লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনিন্দ্য রায়ের ধারাবাহিক: ফর্মায়েসি

প্রথম পর্ব

নয়ার/ননেট
(Nonet)

৯ লাইনের কবিতা ননেট। লাইনগুলিতে ক্রমে কম হতে থাকে দল (Syllable).
প্রথম লাইনে দলের সংখ্যা ৯
দ্বিতীয় লাইনে ৮
তৃতীয় লাইনে ৭
চতুর্থ লাইনে ৬
পঞ্চম লাইনে ৫
যষ্ঠ লাইনে ৪
সপ্তম লাইনে ৩
অষ্টম লাইনে ২
নবম লাইনে ১

অন্ত্যমিল থাকতে পারে, না-ও থাকতে পারে।
যে-কোনো বিষয় নিয়ে লেখা হতে পারে ননেট। সাধারণত শিরোনামযুক্ত।

অসুখ

প্রথমবারের ঘুম ভেঙে যাওয়া
অন্ধকারের প্রথম ধাক্কা
ঘেমে উঠবার তেষ্টাকে
ইনসমনিয়ায় ভোগা
একটুকরো পুরুষ
ভুলে যেতে
কখনও
পারে
না

ননেট শব্দটি সংগীত সম্বন্ধীয়। ৯ জন শিল্পীর বাজানোর জন্য কম্পোজিশন বা ৯জনের সংগীত-দলকে বলে ননেট।
বাংলায় আমরা বলতে পারি ‘নয়ার’। দলনির্ভর মাত্রাগণনা ছাড়াও ‘কলা’নির্ভর হতে পারে।

ছোটো কবিতার কবি

ছোটো কবিতার চে’ বড়ো
কিছু দেখতে পাইনি
নৈঃশব্দ্যের রা
একটি লাইনে
কিছুটা লিখে
চাপা দিয়ে
হারিয়ে
গেছে
সে

বাংলার তিনটি মূল ছন্দেই লেখা যেতে পারে নয়ার।

দশর/ইথারি
(Etheree)

১০ লাইনের কবিতা। লাইনগুলিতে ক্রমে বেশি হতে থাকে দল (Syllable)।
প্রথম লাইনে দলের সংখ্যা ১
দ্বিতীয় লাইনে ২
তৃতীয় লাইনে ৩
চতুর্থ লাইনে ৪
পঞ্চম লাইনে ৫
যষ্ঠ লাইনে ৬
সপ্তম লাইনে ৭
অষ্টম লাইনে ৮
নবম লাইনে ৯
দশম লাইনে ১০

এই ফর্মটি আবিষ্কার করেছেন আমেরিকান কবি ইথারি টেলর আমস্ট্রং (১৯১৮ -১৯৯৪)। অন্ত্যমিল থাকতে পারে, না-ও থাকতে পারে, লেখা হতে পারে যে-কোনও বিষয় নিয়ে।

জলের মতো সহজ কবিতা

প্রেম
হাতের
তালুতে
ধরে রাখা
যায় না কখনও
আঙুলের ফাঁক গলে
ফোঁটা ফোঁটা পড়ে যায়
কিছুক্ষণ ভেজা থাকে হাত
এই চরিত্রের জন্য হয়তো বা
বাংলা ভাষায় প্রেমের অপর নাম জল

বাংলায় ‘দশর’ আমরা বলতে পারি। তিনটি বাংলা ছন্দেই লেখা হতে পারে দশর।

Reverse Etheree বা বিপ্রতীপ দশরে মাত্রা সংখ্যা লাইনের ক্রমে কম হতে থাকে। প্রথম লাইনে দলের সংখ্যা ১০, দ্বিতীয় লাইনে ৯, তৃতীয় লাইনে ৮… অষ্টম লাইনে ৩, নবম লাইনে ২, দশম লাইনে ১।

রাত্রি

রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে
মনে হল উপোস তবে শেষ
খিদে নামল শরীর থেকে
লালসার হাঁ প্রকাণ্ড
আজ চাঁদ ডুবে গেলে
আকাশে দেখি
তারার মতো
ছড়ানো
আছে
ভাত

Double Etheree বা জোড় দশর হয় দুটি ইথারি যোগ করে, ওপরে একটি, নীচে আরেকটি। একটি সোজা ও আরেকটি বিপ্রতীপ ইথারিও হতে পারে। কলাবৃত্তে একটি জোড় দশর

আগুনরমণী

কে
চোখে
আমার
বেঁধে দিল
কালো কাপড়
নিজের শরীর
আগুনে খুলে ফেলে
আমায় বলল, ‘দ্যাখো’
তখন ষোলোটি নেকড়ে
দৌড়ে যায় তার চিৎকারে
আমার কান থেকে শ্রবণ
ছিটকে পড়ে বহু দূরে
নিজেকে নগ্ন করে
আগুনের ভেতর
ঢুকতে ঢুকতে
ছুড়ে মারল
বধিরতা
আমার
দিকে
কে

একে Stacked Etheree (স্তূপ দশর)-ও বলা হয়।

তিনটি দশর নিয়ে হতে পারে Tripple Etheree (ত্রয়ী দশর), চারটি নিয়ে Quardruple Etheree (চার দশর)।

ত্রয়ী/ব্রেভেট
(Brevette)

তিন লাইনের, তিন শব্দের কবিতার আঙ্গিক ‘ব্রেভেট’। আমেরিকার কবি এমিলি রোমানো (জন্ম ১৯২৪) তৈরি করেন এই ফর্মটি। হাইকু রচয়িতা ও হাইগা শিল্পী হিসেবে তিনি বেশ জনপ্রিয়।
প্রথম পঙ্‌ক্তিতে বিশেষ্য
(যা বাক্যটির কর্তা, যে দ্বিতীয় শব্দের কাজটি করে)
দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তিতে ক্রিয়াপদ
(অক্ষরগুলি ক্রিয়াশীলতা বোঝাতে মাঝে স্পেস দিয়ে,ফাঁক ফাঁক করে লেখা হয়।
বা না য়
আর এই স্পেস বাড়িয়ে কমিয়ে বোঝানো হয় ক্রিয়াশীলতার মাত্রা।
হাঁ টে
দৌ ড়া য়)
তৃতীয় পঙ্‌ক্তিতে বিশেষ্য
(কর্ম, এর ওপর কাজটি সম্পন্ন হয়)।

এমিলি রোমানোর একটি লেখা

rainbow
r a d i a t e s
spectrum

রামধনু
ছ ড়া য়
বর্ণালী

শিরোনাম না-ও থাকতে পারে আবার থাকতেও পারে ।
কোনও যতিচিহ্ন থাকে না, থাকে না কোনও সহায়ক ক্রিয়াপদ বা নির্দেশক (আর্টিকেল)।
স্টেফানি অ্যাবনে-র কবিতাটি শিরোনামসহ ব্রেভেট

On the Run

dog
s m e l l s
escapes

দৌড়

কুকুর
শুঁ কে ছে
পলায়ন

Brevette ফরাসি উৎসের একটি শব্দ যার সরাসরি অর্থ পেটেন্ট, লাইসেন্স; বলা যায়, অল্প কথায় লিখিত আইনি কাগজ। তেমনই এই কবিতা, মাত্র তিন শব্দে ।
বাংলায় কর্তা-ক্রিয়াপদ-কর্মের সম্পর্ক এরকম রৈখিক নয়। ক্রিয়াপদের অবস্থানও সচরাচর এরকম নয়। বিভক্তি যোগ হয় কর্মে এই বিষয়গুলি মাথায় রেখেই লিখতে হবে ব্রেভেট।
বাংলায় বলতে পারি ‘ত্রয়ী’

চোখ
লু কি য়ে ছে
অভিধান

স্নান

সাবান
সাঁ ত রা য়
ক্লান্তি

তিন শব্দে কবিতা হয় না ?
তিনটি মাত্র শব্দই তো বিশ্বের মহত্তম কবিতা, নৈঃশব্দ্যে বা কোলাহলে যেখানেই উচ্চারিত হোক, আমরা জানি সেই অমোঘ শব্দ তিনটি

আমি
ভালোবাসি
তোমাকে

হীরক কবিতা
(Diamante Poem)

কবিতাকে রুইতন বা হীরে বা বরফির আকৃতিতে লেখার উদাহরণ যথেষ্টই নজরে আস। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় কবিরা শব্দকে সাজিয়েছেন এমনভাবে যেন ওপর থেকে নিচে আস্তে আস্তে দীর্ঘ হয় পঙ্‌ক্তি, মধ্যভাগ পর্যন্ত, তারপর আবার হ্রস্ব। একদম ওপরে ও একেবারে নীচে সূচিমুখ, মধ্যের পঙ্‌ক্তিটি দীর্ঘতম।
Dylan Thomas-এর ‘Vision and Prayer’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘গ্রীষ্মের সুর’ কবিতাদুটির গঠন এইরকম।
Diamante poem বা ডায়মন্ড কবিতা— এই ফর্মটি ১৯৬৯ সালে তৈরি করেন আইরিশ ম্যাকক্লিলান টেইড্‌ট (Iris McClellan Tiedt) Diamante একটি ইতালীয় শব্দ যার অর্থ হীরক। এই ফর্মকে কেউ কেউ jewel balladও বলেন ।
কিন্তু শুধু রুইতনের মতো দেখতে হলেই তা Diamante poem হবে না।
এই কবিতা সাত লাইনের –
প্রথম লাইনে ১টি শব্দ, বিশেষ্য।
দ্বিতীয় লাইনে ২টি শব্দ, বিশেষণ, যারা প্রথম লাইনের বিশেষ্যকে বিশেষায়িত করে।
তৃতীয় লাইনে ৩টি শব্দ, ক্রিয়াপদ (ঘটমান বর্তমান), প্রথম লাইনের বিশেষ্যের সাপেক্ষে।
চতুর্থ লাইনে ৪টি শব্দ, বিশেষ্য, প্রথম ২টি প্রথম লাইন সাপেক্ষে, শেষ ২টি সপ্তম লাইন সাপেক্ষে।
পঞ্চম লাইনে ৩টি শব্দ, ক্রিয়াপদ (ঘটমান বর্তমান), সপ্তম লাইনের বিশেষ্যের সাপেক্ষে।
ষষ্ঠ লাইনে ২টি শব্দ, বিশেষণ, যারা সপ্তম লাইনের বিশেষ্যকে বিশেষায়িত করে।
সপ্তম লাইনে ১টি শব্দ, বিশেষ্য।
প্রথম ও সপ্তম লাইনের বিশেষ্য দুটি সমার্থক/ বিপরীতার্থক হতে পারে।

লণ্ঠন

অগ্নি
ক্ষুধার্ত প্রবল
পুড়ছে ছুটছে পোড়াচ্ছে
পাপপুণ্য ঘরবাড়ি লোকজন সংসার
দেখছে খুলছে দেখাচ্ছে
চঞ্চল লম্পট
আলো

বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র

ঘৃণা
কর্কশ অসভ্য
চাপছে ভাঙছে ফেলছে
সম্পর্ক শহর বসত হৃদয়
খুলছে হাসছে ধরছে
উজ্জ্বল হালকা
প্রেম

বাংলায় বলব রুইতন কবিতা, হীরক কবিতা।

(ভাষান্তর ও উদারহরণের কবিতা নিবন্ধকারের)

Facebook Comments

পছন্দের বই