লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রজিত জানার সাক্ষাৎকার

সাদা পাতা, কবিতা ও সময়-চিহ্নেরা

কবি প্রজিত জানার মুখোমুখি হলেন অর্পণ বসু

কবিতার কাছে আবার ফিরে আসার প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল?

আটের দশকের মাঝামাঝি সময় পার করে একটু একটু করে হয়তো আবার কবিতার কাছে আমি ফিরে আসতে শুরু করলাম। তা অবশ্য করলাম যথেষ্ট দ্বিধা ও আড়ষ্টতা নিয়েই… এবং নিঃসন্দেহে এটা লক্ষ করলাম যে, ইতিমধ্যে বাংলা কবিতাও আমায় ছেড়ে এগিয়ে গেছে বেশ কিছুটা পথ।

বেশ কিছুটা, তবে অনেকটা বলে আমার মনে হয়নি। এক সময় সেই আড়ষ্টতা কিছুটা কাটতে শুরু করল, আমি ক্রমে অনুভব করলাম দূরত্ব যা তৈরি হয়েছে আমার কাছে তা আর অনতিক্রম্য নয়, দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও আমার পূর্বপ্রস্তুতি ও স্বাভাবিক প্রবণতা সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে আমাকে সাহায্যই করেছিল।
বিশেষ করে এই পর্বে রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে আমার বিচ্ছেদও সম্পূর্ণ হয়েছিল। মানসিক দূরত্ব তো বেশ কিছু সময় ধরেই তৈরি হয়েছিল, এই পর্বে অবশিষ্ট সংঘগত দায় থেকেও আমি নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে সক্ষম হলাম। মানসিকভাবে ‘সংঘ’ ও ‘সংঘের’ অনেকদিনের মুদ্রাদোষ ও অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আমি আবার হয়ে উঠলাম চূড়ান্তভাবে একা… এবং সেই একাকিত্ব ও আপেক্ষিক শূন্যতার মুহূর্তে, আমার স্বাভাবিক প্রবণতা আমাকে আরও গভীরভাবে নিয়ে আসতে শুরু করল কবিতার কাছাকাছি, ক্রমে কবিতাই হয়ে উঠল আমার নিঃশ্বাস ফেলার প্রধান জায়গা, নিজের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার প্রধান পরিসর। তবে আমার ধারণা নিজস্ব কবিতার ভাষা বা পথ খুঁজে পেতে আরও বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল আমায়। কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুর অতি উৎসাহে ওই পর্বে আমার এক-আধটা চটি কবিতার বই বেরিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সেটা না হলেই ভালো হতো। আমি নিশ্চিত আমার কোনও কবিতা সংগ্রহে এই পর্বের একটি কবিতাও আমি রাখব না।

তাহলে সংঘ-মুক্ত একাকিত্বের এই পর্ব থেকে কবিতাকে আপনি সম্পূর্ণ নিজের মতো করে পেলেন?

নিজের মতো অনেকটাই বলতে পার, কিন্তু সম্পূর্ণ আর পেলাম কোথায়! স্নাতকোত্তর অতিক্রম করতে হল, চাকরি খুঁজতে এবং নিতে হল (মা-বাবার তো তখন বয়স হচ্ছিল), তাছাড়া সম্পর্ক, বন্ধুতা, প্রেম, অপ্রেম, বিচ্ছেদ, মিলন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তো সবাইকেই একভাবে এগোতে হয়, আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু সে সব তো জীবনের অঙ্গ। সমাজ-স্পর্শহীন কোনও কাচের ঘরে তো আর কেউ কবিতার সঙ্গে বসবাস করে না, শিল্পের সঙ্গেও করেও না— তবে আমি যেটা বলতে চাইছি যে ওই পর্বে কবিতা এবং সম্পূর্ণ কবিতার সঙ্গেই বসবাস করার যে আর্তি ও তাগিদ আমার মধ্যে জেগে উঠেছিল, নানান কারণে তা আমি পুরোপুরি করে উঠতে পারিনি, প্রাত্যহিক জীবনের অন্যান্য নানান বাধ্যবাধকতা ও চোরাটানকে যেহেতু পুরোপুরি অস্বীকার করার মতো অবস্থা আমার ছিল না। বিশেষ করে জীবিকার সন্ধানে নানা টানাপোড়েনে আমি গিয়ে পড়লাম বিজ্ঞাপনের জগতে… আরও বিশেষ করে বিজ্ঞাপনী লেখার জগতে, যার সঙ্গে স্বাধীন সৃজনশীল লেখালেখির যে মানস-জগত তার তেমন মিল তো নেই-ই বরং সংঘাতই অনেক বেশি। শুধু ঢুকলাম তা নয়, জীবিকার প্রয়োজনে এই বিপরীতমুখী পরিবেশেই কাটিয়ে দিতে হল প্রায় বাকি জীবনের অনেকটাই। সুতরাং বুঝতেই পারছ— এই টানাপোড়েন, এই স্ব-বিরোধী দ্বৈত-অস্তিত্বের যন্ত্রণা ও প্রতিকূল পরিবেশে পরাধীনতার হাত থেকে পুরোপুরি নিস্তার কিন্তু আমি কোনোদিনই পাইনি।

আজকের ফেসবুকমুখর পরিমণ্ডলে যেখানে মানুষ নিজেই নিজের প্রচারে ব্যাপৃত, আপনি সেসব কোলাহলমুখর উন্মাদনা থেকে একটু দূরে থাকেন। নিজেকে নিভৃত রাখতে পছন্দ করেন। এ বিষয়ে কী বলবেন?

ফেসবুক-টেসবুক আসার আগেও যাঁরা কবিতা লেখার চেয়ে যোগাযোগ-দক্ষতায় বেশি উৎসাহ দেখিয়েছেন, তাঁদের সংখ্যা এবং গলার জোর নেহাত কম ছিল না। এঁদের অধিকাংশেরই মূল শক্তির উৎস ছিল ক্ষমতার সাথে নৈকট্য। ক্ষমতা বলতে কোনো না কোনো ধরনের বড়ো প্রতিষ্ঠান বা হয়তো কোনও ক্ষমতাবান ব্যক্তিত্ব, যিনি নিজেই একধরনের প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছেন। তা ছাড়াও বড়ো বাণিজ্যিক পত্রিকা বা প্রকাশনা সংস্থা হতে পারে, প্রতিপত্তিশালী সাংস্কৃতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হতে পারে, সরকারি বা আকাদেমি জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হতে পারে, এমনকী রাজনৈতিক দলের সাংস্কৃতিক শাখাও হতে পারে। একদল চিরকালই ছিলেন যাঁরা এইসব ক্ষমতার কেন্দ্র বা প্রতিষ্ঠানের সাথে সুপরিকল্পিতভাবে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। তাঁরা সবাই যে লেখক বা কবি হিসাবে একেবারে দুর্বল ছিলেন, এটা বলাটা অতিসরলীকরণ হয়ে যাবে। অনেক সময় যশস্পৃহা বা ক্ষমতা-স্পৃহা কোনো কোনো যোগ্য লেখককেও গ্রাস করেছে।

তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে ক্ষমতার সঙ্গে নৈকট্য, বশংবদতা ও আনুগত্যকে যাঁরা ব্যবহার করতে পেরেছেন বা চেয়েছেন, তাঁদের সবাই না হলেও অধিকাংশই লেখালেখির ক্ষেত্রে অযোগ্য, এবং সেই অযোগ্যতাজনিত নিরাপত্তাহীনতাই তাঁদের এইসব প্রতিষ্ঠান-বশংবদতার দিকে আরও ঠেলে দিয়েছে।
এখন তুমি যেটা বলছ, যে ফেসবুকে হোক বা অন্য কোনোভাবে হোক, যেসব তরুণ ও অতি তরুণ কবি-যশপ্রার্থীরা আত্মপ্রচারের কোলাহলে (এটাকে ‘উন্মাদনা’ না বলাই ভালো) ব্যাপৃত হয়েছেন, তাঁদের আমি সমর্থন না করলেও, খুব একটা দোষ দিতে পারব না। তাঁরা তো তাঁদের বিখ্যাত বা অল্প-খ্যাত নিকট-অগ্রজদের অধিকাংশের মধ্যে এই উচ্চকিত ও পরিকল্পিত আত্মপ্রচার-প্রবণতার পূর্ব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। তাঁরা দেখেছেন এসব করে অনেক অযোগ্য লেখকও (তাঁরা যে অযোগ্যতাকেও সবসময় চিহ্নিত করতে পেরেছেন তাও নয়) অন্তত দশ-কুড়ি-তিরিশ বছরের জন্য বেশ একটা কেউকেটা হয়ে উঠেছেন, মাতব্বর হয়ে উঠেছেন। ফলে তাঁরাও অনেকেই সেই একই প্রবাহে গা ভাসানোকেই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ ও স্বাভাবিক বলে মনে করেছেন।

এ প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলি। ফেসবুকে কবিতা দেওয়ার আমি একেবারেই বিরোধী নই। বিশেষত এই অসংখ্য সম্পাদক, প্রকাশক ইত্যাদির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের দায় থেকে যদি একজন কবি বা লেখককে তা আংশিকভাবেও মুক্ত করে। তা ছাড়া শুধু তরুণ বা আনকোরা কবি নন, অনেক সময় যোগ্য বা প্রবীণ কবিরাও প্রকাশক বা সম্পাদকের অনেকের কাছ থেকে তাদের ন্যূনতম প্রাপ্য মর্যাদাটুকুও পান না। তুমি যাদের সম্মান করো, এমন যেকোনও প্রবীণ বা তরুণ কবিকে প্রশ্ন করে দেখো, তাঁদের সকলেরই এই প্রকাশক বা সম্পাদককূলের কারো না কারো কাছে অসম্মানিত হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে।

তাহলে তো একজন নতুন লেখকের অসম্মানিত হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেশি?

স্বাভাবিকভাবেই একজন তরুণ বা নতুন লেখকের সামনে এই বিপদ আরও বেশি। তাই আত্মসম্মান বোধ কিছু মাত্র আছে— এমন তরুণ, অতিতরুণ বা এমনকী প্রবীণ কবিদেরও কেউ কেউ যদি ফেসবুকে তাঁদের নিজের কবিতা পোস্ট করেন, এবং স্ব-ঘোষিত সম্পাদক বা প্রকাশকের সাহায্য না নিয়েই নিজের কবিতার কিছু নতুন পাঠককেও খুঁজে পান; তাতে আমি অন্তত আপত্তি কিছু দেখি না।

কিন্তু, আপত্তি বা বিরক্তি তখনই আসে, যখন দেখি একজন কবি বা লেখক শুধু তাঁর লেখাটি পোস্ট করেই ক্ষান্ত নন, বরং নিজেই নিজের লেখাকে ঘিরে একটি ভাবমূর্তির বলয় তৈরি করতে অতি সক্রিয়, নিজেই নিজের লেখাকে গৌরব প্রদান করতে সচেষ্ট। কেউ প্রত্যক্ষভাবে, কেউ বা হয়তো একটু ঘুরপথে। আর নিজের লেখার কিছু অনুরাগী বা উৎসাহী পাঠক পেলে তো আর কথাই নেই, সেই পাঠককেও চমকিত ও মন্ত্রমুগ্ধ করে, ভক্তে পরিণত করার আপ্রাণ চেষ্টা। ‘লাইক’-এর সংখ্যা দিয়ে নিজের লেখার যোগ্যতাকে তুলে ধরার চেষ্টা। ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার খুব জানতে ইচ্ছা হয়, নিজেদের লেখা সম্পর্কে ন্যূনতম আত্মবিশ্বাসের অভাব থেকেই কি এ ধরনের আত্মপ্রচারের প্রয়োজন হয় তাঁদের! তা যেটা বলছিলাম, এসব যারা করেন, শুধু ফেসবুক নয়, তার বাইরেও তাঁদের চরিত্র ও কর্মপদ্ধতি একইরকমের।

কেউ কেউ আবার এমন ভাব করেন বা অজুহাত দেন, যে ফেসবুকে তাঁরা যেসব লেখালেখি করেন, সেগুলো নেহাতই তাঁদের বাঁ-হাতের লেখা, তাঁদের ‘আসল’ লেখা অন্য। বলা বাহুল্য, এও এক ধরনের নির্বোধ চালবাজি, ফেসবুকেই লিখুন বা নামি-অনামি বানিজ্যিক অথবা ছোট পত্রিকায়, প্রশ্নটা তো এটা নয় যে লেখাটি কোথায় বেরোলো। লেখাটি কোথায় পৌঁছল, কী দাঁড়াল, সেটাই আসল কথা। বানিজ্যিক বড়ো পত্রিকা বা ছোটো পত্রিকায় লিখলেই তো কোনো লেখা জাতে ওঠে না। আবার ফেসবুকে লিখলেও ওঠে না। লেখাটি যোগ্য কিনা, সেটাই লেখাটি বা কবিতাটি সম্পর্কে একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।

হ্যাঁ, একজন কবির পরিচয় তো প্রধানত তার সৃষ্টির মাধ্যমেই!

প্রধানত নয়, একজন কবির পরিচয় একমাত্র এবং শুধুমাত্র তাঁর লেখার মধ্য দিয়েই। তিনি কোথায় লেখেন, কোথায় কফি-চা খান বা খান না, মদ খান বা খান না, মদ খান খালাসিটোলায় না মোকাম্বোতে, কোন মঞ্চে তাঁকে দেখা যায় অথবা যায় না, তিনি সাদা পাঞ্জাবি পরেন না কালো কুর্তা— এগুলোর কোনোটাই একজন কবি বা লেখকের কোনো পরিচয় বহন করে না।

আরেকটা জিনিস ইদানিং খুব লক্ষ করি, যা আমাকে খুবই ক্লান্ত ও হতাশ করে, তা হল কবিদের সংঘস্থাপনের চেষ্টা। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠান, উৎসব, সম্বর্ধনা, মঞ্চ, মেলা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে একধরনের যূথবদ্ধতার আয়োজন বেড়েই চলছে। কবিতাকে কেন্দ্র করে এই ধরনের সংঘ বা গোষ্ঠীভিত্তিক যূথবদ্ধতার আয়োজন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিষ্প্রাণ, ক্লান্তিকর ও উদ্দেশ্যমূলক বলেই আমার মনে হয়। কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণত এসব অনুষ্ঠান বা যূথবদ্ধ ‘কবি’দের সংঘ গঠনের প্রচেষ্টা একেবারেই কোনো সাড়া আমার মধ্যে ফেলে না। আমার মনে হয় অধিকাংশই এসব করেন এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা ও হীনমন্যতার কারণে… আমি নিজে এসবের থেকে শত হস্ত দূরে থাকি এবং থাকব।

একজন, যিনি লিখতে এসেছেন, তাঁকে ব্যক্তি হিসাবে আড়াল খুঁজে নিতে জানতে হয় বলে আমার বিশ্বাস। তাঁর লেখার আড়ালে তিনি যদি পুরোপুরি আত্মগোপন করে যদি থাকতে পারতেন সবচেয়ে ভালো হতো সেটাই এবং এই আত্মগোপন করাটা আমি মনে করি, বিশেষত একজন কবির কাছে কোনও বাহাদুরি বা কৃতিত্ব নয়, এটাই তাঁর স্বাভাবিক চরিত্র বা স্বভাব-বৈশিষ্ট্য। আরও ভালো হতো, যদি শুধু লেখাই থাকত, লেখক না থাকতেন। কিন্তু তেমন তো আর আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে হওয়া সম্ভব নয়।

বাংলা কবিতার লেখালেখির জগতে আপনি কাদেরকে বন্ধু হিসাবে পেয়েছিলেন?

অল্প কয়েকজন বাদে আমার কাছের বন্ধুরা অধিকাংশই কবিতার জগৎ বা লেখালেখির জগতের বাইরের লোক। কবিতা বা লেখালেখির জগতে আমার যাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে, তাও শুধু লেখালেখির কারণে হয়নি, মানুষ হিসাবে তাঁরা আমার এবং আমি তাঁদের বন্ধু হতে পারতাম বলেই হয়েছে। অবশ্য কেউ কেউও নিশ্চয়ই আছেন বা ছিলেন বাংলা কবিতা বা লেখালেখির জগতে, যাঁদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হতে পারত অনায়াসেই, কিন্তু সুযোগ, সময়, উদ্যোগ ও পরিস্থিতির অভাবে তা হয়ে ওঠেনি।

তাছাড়া বন্ধুত্বের একটা প্রাথমিক শর্ত দোষ-গুণ সব নিয়েই একজন মানুষ যা, তাকে সেভাবেই গ্রহণ করা। কোনোরকম বিচার করার প্রবণতা নিয়ে বন্ধুত্ব হয় না। যেখানেই আমি এ ধরনের প্রবণতা লক্ষ করেছি (সেটা কবিতার জগতেই হোক বা তার বাইরেই হোক), সেখানেই বন্ধুত্ব দূরের কথা, পরিচিতি ঘটানোরও কোনো দায় আমি অনুভব করিনি।

তাছাড়া কারো কারো মধ্যে বিশেষত তাঁদের থেকে তরুণতরদের সঙ্গে ওপর থেকে মেশার একটা সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা আছে। কর্তৃত্ব করার, ভক্ত তৈরি করার প্রবণতা আছে। এটা শুধু বিরক্তিকর নয়, সম্পূর্ণ অনাধুনিক পশ্চাদপদ এক মানসিকতা। আর যাই হোক ‘ফ্যান’ বা ‘ভক্ত’ তৈরি করে বা নিজে ‘ফ্যান’ হয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আশা করা যায় না। এই ভক্তকূল এবং ভক্তপরিবৃত গুরুঠাকুরদের আমি সারাজীবন সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছি। বিশেষ করে কবিতার জগতে তো বটেই।

কারণ আমার কাছে আধুনিক বাংলা কবিতা বা আধুনিক কবিতা কোনো নাড়া-বাধা বা গুরু-শিষ্য পরম্পরার জায়গা নয়, সেটা ধ্রুপদী রাগসঙ্গীতের পরম্পরায় চলত এক সময়ে, যেহেতু সেটা ভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষিতের ঐতিহ্য বহন করে। কিন্তু সেই পরম্পরার মধ্যেও পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতার একটা জায়গা ছিল, হালের নাড়া-বাঁধাবাধির মধ্যে যে উদ্দেশ্যমূলক ও স্বার্থ-চালিত হিসেব-নিকেশের সর্বব্যাপী প্রাধান্য, সেটা অন্তত ছিল না।
একটা সময়, আমার বয়স অনেক কম ছিল, আমি আশা করতাম যে অন্তত কবিরা বন্ধুত্ব-স্থাপনের ক্ষেত্রে অনেক উদার বা আধুনিক হবেন। সমাজের অনাধুনিকতার কোনো প্রভাব কবিদের ওপর পড়বে না। কিন্তু অচিরেই সেই মোহ আমার কেটে গেছে। এখন আমি বুঝি মেলামেশার ক্ষেত্রে আধুনিকতা একজন ব্যক্তির মানসিক অবস্থান, ব্যক্তিত্ব গঠন ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতার উপর নির্ভর করে। তিনি কবিতা লেখেন, কলম পেষেন, না চায়ের দোকান চালান, তার ওপর নির্ভর করে না। অনেক কবি, লেখক, গবেষক, অধ্যাপকদের আমি চরম অনাধুনিক, সংকীর্ণ ও অনুদার হিসাবে দেখেছি, আবার বারো-দুয়ারিতে আসা প্রথাগতভাবে শিক্ষাহীন বা শিল্প-সাহিত্যের সাথে আপাত সম্পর্ক-শূন্য জাহাজের খালাসি বা কেরানিকে দেখেছি মানসিকভাবে অনেক প্রসারিত, বিচিত্র ও আধুনিক হিসাবে।

নিঃসন্দেহে কবি, লেখক, শিল্পীদের মধ্যেও মেলামেশা বা জীবনযাপনে প্রকৃত উদার, প্রসারিত ও বৈচিত্র্যময় এমন কাউকে কাউকে আমি পেয়েছি… প্রবীণ ও তরুণতর নির্বিশেষে তেমন কারো কারো সঙ্গে আমার আজীবন বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।

এখন আমারও যেহেতু কিছুটা বয়স হয়েছে, তাই আমার থেকে তরুণতর অনেক কবি বা উৎসাহী পাঠকের সঙ্গে কখনও কখনও দেখা হয়। তাঁদের সঙ্গে, বলা বাহুল্য, আমি বন্ধু হিসাবে সমানভাবে ও সহজ ভাবেই মিশি। বিশেষত যাঁরা অনেক তরুণ, আমার অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তাঁদের মুগ্ধ করা বা তাঁদের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার কোনও চেষ্টা আমি সচেতনভাবেই করি না। কারণ সেই করাটাকে আমি কোনো বাহাদুরি বা কৃতিত্ব নয়, নির্বুদ্ধিতা বলেই মনে করি।

আমি যখন তরুণতর ছিলাম, তখনও প্রবীণতরদের কাছ থেকে সেই ব্যবহারই আশা করতাম। যখনই সেটা না পাওয়ার সামান্যতম সম্ভাবনা দেখা দিত, তখনই আমি সযত্নে সে হেন সম্পর্ক বা সম্পর্কের সম্ভাবনা পত্রপাঠ পরিহার করতাম।

অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে প্রথম আলাপে আমি সাধারণত খুব একটা সপ্রতিভ নই। সেটাকে কখনও কখনও হয়তো কেউ উন্নাসিকতা ভেবে ভুল করেছেন। কিন্তু সেটা উন্নাসিকতা নয়, এক ধরনের স্বভাব-জাত আড়ষ্টতা। এই প্রাথমিক আড়ষ্টতাকে অতিক্রম করার ক্ষেত্রে আমি আমার ব্যর্থতা ও দুর্বলতা স্বীকার করছি।

শেষ পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই