লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনিন্দ্য রায়ের প্রবন্ধ

প্রমথ চৌধুরীর ট্রিওলেট

[আমরা জানি, ট্রিওলেট বা ত্রিওলে হল মূলত আট লাইনের (যদিও ইতিহাসে সাত বা নয় লাইনের ট্রিওলেটের সন্ধান মেলে) এক স্তবকের কবিতা, যার প্রথম লাইনটির চতুর্থ আর সপ্তম লাইনে আর দ্বিতীয়টির অষ্টম লাইনে পুনরাবৃত্তি ঘটে।
এর অন্ত্যমিল-বিন্যাস ক খ ক ক˚ ক খ ক˚ খ˚ (˚ চিহ্ন পুনরাবৃত্তি বোঝাতে ব্যবহৃত)। প্রথম লাইনের সঙ্গে তৃতীয় ও পঞ্চম লাইনের অন্ত্যমিল (পুনরাবৃত্তি নয়), একইভাবে দ্বিতীয়র সঙ্গে অষ্টম লাইনের। আয়ামবিক টেট্রামিটারে লেখা হয় সাধারণত ইংরেজি ট্রিওলেট। ফরাসিতে সপ্তদশ শতক থেকে দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও অষ্টম লাইন আয়ামবিক ট্রাইমিটারে লেখা হয় আর এই লাইনগুলি পরে থাকে অ্যাম্ফিব্রাকিক (দুটি হ্রস্ব সিলেবলের মাঝে একটি দীর্ঘ সিলেবল) ‘ফুট’।
এর জন্ম মধ্যযুগীয় ফরাসি কবিতায়, সম্ভবত ফ্রান্সের উত্তরভাগে পিকার্দি অঞ্চলে। পুনরাবৃত্তি আছে এমন ফরাসি কবিতার ফর্ম রঁদো, রঁদেল, রঁদলে, বলা যেতে পারে, ট্রিওলেটের তুতো-ভাইবোন।
ট্রিওলেট শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ত্রিপত্র, একই বৃন্তে তিনপাতা বিশিষ্ট ‘ক্লোভার’ গুল্মের পাতা।
বাংলাভাষায় প্রথম ট্রিওলেট প্রকাশিত হয় ‘সবুজপত্র’-এর অগ্রহায়ণ, ১৩২১ সংখ্যায়, প্রমথ চৌধুরী লেখেন ‘তেপাটি’ শীর্ষক দুটি কবিতা ‘ঊষা’ ও ‘মধ্যাহ্ন’।
সঙ্গে ফুটনোট:
সবুজপত্রে “অনার্য্য বাঙ্গালী”-নামক প্রবন্ধের লেখক শ্রীযুক্ত বীরেন্দ্রচন্দ্র বসু(আই,সি,এস) বাঙ্গালার একটি Triolet রচনা করে নমুনা স্বরূপ সেটি আমাকে পাঠিয়ে দেন । সেই নমুনা-অনুসারে আমি এই কবিতাগুলি লিখেছি । “তেপাটি” নামও তাঁরই দত্ত। সুতরাং এই কবিতাগুলির নাম ও রূপের জন্য আমি তাঁর নিকট সম্পূর্ণরূপে ঋণী। প্র-চৌ।
যদিও এই রচনাগুলিতে ট্রিওলেটের গঠনকাঠামো পুরোপুরি মেনে চলা হয়নি।
শ্রীযুক্ত বীরেন্দ্রচন্দ্র বসুর কাছে বাংলাভাষার প্রত্যেক ট্রিওলেট-উৎসাহীই ঋণী।
‘সবুজপত্র’-এ ৫ম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, (শ্রাবণ ১৩২৫) নিজের ট্রিওলেট-চর্চা নিয়ে প্রমথ চৌধুরী লেখেন,
“ফরাসী কবিতা Triolet-এর ছাঁচে ঢালাই করে আমি এক সময়ে গুটি-কয়েক পদ্য রচনা করি এবং তার নাম দিই তেপাটি। সে সব তেপাটিতে Triolet-এর ঠিক গড়নটি বজায় রাখতে পারি নি। হাত দুই জমির ভিতর কুঁচিমোড়া ভাঙ্গা যে কি কঠিন ব্যাপার, তা যিনি কখনো কসরৎ করেছেন তিনি জানেন। তেপাটি লেখাও হচ্ছে লেখনীর একটা কসরৎ। Triolet অষ্টপদী কবিতা। এই আটপদের ভিতর, প্রথম পদটি ধুয়ো হিসেবে আর দু’বার, আর দ্বিতীয় পদটি আর একবার দেখা যায়। তা ছাড়া এ পদ্যের ভিতর শুধু একজোড়া মিল আছে। প্রথম তৃতীত চতুর্থ পঞ্চম আর সপ্তম পদ একসঙ্গে মেলা; বাকী তিন পদ একসঙ্গে মেলে। বলা বাহুল্য এ কবিতার ভাব ভাষা দুই নেহাৎ হাল্কা হওয়া চাই।”
প্রমথ চোধুরীর ট্রিওলেটগুলি এখানে সংগৃহীত হল।
:অনিন্দ্য রায়]

ঊষা

ঊষা আসে অচল শিয়রে
তুষারেতে রাখিয়া চরণ।
স্পর্শে তার ভুবন শিহরে
ঊষা আসে অচল শিয়রে,
ধরে বুক নীহারে শীকরে
সে হাসির কনক বরণ।
বসো সখি মনের শিয়রে
হিমবুকে রাখিয়া চরণ।।

মধ্যাহ্ন

আকাশের মাটি-লেপা ঘরে
রবি এঁকে দেয় আলপনা।
দেখ সখি মেঘের উপরে
কত ছবি আঁকে রবিকরে।
কত রঙে কত রূপ ধরে
ছবি যেন কবি-কলপনা।
বুকে মোর আছে মেঘ ভরে
তাহে সখি দাও আলপনা।।

সন্ধ্যা

দেখো সখি দিবা চলে যায়
লুটাইয়া আলোর অঞ্চল,
পিছে ফেলে অবাক নিশায়
দেখো সখি আলো চলে যায়।
বিশ্ব এবে আঁধারে মিশায়,
তাই বলে হোয়ো না চঞ্চল।
বেলা গেলে সব চলে যায়
গুটাইয়া আলোর অঞ্চল।

মধ্যরাত্রি

দেখো সখি আঁধারের পানে
চেয়ে আছে শুভ্র দুটি তারা।
দুটি শিখা বিকম্পিত প্রাণে
দেখো সখি আঁধারের পানে,
আঁধারের রহস্যের টানে
দুটি আলো হয়ে আত্মহারা।
রেখো সখি জ্বেলে মোর প্রাণে
আলো ভরা দুটি কালো তারা।

মিলন

জানো সখি কেন ভালোবাসি
ওই তব ফোটা মুখখানি,
ওই তব চোখভরা হাসি
জানো সখি কেন ভালোবাসি?
যবে আমি তোমা কাছে আসি
ঠোঁটে মোর ফোটে দিব্যবাণী
জানো সখি আমি ভালোবাসি
ওই তব গোটা মুখখানি।

বিরহ

বলি তব কেন চলে যাই
শুনে মোর মরমে কেঁদো না
দুঃখ দিতে, দুঃখ পেতে চাই
তাই সখি তোমা ছেড়ে যাই।
আমি চাই সেই গান গাই,
সুরে যার উছলে বেদনা।
তাই যবে দূরে যেতে চাই,
সখি মোরে থাকিতে সেধো না।

ছোটো কালীবাবু

লোকে বলে আঁকা ছেলে ছোটো কালীবাবু,
অপিচ বয়স তার আড়াই বছর।
কোঁচা ধরে চলে যবে, সেজে ফুল বাবু,
লোকে বলে বাঁকা ছেলে ছোটো কালীবাবু।
দিনমান বকে যায়, হয় নাকো কাবু,
সুরে গায় তালে নাচে, হাসে চরাচর।
লোকে বলে পাকা ছেলে ছোটো কালীবাবু,
যদিও বয়স তার আড়াই বছর।

সমালোচকের প্রতি

তোমাদের চড়া কথা শুনে
যদি হয় কাটিতে কলম,
লেখা হবে যথা লেখে ঘুণে,
তোমাদের কড়া কথা শুনে।
তার চেয়ে ভালো শতগুণে
দেয়া চির লেখায় অলম্‌,
তোমাদের পড়া কথা শুনে
যদি হয় কাটিতে কলম।

Facebook Comments

পছন্দের বই