লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনিন্দ্য রায়ের প্রবন্ধ

পাঁচ পঙ্‌ক্তির পৃথিবী

যক্ষ্মা, এই রোগটির খুব প্রিয় কবিদের ফুসফুস, সেখানে বাসা বাঁধে, বেড়ে ওঠে, তৈরি করে নিঃসীম ক্ষত। কত যে কবি ভুগেছেন, ক্ষয়ে গেছেন, প্রয়াত হয়েছেন যক্ষ্মায়!
৮ অক্টোবর, ১৯১৪। নিউইয়র্ক, রোচেস্টার। ৩৬ বছরের এক ভদ্রমহিলা মারা গেলেন এই অসুখে। পরের বছর ম্যানাস প্রেস প্রকাশ করল তাঁর একটি কবিতার বই ‘Verse’. এটিই তাঁর একমাত্র কবিতার বই আর কবিতাগুলিও লেখা জীবনের শেষ দিনগুলিতে। বইটিতে ২৮টি কবিতা ছিল বিশেষ চরিত্রের, লেখাগুলি ৫ লাইনের আর ২২ মাত্রার। পাঁচ লাইনের কবিতা/স্তবককে বলা হয় সিনকেইন (Cinquain, origin: Late 19th century: French, from cinq ‘five’), যে-কোনো পাঁচ লাইনের স্তবককেই। কিন্তু এই বইয়ের পাঁচ লাইনের কবিতাগুলির প্যাটার্ন বিশেষভাবে চিহ্নিত হল সিনকেইন বা অ্যামেরিকান সিনকেইন নামে।

সেই কবির নাম Adelaide Crapsey, জন্ম ৯ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৮, ব্রুকলিন হাইটস, নিয়িউর্ক। তিনি ছিলেন Algernon Sidney Crapsey নামের এক স্প্যানিশ পাদ্রির কন্যা। Adelaide ১৮৯৩ সালে Kemper Hall স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৮৯৭-এ Vassar College-এ। তারপর ১৯৯৩-এ নিজের স্কুলেই সাহিত্য পড়ান শুরু করেন। অসুস্থতার জন্য পরের বছরেই তাঁকে এই কাজ ছাড়তে হয়। আসেন ইউরোপে রোমে, অ্যামেরিকান অ্যাকাডেমিতে। কাটান ইংল্যান্ডেও। এই সময়ে তিনি উৎসাহী হন কবিতার মাত্রা ও তার বিন্যাস নিয়ে। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯১৮-তে প্রকাশিত হয় এই সমস্ত ভাবনার ফসল ‘A Study in English Metrics’ বইটি। ১৯১১-য় অ্যামেরিকা ফিরে এসে ম্যাসাচুয়েটসের স্মিথ কলেজে কাব্যতত্ত্বের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৩৩-এ অসুস্থ হয়ে স্যানেটরিয়ামে ভর্তি হন।
তারপর মৃত্যু এবং মৃত্যুর পর বই প্রকাশ। এক বিশিষ্ট কবিতার ফর্মের প্রবক্তা হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি।
কী আছে তাঁর ওই ৫ লাইনের কবিতাগুলিতে? কী আছে যা নিয়ে এত আলোড়ন?
তাঁর আগেও বিভিন্ন দেশে প্রচলন ছিল পাঁচ লাইনের কবিতার। সিসিলিয়ান কুইন্টেইন (Quintain), ইংরেজি কুইন্টেইন (quintain), স্প্যানীয় কুইন্টেল্লা (quintella), ফরাসি সিনকেইন (cinquain), জাপানি তন্‌কা, হাস্যরসাত্মক আঙ্গিক লিমেরিক— এসব তো ছিলই। তিনি যেটা করলেন এই পাঁচ লাইনকে নির্মাণ করলেন নির্দিষ্ট মাত্রাকাঠামোয়। তাছাড়াও কবিতায় পাঁচ লাইনের স্তবক আমাদের যথেষ্টই পরিচিত। Edgar Poe-এর কবিতা ‘To Helen’ মনে আসে আমাদের।
“Helen, thy beauty is to me
Like those Nicean barks of yore,
That gently, o’er a perfumed sea,
The weary, way-worn wanderer bore
To his own native shore.

On desperate seas long wont to roam,
Thy hyacinth hair, thy classic face,
Thy Naiad airs have brought me home
To the glory that was Greece.
And the grandeur that was Rome.

Lo! in yon brilliant window-niche
How statue-like I see thee stand!
The agate lamp within thy hand,
Ah! Psyche from the regions which
Are Holy Land!”

পাঁচটি লাইনের সিলেবল (বাংলায় কেউ অক্ষর বলেছেন, কেউ দল। আমরা ছন্দ অনুসারে মাত্রা ধরব) বিন্যাস ২-৪-৬-৮-২ আর স্ট্রেস (শ্বাসাঘাত) ১-২-৩-৪-২। জাপানি কবিতা হাইকু আর তন্‌কার প্রভাব ছিল এর গঠনবৈশিষ্ট্যে আর ইমেজিস্ট ভাবনার সাথে সাযুজ্য। ক্র্যাপসে তাঁর সিনকেইনে নাম হিসেবে ষষ্ঠ লাইনটিকে ব্যবহার করেছিলেন।
‘Verse’ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোয় ১৯২২-এ, তাতে ছিল, একটি পর্ব CINQUAINS 1911-1913, সেই ২৮টি পাঁচ পঙ্‌ক্তির।
তারই কয়েকটি:

NOVEMBER NIGHT

Listen…
With faint dry sound,
Like steps of passing ghosts,
The leaves, frost-crisp’d, break from the trees
And fall.

TRIAD

These be
Three silent things:
The falling snow…the hour
Before the dawn…the mouth of one
Just dead.

THE GUARDED WOUND

If it
Were lighter touch
Than petal of flower resting
On grass, oh still too heavy it were,
Too heavy!

THE WARNING

Just now,
Out of the strange
Still dusk…as strange, as still…
A white moth flew. Why am I grown
So cold?

১৯৩৪-এ প্রকাশিত বইটির তৃতীয় সংস্করণে আরও কিছু সিনকেইন যুক্ত হয়, আরও কিছু ১৯৭৭-এ প্রকাশিত ‘The Complete Poems and Collected Letters of Adelaide Crapsey’ বইটিতে।
স্কটল্যান্ডের কবি William Soutar (১৮৯৮-১৯৪৩) এই ফর্মে শতাধিক কবিতা লিখেছেন, যদিও তিনি এগুলির নাম দিয়েছেন Epigrams.
আরও নানান ভ্যারিয়েশন আছে সিনকেইনের, সেগুলিও দারুণ আকর্ষণীয়।
বিপ্রতীপ সিনকেইন (Reverse cinquain): মাত্রা ভাগ হবে উলটো। ২-৮-৬-৪-২ ।
মুকুর সিনকেইন (Mirror cinquain ): ১০ লাইনের, একটি সিনকেইন ( ২-৪-৬-৮-২ )-এর পর
একটি বিপ্রতীপ সিনকেইন (২-৮-৬-৪-২ ) ।
মুকুট সিনকেইন (Crown cinquain): একটি কবিতা যখন শুরু হয় একটি সিনকেইন দিয়ে।
প্রজাপতি সিনকেইন(Butterfly cinquain): ৯ লাইনের কবিতা, মাত্রা বিন্যাস ২-৪-৬-৮-২-৮-৬-৪-২
সিনকেইন মাল্য (Garland cinquain): ৬টি সিনকেইনের একটি সিরিজ, ষষ্ঠ স্তবক আগের স্তবকগুলির লাইন দিয়ে লেখা, প্রথম লাইন প্রথম স্তবকের প্রথম লাইন দ্বিতীয় লাইন দ্বিতীয় স্তবকের দ্বিতীয় লাইন… এইভাবে।
শিক্ষামূলক সিনকেইন (didactic cinquai): স্কুলে পড়াশুনোয় এর ব্যাবহার।
প্রথম লাইন: ১টি শব্দ, বিশেষ্য, শিরোনাম।
দ্বিতীয় লাইন: ২টি শব্দ, বিশেষণ যা বর্ণনা করবে প্রথম লাইনের বিশেষ্যের।
তৃতীয় লাইন: ৩টি শব্দ, প্রথম লাইনের বিষয়ে ক্রিয়া, অনেকক্ষেত্রে ক্রিয়াবিশেষ্য।
চতুর্থ লাইনে: ৪টি শব্দ প্রথম লাইনের শব্দটির বিষয়ে ভাব/অনুভূতি প্রকাশ করে।
পঞ্চম লাইনে: ৫টি শব্দ, প্রথম লাইনের শব্দটির অনুসারি বা সমার্থক।
“Bunny
Quiet, furry
Munching, sniffing, hopping
Asleep in the clover
Rabbit”

বাংলায়?
৫ লাইনের স্তবক আমরা দেখেছি। জীবনানন্দ দাশের ‘মেয়ে’ কবিতাটি ৬টি পাঁচ পঙ্‌ক্তির স্ট্যানজায় লিখিত।
“আমার এ ছোট মেয়ে— সব শেষ মেয়ে এই
শুয়ে আছে বিছানার পাশে
শুয়ে থাকে— উঠে বসে— পাখির মতন কথা কয়
হামাগুড়ি দিয়ে ফেরে
মাঠে মাঠে আকাশে আকাশে।”
[(প্রথম স্তবক) মেয়ে/জীবনানন্দ দাশ]

পাঁচ লাইনের কবিতা/স্তবককে বলা হয় সিনকেইন (Cinquain, origin: Late 19th century: French, from cinq ‘five’), যে-কোনো পাঁচ লাইনের স্তবককেই। কিন্তু এই বইয়ের পাঁচ লাইনের কবিতাগুলির প্যাটার্ন বিশেষভাবে চিহ্নিত হল সিনকেইন বা অ্যামেরিকান সিনকেইন নামে।

পাঁচ লাইনের সম্পূর্ণ কবিতার উদাহরণও আছে আমাদের ভাষায়।
একটি বাক্যের কবিতা যা পাঁচটি পঙ্‌ক্তিতে লেখা। মূল ঘটনাটি শেষ লাইনে বলা হয়েছে আর তাকে বর্ণিত করা হয়েছে আগের চার লাইনে।
“সোনালি ঝাড়লন্ঠনের মতো
টকটকে লাল মদ এবং তারপিন তেলের গন্ধমদির ময়লা ন্যাকড়ার
সম্মিলিত আরক্ত বিন্যাসে
পশ্চিমে
সূর্যাস্ত হ’লো।
(সূর্যাস্ত/অনন্য রায়)

শিরোনামে একটি বিশেষ্য, তাকে নিয়েই কবিতাটি পাঁচ পঙ্‌ক্তিতে।
“হাতপাখা, তার কাঁপা কাঁপা
সঞ্চালন থেকে হালকা সুতো
ছড়িয়ে পড়ছে সুতোগুলি
জাল বুনে চলে, সেই জাল
হাতপাখাটির গায়ে আঁকা”
(হাতপাখা/জয় গোস্বামী)

প্রথম লাইনটি এক শব্দের, সেটিই শিরোনাম সূচক, বাকি চারলাইন তাকেই কেন্দ্র করে, তার সম্পর্কেই বলা হয়।
স্টেশন
পৃথিবী একটা স্টেশন
কেউ টিকিট কেটেছে
কেউ বিনা টিকিটের যাত্রী
সবাই ট্রেনের অপেক্ষা করছে”
(সংহিতা-২/পরেশ মণ্ডল)

বাংলা ছন্দশাস্ত্রে পাঁচ পঙ্‌ক্তির স্তবককে বলে পঞ্চক।
“চারের অধিক পঙ্‌ক্তির প্রণালীবদ্ধ সমাবেশকে বলা হয় কলুক (stanza). কলুকও আবার পঙ্‌ক্তিসংখ্যা অনুসারে পঞ্চক(quintet)…”
—প্রবোধচন্দ্র সেন।

পাঁচ পঙ্‌ক্তির কবিতা, অসংখ্য সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের মুখোমুখি। সিনকেইন বা পঞ্চক, যে-নামেই ডাকি, পাঁচ লাইনে আরও আরও নিরীক্ষায় প্ররোচিত করে আমাদের।
তরুণ কবি, আপনার মনোযোগ এই ব্রহ্মাণ্ডকে আরও সুন্দর করবে, আমরা তো জানি, ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম এই পাঁচ পদার্থেই সৃষ্টি হয়েছে সকল।
হ্যাঁ, কবিতায় রচিত হোক পাঁচ পঙ্‌ক্তির পৃথিবী।

Facebook Comments

পছন্দের বই