লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ঝিলিক কর্মকারের প্রবন্ধ

বাংলা পুঁথি সংগ্রহে বিশ্বভারতীর অবদান

পুঁথিভিত্তিক গবেষণার জন্য বিশ্বভারতীর পুঁথি বিভাগের কাজের সূচনা হয় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে। ঘটনাক্রমে বিশ্বভারতীতে বৈজ্ঞানিকভাবে পুঁথি সম্পাদনা শিক্ষার পথপ্রদর্শকদের মধ্যে অন্যতম হলেন জার্মান পণ্ডিত Winternitz. ১৩৩০ সালের ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যা থেকে জানা যায় Winternitz এবং ৮ জন বিশিষ্ট ছাত্র মহাভারতের প্রথম অধ্যায়ের পাঠোদ্ধার ও সম্পাদনা করেন। এ-কাজের জন্য তাঁরা ১৫ খানা বিভিন্ন অক্ষরে লেখা পুঁথি ব্যবহার করেন। তবে মনে রাখতে হবে ইতিপূর্বে আচার্য বিধুশেখর ভট্টাচার্যের (১৮৭৮-১৯৫৯) নেতৃত্বে পুঁথি সংগ্রহ ও চর্চায় একসময় শান্তিনিকেতন কর্মচঞ্চল ছিল। অসিতকুমার হালদারের ‘পঞ্চপল্লব’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়: ‘…মধ্যযুগের চিত্রকলার যথেষ্ট নিদর্শন না পাওয়া গেলেও কতকগুলি অষ্টম বা নবম শতাব্দীর বৌদ্ধ আমলের বৌদ্ধ ধর্ম সংক্রান্ত চিত্রসম্বলিত তালপত্রের পুঁথির ওপর আঁকা ছবি পাওয়া গিয়াছে।’ বস্তুত শান্তিনিকেতনে পুঁথি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সূচনা হয় বিশ্বভারতীর আদিরূপ ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই [২৩শে ডিসেম্বর, ১৯০১ (৭ই পৌষ, ১৩০৮]। ‘তত্ত্ববোধনী’ পত্রিকায় একাধিক বিজ্ঞাপন দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন:

“বিজ্ঞাপন
যে সকল মহাশয় আদি ব্রহ্মসমাজের পুস্তকালয় হইতে হস্তলিখিত পুঁথি ও পুস্তকাদি পাঠ জন্য ঋণ লইয়া গিয়াছেন তাঁহাদিগের প্রতি নিবেদন যে তাঁহারা অনুগ্রহ করিয়া এই মাঘ মাসের মধ্যে সমাজের লাইব্রেরিয়ানের নিকট প্রতিপ্রেরণ করেন।

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সম্পাদক
(‘তত্ত্ববোধনী’, ১৮০৮ শকাব্দ)’’

বলেন্দ্রনাথের সহায়তায় আদি ব্রাহ্মসমাজের অনেক সংস্কৃত ও বাংলা পুঁথি শান্তিনিকেতনে আনেন রবীন্দ্রনাথ।

১৯২৩ সালে Winternitz যখন শান্তিনিকেতনের পুঁথির কাজ পরিচালনা করেন তখন বিশ্বভারতীতে পুঁথির সংখ্যা প্রায় এক হাজার। এছাড়া লেভি দম্পতি ও প্রবোধ চন্দ্র বাগচী ১৯২২ খ্রিঃ নেপাল যাত্রা করেন এবং সেখানকার প্রাচীন ও মূল্যবান পুঁথি সংগ্রহ করেন। ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকায় লেখা হয়: ‘আচার্য লেভি ও তাঁহার পত্নী নেপাল যাত্রা করিয়াছেন… নেপালে অনেক প্রাচীন মূল্যবান পুঁথি আছে, সেগুলি উদ্ধার করিবার বাসনা লেভি সাহেবের আছে।’ (‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকা/১৩২৯ সাল/বৈশাখ সংখ্যা/পৃঃ ৪৯) বিশ্বভারতী পুঁথিবিভাগে চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজ, শিলালিপির ফটোগ্রাফ (১১শ খ্রিঃ নয়পালের রাজত্বকালে শিঙান শিলালিপি), হায়ারোগ্লিফিক লিপির স্ট্যাম্পেজ প্রভৃতি সংগৃহীত আছে।

১৮৮৫ খ্রিঃ রবীন্দ্রনাথ ও শ্রীশচন্দ্র মজুমদার যে-‘পদরত্নাবলী’ গ্রন্থ সম্পাদনা করেন তা পুঁথিভিত্তিক গ্রন্থ। ‘পদরত্নাবলী’ সম্পাদনার জন্য মহারানী স্বর্ণময়ী মহোদয়ার গুরুকুল শ্রীখণ্ডের মোহান্ত মহাশয়ের গৃহ থেকে বেশ কিছু প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করা হয়েছিল। বিধুশেখরের সহায়তায় রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং শান্তিনিকেতনে পুঁথি সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। জমিদারি পরিচালনার সূত্রে পূর্ববঙ্গে থাকাকালীন ‘মেয়েলি ছড়া’, ‘ব্রতকথা’, ‘রূপকথা’, ‘বাউলগান’ এবং বিভিন্ন পল্লীগীতিকা সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে আউল-বাউল-মুর্শিদী ইত্যাদির কিছু পুঁথি সংগ্রহ করেন রবীন্দ্রনাথ। এরূপ একটি পুঁথি হল ‘যোগীর গান’। বিশ্বভারতী পুঁথি বিভাগে এটিকেই রবীন্দ্রনাথ সংগৃহীত প্রথম পুঁথি হিসাবে ধরা হয়। পঞ্চানন মণ্ডল ও রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে জানা যায় পুঁথিটি শিলাইদহ অঞ্চলের লালন ফকির অথবা কুমারখালির বাউল সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় সে-সময় ধর্মমঙ্গল নিয়ে গবেষণা করেন। রবীন্দ্রনাথ সেজন্য তাঁকে যোগীর গানের খাতাটি ব্যবহার করতে দেন। ২৬ বছর পর প্রভাতকুমার সেটি বাংলা পুঁথি বিভাগে প্রদান করেন সংরক্ষণের জন্য।

সে-সময়ের আর একটি উল্লেখযোগ্য পুঁথি হল ‘নিরঞ্জনমঙ্গল’ বা ‘নিরঞ্জনপুরাণ’। লেখক ধর্মদাস বণিক। রবীন্দ্রসুহৃদ প্রেমতোষ বসুর কন্যা ইভা বসু পুঁথিটি সম্পাদনা করেন। ইলামবাজারের শ্রীরামনগর গ্রাম থেকে ৩২৩ পৃষ্ঠার এই পুঁথিটি সংগ্রহ করেছিলেন কালীমোহন ঘোষ। এই পুঁথিটি বিশ্বভারতীর পুঁথিশালায় সংরক্ষিত আছে।

১৯২২-২৩ খ্রিঃ রবীন্দ্রনাথ বরোদা লাইব্রেরি থেকে পুঁথি বিশেষজ্ঞ অনন্তকৃষ্ণ শাস্ত্রীকে বিশ্বভারতীতে আনয়ন করেন। বিশ্বভারতীতে কয়েক হাজার পুঁথি একাই সংগ্রহ করেছিলেন অনন্ত শাস্ত্রী। প্রথমে বীরভূম ও সন্নিহিত অঞ্চলে পুঁথি সংগ্রহের পর বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষার পুঁথি সংগ্রহ করতে থাকেন অনন্ত শাস্ত্রী। রবীন্দ্রনাথ তাঁর উদ্যোগের কথা ঘোষণা করে হিন্দু, বিহার হেরল্ড প্রভৃতি তৎকালীন বিভিন্ন প্রসিদ্ধ পত্রিকায় ‘Letter to the editor in quest of rare manuscripts’ শিরোনামের আবেদনে লেখেন: ‘Being a man of vast experience in this line of work he hopes to collect a large number of rare manuscripts scattered in obscure and out of the way villages, often in possession of illiterate persons.’

(‘পুঁথি-পরিচয়’/৪র্থ খণ্ড/শ্রীপঞ্চানন মণ্ডল সংকলিত)

পুঁথিবিভাগ প্রতিষ্ঠার সময় পুঁথি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণায় রবীন্দ্রনাথের সহযোগী হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন— কালীমোহন ঘোষ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়, ক্ষিতিমোহন সেন, মার্ক কলিন্স, মথু্রানাথ, সুখলাল, কালীকিঙ্কর দত্ত প্রমুখেরা। কালীমোহন সেন বীরভূমের বিভিন্ন গ্রাম থেকে বেশ কিছু মঙ্গলকাব্যের পুঁথি সংগ্রহ করেন। বীরভূমের পুঁথি সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি জানান: ‘বীরভূম জেলার একটি মুসলমান পল্লীতে রাধূগোপ নামক একজন হিন্দুর লিখিত মহরম সম্বন্ধে একটি কাব্য পাওয়া গিয়াছে। তাহার ওপর লিখা ‘শ্রীহরি সহায়’, ভিতরে মহম্মদের গুণগান,… কীর্তনই এই জিলার বিশেষত্ব, প্রতি গ্রামে গ্রামে বৈষ্ণব কবির হস্তলিখিত পুঁথি পাওয়া যায়।’ (Visva-Bharati News/January-February/1985)

বিশ্বভারতীতে পুঁথি সংগ্রহের কাজ অত্যন্ত দ্রুত চলছিল। ১৯২৩ খ্রিঃ আগস্ট মাসে পুঁথিসংখ্যা ছিল ১ হাজারের থেকে কিছু বেশি। ১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তা হয় ৩-৪ হাজার। কিন্তু ১৯৪১ সালে আশ্রমপিতা রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণে বিশ্বভারতীতে পুঁথি সংগ্রহের কাজ বেশ কিছুদিন বন্ধ হয়ে যায়।

পুঁথির কাজ পুনরায় আরম্ভ হয় ১৯৪৬ খ্রিঃ রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রবোধচন্দ্র বাগচী মহাশয়ের প্রচেষ্টায়। নতুন পরিকল্পনা অনুসারে ভাষা ও বিষয় অনুসারে পুঁথিগুলি আলাদা করা হয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে। ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬ খ্রিঃ পুঁথি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজে নিযুক্ত হন পঞ্চানন মণ্ডল। তিনি তাঁর কর্মক্ষেত্র হিসাবে নির্বাচন করেন বাংলা পুঁথিকে। পঞ্চানন মণ্ডল ১৯৪৬ সালের ১৩ নভেম্বর-২রা ডিসেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণ বর্ধমান ও উত্তর-পূর্ব বাঁকুড়ার ১০টি গ্রাম পরিভ্রমণ করে মোট ৩৯ খানি বাংলা পুঁথি সংগ্রহ করেন। এ-সময় শান্তিদেব ঘোষ তাঁর পিতা স্বর্গীয় কালীমোহন ঘোষ মহাশয়ের সংগৃহীত পুঁথিগুলি বাংলা পুঁথিবিভাগে দান করেন। আবার ২৮/০১/১৯৪৭ থেকে ০২/০৩/১৯৪৭ পর্যন্ত পশ্চিম বর্ধমান ও উত্তর পশ্চিম বাঁকুড়ার গ্রামগুলি অনুসন্ধান করে মোট ৪৪টি বাংলা পুঁথি সংগ্রহ করেন। ১৯৪৬ সালে পঞ্চানন মণ্ডল যে-সমস্ত বাংলা পুঁথি সংগ্রহ করেন তার কয়েকটি যথা: ১। ‘ধর্মমঙ্গল’ ২। ‘চন্ডীমঙ্গল’ ৩। ‘জগৎমঙ্গল’ ৪। ‘কালিকা-মঙ্গল’ ৫। ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল’ ৬। ‘কপিলামঙ্গল’ ৭। ‘মহাভারত’ (বিরাট) ৮। ‘মহাভারত’ (শান্তি) ৯। ‘রামায়ণ’ (লঙ্কা) ১০। ‘গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী’ ১১। ‘নারদসংবাদ’ ইত্যাদি।

কালীমোহন ঘোষ সংগৃহীত পুঁথির কয়েকটি যথা: ১। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ ২। ‘মনসামঙ্গল’ (ভাসান) ৩। ‘নারদসংবাদ’ ৪। ‘মহাভারত’ (বিরাট) ৫। ‘রামায়ণ’ (অযোধ্যা-কিষ্কিন্ধ্যা) ৬। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ (আদি, মধ্য) ইত্যাদি।

১৯৪৭ সালে পঞ্চানন মণ্ডল যে-সমস্ত বাংলা পুঁথি সংগ্রহ করেন তার কয়েকটি যথা: ১। ‘ধর্মমঙ্গল’ ২। ‘নিরঞ্জনমঙ্গল’ (শ্যামপণ্ডিত) ৩। ‘গৌরী-মঙ্গল’ ৪। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ (আদি) ৫। ‘যোগাদ্যার বন্দনা’, ইত্যাদি।

১৯২৪ খ্রিঃ প্রথম দিকে বাংলা ভাষায় পুঁথির সংখ্যা ছিল নগণ্য। ৩০-৪০ খানির বেশি নয়। ১৯২৪-এর মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলা পুঁথি সংগ্রহের প্রতি সমান গুরুত্ব আরোপ করা হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে বাংলা ভাষার পুঁথিসংখ্যা ৭৫০-৮০০-এর অধিক ছিল না। পঞ্চানন মণ্ডল এগুলিকেই সাবেক সংগ্রহ বলেছেন। সাবেক সংগ্রহের কিছু উল্লেখযোগ্য বাংলা পুঁথি হল: ১। ‘রাজাবলি’ (মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার) ২। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ (মুকুন্দরাম) ৩। ‘রামায়ণ’ (কবিচন্দ্র) ৪। ‘মহাভারত’ (কাশীরাম দাশ) ৫। ‘রাধিকামঙ্গল’ (কবিচন্দ্র) ৬। ‘চৈতন্যভাগবত’ (বৃন্দাবন দাস) ৭। ‘বিদ্যাসুন্’র’ (ভারতচন্দ্র) প্রভৃতি। (‘সংক্ষিপ্ত পুঁথি পরিচয়’/সংকলক সুখময় মুখোপাধ্যায়)

বছর দুয়েকের মধ্যে হাজার খানেক পুঁথি সংগ্রহ করেন পঞ্চানন মণ্ডল। ১৯৪৮ ডিসেম্বরে বিশ্বভারতীতে বাংলা পুঁথির সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২০০০। পঞ্চানন মণ্ডলের ‘পুঁথি পরিচয়’ (১ম খণ্ড, ভূমিকা, পৃঃ ৮) থেকে জানা যায়, ১৯৪৮ সালে সিউড়ির শিবরতন মিত্রের রতন লাইব্রেরিতে রক্ষিত পুঁথি থেকে অমলেন্দু মিত্রের নিকট ৩৫৫০টি বাংলা পুঁথি বিশ্বভারতীর জন্য ক্রয় করা হয়। সেগুলির মধ্যে কয়েকটি হল:
১। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ (আদি)— কৃষ্ণদাস কবিরাজ
২। ‘চৈতন্যমঙ্গল’— লোচনদাস
৩। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ (অন্ত্য)— কৃষ্ণদাস কবিরাজ
৪। ‘চণ্ডীমঙ্গল’— মুকুন্দরাম
৫। ‘মনসামঙ্গল’— বিষ্ণুপাল
৬। ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’— ভারত
৭। ‘আত্মবোধ’— রঘুনাথ দাস, প্রভৃতি।

পঞ্চানন মণ্ডলের বাংলা পুঁথি সংগ্রহের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারি, বাংলা পুঁথি অনাদরে স্থান পেয়েছে ঘুঁটের মাচায়, গোয়ালঘরের আবর্জনা স্তূপে, বাঁশতলায়, পুকুরের জলে, নদীর স্রোতেও অনেক বাংলা পুঁথি বিসর্জিত হয়েছে। অনেকে রোগশয্যায় বাংলা পুঁথি স্পর্শ করে রোগমুক্তির চেষ্টা করেছে। আবার কুসংস্কার বশে দেবতা বা অপদেবতা পুঁথির ওপর ভর করার ভয়ে অনেক পুঁথিকে দাহও করা হয়েছে। অনেকে আবার পুঁথিকে বংশ পরম্পরায় তান্ত্রিক বাঙালি মন্ত্রের মতো গোপন করে রাখে। কেউ-বা ভেবেছে পুঁথির দ্বারা সব সম্পত্তি হস্তগত করা যায়। ফলত সেখানে পুঁথি চাক্ষুষ করার কোনো সুযোগ পাওয়া যায়নি। এভাবে বিভিন্ন পুঁথির পাতায় পাতায় যে একটা জাতির ইতিহাসের পরিচয় পাওয়া যেত তার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়।

১৯৪২ খ্রিঃ জুলাই মাসে রবীন্দ্রভবন স্থাপিত হয়। রবীন্দ্রনাথের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি এখানে পুঁথির আকারে সংগ্রহ করে রাখা হয়। Catalogue in progress, Rabindra-Bhavana collection, No.13 থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে—

রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, ‘আধুনিক বাঙ্গালার আদর্শে যাঁহারা প্রাচীন বাঙ্গালা পুঁথি সংশোধন করিতে থাকেন তাঁহারা পরম অনিষ্ট করেন।’ [‘সাময়িক সাহিত্য’/‘ভারতী’/অগ্রহায়ণ, ১৩০৫] বিশ্বভারতীর পুঁথি সম্পাদনায় রবীন্দ্রনাথের এই আদর্শই অনুসরণ করা হত।

বিশ্বভারতীতে সংরক্ষিত বাংলা পুঁথির নানান বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। যেমন বাংলা লিপিতে লেখা ৮ পত্রের ষট্কর্মের পুঁথিটির কাগজ হলুদ। আবার ৯ পত্রের কুব্জিকা তন্ত্রের পুঁথির কাগজ লাল ঘেঁষা সাদা। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নানুরের ভট্টাচার্য মশাই অনুলিখিত সর্পবন্ধ ও নৌকাবন্ধ ছাঁচে লেখা কিছু বাংলা পুঁথি বিশ্বভারতী পুঁথিবিভাগে সংরক্ষিত আছে। গোয়ালপাড়ার পঞ্চানন আস অনুলিখিত অনেক প্রাচীন ও মূল্যবান বাংলা পুঁথি বিশ্বভারতীর সংগ্রহে আছে। দ্বিজ নারায়ণ রচিত ‘ভবানীমঙ্গল’-এর পুঁথি বিশ্বভারতী ছাড়া আর কোথাও নেই।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে দু-টি পর্যায়ে বিশ্বভারতীর পুঁথি সংক্রান্ত কার্যসম্পাদনা ঘটে। এক। কবিগুরুর জীবদ্দশায় দুই। তাঁর জীবনাবসানের পরবর্তীতে। তার সঙ্গে যোগদান করেছিলেন দেশ-বিদেশের তৎকালীন নানা বিদগ্ধ মানুষ। বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত, তিব্বতি, আরবি, ফার্সি, হিন্দি প্রভৃতি ভাষার সমাহারে গঠিত বিশ্বভারতীর পুঁথিশালা। বলা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ-সহ অন্যান্যরা পুঁথি বিষয়ক কাজের যে-উদ্যোগ একদিন গ্রহণ করেছিলেন, তার দ্বারা বিশ্বভারতীর পুঁথিশালা আজ সমৃদ্ধ।

Facebook Comments

পছন্দের বই