লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রজিত জানার সাক্ষাৎকার

সাদা পাতা, কবিতা ও সময়-চিহ্নেরা

কবি প্রজিত জানার মুখোমুখি হলেন অর্পণ বসু

ঠিক কোন সময় আপনার প্রথম কবিতা লেখালেখির শুরু? শুরুর দিনগুলোতে কাদের কবিতা আপনাকে প্রভাবিত করেছিল?

কবিতা লেখার বদভ্যাস আমার মধ্যে দানা বেঁধেছিল বেশ বাল্যকাল থেকেই। প্রথম লেখা স্কুলের (পাঠভবন, কলকাতা) দেওয়াল পত্রিকায়। ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন। অতিরিক্ত স্নেহপ্রবণ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশ্রয় ও প্রশংসা আমার বালকোচিত উৎসাহকে একটু বেশি মাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে স্কুলের দেওয়াল ও ছাপা পত্রিকায় নিয়মিত লিখতাম। সাহিত্যসভায় কবিতা পড়তাম। সাহিত্য-প্রতিযোগিতায় কবিতা লিখে পুরস্কার-টুরস্কার পেতাম। ওই বয়সে ভালোই লাগত। ক্লাস টেন অবধি সম্ভবত এই পর্ব চলল। বছর পাঁচেক লেখালেখির, কবিতার… একটা প্রবল ঘোরের মধ্যে কেটে গিয়েছিল। তারপরে অবশ্য শুরু হয় এক দীর্ঘ বিচ্ছেদ-পর্ব। সে কাহিনি অন্য। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫-৮৬ অবধি আমি সম্ভবত একটি নতুন লাইনও লিখিনি। যে দু’চারটে লিখেছি— সেগুলো কিছুই হয়নি।

এবার তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে আসি। শুরুর দিনগুলোতে কেন, এখনো বাংলা কবিতায় যে দু’জন আমাকে সবচেয়ে ভিতর থেকে স্পর্শ করেন, তাঁরা হলেন— রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দ। আরও অনেকেই করেন, কিন্তু এঁদের মতো আর কেউ নন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমার কাছে প্রথম এসেছিল তাঁর গানের হাত ধরে। এখনো তাই আসে। রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যেই আমি তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাদের খুঁজে পাই। বরং কবিতা হিসেবে প্রকাশিত তাঁর বহু লেখাই আমাকে ততটা স্পর্শ করেনি কোনোদিন।

আর জীবনানন্দের কবিতার বই ছোটোবেলা থেকেই আমার বাড়িতে থাকলেও তাঁর কবিতা, আমি প্রথম মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করি কিছুটা পরে। ক্লাস এইটে স্কুলের সাহিত্য (কবিতা) প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়ার সুবাদে তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ আমি উপহার হিসাবে পাই। সাথে পেয়েছিলাম ‘ছন্দের জাদুকর’ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার বই। কিন্তু জীবনানন্দ আমাকে গ্রাস করেন। সেই শুরু…

যা বলেছিলাম, আরও অনেকের কবিতাই আমাকে মুগ্ধ করত। এখনও করে। কিন্তু এঁরা দু’জন যাবতীয় মুগ্ধতাকে অতিক্রম করে, কবিতার এক রহস্যময় জাদু-দরজা আমার সামনে খুলে দেন বারবার…

শৈশবের লেখালেখি আপনার কাছে আজ কতটা প্রাসঙ্গিক?
তেমন কিছু নয়। সে সময় একটা প্রবল ঘোরের মধ্য দিয়ে লিখতাম… এই অবধিই। সে সময়ের কবিতা বা লেখালেখির কিছু নিদর্শন হয়তো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আর বেশির ভাগই প্রায় হারিয়ে গেছে, মানে আমিই তাদের হারিয়ে যেতে দিয়েছি। আসলে ওই সময়টার প্রতি আমার যতই মমতা থাকুক না কেন, ওই সময় লেখা অধিকাংশ কবিতার প্রতি তেমন কোনো স্মৃতিকাতরতা আমার মধ্যে নেই বললেই চলে। তবে ওই যে বললাম… কবিতাগুলি বা অকবিতাগুলি ততটা নয়, কিন্তু তাদের হয়ে ওঠার পিছনে যে শিহরণ ও রোমাঞ্চ, তার তাপ যেন অনেক বছর পেরিয়ে এসে আজও আমাকে রোমাঞ্চিত ও উদ্বেলিত করে।

শুনেছি বেশ কিছু বছর আপনি লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছিলেন!
১৯৭৫ এর পরে বিশেষত জরুরি অবস্থার সময় থেকে আমার কবিতা লেখা বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় আরও অনেক কিছুই। যে-সব দিকে আমার আগ্রহ ও ঝোঁক ছিল, সেইসব কিছু থেকেই আমি ক্রমশ নিজেকে প্রত্যাহার করতে শুরু করি।

আরও বেশি জড়িয়ে পড়তে শুরু করি বামেরও একটু বাম দিকে হেলা সক্রিয় বিপ্লব-প্রয়াসী রাজনীতিতে। এর সূত্রপাত অবশ্য হয়েছিল সেই একাত্তর সাল নাগাদ, স্কুলে পোস্টার লেখা ও পাড়ায় মশাল-মিছিলে যোগদানের মধ্য দিয়ে। ’৭৩ সালে একবার বাড়িও ছেড়েছিলাম, কিন্তু সে গল্প স্বতন্ত্র। কিন্তু এইসব কাজকর্ম তখনও আমার অন্য সব জানালা-দরজা বন্ধ করতে পারেনি। ওই ’৭৫ সাল নাগাদ আমি আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়লাম বিপ্লবের স্বপ্নতাড়িত বাম রাজনীতির সঙ্গে… যা ইতিমধ্যেই ঐতিহাসিকভাবে পরাজিত ও বিপর্যস্ত। কিন্তু সেটা বুঝেও বা পুরোটা না বুঝেও আমি বা আমার মতো কতিপয় অর্বাচীন, কেন জানি না, সেই পরাজিত নায়কদেরই পক্ষ অবলম্বন করলাম… আরও বেশি উদ্যম ও সংকল্প নিয়ে। কোথা থেকে এসেছিল অযুক্তি-নির্মিত সেই জেদি আবেগ, তা আমি এখন আর স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করতে পারব না… তবে পরাজিত যোদ্ধাদের প্রতি আমার যেন চিরকালই কীসের একটা টান থেকে গেছিল। আজও যে একেবারেই নেই, তা নয়। প্রচলিত অর্থে যারা সফল ও জয়ী, তাদের ভাবনাচিন্তা কর্মকাণ্ডে আমি সাধারণত কোনও রোমাঞ্চ বা মৌলিক সৃজন খুঁজে পাইনি… পাওয়ার কথাও নয়, কারণ স্রোতের পক্ষে গা ভাসিয়ে রাখার দক্ষতাই তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য.. এইসব সামাজিকভাবে সফল ও জয়ীদের সাধারণত (ব্যাতিক্রম সাপেক্ষে) ধূর্ত ও প্রতিভাহীন বলেই আমি জেনে এসেছি…শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, সমাজ-সংসার-সংস্কৃতির প্রায় সর্বস্তরেই।

সে যাইহোক, সেই যে ’৭৬ সাল নাগাদ থেকে কবিতা লেখা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল তার জের চলেছিল ৮৫- ৮৬ সাল অবধি।

এই পর্বে কবিতার সঙ্গে কি কখনই সম্পর্কিত হননি আপনি?
রাজনৈতিকভাবে সে সময় বিপ্লবপন্থী বাম-মতাদর্শের শরিক হলেও শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমার কোনোদিনই তেমন মিল ছিল না। তাঁদের যেটুকু শিল্প-ভাবনা ছিল, ক্রমশ আমার কাছে তা অত্যন্ত যান্ত্রিক বলে মনে হতে শুরু করল। তাঁদের মতাদর্শের কাছাকাছি নন (বা তাঁরা যাদের মনে করতেন কাছাকাছি নন) এমন অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক বা কবিদেরই তাঁরা সন্দেহের চোখে দেখতেন। ব্যক্তি হিসাবে দু-চারজন হয়তো কিছুটা উদার ছিলেন, কিন্তু আমি এখানে বলতে চাইছি রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা সংগঠনের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতার কথা। মায়কভস্কি, নেরুদা বা সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁদের কাজ গ্রহণযোগ্য, কিন্তু সেটা যত না তাঁদের কবিতার কারণে, তারচেয়ে অনেক বেশি তাঁদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের দরুন। অন্যদিকে ইলিয়ট, পাউন্ড, আলেকজান্ডার ব্লক, আখমাতোভা বা পাস্তারনেক তাঁদের কাছে সন্দেহজনক, এমনকী জীবনানন্দ বা সুধীন দত্ত-ও অনেকটাই তাই, কারণ রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক থেকে তাঁদেরকে তথাকথিত ‘কমিউনিস্ট’ বা বামপন্থী বলা যাবে না। এরা কেউই দক্ষিণপন্থী নন, কিন্তু তা তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতার পক্ষে যথেষ্ট নয়। আর রবীন্দ্রনাথের গানকেই তো এক ধরনের পশ্চাদমুখী নিষ্ক্রিয়তার ভাববাদী দর্শন হিসাবে দেখা হতো। এই ছিল মোটামুটি ভাবনাচিন্তার ধরন। এবং এই ধরনটা, বলা বাহুল্য, অনেক পুরানো। পরে দেখেছি, ভারতীয় তথা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট বা বাম আন্দোলনের ইতিহাসে এটাই একটা প্রধান ধারা, যা তুলনামূলকভাবে উদার শিল্প মানসিকতাকে চিরকালই পশ্চাদপটে ঠেলে দিয়েছে এবং মাথা চারা দিতে দেয়নি কখনও। এমনকী আর্নস্ট ফিশারের ‘নেসেসিটি অফ আর্ট’-ও নয়, খ্রিস্টোফার কডওয়েলের ‘ইলিউসান অ্যান্ড রিয়েলিটি’-র তাত্ত্বিক সংকীর্ণতাই তখনও বাম-সংস্কৃতিক ভাবনাকে চালিত করে এসেছে।

কবিতা তথা শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের এই মনোভাবের কারণ কী?
আসলে শিল্প-সংস্কৃতি তথা কবিতা ও সাহত্যিকে তাঁর বিচার করতেন অত্যন্ত একপেশে সংকীর্ণ মাপকাঠিতে, নিজেদের ‘বৃহত্তর’ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের চাবিকাঠি হিসাবেই তাঁরা গোটা বিষয়টিকে দেখতেন। অবশ্য এটুকুও ভাবতেন খুব সামান্যই একটা অংশ, সক্রিয় কর্মী-সমর্থকদের অধিকাংশই কবিতা-টবিতার তেমন ধার ধারতেন না, যা কিছু সংস্কৃতি কাতরতা তা ছিল পথ-নাটক ও গণসংগীত কেন্দ্রীক। কারণ তা সরাসরি মানুষকে আলোড়িত ও উত্তেজিত করার কাজে অনেক বেশি লাগত।

পরে অবশ্য বুঝেছি বিপ্লবী-বাম বা সরকারি-বাম বলে নয়, ডান-বাম-মধ্য অধিকাংশ রেজিমেন্টেড রাজনীতির লোকেরাই (কী নেতৃত্ব, কী কর্মীরা) মূলত শিল্প-সংস্কৃতি-কবিতা সম্পর্কে বোধহীন, নিজেদের মতাদর্শের প্রচারের স্বার্থের বাইরে শিল্প-সংস্কৃতি তথা কবিতার নিজস্ব স্বাধীন পরিসর ও সম্ভাবনাকে বোঝার কোনো শিক্ষা বা প্রস্তুতিই তাঁদের অধিকাংশের নেই। তফাৎ এই, বামপন্থীদের কাছ থেকে আমার মতো অর্বাচীনরা আরও কিছুটা সংবেদনশীলতা আশা করেছিলাম, যেটা গোঁড়া ডান বা রক্ষণশীলদের কাছ থেকে কখনওই করিনি (আজও করি না), কিন্তু সেই আশা করাটা ছিল নিছকই একটা ঐতিহাসিক ভ্রান্তি।

তাহলে এই পর্বে কবিতার কাছ থেকে আপনি পুরোপুরি দূরে সরে গেলেন?
এহেন পরিবেশে, কবিতা লেখা বা কবিতা চর্চার প্রায় কোনো পরিসর বা অবকাশ ছিল না। তাছাড়া আমি যে ধরনের কবিতা লিখতাম বা লেখার কথা ভাবতাম তা তো এদের কাছে পুরোপুরি নিরাশা ও নেতিবাচক অবক্ষয়ের কবিতা বলে চিহ্নিত হতো— ফলে এ সবের ধার দিয়েও যেতাম না। ‘বৃহত্তর’ স্বার্থে বা ‘বিপ্লব’-এর স্বার্থে আমি আমার ওইসব ‘নিরাশাবাদী’ ও ‘অবিপ্লবী’ কবিতা লেখা বন্ধ করে দিলাম। সেই যে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম, কবিতা ও কবিতা-যাপন থেকে সম্পর্কহীন হয়ে রইলাম বেশ কিছু বছর, তা আমার মধ্য যে আড়ষ্টতা ও দ্বিধার জন্ম দিয়েছিল, তা কাটিয়ে তোলা, অনেক অনেক বছর পরেও আমার পক্ষে বড়ো সহজ হয়নি। তার জন্য কবিতার কাছে আবার ফিরে আসতে আমার একটু বেশি সময় লেগে গিয়েছিল।

তবে একথা ঠিক, একদিকে যেমন অনেক জানালা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে আবার বেশ কিছু জানালা খুলেও গিয়েছিল। সরাসরি শিল্প-সংস্কৃতির বাইরেও দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিভিন্ন বিষয়কে নেড়ে চেড়ে দেখার সুযোগ কিছুটা হয়েছিল। পড়াশুনার পরিধি কিছুটা বেড়েছিল।

সবচেয়ে বড়ো কথা অনেক বেশি মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলাম সমাজের বিভিন্ন স্তরের অনেক বিচিত্র ও মৌলিক মানব ও মানবী চরিত্রের সাথে, কিছুটা বেরিয়ে এসেছিলাম শিক্ষিত, মার্জিত মার্ক্স ও রবীন্দ্রমনস্ক বাঙালি সুভদ্র সমাজের চৌহদ্দির বাইরে, এমনকী মুখোমুখি হয়েছিলাম আতঙ্ক, সন্ত্রাস ও মৃত্যুভয় তথা মৃত্যুচেতনার, তুলনামুলকভাবে নিরাপদ ভদ্রলোকের জীবনে সীমারেখাকে কিছুটা অতিক্রম করে, এসে পড়েছিলাম এক ধরনের বিপদসীমানার প্রান্তরেখায়… তা এইসব মুহূর্ত একেবারে তাৎক্ষণিক এবং সরাসরিভাবে না হলেও আমার ভবিষ্যৎ ব্যক্তিত্বগঠন, জীবনযাপন ও কবিতা-যাপনের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রভাব ফেলেছিল তো বটেই।

তৃতীয় পাতা

 

Facebook Comments

পছন্দের বই