লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রজিত জানার সাক্ষাৎকার

সাদা পাতা, কবিতা ও সময়-চিহ্নেরা

কবি প্রজিত জানার মুখোমুখি হলেন অর্পণ বসু

নিধিরাম দেখ দূরে আড্ডাঘর, নীল পানশালা।।
শাপভ্রষ্ট বন্ধুদের ম্লান মুখ, পান্ডুলিপি, কবিতার প্রেত
আকাশে উড়ন্ত লেখা, হত্যাদৃশ্য, বৃষ্টিহীন রাত
সুতিকাবাবের চুল্লি। মৃত্যু-গন্ধে জেগে ওঠা মেঘের প্রলাপ…

প্রথমেই শুরু করতে চাই আমার কাছে প্রাসঙ্গিক এ সময়ের একটি জরুরি প্রশ্ন দিয়ে। আজকের এই জটিল সময়ে কবি ও কবিতা কি ত্রাতা হিসেবে কাজ করতে পারে? তাকে চালিত করতে পারে উচ্চতা ও মহত্ত্বের দিকে?

দেখো, কবি তো নিজেই পতনোন্মুখ মানুষ ও তার পতনচিহ্নের অংশ। তিনি কি করে ত্রাতার ভূমিকা পালন করবেন? তাছাড়া, কবি তো কোনো ধর্মগুরু নন, কবিতাও কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়। তাই, ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কোনো দায়িত্ব কবি বা কবিতার নেই। আসলে, আমাদের ভাবনা-চিন্তায় আজও কতগুলি নির্বোধ ও গতানুগতিক প্রচলিত বয়ান (narrative) আধিপত্য বিস্তার করে আছে। তার একটি হল চারপাশের ক্ষরণ, গ্লানি, অবরোহণ ও ক্লেদের যেন বহু ঊর্দ্ধে কোনো একটা উঁচু বেদীর ওপর কবি ও কবিতার অবস্থান। যেন শ্বেত-পট্টবস্ত্র-পরিহিত পবিত্র এক বিগ্রহ— পাপ ও পচনের দুর্গন্ধ যাকে স্পর্শ করে না। এই গদগদ, চটুল উচ্চতা-ধারণা ও ছদ্ম-মাহাত্মের নির্মাণ চলছে সেই রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ বানানোর দুরভিসন্ধির পর্ব থেকেই। আর এখনকার কথা যত কম বলা যাই, ততই ভালো। তথাকথিত সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালির আত্ম-মর্যাদাবোধের অভাব ও বৌদ্ধিক নিরাপত্তাহীনতা আজ সম্ভবত এতটাই তলানিতে এসে ঠেকেছে যে, চাতকপাখির মতো তাদের তরল-মহত্মকামনা ও মুগ্ধতাবোধের তৃষ্ণা যে কোনও একটা নিকৃষ্টতম বিগ্রহ বা বেদীর জন্য হাপিত্যেশ করে বসে আছে।

অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন কবি ও কবিতাকে কোনো উচ্চতর মহত্বের আসনে বসানোর প্রবণতা অসংগত?

শুধু অসঙ্গত নয়, হাস্যকর। কবিতা তো নিজেই ব্যক্তির ও সময়ের সংকট ও পতনচিহ্নকে ধারণ করে। একজন আধুনিক কবি তো কোনো তরল মহত্ম-বাসনার উপাসক নন, কোনো ছদ্ম-উচ্চতায় বিচরণ করার বায়বীয় অভিলাষ পোষণ করেন না তিনি। কবিতা নিজেই নতুন পিপাসা ও জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়, কিন্তু নিছক সরল পিপাসা-নিবৃত্তির সমাধান-সূত্র সে হাজির করে না। একজন কবি তো নিজেই পাপ ও পতনের অংশ… তিনি আবার একটা কপট ও বানানো বেদীতে গিয়ে বসবেন কী করে!

তাহলে সময়ের পতন-চিহ্নকে ধারণ করাই একজন আধুনিক কবির কাজ?

ধারণ করা, তাকে আত্মস্থ করা এবং সেই সঙ্গে অতিক্রম করাও। কিন্তু, অতিক্রম করতে গেলে আগে তো তাঁকে ও তাঁর কবিতাকে এই পাপ ও পতনের অংশ হতে হবে! নরকের আগুনের (ইনফার্নো) মধ্যে দিয়ে না হেঁটেই বিয়াত্রিচের কাছে কীভাবে পৌঁছান যাবে? জরাকে অনুভব না করলে কীভাবে অগ্রসর হওয়া যাবে নিরাময় বা আরোগ্যের দিকে? পরাধীনতার জ্বালাকে অনুভব না করলে কীভাবে আসবে মুক্তির উপলদ্ধি বা তার সম্ভবনাটুকুও! এই সময়ের একজন সত্যিকারের আধুনিক কবির মনন, উপলদ্ধি ও সৃষ্টির সর্বাঙ্গে পতনের চিহ্নরা, উপাদানেরা ছড়িয়ে আছে… থাকতে বাধ্য! সেইসব পতন ও পাপের সংকেত ও অনুষঙ্গের মধ্যে দিয়ে তাঁর কবিতায় আসলে তো তিনি নিজেরই মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছেন, নিজেকে প্রশ্ন করছেন, এমনকি সন্দেহও করছেন…

সন্দেহও করছেন?
অবশ্যই। এ সময়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে সন্দেহ করা, নিজের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব ও তুচ্ছতাকে জিজ্ঞাসা চিহ্নের সামনে দাঁড় করানোই একজন আধুনিক কবির কাজ। তিনি তো কোনো উচ্চকিত-বাগ্মী নন, তথাকথিত ত্রাতা বা পথ-প্রদর্শক নন। কোনো ছদ্ম-আশাবাদের স্বরলিপি রচনা করা তাঁর কাজ নয়, কোনো সরলরৈখিক অবসান (closure) বা সমাধানের দিকনির্দেশ দেওয়া তাঁর কাজ নয়।

তিনি শুধু কথা বলার চেষ্টা করতে পারেন, বহু স্বরে; স্মৃতি ও অবচেতনের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা গভীরতম সংশয়, অসুখ, অসহায়তা, জিজ্ঞাসা, অপ্রেম, পাপ, ভালবাসা, স্বপ্ন, অভিজ্ঞতা, দুঃস্বপ্ন ইত্যাদিকে জাগিয়ে তোলা ও পুনর্নিমিত করার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজের অজান্তেই হয়তো নিজেকে ও নিজের “অপর”-কে, নিজের মধ্যে নিহিত ভবিষ্যতের সম্ভবনাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেন। এটাই… এটুকুই তাঁর স্বভাব ধর্ম ও ভবিতব্য।

এইবার একটু সরাসরি চলে আসব আপনার নিজস্ব কবিতা-যাপনের মধ্যে। ইতিমধ্যেই অবশ্য এ আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে… তবু, আর একটু সরাসরি জানতে চাইব— কবিতা আপনার কাছে ধরা দেয় কীভাবে?

তুমি হয়তো ঠিক সেভাবে বলতে চাওনি, অর্পণ। তবে আমি যতটুকু বুঝি, কবিতা তো ‘ধরা’ সেই অর্থে দেয় না। হয়তো কাছে আসে। ইশারায় কিছু জানতে চায়। কোথাও কোনো মূহুর্তে স্পর্শও করে। এমনকি কখনো কখনো যে লেখে, তাঁর সঙ্গে হয়তো কবিতাকে সেভাবে আলাদাও করা যায় না। লেখকের শরীর ও অনুভূতির অস্তিত্ব চেতনার ভিতর সে প্রবেশ করে— সম্ভবত এমন কোনো মুহূর্তে, যেখানে কবিতা ও কবির পার্থক্যরেখাটি প্রায় মুছে যায়। আর যে কোনো লেখককেই অপেক্ষা করতে হয় এমন কোনো মুহূর্তের জন্য। কিন্তু ওই পর্যন্তই। শেষ অবধি কবিতা ‘ধরা দেয়’ না। বাঁধা পড়ে না কোথাও। সে আসে ঠিকই, কিন্তু যে লেখে তাকেও সেই উপস্থিতিকে অনুভব করতে হয়, তাঁর উপযুক্ত হয়ে উঠতে হয়। যে কারণে আমার মনে হয়, কোনো প্রকৃত কবিতাই একেবারে শেষ হয় না, অসম্পূর্ণ থেকে যায়…

কিন্তু একজন কবি? তিনি কি ধরা পড়েন? এ বিষয়ে আপনার কী মত?

হ্যাঁ, কবি ধরা পড়েন… বাঁধা পড়েন বারবার— দৈনন্দিকতায়, তুচ্ছতায়, কপটতায়, সামাজিকতায়… ধরা পড়েন সাবধানতায়, সংসারে, দায়িত্ববোধে, মহত্ব-কাতরতায়… সর্বোপরি অমরত্ব বাসনার খোয়াবে বা মুহ্যমানতার তাৎক্ষনিকতায়। একজন সচেতন কবি হয়তো সেইসব প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করতে চান, হয়ে উঠতে চান প্রায় কবিতার মতো মুক্ত, সুদূর, দিকশূন্য, উপযোগিতাহীন, অসম্পূর্ণ ও নির্মোহ। কেননা, কবিতার… সেই রহস্যময় ডানাটিকে কোনো এক আশ্চর্য মুহূর্তে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন।

তাহলে শেষ পর্যন্ত কবিতা আপনার সামনে এসে দাঁড়ায় কীভাবে?

এটা বলা খুব মুশকিল। ব্যক্তিগতভাবে কবিতার সঙ্গে আমার সম্ভবত দেখা হয় যত না মায়া-বাস্তবতায়, তার চেয়েও দিনগত পাপক্ষয়ের তুচ্ছতা ও সামান্যতার ফাঁকে-ফোকরে। এক ক্লান্তিকর দৈনন্দিকতার ভিতর থেকে উঠে আসা কোনো অপ্রত্যাশিত বাঁকে। এই বাঁককে তুমি জাদু-বাস্তবতা বলতে পারো, পরাবাস্তবতা বলতে পারো, কাল্পনিক বা বিনির্মিত বাস্তবতা বলতে পারো, বা অন্য কিছুও বলতে পারো। তা এসব বাঁক বা তথাকথিত বাস্তবতার এই সব মায়াবী ফাটলগুলোতে হয়তো অনিবার্য ভাবেই মিশে যায়— স্মৃতি বা অবচেতনের গভীরতর স্তরে লুকিয়ে থাকা মুহূর্ত-স্বপ্ন-বেদনা-আকাঙ্ক্ষারা। কেন জানি না, আমার খুব মনে হয়… শরীর যেখানে থেমে যেতে চায়, সেই বিপদ সীমানায় যেন আবার নতুন করে জেগে ওঠে দূরাভিলাষের সেই সব আশ্চর্য সংকেত… কবিতা যেন অনেকটা শরীর, বাস্তবতা, পারিপার্শ্বিকতা ইত্যাদিকে আপাদমস্তক ছুঁয়েও তাদের অতিক্রম করার সেই স্পর্ধা, সেই দূরাভিলাষের সংকেতের মতোই… হয়তো আমি সম্পূর্ণ ভুল বলছি অর্পণ, কিন্তু আমার এ’রকমই মনে হয়।

সেই সংকেতগুলো কি শেষ পর্যন্ত কবিতার জন্ম দেয়?

না, কবিতার জন্ম দেবেই তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। এইসব সংকেত সম্ভবত কবিতার সম্ভাবনাকেই শুধুমাত্র বহন করে। আর তাদের যে খুব সুস্পষ্ট চেহারা বা অবয়ব থেকে যায়… এমন নয়। ধরো, একটা বিরাট অন্ধকার নিঃসঙ্গ টানেলের মুখ থেকে আচমকা বেরিয়ে আসা একটা রেলগাড়ির হেডলাইট, মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠেও মাঝ-দরিয়ায় হারিয়ে যাওয়া কোনো অজানা চর, পুরনো ক্ষতের মতো অকস্মাৎ বালির কবর থেকে উঠে আসা একটা সাদা ঝিনুকের মৃতদেহ— এ ধরনের যে কোনো অপ্রত্যাশিত সংকেত হয়তো তৈরী করতে পারে কবিতার মুহূর্ত বা সম্ভাবনা। আবার নাও করতে পারে। করবেই… এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। তবে এইসব সংকেত ও ইশারার মধ্যে দিয়ে ঠিক কবিতার সঙ্গেও নয়, কবিতার এক অস্পষ্ট অবয়বের সঙ্গে হয়তো কখনো কখনো দেখা হয় আমার, যার সামান্যই উন্মেলিত, বেশিটাই ধোঁয়ার চাদরে ঢাকা।

এই যে কবিতা বা কবিতার অস্পষ্ট অবয়বের সাথে আপনি মুখোমুখি হলেন, সেখান থেকেই কি কয়েকটা লাইন উঠে এলো? সেই লাইনগুলো কি আপনি স্মৃতির ভিতর টুকে রাখলেন, নাকি কাগজে?

কয়েক লাইন হয়তো নয়, বড়জোর দু’চারটি শব্দ বা একটি ছবি, অথবা কোনো শব্দ-নির্মিত চিত্রকল্প। তবে প্রথমেই তাকে ধারণ করার বা তুমি যেটা বলছ স্মৃতির ভিতর টুকে রাখার… কোনো উদ্যোগ আমার দিক থেকে থাকে না। কাগজে লিখে রাখার তো প্রশ্নই নেই। তবে হ্যাঁ, ওই একটি-দুটি শব্দ, লাইন বা চিত্রকল্প যাই বলো, ওদের সঙ্গে হয়তো ভিতরে ভিতরে বসবাস করি কিছুদিন। অনেক সময়ই সেই বসবাস ক্ষণস্থায়ী হয়। প্রথম মুগ্ধতা বোধ আসতে আসতে ফিকে হয়ে আসতে থাকে। আমি তাদের জোর করে ধারণ করার কোনো চেষ্টা করি না। যেভাবে তারা এসেছিল, সেভাবেই তাদেরও চলে যেতে দিই, মুছে যেতে দিই।

তবে কখনো কখনো এমন হয়, এক-একটা লাইন বা একটি ছবি কিছুতেই মুছে যেতে চায় না। তাদের সঙ্গে বেশ কিছুকাল বসবাস করেও আমার মধ্যে কোনো ক্লান্তি বা জড়তা আসে না। এবং তাদের ধারণ করতে, এবং ভিতরে ভিতরে প্রসারিত হতে দিতে আমাকে আলাদা করে কোনও সক্রিয় চেষ্টা করতে হয় না। এইরকমই কোনও একটা মুহূর্তে সত্যিই আমি কবিতার মুখোমুখি এসে দাঁড়াই, হয়তো…

কবিতার সম্ভাবনা কীভাবে কবিতায় রূপান্তরিত হতে পারে, আপনার আগের আলোচনা কি তারই একটা রূপরেখা?

না, রূপরেখা ঠিক নয়… আমি ব্যক্তিগতভাবে কী ধরণের প্রক্রিয়া বা রসায়নের মধ্যে দিয়ে কবিতার মুখোমুখি হই, কবিতার সম্ভাবনা বা প্রাথমিক উন্মেষকে কীভাবে আমার মতো করে ধারণ করি, বা করি না— সেই কথাই বলতে চেয়েছি। একান্তভাবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা প্রতিক্রিয়ার কথা। কিন্তু, কবিতার মুখোমুখি হওয়া বলো, উন্মীলন বা প্রসারণ বলো, কিংবা নির্মাণ প্রক্রিয়া বলো— তার কোনো ধরাবাঁধা রূপরেখা নেই। অসংখ্য ভাবে এবং অসংখ্য পথে কবিতার সাথে একজন কবির দেখা হয় এবং সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রূপরেখা মানেই একটা নির্দিষ্ট সীমান্ত, একটা ক্লোজার (closure)। কবিতা ও কবিতাযাপন এবং তার বিচিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ায় এ ধরণের কোনো সীমানা বেঁধে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই।

দ্বিতীয় পাতা

 

Facebook Comments

পছন্দের বই