লেখক নয় , লেখাই মূলধন

জয়ন্ত ঘোষালের প্রবন্ধ

‘এই রহস্যকে সহ্য করতে হচ্ছে’

“সামসারাস আয়াস তাপসি
বোধা-প্রকাশা লো বুম সহজ”

“এসেছি বসুন্ধরায় এক তপস্বিনী আমি,
‘আমি’-র পথে ‘বোধ’ আলো দেখিয়েছে আমাকে”

লাল দেদের সঙ্গে কিংবদন্তি আর আশ্চর্য গল্পের সহবাস জন্ম থেকেই। পণ্ডিত আনন্দ কাউল (১৮৬৮-১৯৪১), তাঁর জন্ম সম্পর্কিত এমন কিছু অদ্ভুত কিংবদন্তি সংগ্রহ করেছিলেন। যেমন, তাঁর পূর্বজন্মে লাল দেদের বিয়ে হয়েছিল পানদ্রেনথানের জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে, যেখানে তিনি এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। সন্তান প্রসবের এগারোতম দিন, কহ্নেথুর অনুষ্ঠানে, তাঁদের পারিবারিক পূজারী সিদ্ধা শ্রীকান্তকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই শিশুটা আমার কে?’— ‘কেন?’, সিদ্ধা বলেন, ‘এ তো তোমার ছেলে’।— ‘না’, লাল দেদ বলেন, ‘আমি অতি সম্প্রতি মারা যাব আর মারহম গ্রামে এক বাচ্চা ঘোটকি হয়ে জন্ম নেব, এই এই চিহ্ন নিয়ে। যদি আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর জানতে উৎসুক হন, এক বছর পরে মারহম গ্রামে এসে দেখতে পারেন।’ শ্রীকান্ত সেই গ্রামে গিয়েছিলেন এবং সেখানে সেই চিহ্ন-সংবলিত বাচ্চা ঘোটকির সন্ধানও পান। তাকে প্রশ্ন করতেই, সেই বাচ্চা ঘোটকি তাঁকে বলল যে, সে এখুনি মারা যাবে। সে বলে, আরও ছয় মাস পর ভেজিব্রর গ্রামে কুকুরছানা হয়ে সে জন্ম নেবে আবার, আর তিনি সেখানে গিয়েই তখন তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেতে পারেন। অবিলম্বে, হঠাৎ করে, নিকটবর্তী ঝোপ থেকে একটি বাঘ তীব্র বেগে এসে বাচ্চা ঘোটকিটিকে খেয়ে ফেলে। শ্রীকান্তের উৎসুকতা অত্যন্ত প্রবুদ্ধ হয়ে পড়ায়, তিনি কেবল ভেজিব্রর গ্রামে নয় তাঁকে অনুধাবন করতে যেখানে চিহ্ন-সংবলিত কুকুরছানা দেখতে পাওয়া গেল সেখানে গেলেন আর সেখানে গিয়ে তিনি কুকুরছানাটিকে আবার কোন জন্মে অন্য কোথায় দেখা হবে, এই প্রশ্ন করতে লাগলেন, আর এটা চলল তাঁর ষষ্টজন্ম অবধি। তারপর, সপ্তমবার, লাল দেদের পুনর্জন্ম হল পানদ্রেনথানের সেই একই পরিবারে, যেখানে তিনি প্রসবের এগারোতম দিবসে মারা গিয়েছিলেন। যেখানে বারো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হল পাম্পোরের দ্রাঙ্গাবালমহলে বসবাসকারী নিচাভাট নামের ব্রাহ্মণ পরিবারের এক যুবকের সঙ্গে। যে-পাম্পোর হল রাজা অজতপুরার মন্ত্রী পদ্মর (৮১২-৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ) স্থাপন করা প্রাচীন পদমপুর। এটা তখন, যখন তাঁর বাপের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে, বধূবেশী লাল্লা শ্রীকান্তকে ফিসফিসিয়ে বলেন: ‘ছেলেটি আমার কোনো এক পূর্বজন্মে আমার কোলে জন্ম নিয়েছিল, আপনি জানেন সেই আজ এখানে আমার বর।’ শ্রীকান্তের সব মনে পড়ে যায় আর বিস্মিত হয়ে পড়েন।

সন্তবৃত্তের কিংবদন্তিগুলোর সূত্রের খোঁজ পাওয়া অথবা তাদের গুরুত্ব, যদি কিছু থাকে, অনুধাবন করা সবসময় সহজ হয়ে ওঠে না। মৃত্যুর পরে আত্মার দেহান্তরপ্রাপ্তি এবং পুনর্জন্মে লাল দেদ বিশ্বাস করতেন। তাঁর বাকেও নিজের পূর্বজীবনের ঘটনাবলির উল্লেখের নজির আছে। এই নিত্য সময়কালের ধারায় তিনি স্মরণ করেন, তিনি জগতের এবং অন্যান্য সব বিদ্যমান বস্তুর লয় প্রত্যক্ষ করেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের পুনর্গঠনও। আরও অনেক কিংবদন্তি আছে লাল দেদকে নিয়ে, যেমন, শ্রীকান্ত ‘চান্দ্রায়ণ’ নিয়েছিলেন, এ হল চল্লিশ দিনের উপবাস আর রিপু দমনের উগ্র প্রায়শ্চিত্ত। একদিন সকালে লাল্লা তাঁর বাড়ি আসেন এবং জিজ্ঞেস করেন কোথায় ছিলেন তিনি। তিনি ধ্যানে মগ্ন ছিলেন এ-কথা জানার পর, লাল্লা মৃদু বিদ্রূপের সঙ্গে বলেন, ‘হ্যাঁ, দেখছিলাম তার ঘোড়াটা লাথাচ্ছে নন্দমার্গের তৃণভূমিতে।’ সামান্য ভিন্ন আরেকটি মন্তব্য পাওয়া যায়, ‘হ্যাঁ, নন্দমার্গে তার ঘোড়াটাকে নুন খাওয়াচ্ছিল।’ শ্রীকান্ত তার মন্তব্য শুনে অপমানিত বোধ করলেন, কারণ, তাঁর মন সত্যিই উদ্বিগ্ন ছিল এই ভেবে যে, গ্রীষ্মকালে তৃণভূমিতে তাঁর ঘোড়াটাকে অন্য একটা ঘোড়া লাথি মারছে। তারপর লাল দেদ সিদ্ধাকে প্রায়শ্চিত্ত প্রকৃত কেমন হওয়া উচিত তার নমুনা করে দেখান, তিনি মাথার উপর একটা মাটির হাঁড়ি রাখেন আর অন্য একটা হাঁড়ি পায়ের উপর এবং ক্ষীয়মান চাঁদের মতো, তাঁর শরীর ক্ষীয়মান হতে থাকে, পনেরো দিনের দিন ঘোর অমাবস্যায় তাঁর শরীরের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না এক ফোঁটা কম্পমান পারদ ছাড়া, তারপর শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় তাঁর শরীর আবার পূর্ণতা পায় ধীরে ধীরে পূর্ণিমার দিনে। আশ্চর্য হয়ে গুরু জিজ্ঞাসা করেন, ‘হাঁড়ির মধ্যে সর্বদা পারদের মতো তরলটা কী ছিল?’ ‘এটা ছিলাম আমি,’ লাল দেদ উত্তর দেন। অনুভূতি, আকাঙ্ক্ষা মন ও অহম, শরীরের সব উপাঙ্গ কর্তিত করেও আমি কাঁপছিলাম এই ভেবে যে, আমি হয়তো গৃহীত হব না, নিছক আত্মরিপু দমনে কোনো মুক্তি নেই। শেষমেশ ঈশ্বরের কৃপায় তা মেলে। গুরু বুঝতে পারেন শিষ্যা গুরুকে পিছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মুসলিম আখ্যানকার, পীর গুলাম হাসানও এই কাহিনির অন্য এক চেহারা দিয়েছেন। বলা হয় লাল দেদ শুদ্ধাচারি শব্দ আবৃত্তির প্রথাগত ভঙ্গির বদলে রহস্যময় আচার, নফি-ও-ইসবত, (অর্থাৎ, না বা ‘লা ইলাহ’, ও হ্যাঁ বা ‘ইল্ল-লাল-লাহ’), করে তাঁর প্রায়শ্চিত্তের নমুনা এক মুসলিমের কাছে পেশ করেছিলেন।

লাল দেদ ধার্য আচার আর অনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজনিয়তা এমনকী বিগ্রহ ও ছবি পুজোকেও ছাপিয়ে গেছিলেন। বস্তুত, মূর্তি পুজো, বলি, তীর্থযাত্রী হয়ে দেবতার থান ও পবিত্র স্থানে যাওয়া, নিছক শাস্ত্র আওড়ানো, উপবাস, বা নির্দিষ্ট আচার, এ-সব বাহ্যিক ক্রিয়া করেই যারা তৃপ্ত হতেন তাদের ভর্ৎসনাও করতেন। আসলে অসার ক্রিয়াকর্মকে গুরুত্ব না দেওয়াটা একজন শৈব যোগিনীর কাছে না ছিল কিছু অধর্ম, না ছিল অস্বাভাবিক। ত্রিক পন্থার গুরু বা আগমরাও এমনটাই বলছেন। যোগী তাঁর প্রাত্যহিক অর্চনা, মন্ত্রোচ্চারণ ও জল ব্যতিরেকেই করেন, তাঁর হোমও জপমালা ছাড়াই, তাঁর ধ্যান এমনি আচারহীন সম্পাদন, ফুল ও আনুষাঙ্গিক জিনিসের পুজো ব্যতিরেকেই তাঁর যজ্ঞ। ত্রিক মতে, মালা জপা কী ঠাকুরের নামোচ্চারণ এবং পুজোর নিমিত্তে শ্লোক আওড়ানো এ-সব নিম্ন স্তরের অর্চনা, আবার হোমে ও পুজোয় নৈবেদ্য চড়ানো আরও নিম্নের থেকেও নিম্ন স্তরের অর্চনা। নিম্ন মেধার লোকের কাছে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান বিগ্রহে অথবা প্রতীক চিহ্নে আর একইরকম নিরর্থক উপবাসের তুচ্ছ মান ও মূল্য। ঈশ্বরকে সাধনা করতে হবে সেই একজনের মতো ভেবে যার হাত পা পেট বা কোনো অঙ্গই নেই, কেবল সচ্চিদানন্দ ও প্রকাশ।

ধর্মের আনুষ্ঠানিক ভক্তির এই অন্তঃসারশূন্যতাকে লাল দেদ তাঁর বাকে এভাবে দেখান—

“হে মূর্খ, প্রকৃত কাজ নিহিত থাকে না
উপবাস বা কী অন্য অনুষ্ঠানিক আচারে
অথবা
মূর্তি নিছক পাথর
মন্দিরও পাথর বৈ কিছু না
মাথা থেকে পা অবধি পাথর।”

একদিন লাল দেদ বড়ো মাটির শঙ্কু আকৃতি (তাগারা) ঘড়ার মধ্যে বসেছিলেন আর মাথায় চাপিয়ে ছিলেন অনুরূপ আরেকটি ঘড়া, আর নিজে ছিলেন এই দুই-এর মধ্যে লুক্কিয়ায়িত। যারাই তাঁকে এমনটা করতে দেখেছিলেন হতভম্ব হয়েছিলেন এবং এর কিছুক্ষণ পরে ওপরের ঘড়াটা সরানো হলে তাঁরা দেখেন সেখানে আর কিচ্ছু নেই আর এই কিবংদন্তি অনুয়ায়ী এইভাবেই তাঁর মহাপ্রস্থান হয়।

লাল দেদ চলে গেলেন, কোনো প্রথাগত পরম্পরা না রেখেই। তাঁর দেহটি যেখানে পোড়ানো বা কবর দেওয়া হয়েছিল সেখানে কোনো সমাধি বা মন্দির অথবা মকবরা কিছুই গড়ে তোলা হয়নি। স্মৃতিচিহ্ন বলতে একটা তরাগ বা জলাশয়, এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যা লাল্লা তরাগ বলে পরিচিত ছিল, যেখানে অমরনাথ যাওয়ার পথে পুণ্যার্থীরা ডুবকি দিত।

“মারায়াম না কুনহ তা মারা না কাঁসি
মারা নেচ তা লাসা নেচ”

“আমার কাছে জীবন মৃত্যু সমান
আনন্দে বাঁচা আর আনন্দে মরা
আমি কারোর জন্যে শোকাহত নই,
না শোকাহত কেহ আমার জন্যে।”

আমার গুরু এক নিদান দিয়েছেন কর্মবিধির—

“চোখ না ফিরিয়ে চেয়ে থেকো অন্তরের দিকে,
সেঁটে রেখো অন্তরাত্মায় অটল।”

আমি, লাল্লা, হৃদয়ে নিয়েছি নিদানখানি, নগ্ন তাই জগৎময় আমি নৃত্য করেছি শুরু—

আমাদের পক্ষে লাল দেদের জীবন ও তাঁর বাকের সম্বন্ধে নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন। তাঁর জীবনকাহিনি রহস্যে আর কিবদংন্তির চাদরে ঢাকা, যাদিও আজও নানা কাশ্মীরি প্রবাদে ও লৌকিক বুলিতে এমন কিছু বাক্য পাওয়া যায় যা লাল দেদের জীবন সম্পর্কিত কোনো-না-কোনো কিবদংন্তির সঙ্গে জুড়ে আছে। তাঁর মুখে মুখে বলা বাক বলে যা পরিচিত সে-সবের প্রামাণিকতা নিয়েও নানা দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে।

লালা দেদ, না কিছু লিখে রেখে গেছিলেন, না কেউ স্বকর্ণে শুনে সে-সবের প্রতিলিপি করে রেখেছিলেন। তাঁর সমকালে তো দূর, যে-প্রাচীন কাশ্মীরিতে লাল দেদ বলেছিলেন, তা কখনো কেউ লিখে রেখেছিলেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। যে-কাশ্মীরি ভাষায় লাল দেদের বাকগুলো প্রাপ্ত হয়েছিল তা আধুনিক কাশ্মীরি এবং কালের প্রভাবে, নিরক্ষর চারণ কবিদের বদলে যাওয়া ধর্মীয় আনুগত্যের চাপে, ফারসি শব্দের ভেজালে, হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের পূর্বতন যোগ ও ত্রিক পন্থায় ব্যবহৃত নানা শব্দ ও আচার বিস্মৃত হওয়ায় মূলের শব্দ ও বাক্য অর্থ হারিয়ে ফেলায় প্রাপ্ত বাকগুলো বহু ক্ষেত্রেই মূলের থেকে সরে এসেছিল এবং তাপ্পি বা গোঁজ শব্দ জায়গা করে নিল অনেকখানি, ফলত লাল দেদের বাকের প্রামাণিকতার দ্বন্দ্ব জারিই থাকল, এবং নুন্দ ঋষির ‘নুরনামা’ কী রূপ ভবানীর ‘রহস্যাপদেশা’-য় অন্তর্ভুক্ত অনেক বাকই লালা দেদের বাক বলেও প্রচারিত ও পরিচিত, এমনকী এর উলটোটাও ঘটেছে।

যদিও লালা দেদের পক্ষে কিছু লেখা বা লিখিত কোনো পাণ্ডুলিপি রেখে যাওয়া কোনো অসম্ভব কিছু ছিল না। তিনি লিখতে চাননি, হয়তো এটাই একমাত্র কারণ। উদাহরণস্বরূপ লাল দেদের প্রায় সমকালের শিথিকান্তার মহান্যায়াপক্ষার পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি যেমন পাওয়া গেছে। লালা দেদ না প্রকাশের জন্য কিছু লিখেছেন, না করেছেন বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অবদান রাখার মতো কিছু। বস্তুত, তিনি বাকগুলো শুধু আওড়াতেন এবং সে-সময়ের প্রথানুযায়ী, মুখে মুখে ছড়িয়েছে। এ-সবই আমাদের অনুমান। কেউ, হয়তো লিপিবদ্ধ করেছিলেন সে-সব বাকগুলো ছাড়াও আরও কিছু, অন্য কয়েকটি, যা তিনি হয়তো ঘটনাচক্রে নিজে অথবা অন্যের থেকে শুনেছিলেন। এবং এভাবেই চলেছে যতদিন না এ-সব কথকতার অঙ্গীভূত হয়ে গ্রাম্য ভ্রামণিক চারণদের গানে, এবং পরবর্তীতে আজও কাশ্মীরি ধ্রুপদি সংগীত, সুফিয়ানা কালামে মজলিস-এ-মা’রিফিম, বা সুফি বা আধ্যাত্মিক অন্বেষীদের জমায়েতের শুরুতে পবিত্র আবাহন হিসেবে গীত হতে শুরু করল। এত দুষণ সত্ত্বেও লাল দেদের বাক বেঁচে রয়েছে এবং এর মধ্যেও অন্তত প্রায় শ-দেড়েকের বেশি বাককে লালা দেদের বাক বলে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু কেউ কেউ বলতেই পারেন সেটারই বা কী প্রামাণিকতা?

আমাদের লালা দেদের বাকের অন্তর্গত নিজস্ব প্রমাণাদির কাছে ফিরে আসতে হবে, এর যা কিছু প্রমাণকারী বলো, নিহিত আছে এর ভাষ্যে ও শৈলীতে। তথাপী এরও অনেকানেক সীমাবধ্যতা আছে। রাজরাজাদের উত্থান পতনের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত গ্রাম্য নারী লাল্লার বাকে সমসাময়িক ঘটনাবলীর কোনো ইশারা বা প্রাসঙ্গিক উল্লেখ নেই অথবা না আছে কোনো ঘটনার কোনো সুনির্দিষ্ট দিনাঙ্ক। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ধারণের, জন্য আমাদের কাছে পড়ে রয়েছে শুধু লাল দেদের কিছু রচনাশৈলীর প্রমাণ আর ছন্দ এবং চিন্তার বিন্যাস ও গুনাগুণ, যেভাবে এগুলো কোনো একটা ভাব প্রকাশে সংগঠিত হয়েছিল, এক কথায়, লাল দেদের শৈলীর বিশিষ্টতা। এগুলো আর অন্য কিছু নয়, তাঁর বাক থেকে, অন্যের দ্বারা রচিত বা ভ্রমবশত তাঁর নামে প্রচারিত বা লাল দেদের শৈলীর বৈশিষ্ট্য বহন করে না এমন রচনাগুলো থেকে তফাত করতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, কোনো একটি বাক যে সামগ্রিক ছাপ রেখেছে তার বৈশিষ্ট্যগুলোর সামগ্রিকতার বিচারে। যে-কাশ্মীরি সাহিত্যই আমাদের সমকালে পাই না কেন, তার সঙ্গে লাল্লার বাকের পূর্বের ও পরবর্তীর ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক তুলনা করতে গেলে যেটা দরকার তা হল, তাঁর যুগের পূর্বের ও পরের কাশ্মীরি সাহিত্যের নানাবিধ গ্রন্থ পাঠের সক্ষম জ্ঞান, এছাড়া, প্রাচীন কাশ্মীরি ভাষা থেকে ছিঁড়ে আনা টুকরোগুলো যা ত্রিক দর্শনের বিবিধ পুঁথিগুলোর প্রশ্নাবলীগুলোর মধ্যে নিহিত। সন্দেহাতীতভাবে, লাল্লার বাক রচিত হয়েছিল, যাকে সঠিকভাবে বলতে পারি প্রাচীন কাশ্মীরিতে, কিন্তু এগুলো আমাদের কাছে এসেছে যে-ভাষায় তা আশ্চর্যজনকভাবে আধুনিক। এগুলো মুখে মুখে ছড়িয়েছে এবং বদল ঘটেছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের ভাষার বদল ঘটেছে যেমন সেই মোতাবিক। তবু লালা দেদের বাক সমন্ধে স্যার গ্রীয়ারসনের অনুধাবন করেছেন, “লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা এবং গানগুলোর ছন্দময়তা অটুট রেখেছিল বহুসংখ্যক সেকেলে প্রকাশভঙ্গিগুলো। এবং আমি এখানে যুক্ত করতে পারি, এই সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছিল কারণ কিছু পুরুষ ও নারী গুরুশিষ্য পরম্পরার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, সেই সরাসরি সূত্র, অর্থাৎ, গুরু ও শিষ্যের পরম্পরা, বাকগুলোকে স্মৃতিতে সংরক্ষিত করেছিল, তাঁদের প্রাত্যহিক প্রত্যুষের প্রার্থনার অঙ্গ হয়ে, তাদের নিজ-পাঠের। স্পষ্টত, এঁরা, তাঁরা, যাঁরা এগুলোকে সংরক্ষণ করেছিলেন, ধার্মিক যত্নে ও যথার্থতায়, এমনি অনেক শব্দ ও বাক্যবন্ধের অর্থ না বুঝেও, “এবং তাদের সেই শততা ছিল, বিরত ছিলেন, বাকগুলোকে বোধগম্য করার জন্য কোনো অনুমানমূলক সংশোধন থেকে।” এ-কারণেই স্যার গ্রীয়ারসন বলেন, “এই ধরনের সরংক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে লিখিত পাণ্ডুলিপির চেয়েও বেশি মূল্যবান।”

লাল দেদ নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই উলঙ্গ হয়ে ঘুরতেন এমন একটা প্রসঙ্গকে সামনে রেখে আলোচনা করাটা একটা খারাপ সংস্কার। শুনেছি উলঙ্গিনীর গান বলে একটি গানের সিডিও বেরিয়েছে। এভাবে লাল দেদকে দাগানো অনুচিত বলে মনে করি, কেন-না লাল দেদের বাকগুলোর কাব্যগুণ বিচার করতে গেলে, প্রাচীন ভারতীয় কবিতার ছন্দকে চিনতে হবে, বুঝতে হবে যিনি বলেছেন, তাঁর মেধা ও মননকে, জানতে হবে তাঁর সময়কালীন ইতিহাস ও বাকগুলির সঙ্গে অদ্বৈতবাদী ত্রিকপন্থা শৈবসাধনার ‘প্রতি-অভি-জ্ঞান’-এর ধারণার সম্পর্ককে, যে-ধারা পুষ্ট হয়েছিল কাশ্মীরি শৈব তন্ত্রের বিখ্যাত দার্শনিক অভিনবগুপ্তের দ্বারা। আবার বুঝতে হবে, লাল দেদের বাকের কাব্য মাধুর্য ও গভীর দার্শনিক বোধ কেমন করে সুফি সিলসিলা ‘ঋষি পন্থা’-র বিশিষ্ট সাধক নুর-উদ-দিন ঋষি ও সামগ্রিকভাবে ঋষি সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেছিল। সে-সব বুঝেই এগোতে হবে। সেখানে তাঁর পোশাক নিয়ে কাব্য আলোচনা শুরু হলে একধরনের শহুরে সাবঅর্ল্টান-স্টাডিসের চেহারা নেয়, ফলত সাহিত্য আলোচনা যে-পথে হওয়া দরকার সে-পথ হারিয়ে যায়। ভারতের শৈব সাধনার নানা ধারা সমন্ধে যাঁরা কিছুমাত্র খবর রাখেন তাঁরা জানেন লাল দেদ বা আক্কা মহাদেবীরা নগ্ন ছিলেন বা নগ্ন হয়ে ঘুরতেন এটা একটা তথ্য মাত্র না হলেও, সেইসব কাব্যধারার রসাস্বাদনের জন্য মূল বিচার্য বিষয় নয়। একটি ইংরাজি সংকলনও আছে ন্যাকেড সেইন্ট, এরকম নামে। এতে একটা ওপর ওপর দেখানো সহানুভূতি তৈরি করার চেষ্টা চলে, যে-সবের ধার ধারতেন না লাল দেদ। কিংবদন্তিগুলোর নির্যাস নিয়ে বাকগুলো পড়তে হবে কোন পূর্বনির্ধারিত কোনো মতবাদের তোয়াক্কা না করেই। প্রথাগত ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করেছে শৈব পন্থাগুলো, দার্শনিক বিতণ্ডা করেছে, খারিজ হয়েছে সমকালের ব্রাহ্মণ্যবাদী ইতিবৃত্তে বা সন্তবৃত্তে। আনন্দ কাউলের অনুবাদ ও টীকা থেকে দেখতে পাই তিনি সুলতানদের ক্ষমতার বলে ইসলামীকরণের নিমিত্তে নতুন ধর্মান্তরিতদের দিয়ে চরবৃত্তি করানোকেও কটাক্ষ করেছেন। দুই ধর্মের প্রথাগত মেইন্সট্রিম তাই তাঁকে শতকে পর শতক নাকচ করেছে। লাল দেদের সেই নগ্নতা, নিয়ে মানী গবেষক জয়লাল কাউল কি লিখেছেন দেখি— “একটা কিংবদন্তি গড়ে ওঠে, এবং নাছোড় হয়ে থাকে যে, তিনি ঘুরে বেড়ান নগ্ন হয়ে, নৃত্য করে, গান গেয়ে পরমানন্দ ক্ষিপ্ততায়, যেমন করতেন পুরাণের হিব্রু নবি আর তুলনামূলকভাবে এখনকার দরবেশরা, যে তিনি ঘুরে বেড়াতেন প্রায় নগ্ন হয়ে। সেটা সত্য হতেই পারে কিন্তু তিনি যে দরবেশদের মতন ঘূর্ণনাচ নেচে বেড়াতেন, এটা এমন এক প্রতিবেদন যে, কাশ্মীরি শব্দ নৎসুনের সঙ্গে যায় না। শব্দটা বোঝায়, কোনো কোনো প্রসঙ্গে নৃত্য করা, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার হয় উদ্দেশ্যবিহীনভাবে যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে ঘুরে বেড়ানো বোঝাতে; বাকের প্রেক্ষিতে পরের অর্থটাই বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তাঁর কাছে বেশি মূল্যবান ছিল যে, তাঁর অন্তরাত্মার জন্য তিনি আর নিজের বহিরাবরণের দিকে ফিরে তাকাবেন না। সেই জন্যই তাঁর কিছুই মনে হবে না, যদি তিনি নগ্ন হয়েই চলে যান যেদিকে খেয়াল তাঁকে নিয়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যে কী-ই-বা আছে নৃত্য করার? যার জন্য তিনি অন্তরের দিকে চেয়ে থাকবেন? এটা ঠিক প্রত্যয়জনিতও নয়। পরে সত্যিই একটা সময় আসে যখন তাঁর নৃত্যের সেই প্রেক্ষিত তৈরি হয়ে যায়। “পরমানন্দে ঈশ্বরের সঙ্গে বিত্তবিনিময়ের”: মে’ সে’ তা পানাস দ্যুতুম শোহ। কিন্তু তখনও সেটা আসেনি, সে-সময় আসেনি। তখনও অবধি তাঁর গুরুর বাণী, আত্মজ্ঞান অর্জন করতে পার্থিব এই জগৎকে হারিয়ে ফেলতে হবে, যা ছিল তাঁর কাছে এক বেদনাদায়ক ‘সব হারানোর ফোসকা (রাভান তভ’ল)”। গ্রিয়ারসন যেমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন তেমন ভাবাটা ভাষার ওপরে জুলুমই হবে অতিশয়। উপরন্তু, এই শ্লোকের কল্যাণেই এর পর থেকে পাম্পোরের পদ্মাবতী লাল দেদ (লাল ঠাকুরমা) বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন তাঁর পেটের নীচ দিকের থলথলে ভাবের জন্য, যা ঢিলে হয়ে তাঁর তলপেটের নিম্নাংশের ওপরে ঝুলে থাকত। তাঁর নামের বিষয়ে এই তথ্য মেনে নেওয়া যদিও খুব কঠিন। বা, সাম্প্রতিক কিছু লেখকের যেমন অনুমান, লাল্লা লীলা বা লোল শব্দদ্বয়ের অপভ্রংশ। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পক্ষে এমন ভাবনা অন্যায্য। লাল্লা, মনে হয়, প্রাচীনকালে ব্যবহৃত একটা নাম। আর, খুব সম্ভবত এটা ছিল তাঁর কুমারী নাম। তিনি এই নাম ব্যবহার করতেন তাঁর নিজের সম্বন্ধে বলার সময়, এই নামটা তিনি ব্যবহার করেছেন নিজেকে উল্লেখ করার সময়। যেমন, যখন তাঁর বন্ধুদের তিনি বলেছেন, “লালি নালাবথ সালি না যানহ”, যেখানে নিজেকে বললেন, লালি, (লাল্লাকে), সে-সময় লক্ষ করলে দেখা যায়, তিনি ছিলেন, একজন গৃহবধূ, ‘পরিব্রাজক তপস্বিনী’ নন। তাছাড়াও, নিজের বাকে নিজেকে যখন উল্লেখ করেছেন, তিনি এই একই নাম, লাল (বা লালি, লা’লি, যেটা কাশ্মীরি ব্যাকরণে অন্য আরেক রূপ) ব্যবহার করেছেন, আর এই নাম তাঁর ১৮৪টি বাকে অন্ততঃপক্ষে ২১বার উচ্চারিত হয়েছে, ১০৯টি গ্রিয়ারসনের, ৭৫টি আনন্দ কাউলের। শব্দচর্চায় এটা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মূল কাশ্মীরি ভাষায় লাল বা লাল্লা-র উচ্চারণ প্রায় অভিন্ন।”

শেষ পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই