লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনুপম মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ

এই ২০২০ খৃস্টাব্দে বাংলা উপন্যাস লেখার ব্যাপারে দু-চারটে কথা

বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশের সেই বাজারচলতি লেখকরা এইসব দুর্দ্ধর্ষ বই লিখে বড়োলোক হয়ে গিয়েছিলেন। আজও এঁদের নাম মুছে যায়নি। যেমন বিমল মিত্র, তিনিই তো আজ যে ডেইলি সিরিয়াল চলে তার বিকল্প প্রস্তুত করেছিলেন তাঁর ঢাউস সব উপন্যাসের মধ্যে, তিনিও তো প্রচুর পয়সা করেছিলেন উপন্যাস লিখে। আছেন গজেন্দ্রকুমার মিত্র তাঁর ‘কলকাতার কাছেই’ ‘পৌষফাগুনের পালা’ আর ‘উপকণ্ঠ’ নিয়ে, একটার পর একটা বুঁদ হয়ে পড়ার বই, কিন্তু মস্তিষ্কের কোনো মেহনত ছাড়াই। সেইসব লেখকরা ১লা বৈশাখে প্রকাশকের দোকানে হালখাতার নেমন্তন্ন পেতেন। সেই বইগুলো এখনও বই দোকানে পাওয়া যায়, কারণ বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের সেই ‘মাঝারি’ পাঠকরা আজও মৃত হননি, তাঁদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তাঁরা আজও বিদ্যমান, এবং এঁদেরই বইয়ের তাকে বাঙালি মহাপুরুষের লিঙ্গোত্থানের এবং বিচির লোম কামানোর ইতিহাস আজ সগর্বে শোভিত। নিমাইবাবুর ‘মেমসাহেব’ আর বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’-কে এঁরা বাপ-কাকা-মা-কাকীমার মুখ থেকে গ্রহণ করেছেন। মুখে মুখে এভাবেই একটা বই অনেক পথ চলে যায়। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ লেখেন-টেখেনও। বলে রাখি, আমি নিজেও এই বইগুলো কিনেছি, পড়েছি, কারণ শুধু বাংলা উপন্যাস লেখা নয়, বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসটা নিয়ে আমার যারপরনাই কৌতূহল আছে। আপনিও নিশ্চয়ই সেই কৌতূহলেই বইগুলো কিনে থাকবেন।

কিন্তু, ‘মেমসাহেব’ আর ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-র মধ্যে কী পার্থক্য আছে যে আমি প্রথমটাকে মুছে দিতে চাইছি পাঠকের মন থেকে? আমি মুছে দিতে চাইলেও সে মুছবে না। তার নিজের জোর আছে। আবহাওয়া আছে। উত্তম-অপর্ণার সুপারহিট সিনেমাও আছে। কিন্তু যেটা নেই, তা হল সেই গুণ যার ধ্বংস নেই— নিজেকেই ধ্বংস করার টান। এটা আসে কল্পনাশক্তির সেই সীমাকে পেরিয়ে যেখানে বাস্তব আর স্বপ্নের ভেদ ঘুচে যায় এবং একজন পাঠক চিরকালের মতো একটা অন্য জগতে ফেঁসে যায়। ইউরোপজুড়ে অজস্র লোহার পেরেক পাওয়া গেছে, দাবি করা হয়েছে সেগুলো দিয়েই নাকি যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, পাওয়া গেছে অনেক বর্শা, সবগুলোর ক্ষেত্রেই দাবি যে, সেই বর্শা দিয়েই নাকি যিশুকে খোঁচা মারা হয়েছিল। সেগুলো অনেক চার্চে উপাসিত হয়। লোকজন প্রচুর মানে, তীর্থযাত্রায় যায়, এবং মানত করে, সেই ইচ্ছা হয়তো পূর্ণও হয়ে যায়, ইচ্ছার নিজগুণেই হয়ত। তাহলেও, সেগুলো আদৌ সেই পেরেক বা বর্শা যে নয়, এটা স্বতঃসিদ্ধ। পেরেকত্বের কোনো ঘাটতি থেকে এটা হয় না, এটা হয় পেরেকের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া নশ্বরতা আর অবিনশ্বরতার টানাপোড়েনে। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ আর ‘মেমসাহেব’- প্লটভিত্তিক উপন্যাস দুটোই। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ প্রায়ই নিজেকে নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছে, লেখক নিজের অনিশ্চয়তা নিয়ে খেলেছেন, কিন্তু ‘মেমসাহেব’-এ আত্মঘাতী প্রবণতা একেবারেই নেই, লেখক জানেন তিনি কী লিখছেন, ঘটনা অনেক বেশি প্রকট, লেখা অনেক বেশি সাবলীল, পাঠককে টেনে রাখার মতো যথেষ্ট জটিলতা আছে, টেনশন আছে। কিন্তু, ‘মেমসাহেব’-এ সেই শাশ্বত লোহা নেই যা একটা পেরেককে যীশুর রক্তের সঙ্গে যুক্ত করে, যদি সত্যিই কোনো ঐতিহাসিক যীশু ছিলেন কখনো, সেই মর্চেও নেই। ‘শাশ্বত’ সবটাও আজকাল বড্ড ইউরোপীয় শোনায়, যাই হোক, যীশুকে উদাহরণ করেই তো বললাম।

আমি সেই উপন্যাসকেই বরণ করে নিতে চাই যে-উপন্যাসের মধ্যে নিজেই নিজেকে নষ্ট করে ফেলার প্রবণতা আছে। একজন সুখী লেখকের দুঃখের কাহিনি নয়, একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী লেখকের সুখের গল্প নয়। একটা উপন্যাস যখন আপনি লিখছেন, আপনি একটা পৃথিবী তৈরি করছেন। পৃথিবী তৈরি করার প্রথম এবং সবচেয়ে বড়ো বাধাটা হল, পৃথিবীটা তৈরি হতেই চায় না, তার নিজের মধ্যে তৈরি হওয়ার কোনো সাধ থাকে না, কারণ তৈরি হতে গেলে তাকে বিস্তর যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। নিজেকে নষ্ট করে দিতে চায় একটা নির্মীয়মান উপন্যাস প্রত্যেক শব্দচয়নে, প্রত্যেক বাক্যগঠনে। এটাকে গ্রাফিকভাবে দেখিয়ে গেছেন জেমস জয়েস তাঁর উপন্যাসগুলোয়, দেখিয়েছেন মার্সেল প্রুস্ত, দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ‘চতুরঙ্গ’-এ, দেখিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘কারুবাসনা’ বা ‘জলপাইহাটি’-র মতো সৃষ্টিগুলোয়, যেগুলো আসলে উপন্যাস কীভাবে লেখা হয় তার ডকুমেন্টেশন, এবং, একইসঙ্গে, কীভাবে লেখা হয় না।

পৃথিবীর প্রথম উপন্যাস লেখা হয়েছিল, যদি ধরেই নেওয়া যায় তার নাম ‘দন কিহোতে’, উপন্যাস কাকে বলে সেটা বিন্দুমাত্র না জেনেই। পৃথিবীর প্রথম যে-কোনো কিছুর দোষগুণ পরবর্তীদের ধারণ করতেই হয়। আজও একটি উপন্যাস লেখা হতে পারে একমাত্র উপন্যাস কাকে বলে সেটা পুরোপুরি ভুলে গিয়েই, পুরোপুরি যদি অসম্ভব হয়, সাধ্যমত ভোলার চেষ্টা অনিবার্য।

কিন্তু, এই ভুলে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, আপনি আপনার উপন্যাসটা লিখতে বসে সেই উপন্যাসগুলোর কথা মনের মধ্যে ছকে রেখে দেবেন যেগুলো বিংশ শতাব্দীতে লেখা হয়েছিল, এবং সেগুলোর গায়ে জুটেছিল ‘পরীক্ষামূলক’ ‘নিরীক্ষামূলক’ ‘অন্যধারার’ ‘সমান্তরাল’ ইত্যাদি তকমা। দুটো শতাব্দীর মধ্যে একটা প্রজন্ম থেকে আরেকটা প্রজন্ম নয়, প্রায় দুই প্রজাতির মানুষের দেখা মেলে। ১৮৬০-এর বাংলা উপন্যাস যেমন ১৯৬০-এ লেখা যায় না, ১৯৬০-এর বাংলা উপন্যাসও ২০২০-তে লেখা যেতে পারে না, তা সেই ১৯৬০-এর উপন্যাস যতই বিস্ফোরক হোক, যতই প্রাসঙ্গিক থাকুক, আজও তার পাঠক তৈরি হোক বা না হোক, আপনাকে সেই উপন্যাসকে নেগেট বা খারিজ করেই নিজের উপন্যাসে ঢুকতে হবে। যা হয়ে গেছে তা আর আনা হওয়ানোই উপন্যাস লেখার অনিবার্য শর্ত, হয়তো যে-কোনো শিল্পসাহিত্যেরই এটা প্রাথমিক শর্ত, এবং এটা পালন করতেই হয়। এটা পালন করার জন্য একজন তারকাটা সাহিত্যিককে লাগে, যে প্রচলিত কোনোকিছুকেই মানতে চায় না, সেই প্রচলিত ভালো হোক বা খারাপ, যেমন চাকরি করা ভাদ্রবউ তার দোর্দণ্ডপ্রতাপ ভাশুরের সামনে ঘোমটা দ্যায় না, আবার বুকও খোলে না। ফেমিনিস্টরা রেগে যাবেন না প্লিজ। আজকাল অতিসংবেদনশীলতার অসুখে ধরেছে মধ্যবিত্ত বাঙালি জাতিকে। সে যাক। চ্যালেঞ্জটা এখানেই।

সৃষ্টির সর্বনাশ করে ধাঁচা। বিধাতারও কোনো ব্লু প্রিন্ট ছিল না দুনিয়া বানানোর। সিমুলেশন যেটা হয়েছে সেটাতে তাই তাঁর নিজের খেলার আনন্দ রয়ে গেছে। আজ যেমন পুজো সংখ্যার বাণিজ্যিক উপন্যাস একটা গতানুগতিক ধাঁচাকে আশ্রয় করেই লিখিত হয়, যে-ধাঁচা বানিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বিমল কর, সমরেশ বসু, আশাপূর্ণা দেবীরা, শুধু পলেস্তারা আর রং বদলে দিলেই চলে, আজকাল তথাকথিত পরীক্ষামূলক উপন্যাসও কিন্তু একটা ধাঁচাই মেনে চলে, সেই চরম প্রেডিক্টেবল ধাঁচার প্রণেতা কখনো নবারুণ ভট্টাচার্য, কখনো সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। প্লটভিত্তিক উপন্যাস একদিন যেমন বাংলা সাহিত্যের অভিশাপ হয়ে উঠেছিল, আজ কিন্তু প্লটবিহীন উপন্যাস একইভাবে গড্ডলিকায় পর্যবসিত হয়েছে, যদিও আজও তার ঠাঁই হয়নি বাজারচলতির পঙক্তিতে। বাজারের বাইরে আরেকটা বাজার বসানোর চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। পাঠক তো মূল বাজার থেকেই পালিয়ে গেছে টেলিভিশনের দিকে বহুদিন, এখন আবার হাতের মুঠোয় সিনেমা দেখার যুগ চলছে।

যে কোনো ধাঁচাই অসহ্য। আশাপূর্ণা দেবী বা বিমল করের ধাঁচার চেয়ে নবারুণ ভট্টাচার্য বা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়েরটা যে অনেক মূল্যবান ও মহার্ঘ্য ধাঁচা এ তো একটা ট্রাইবাল কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। এই যে ট্রাইব, যাদের টোটেমের নাম ‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’ বা ‘কাঙাল মালসাট’, তাদের আমরা চিনি, তারা নাস্তিক কিন্তু গীতা বা কোরান পড়েনি, তারা ঋত্বিকভক্ত এবং সত্যজিৎবিদ্বেষী, তারা ওম পুরীর ভক্ত ও অমিতাভবিদ্বেষী, তারা নেশারু কিন্তু হাঁড়িয়া খায় স্টাইল স্টেটমেন্ট হিসাবে, তারা দান করে ফেসবুকের জন্য সেলফি তুলে, তারা গাঁজার কলকেতে টানও দ্যায় ফেসবুকের জন্য সেলফি তুলেই, সমবেত মদ্যপানের ছবি পোস্ট করে নিজেদের বিপ্লবী হিসাবে প্রত্যয়িত করতে চায়, তারা মার্কসিস্ট কিন্তু কোনো অসুস্থ রিক্সাচালকের সঙ্গে তুমুল দরকষাকষিই তাদের খাঁটি ক্লাস স্ট্রাগল, তারা ভাবে বাংলাভাষা তাদের অপেক্ষায় আছে কিন্তু এই ভাষার বানান এবং ব্যাকরণে তারা সিদ্ধহস্ত নয়, নিজেদের গাঢ় লাল বা সিপিয়া টোনের ব্যধিগ্রস্ত চেহারাটাই তাদের পত্রিকা-বইয়ের প্রচ্ছদ আর শিল্পীসত্তার ব্র্যান্ড ভ্যালু ঠিক করে দ্যায়। এই ট্রাইবটার দ্বারা বাংলা সাহিত্যের কোনো কল্যাণ হবে না, বরং পাঠক ব্যাপারটা আরো দূরেই সরে যাবে।

পাঠকের ব্যাপারটা গুরুত্ব দিতে উপন্যাস লেখক বাধ্য। একটা মহাকাব্য যেমন এক বিশেষ জনগোষ্ঠীর নায়ককে উপস্থিত করে এবং সেই জনগোষ্ঠীর এক সারসংক্ষেপ পেশ করে, যেটা খণ্ডকবিতা বা দীর্ঘকবিতার পক্ষে অসম্ভব, উপন্যাসও এক বিশেষ বা সাধারণ সমাজের এক চলচ্চিত্র আমাদের আমনে তুলে ধরে, সে ব্যক্তিগত হতে পারে না, ব্যক্তিগত যে হতে পারে না, লেখকের চোখে যে নৈর্ব্যক্তিকতা থাকতেই হবে, এই শর্ত তাকে পালন করতেই হবে, অন্যথায় সে-উপন্যাস হবে না। উপন্যাস হল এক কাল্পনিক ও বাস্তবিক সমাজ, একইসঙ্গে। পাঠক সেখানে গিয়ে বাস করতে পারবেন, কিছুক্ষণ বা কিছুদিন, বা সারাজীবন। যেমন সমতলের মানুষ পার্বত্য উপত্যকায় বেড়াতে গিয়ে সেখানেই থেকে যাওয়ার কথা ভাবে, থেকেও যায় কিছুদিন, তেমন পাগলা হলে সারাজীবনই। এই মুহূর্তে যদি আপনি হারুকি মুরাকামির লেখা পড়েন, যদি পড়েন করমাক ম্যাকার্থি, স্টিফেন কিং, অরহান পামুক বা পাওলো কোহেলোর লেখা দেখবেন, তাঁরা পাঠককে বিভ্রান্ত করেন না। আমাদের এখানে তথাকথিত অল্টারনেটিভ লেখকদের দেখলে মনে হয় পাঠকদের সঙ্গে তাঁদের একরকম শত্রুতাই যেন আছে, তাঁরা সবাই লেখকদের লেখক হতে চান। এতে সুরাহা কিছু হয় না। বাজারি পত্রিকার লেখকদের এতে তাঁদের সস্তা লেখাগুলো লিখে যাওয়ার নৈতিক সুবিধাই বরং হয়ে যায়।

আমি যে চলচ্চিত্রের কথাটা বললাম একটু আগেই, সেটা খেয়াল রাখুন। উপন্যাস স্বয়ং এক চলচ্চিত্র। সে ঘটমান। সে নাটকের বিকল্প হিসেবে জন্ম নিয়েছিল। আজও সে কবিতার ভাষায় লেখা হোক বা খবরের কাগজের ভাষায়, সে কিন্তু নাটকেরই বিকল্প। এবং, এই কারণেই সে সিনেমার ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী। সিনেমার অবকাশ তার চেয়ে অনেক বেশি, জনপ্রিয়তা তার চেয়ে অনেক বেশি, এ এক পোয়েটিক জাস্টিস অবশ্যই। উপন্যাস নিজে একদা নাটকের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল অনেক কিছু, নাটক অনেক রিক্ত হয়ে পড়েছিল উপন্যাসের জনপ্রিয়তার ফলে। আজ সিনেমা অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে উপন্যাসের হাত থেকে, হাত ফাঁকা করে দিতেই চেয়েছে।

পরের পাতা
আগের পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই