সামর্থ্য নিয়ে আমরা ছুঁয়ে চলেছি শুধু।

কিন্তু গাণিতিক নিয়ম ও সংখ্যাগুলির ‘হয়ে ওঠা’ যদি চেতন ও মনন-সাপেক্ষ হয়, অর্থাৎ তা যদি আমাদের ইনভেনশন (মৌলিক উদ্ভাবন) হয়ে থাকে তা হলে নাথিংনেস বিষয়টি অধিক জটিল হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে নাথিংনেস একইসঙ্গে প্রকৃতির মধ্যে খোদিত হয়ে থাকা ও আমাদের আবিষ্কার হয়ে ওঠে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের বিজ্ঞান ও মনন সেই উচ্চতায় আরোহন করতে না-পারছে ততক্ষণ পর্যন্ত সেই নাথিংনেস আমাদের কাছে প্রতারক। কারণ, ইনভেনশন-ধারণার মাধ্যমে ইনভেনশনের পূর্বে কোনো কিছুর অস্তিত্বকে আমরা নস্যাৎ করে দিতে পারি। অর্থাৎ, সেক্ষেত্রে আমাদের উদ্ভাবিত নাথিংনেসের ধারণার ধারা বেয়েই আমরা নাথিংনেসকে আবিষ্কার করব।

কিন্তু সেক্ষেত্রে আরেকটি জটিলতর প্রশ্ন উঠে আসতে বাধ্য। আমাদের চেতনা ও মনন-সঞ্জাত গাণিতিক নিয়ম মূর্ত। গাণিতিক কাঠামোর মধ্যে শূন্যের ভূমিকা অসীম, হয়তো সব থেকে বেশিই। কিন্তু ‘শূন্য’ নিজেই একটি মূর্ত বিষয়। ঋণাত্মক-রাশির থেকে শূন্যের মান অধিক। ফলে শূন্যের ‘মান’ কখনোই নাথিংনেসকে সূচিত করতে পারে না। কারণ, নাথিংনেস এই শূন্যের ধারণা পেরিয়ে আরেকটি স্তর। নাথিংনেস শূন্যকেও ছাপিয়ে ওঠা এক নাথিংনেস।

যা কিছু আমাদের মননের মধু, যে-পথ ধরে আমাদের মননবিশ্ব নির্মিত হয়েছে সে-পথ ধরে নাথিংনেসকে ছোঁয়া কি আদৌ সম্ভব?

গ্রিন ও নজিকের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা ডিসকোর্সের সামনে দাঁড়িয়ে ঈশ-উপনিষদের একটি শ্লোকের কথা মনে পড়ছিল—

‘ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে

পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে’

— (পরব্রহ্ম পূর্ণ, ইহা পূর্ণ; এই সকল সূক্ষ্ম ও স্থূল পদার্থ পরিপূর্ণ ব্রহ্ম হইতে উদগত বা অভিব্যক্ত হইয়াছে। আর সেই পূর্ণস্বভাব ব্রহ্ম হইতে পূর্ণত্ব গ্রহণ করিলেও পূর্ণই অর্থাৎ, পরব্রহ্মই অবশিষ্ট থাকে। ত্রিবিধ বিঘ্নের শান্তি হউক)

শান্তিপাঠের ‘কল্যাণকর’ অংশটুকু এক পাশে সরিয়ে রাখলে এই শ্লোকের ঠিক বিপ্রতীপে গড়ে ওঠা ‘কাল্পনিক’ শ্লোকটি নাথিংনেসের খুব কাছে পৌঁছাতে পারত, হয়তো। নাথিংনেস, এই মাল্টিভার্সের মধ্যে ঘনিয়ে থাকা নাথিংনেস আসলে পূর্ণ পরব্রহ্মের বিপ্রতীপে এক ‘শূন্য’ পরব্রহ্ম… সেই শূন্যের থেকে সবটুকু শূন্য গ্রহণ করবার পরেও, হয়তো, সে-শূন্যের কোনো শেষ নেই।

হায়, সে-নাথিংনেসের মধ্যে হয়তো শূন্যেরও কোনো অস্তিত্ব নেই।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

ষষ্ঠ পর্ব

Facebook Comments

পছন্দের বই