লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনিন্দ্য রায়ের ধারাবাহিক: ফর্মায়েসি

 একাদশ পর্ব

ভিলানেল
(Villanelle)

উনিশ পঙ্‌ক্তির কবিতা ভিলানেল, ছয়টি স্তবকের। প্রথম পাঁচটি স্তবক তিন পঙ্‌ক্তির এবং শেষেরটি চার পঙ্‌ক্তির।
প্রথম স্তবকের প্রথম ও তৃতীয় পঙ্‌ক্তিদুটির পুনরাবৃত্তি হয়, প্রথমটি ফিরে আসে দ্বিতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ স্তবকের তৃতীয় পঙ্‌ক্তি হিসেবে। প্রথম স্তবকের তৃতীয় পঙ্‌ক্তিটি ফিরে আসে তৃতীয় ও পঞ্চম স্তবকের তৃতীয় পঙ্‌ক্তি হিসেবে এবং শেষ স্তবকের চতুর্থ পঙ্‌ক্তি হিসেবে।
প্রথম স্তবকের প্রথম ও তৃতীয় পঙ্‌ক্তিদুটির মধ্যে অন্ত্যমিল থাকে। প্রথম স্তবকের প্রথম পঙ্‌ক্তির সঙ্গে প্রতিটি স্তবকের প্রথম পঙ্‌ক্তির অন্ত্যমিল থাকে। একইভাবে প্রথম স্তবকের দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তির সঙ্গে অন্ত্যমিল থাকে প্রতিটি স্তবকের দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তির।
অন্ত্যমিল-বিন্যাস ক খ ক´ ক খ ক˚ ক খ ক´˚ ক খ ক˚ ক খ ক´˚ ক খ ক˚ ক´˚
(˚ চিহ্ন পুনরাবৃত্তি বোঝাতে ব্যবহৃত, ক´ প্রথম স্তবকের তৃতীয় পঙ্‌ক্তির শেষ ধ্বনি )।
এই সব নিয়ম মেনে লেখা ভিলানেল হল নির্দিষ্ট কবিতারূপ (fixed verse form)।
এর উদ্ভব গাথাধর্মী গান থেকে, চাষীদের গাওয়া গানের দ্বারা অনুপ্রাণিত এই ধারাটির প্রাথমিক অবস্থায় বাঁধাধরা কোনো নিয়ম ছিল না। পল্লীবিষয়ক এই রচনাগুলি ছিল খানিক অমার্জিত আর পুনরাবৃত্তির প্রবণতা ছিল প্রবল। জঁ প্যাসার ( ১৫৩৪-১৬০২) কবিতা ‘ভিলানেল’ (আমি যে হারিয়েছি আমার ঘুঘুটিকে … ) থেকে এই ফর্মটি নির্দিষ্ট রূপ পায়।
ভিলানেল শব্দটি এসেছে ইতালীয় শব্দ ‘ভিলানেলা’ থেকে, যার অর্থ গ্রাম্য গান বা নাচ । ‘ভিলানেলা’ আবার এসেছে ‘ভিলানো’ থেকে যার মানে পল্লীবিষয়ক, যার উৎস আবার মধ্যযুগীয় ল্যাটিনের ‘ভিলানাস’ শব্দটি, অর্থ খেতমজুর । ব্যুৎপত্তিগতভাবে গ্রামজীবনের সঙ্গে এর সম্পর্ক ভিলানেল বহন করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত সাধারণভাবে পল্লীগীতি বোঝাতেই ব্যবহৃত হত শব্দটি।
নির্দিষ্ট পঙ্‌ক্তিসংখ্যা, অন্ত্যমিল ও পুনরাবৃত্তি বিন্যাসসহ একটি কবিতা-ফর্মের দিকে যাত্রার শুরু করে জঁ প্যাসার এই কবিতাটি

ভিলানেল

আমি যে হারিয়েছি আমার ঘুঘুটিকে
শান্ত ওই ডাক, ও ডাক নয় তার ?
আমার প্রেম খুঁজে পাব তো সেইদিকে

ঘুরছ কেঁদে তুমি হারিয়ে সঙ্গীকে
আমিও, ভগবান, করছি হাহাকার
আমি যে হারিয়েছি আমার ঘুঘুটিকে

ভরসা করো যদি তোমার ঘুঘুটিকে
আমার বিশ্বাস হবেই ঠিক আর
আমার প্রেম খুঁজে পাব তো সেইদিকে

বলেছ প্রেমকথা করুণ সুর শিখে
আমার সব কথা আজকে এই সার
“আমি যে হারিয়েছি আমার ঘুঘুটিকে”

ছিল কি সুন্দর ঘুঘু সে হার্দিকে
অপর কেউ তার নিকটে কোন ছার
আমার প্রেম খুঁজে পাব তো সেইদিকে

মরণ, এইটুকু দিও গো শুধু ভিখে
তাকেই নিও যাকে দিয়েছি উপচার
আমি যে হারিয়েছি আমার ঘুঘুটিকে
আমার প্রেম খুঁজে পাব তো সেইদিকে।

যদিও এর উৎস ফরাসিতে অনেক ভিলানেল লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। এডমুন্ড গুস (১৮৪৯ – ১৯২৮) ও অস্টিন ডবসন (১৮৪০-১৯২১) ইংল্যান্ডে এই ফর্মটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
পরবর্তীতে ইংরেজিতে ভিলানেল লিখেছেন সিলভিয়া প্লাথ, ডিলান টমাস, এলিজাবেথ বিশপ, অ্যান্টনি লরেন্স, উইলিয়ম এম্পসন, এডউইন আরলিংটন রবিনসন প্রমুখ কবিরা।
ডিলান টমাসের লেখা ‘Do not gentle into that good night’ শীর্ষক এই ভিলানেলটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। জেমস জয়েসের ‘A Portrait of the Artist as a Young Man’ উপন্যাসে মুখ্যচরিত্র স্টিফেন ডেডালুস-এর লেখা হিসেবে একটি ভিলানেল আছে।
বাংলা ভাষায় ভিলানেলচর্চা আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময়ে কবিদের কলমে। আমাদের ভাষার গীতিময়তা্র সঙ্গে মানিয়ে যায় এই ফর্মটি। এবং পালাগান প্রভৃতিতে ‘ঘুরে ঘুরে গাওয়া’ ধুয়া-র যে রীতি তা মনে করলে ভিলানেল যেন আর বিদেশী থেকে না আমাদের কাছে।
যেমন বিষ্ণু দের ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৫০) কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটি

ভিলানেল্‌

দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে
সে কার হাওয়া আনে বনের নীল ভাষা।
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।

আলোর ঝিকিমিকি তোমার কালো চুলে,
উষার ভিজে মুখে দিনের স্মিত আশা,
দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে

পরশ মেলে মেলে তুমি যে ধরো খুলে,
হৃদয় সে উষায় থামায় যাওয়া-আসা,
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।

কে খোঁজে পথে আর কে ঘোরে পথ ভুলে;
অস্ত গোধুলিকে কে সাধে দুর্বাসা
দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে?

ঈশান মেঘে আর ওঠে না দুলে দুলে
ত্বরিতে কাঁদা আর চকিতে মৃদু হাসা,
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।

সে তরু এ হৃদয়, তুমি যে-তরুমূলে
বসেছ ফুলসাজে, ছায়ায় দাও বাসা
দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে,
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।

এছাড়াও শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়, বাণীউৎপল মুখোপাধ্যায় প্রমুখেরা বাংলা ভাষায় উল্লেখযোগ্য ভিলানেলচর্চা করেছেন।

জগাখিচুড়ি
(Fatras)

উদ্ভটরসের একটি কবিতার ফর্ম ফ্যাতা (Fatras), যার অর্থ জগাখিচুড়ি। এরও উদ্ভব মধ্যযুগের ফরাসি সাহিত্যে।
এই কবিতা
১১ লাইনের।
একটি দ্বিপদী থেকে প্রথম ও একাদশতম লাইন তৈরি হয়, যা পুরো কবিতাটির থিমকে ব্যক্ত করে। মধ্যের ৯ লাইনে থাকে বুদ্ধিদীপ্ত শব্দ-ক্রীড়া, ইচ্ছাকৃত অর্থহীনতা, উদ্ভটরস। দ্বিপদী অনেকসময় অন্য কোনও কবিতা বা গান থকে নেওয়া হয়।
মাত্রার বিধিনিষেধ নেই।
সাধারনত অন্ত্যমিলহীন, অন্ত্যমিলযুক্তও লেখা হতে পারে।

ফরাসির সীমা ছাড়িয়ে অন্য ভাষাতেও এই আঙ্গিকে লেখা হচ্ছে।
ব্রিটিশ কবি ক্লেয়ার ক্রোথার (জন্ম: ১৯৪৭) ইংরেজিতে লিখেছেন:

Tremella Nostoc

Our parents hunting star jelly
harvested fat.

Our parents hunting star jelly
after a storm
or when they had seen stars falling
on paths near home,
found stuff that had lost its light,
Tremella Nostoc, ‘a strange
gelatinous substance of no form
creeping over gravelly soils and mixing
with mosses on rocks by waterfalls’,
as familiar and weird as flesh-
harvested fat.

বাংলায়:

ছাই

“প্রতিটি হত্যার মুহূর্তেই
আলো নিভে যাওয়া আবশ্যিক”

প্রতিটি হত্যার মুহূর্তেই
গাছে গাছে কবিতার খাতা
রূপের চামচ বেজে ওঠে
সাতবছর হয়নি মাঘমাস
সাতমাস হয়নি সোমবার
মূষিকেরা নক্ষত্রে উধাও
ঘুম পড়ে সারারাত ধরে
বাদুড়ের ফলিত গণিত
দর্শন, তালগাছ, প্রেম
ভেঙে ফেলবার ঠিক আগে
আলো নিভে যাওয়া আবশ্যিক

যখন মধ্যের ৯ লাইনে কিছু সংহতি থাকে তাকে বলে জগাখিচুড়ি-সম্ভব (Fatras possible) আর যদি পুরোটাই হয় সঙ্গতিহীন, নিরর্থক তাকে বলে জগাখিচুড়ি-অসম্ভব (Fatras impossible) ।
পরপর দুটি ফ্যাতা মিলে তৈরি করে জগাখিচুড়ি-জোড় (Fatras double)।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

ষষ্ঠ পর্ব

সপ্তম পর্ব

অষ্টম পর্ব

নবম পর্ব

দশম পর্ব

Facebook Comments

পছন্দের বই