লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ফাল্গুনী ঘোষের প্রবন্ধ

বারোমাসে তেরো পার্বণ

বাঙালির নাকি বারো মাসে তের পাবণ। ভাগ্যিস! এই উৎসবের সুবাদেই তো একঘেঁয়েমির অসুর দমন সম্ভব হয়ে ওঠে। জীবনে আসে রঙিন উচ্ছ্বাস। উৎসবের ডাক নাম আনন্দ। আর আনন্দের সহযাত্রী হতে কে না চায়! উৎসব তো বন্ধনহীন গ্রন্থি যা মানুষকে সুযোগ করে দেয় বহু পরিচিত-অপরিচিতের সাথে আবেগ অনুভূতির বিনিময় করে, ভেদাভেদ ভুলে একসূত্রে গ্রথিত হয়ে উঠতে। বৃহত্তর ক্ষেত্রে উৎসব মানুষের মিলন তীর্থ। উৎসবের সুতোর বাঁধনে মুছে যায় বিভেদ, সম্প্রদায়, সীমারেখা, সীমানা। তাই বোধহয় বারোমাসি সময়সূচিতে কুলোয় না, তের পার্বণের হাত ধরতে হয়। কিন্তু সত্যিই কি তের নাকি হিসেবের খাতায় আরো বেশি— নববর্ষ সূচনাতে এসে পরপর ডেকে আনে জামাইষষ্ঠী, মনসাপুজো, ঝুলন, রাখি বন্ধন, রথযাত্রা, মনসা, ভাদুপুজো, বিশ্বকর্মা, দুর্গাপুজো, লক্ষীপুজো, কালীপুজো, ভাইফোঁটা, কার্ত্তিকপুজো, জগদ্ধাত্রীপুজো, নবান্ন, পৌষসংক্রান্তি, রাসযাত্রা, সরস্বতীপুজো, দোলযাত্রা, চড়কসংক্রান্তি, ঈদ, মহরম, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা— বলতে বলতে আমি আর পড়তে পড়তে আপনারা ক্লান্ত হয়ে যাবেন। কিন্ত বাঙালির উৎসব স্পৃহাতে ভাঁটা পড়বে না। সাধে কি আর বলে বাঙালি হুল্লোড়ে জাতি।

সত্যিই যে জাতির উৎসব নেই সে জাতি প্রাণহীন, চলৎশক্তিহীন। উৎসবই মানুষকে যুগিয়েছে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে সৃষ্টি করেছে প্রাণচাঞ্চল্য। স্বভাবতঃই উৎসব প্রায়ক্ষেত্রে ঐতিহ্য নির্ভর। মানুষের জীবনের মৌলিক দুটি উৎসব জন্ম ও মৃত্যুও তো সৃষ্টি ও বিনাশ ঐতিহ্যের ধারক। উৎসব কথাটিই বহুমাত্রিকতার রঙে রঙিন, যার মধ্যে কোনোটিতে ধর্মের ছাপ, কোনোটিতে রাজনীতির ছাপ, কোনোটি আবার অতিপ্রাচীন ও সুপরিচিত খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যানুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত। এখানে হিন্দু ধর্মের যে ধর্মীয় উৎসবগুলি নিয়ে আলোচনা করা হবে কিছুক্ষেত্রে সেগুলি ধর্মীয় কারণে উদ্ভূত হলেও পরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনুষ্ঠানিক উৎসবে পরিণত হয়। তবে অনেকক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুষঙ্গ সুদৃঢ়ভাবেই রয়েছে কারণ মানুষের বিশ্বাস উৎসবের মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনও সম্ভব। ধর্ম তাই উৎসবকে একটু আলাদা চোখে দেখে। আনন্দ উল্লাসের পাশাপাশি সেখানে কিছু নিয়ম রীতি মানার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বলা হয় এসব রীতি মেনে চললে পূণ্যার্জন সম্ভব।

নববর্ষ:

প্রাচীন সভ্যতার যুগে (খ্রি:পূ: চার হাজার বছর থেকে ৫ম শতক পর্যন্ত) চান্দ্রমাস বা সৌরবছর অনুযায়ী প্রায় সবকটি সভ্যতাতেই নববর্ষ পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে প্রথম মত অনুযায়ী প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খৃ:) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। ২য় মতানুসারে ১২০১ ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বঙ্গবিজয় এর পর থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যবহৃত হত হিজরি সন। পাশাপাশি ফসলি সন ও প্রবর্তিত হয়। চৈত্র মাস ছিল নতুন ফসল ওঠার সময়। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রনয়ণের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌরসন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পয়লা বৈশাখ নতুন বছর হিসেবে নির্ধারিত হয়।

ফসল ওঠার খাজনা আদায়কে কেন্দ্র করে সূচনা হল পূণ্যাহ উৎসব। জমিদার বাড়িতে মাসব্যাপী এই উৎসবে গ্রামপ্রধান নেতৃস্থানীয় কৃষকসহ সকলেই যোগদান করত। সেখানে বিগত বছরের খাজনা পরিশোধ করা, নতুন বছরের বায়নাপত্রও করা হত। প্রজারা জমিদারদের মনোতুষ্টির জন্য নানারকম খাবার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, হস্তশিল্পের পসরা বসাতেন। জমিদারবাড়ির মেলায় পণ্য কেনাবেচার ব্যবস্থা থাকত। ব্যাপকার্থে গ্রামীণ সমাজের অর্থনীতিতে সরকার, জমিদার, প্রজা ও ব্যবসায়ী শ্রেণী সরাসরি যুক্ত হল। পরবর্তীতে এইসব মেলা স্থানীয় ব্যাবসায়ী, বণিক, মহাজন, দোকানদারদের হাতে চলে যায়। তারাও বিগত বছরের পাওনা আদায় করে নতুন খাতা খোলার ব্যবস্থা করে, এটাই হালখাতা। বর্তমানেও নববর্ষর দিন আমবাঙালি প্রায় একই রেওয়াজে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নতুন জামাকাপড় পরে পরিচিত ও প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা বিতরণ ও মিষ্টিমুখ করে। দোকানে দোকানে হালখাতার দেনাপাওনা মেটায়।

জামাই ষষ্ঠী:

বাংলার অন্যতম লৌকিক উৎসব জামাই ষষ্ঠী। জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে পালিত হয়। শাস্ত্রমতে ষষ্ঠী হল আসলে সন্তান প্রাপ্তির আশায় ‘মা বিন্ধ্যবাসিনী স্কন্দ ষষ্ঠীর কাছে মা’য়েদের নিবেদন এবং প্রার্থনা’। তাই ষষ্ঠী দেবী মাতৃত্বের প্রতীক, আর্য-অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণের ফল। এখন দেখার বিষয় যে মা ষষ্ঠীর সঙ্গে জামাই -এর সম্পর্ক কী? ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে একসময় সংস্কার ছিল কন্যা যতদিন না পুত্রবতী হয় ততদিন কন্যার পিতা বা মাতা কন্যাগৃহে পদার্পণ করবেন না। সন্তানধারণে সমস্যা বা শিশুমৃত্যুর কারণে পিতামাতাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হত। তাই সমাজের বিধানদাতারা সমাধানের জন্য জামাইষষ্ঠীর কথা বললেন, যেখানে সন্তান লাভের কামনায় মা ষষ্ঠীর পুজো করাও হল আবার কন্যার মুখদর্শন করাও হল।
সনাতন ধর্মাবলম্বীমতে, এই পার্বণ মূলত পরিবেশ রক্ষার্থে গাছকে দেবতা বিশ্বাসে পুজো করা। ঘর ও মন্দিরের বাইরে বট, করমচার ডাল পুঁতে প্রতীকী অর্থে অরণ্য রচনা করে এ পুজো করা হয় বলে জামাইষষ্ঠীকে অরণ্যষষ্ঠীও বলা যায়। ষষ্ঠীর বাহন হিসেবে এদিন বিড়ালদের খুব যত্ন করা হয়। বিভিন্ন প্রকার ফলজ, বনজ ও ওষুধি গাছের ডাল একত্র করে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় স্নান করে পুজোর সূচনা করা হয়। দুর্বা ঘাসের দীর্ঘায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে এই ঘাস জলে ডুবিয়ে জামাই ও অন্যান্য সদস্যদের ছোঁয়ানো হয়। তারপর পাখার বাতাস, দই হলুদের ফোঁটা, হাতে হলুদ সুতো বেঁধে ফল হাতে নিয়ে শাস্ত্রীয় পর্বের ইতি ঘটে। পরবর্তীতে চলে ভুরিভোজ ও উপহার বিনিময় পর্ব। জামাই আপ্যায়নের এই উৎসব এক সময়ে এতটাই ব্যাপ্তি লাভ করেছিল যে বাংলাদেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও জৈষ্ঠ্যমাসে জামাইকে ডেকে আম-দুধ খাওয়ানোর রেওয়াজ রয়েছে।

রথযাত্রা:

হিন্দুদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেন্দ্রিক উৎসবগুলির অন্যতম রথযাত্রায় আমরা পাই ঔপনিষদিক বাণীর প্রচার। কঠোপনিষৎ-এ বলা হয়েছে, এ দেহই রথ আর আত্মা দেহরূপ রথের রথী। এবিষয়ে কৃষ্ণযজুর্বেদীয় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ৩য় অধ্যায়ে বলা হয়েছে—
“অপাণিপাদো জাবানো গ্রহীতাপশ্যত্যচক্ষু: স শৃণোত্যকরণ:।/ স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তাত্মাহুরগ্রং পুরুষং মহাত্মম।” অর্থাৎ ঈশ্বরের লৌকিক হস্ত নেই, অথচ তিনি সকল দ্রব্য গ্রহণ করেন। তাঁর পদ নাই অথচ সর্বত্রই চলেন। তাঁর চোখ নাই অথচ সবই দেখেন। কান নাই কিন্তু সবই শোনেন। তাঁকে জানা কঠিন, তিনি জগতের আদিপুরুষ। এই বামনদেবই বিশ্বাত্মা,তাঁর রূপ নেই,আকার নেই। এই ঔপনিষদিক বর্ণনার প্রতীকী রূপই হল রথের জগন্নাথ দেবের রূপ।

এ সম্পর্কে স্কন্দ পুরাণে আছে উৎকল রাজ্যের রাজা ইন্দ্রদুম্ন দৈবাদেশ পেয়ে সমুদ্রে ভেসে আসা নিমকাঠ থেকে বিগ্রহ বা মূর্তি তৈরী করেন। এ সম্পর্কে আরো একটি পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে— ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ১২ বছর বয়সে বৃন্দাবন ত্যাগ করার বহুদিন পরে একবার রথে করে বৃন্দাবনবাসিদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কৃষ্ণের বিরহে তাঁর প্রিয়জনদের অবস্থা ও কৃষ্ণের প্রতি তাদের ভালোবাসা দেখে তিনজন বলরাম, কৃষ্ণ, সুভদ্রা নির্বাক হয়ে যান। তখন তাঁদের অমূর্ত রূপ ফুটে ওঠে। এই রূপই বর্তমান জগন্নাথ দেবের রূপ।
এই পৌরাণিক ঐতিহ্য মেনে উড়িষ্যার পুরীসহ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা পালিত হয়। আর একাদশী তিথিতে হয় প্রত্যাবর্তন বা উল্টো রথ। অর্থাৎ রথটি প্রথম দিন যেখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, আট দিন পর আবার সেখানেই এনে রাখা হয়। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, হুগলির মাহেশ কলকাতা ও বাংলাদেশের ইস্কনের ধামরাই এর জগন্নাথ রথ বিশেষ প্রসিদ্ধ। রথযাত্রা উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। সমগ্র বাংলার পাড়ায় পাড়ায় কুচো কাঁচার দল খেলনা রথ বানিয়ে আনন্দে মাতে। সঙ্গে থাকে পাঁপরভাজা আর জিলিপি দিয়ে মুখ মিষ্টির পর্ব।

ঝুলন ও রাখি বন্ধনরাখি বন্ধন:

উৎসবের সূচনা হয় মূলত পাঁচদিন আগে থেকে ঝুলনযাত্রা উৎসবের মধ্য দিয়ে। শ্রাবণ মাসের শুক্লা একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচদিন ধরে এই অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এর সংস্কৃত নাম হিন্দোল। রাধাকৃষ্ণ দোলায় স্থাপন করে দোল দেওয়া এই অনুষ্ঠানের প্রধান অঙ্গ। ভগবান ও ভক্তের মিলন রাধা-কৃষ্ণ প্রেমের স্বরূপে এই উৎসবে পালনীয়। তাই রাধা-কৃষ্ণের মন্দিরকে ছাড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা ঝুলন উদ্যান সাজিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে যার পরিসমাপ্তি রাখি বন্ধন পালনে।
ভারতবর্ষের একাধারে একটি সর্ববৃহৎ পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক উৎসব রাখি বন্ধন। শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দিদি বা বোনেরা তাদের ভাই বা দাদার হাতের কবজিতে রাখি নামের একটি পবিত্র সুতো বেঁধে মিষ্টি মুখ করায় ও উপহার দেয়, পরিবর্তে ভাই বোনকে সারাজীবন রক্ষা করার শপথ নেয়। মহাভারতে আছে, একটি যুদ্ধে কৃষ্ণের কবজিতে আঘাত লেগে রক্তপাত শুরু হলে পান্ডবদের স্ত্রী দ্রৌপদী তাঁর শাড়ির আঁচল খানিকটা ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন। এতে অভিভূত হয়ে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় কৃষ্ণ তাঁর সম্মান রক্ষা করলে এই উৎসব চালু হয়। অন্য একটি গল্পে আছে ভক্ত বলিরাজাকে রক্ষা করতে এসে বিষ্ণু বহুদিন বৈকুণ্ঠ ছেড়ে এলে লক্ষী বলি রাজার আশ্রয়ে এসে শ্রাবণ পূর্ণিমা উৎসবে রাখি বেঁধে দেন ও বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। সেই থেকে রাখি বন্ধন পালিত হয়। আবার অন্য একটি পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায় দেবতা ও অসুরদের যুদ্ধে ইন্দ্রের রক্ষাকবচ হিসেবে ইন্দ্রের স্ত্রী রাখি বেঁধে দিলে রাখি উৎসব প্রচলিত হয়।

ঐতিহাসিক সূত্র থেকে আমরা পাই— ৩২৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো পাঠিয়ে অনুরোধ করেন আলেকজান্ডারের ক্ষতি না করার জন্য। পুরু সেই সম্মান রক্ষা করেছিলেন। আবার মধ্য সপ্তদশ শতকের রাজস্থানি লোকগাথায় উল্লেখ পাওয়া যায়—গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে বিধবা রানি কর্নবতী ১৫৩৫ খ্রীষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে একটি রাখি পাঠান। হুমায়ুন তাঁর রক্ষার্থে সৈন্য পাঠান। তবে বাহাদুর শাহের হাত থেকে সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য ১৫৩৫ সালের ৮ই মার্চ ১৩০০০ পুরস্ত্রীকে নিয়ে জওহরব্রত পালন করে আগুনে আত্মাহুতি দেন। পরবর্তীতে হুমায়ুনের প্রচেষ্টায় কর্ণবতীর পুত্র বিক্রমজিৎ সিং সিংহাসনে বসেন।

আর পরাধীন ভারতবর্ষে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রতিরোধ আন্দোলনে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ রাখি বন্ধন উৎসবকে জাতীয় ঐক্যবন্ধনের হাতিয়ার করে তুলেছিলেন। তাই বোধহয় পারিবারিক ও ধর্মীয় গন্ডী ছাড়িয়ে অনাত্মীয় বা জাত-পাত সম্প্রদায়ের বিভেদ না রেখে রাখি বন্ধন ব্যাপক অর্থে সামাজিক উৎসব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

জন্মাষ্টমী:

হিন্দুধর্মে ভগবান শ্রী কৃষ্ণকেন্দ্রিক উৎসবগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল জন্মাষ্টমী। ভগবান বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের জন্মদিন হিসেবে সৌরভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্যের সময় জন্মাষ্টমী পালিত হয়। এর অপর নাম কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী, অষ্টমী রোহিণী, শ্রীকৃষ্ণভারতী। শাস্ত্রীয় বিবরণ ও জ্যোতিষ গনণার ভিত্তিতে লোকবিশ্বাস অনুযায়ী কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল ৩২২৮ খ্রিস্টাব্দ পূর্বাব্দের ১৮ অথবা ২১ জুলাই। যাদববংশীয় বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান কৃষ্ণ। দুরাচারী কংস (দেবকীর দাদা) তার পিতা উগ্রসেনকে বন্দী করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দৈববাণী হয়— দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের হাতে কংসের বিনাশ ঘটবে। ফলত কংসের পাশবিক অত্যাচারে দেবকীর ষষ্ঠ গর্ভের সমস্ত সন্তানের হত্যা হয়। দেবকী তাঁর সপ্তম গর্ভ বসুদেবের প্রথম স্ত্রী রোহিণী কে দান করলে (সারোগেট মাদার) বলরামের জন্মগ্রহণ করেন। অষ্টম গর্ভে কৃষ্ণ জন্মালে বসুদেব গোকুলে কৃষ্ণের পালক মাতাপিতা যশোদা ও নন্দের ঘরে রেখে আসেন। পরবর্তী কালে ভগবান কৃষ্ণ কংসের প্রাণসংহার করে স্বৈরাচারীর বিনাশ ঘটান।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে জন্মাষ্টমীর দিনে উপবাস করলে সাত জন্মের পাপ বিনাশ হয়। তাই এদিন ভগবান কৃষ্ণের আরাধনা করা হয়। কালের স্রোতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় মেলা, মিছিল প্রভৃতি। প্রসঙ্গত ঢাকার কৃষ্ণদাস বসাক আয়োজিত ‘লক্ষীনারায়নের দল’ ও ‘মুরারীমোহনের দল’ বিশেষভাবে উল্লেখ্য। অশুভকে বিনাশ করে শুভর প্রতিষ্ঠা করতে এবং সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির বন্ধনে বিশ্ব সমাজকে আবদ্ধ করতে কৃষ্ণের দর্শন ও বানী উল্লেখ্য এবং কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।

মনসা:

বর্ষা ঋতুর অন্য একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব মনসা পুজো। মনসা নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে ভারতের কানাড়া অঞ্চলের ‘মনে-মাঞ্চাম্মা’ নামক দেবী, মহীশূরের ‘মুদামা’, বা মধ্যপ্রদেশের কোল উপজাতীয়দের ‘মনসা দেও’ দেবতা প্রভৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করা হলেও মনসা বাংলার লৌকিক দেবী। উৎপত্তিগত দিক থেকে পুরাণ মঙ্গলকাব্যে রয়েছে দু-ধরণের ভাষ্য। পুরাণের ভাষ্য অনুযায়ী ব্রহ্মার নির্দেশে কশ্যপ মুনি সর্পবিষনাশক মন্ত্র রচনাকালে ধ্যান মগ্নাবস্থায় মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর আবির্ভাব ঘটে এবং তার মন থেকে আবির্ভাব ঘটায় দেবীর নাম হয় মনসা। পরবর্তী সময়ে তাকে জরৎকারু মুনির সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। মহাভারতে কশ্যপ ও কদ্রুর বিয়ে এবং তাদের ঘরে সহস্র সর্পের জন্ম, সেই সঙ্গে জরৎকারু ঋষি ও মনসার বিয়ে এবং আস্তিক মুনির জন্মলাভের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। আবার পিতা শিব ও সৎমা চন্ডীর ঘৃণা-প্রত্যাখ্যানের কারণে মনসা সর্বদা নিরানন্দ ও বদরাগী। কিংবদন্তী অনুযায়ী, শিব সমুদ্র মন্থনে উত্থিত বিষ পান করলে মনসা সেই বিষ হরণ করে শিবের প্রাণ রক্ষা করেন তাই তিনি বিষহরি নামেও পরিচিতা। এছাড়াও পদ্মাবতী, নিত্যা প্রভৃতি নামেও তিনি পরিচিতা।

যাই হোক বাংলায় বর্ষাকালে যখন সাপের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়, তখন মনসার পুজো মহাসমারোহে হয়ে থাকে। সমস্ত আষাঢ় -শ্রাবণ মাস জুড়ে এই পুজো করা হয়। সাধারণত স্নুহী বা সীজ গাছের ডালে অথবা সর্পচিত্রিত ঘট বা ঝাঁপিতে মনসার পুজো হয়। যদিও কোথাও কোথাও মনসা মন্দিরেও মূর্তি হিসেবে পূজিতা হন। দুই বা চার হাত বিশিষ্ট মাতৃমূর্তি মাথায় সপ্তফণাযুক্ত নাগছত্র এবং কোলে শিশু সর্পাভরণভূষিতা, পদ্ম বা নাগপৃষ্ঠে আসীনা মনসার মূর্তি। শ্রাবণ মাসে নাগপঞ্চমীতে মনসার বিধিপূর্বক পুজোর দিন ধার্য রয়েছে। বাঙালি মেয়েরা এদিন উপোস করে সাপের গর্তে দুধ ঢালেন। আবার নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের কাছে মনসা একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন দেবতা। তাঁরা বিবাহের সময় ও সন্তান কামনায় মনসার পুজো করেন। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মনসার সঙ্গে নেতোর (মনসার সহচরী, মনসার চিন্তায় কাতর শিবের চোখ থেকে জল পড়ে যার জন্ম) পুজোও করা হয়। মনসামঙ্গল ও মনসাবিজয় কাব্যে চাঁদ সদাগর প্রথম মনসার পুজো করেছিলেন তাই বাংলার বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যেও মনসাপুজো বিশেষ প্রচলিত।

ভাদু:

বাঙালি কৃষকের বীজবপন উপলক্ষ্যে মেয়েদের দ্বারা পালিত লোকউৎসব ভাদু। পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজকন্যা ভাদু বা ভদ্রেশ্বরীর কাহিনী থেকে এর উদ্ভব। বাগদত্ত এক রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে না হওয়ায় ভাদু আত্মহত্যা করেন। এই শোকাবহ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূমে ভাদু উৎসব পালন প্রচলিত হয়। সাধারণত মহিলারা সারা ভাদ্রমাস ব্যাপী ভদ্রেশ্বরীর মূর্তি তৈরি করে তার সমুখে নৃত্য গীত পরিবেশন করে। বিবাহ প্রধান গান ভাদু উৎসবের মূল আকর্ষণ। ‘ভাদু ভাসান’ পর্বটি খুবই বিষাদময়। ব্রতীরা ভাদ্র সংক্রান্তিতে উপোস করে নদীর তীরে সমবেত হয়ে মূর্তি বিসর্জন দেয়।
বীরভূম জেলায় ভাদু উৎসব অন্যান্য অঞ্চলের থেকে সামান্য আলাদা। বীরভূমের ভাদুতে নারীরা অংশগ্রহণ করেন না। গ্রামের একটি পুরুষকে নারী সাজিয়ে তার কোলে ভাদুমূর্তি স্থাপন করে সারা মাস ব্যাপী গান গেয়ে ও নাচ করে ঘুরে ঘুরে অর্থ আদায় করে। ভাদু সংগীতে রামায়ণ-মহাভারত থেকে শুরু করে ঝুমুর কীর্তন এবং রামপ্রসাদী সুরেরও প্রাধান্য থাকে। আরো একটা মজার ব্যাপার হল এই সব গানে এখনকার সময়ের কথা, জীবনের কথাও উঠে আসে সহজেই। “আমার ভাদু সোনার জাদু, কে পাঠাইলে কোলকেতা, সেই কেলকেতারই লুনা জলে, ভাদু হইল শ্যামলতা…।”

বিশ্বকর্মা পুজো:

হিন্দুর তথা বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব শারদোৎসবের সূচনা যেন হয় বিশ্বকর্মা পুজোর হাত ধরে। বেদে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি কর্মের ও শিল্পসমূহের দেবতা। তিনি চতুর্ভুজ এবং গজারূঢ়। বৃহস্পতির বোন যোগসিদ্ধা তাঁর মাতা এবং অষ্টম বসু প্রভাস তাঁর পিতা। বিশ্বকর্মাকে লংকা, দ্বারকা, হস্তিনাপুর, ইন্দ্রপ্রস্থ, জগন্নাথ মূর্তির স্রষ্টা বলে মনে করা হয়। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে সমস্ত ধরণের যানবাহন, যন্ত্রশিল্প এবং অলংকার শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা সাড়ম্বরে পুজো করেন। এই পুজো উপলক্ষ্যে কোথাও কোথাও নৌকা বাইচ, ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ভুরিভোজনের ব্যবস্থা থাকে।

দুর্গা পুজো:

বাংলাদেশে দুর্গা পুজোর সূচনা কবে এবং কেন সে নিয়ে একটি ইতিহাস রচনা করে ফেলা সম্ভব। শরৎকালের দুর্গা পুজো নাকি শুরু হয়েছিল শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধন দিয়ে এ গল্প আমাদের সবার জানা। কারণ মূলত বসন্তকালেই দুর্গা পুজো হত তার নাম ‘বাসন্তী পুজো’। রাজা গোপালের পর থেকে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে প্রাচীন বাংলায় দুর্গা কেন, কোনো মূর্তি পুজোরই চল ছিল না। তখনও বাসন্তীই প্রধান দেবী। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে বাণীকুমার রচিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ যা মহালয়া নামেই পরিচিত তাও কিন্তু প্রথমে বসন্তকালেই প্রচারিত হত, ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে। আবার শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যপাট ছিল উত্তর ভারতের অযোধ্যা। এই অঞ্চলে দেবী দুর্গার প্রাধান্য বেশি পাওয়া যায় না বরঞ্চ রাম রাবণের যুদ্ধে রামের বিজয় উপলক্ষে ‘দশেরা’ উৎসবকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। আবার বেদ ও পুরাণে যে দেবী চন্ডীর উল্লেখ আছে তিনি পুরুষ দেবতাদের দ্বারা সৃষ্টি করা তুলনায় লৌকিক চন্ডী একেবারেই নির্ভেজাল নারী শক্তি। আবার বাংলার ঋতুচক্রে আগস্ট-সেপ্টেম্বর বন্যার মাস। হলকর্ষণ, বীজবপন, কৃষি শ্রমিকের খোরাকি মেটাতে কৃষক নাজেহাল হতেন। শরৎ বাংলার কৃষকের কাছে কোনো আনন্দই বয়ে আনত না। তাহলে কিভাবে শরৎকালে দুর্গা পুজোর প্রচলন হল!

বাংলাদেশে দুর্গা পুজোর প্রচলন হয় মোগল সম্রাটের বিদূষক কুল্লুক ভট্টের পুত্র তাহিরপুরের রাজা (বর্তমান রাজশাহী) কংশনারায়ণ প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা ব্যয়ে প্রথম শারদীয় দুর্গোৎসব করেন। কংশনারায়ণের পুর্বপুরুষ রাজসূয়, অশ্বমেধের মত বৃহত্তর যজ্ঞ করতে ইচ্ছুক হলে রাজপুরোহিত লক্ষী সরস্বতী সহ দুর্গা পুজো করার বিধান দেন (কলিকালে অশ্বমেধ বা রাজসূয় যজ্ঞের বিধান নেই বলে)। পরে পাল্লা দিয়ে রাজা জগৎ নারায়ণ প্রায় ৯ লাখ টাকা ব্যয় করে বাসন্তী দুর্গোৎসব করেন। তারপর থেকে রাজা ও জমিদাররা পূজা আরম্ভ করলেও সাধারণ মানুষদের প্রবেশাধিকার ছিল না। হুগলির গুপ্তি পাড়ার এক ধনী গৃহস্থের বাড়ির পুজোয় অংশ নিতে না পারার জন্য ১২জন মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে চাঁদা তুলে নতুন করে পুজোর আয়োজন করেন ১৮৯০ সালে। তাই এর নাম বারোয়ারি (বারো-ইয়ারি)।

এই বারোয়ারি পুজোই শহর থেকে ছড়িয়ে গ্রামে গ্রামান্তরে সার্বজনীনতার স্তরে পৌঁছে গেল। রামায়ণ, পুরাণ, চন্ডীতত্ত্ব, মহিষাসুরদলনী থেকে দুর্গতিনাশিনী দুর্গা হয়ে উঠলেন বাঙালি ঘরের মেয়ে উমা— যিনি সপরিবার বাপের বাড়ির আদর খেতে আসেন। গঙ্গার মৃত্তিকা ছুঁইয়ে রচিতা এই মৃণ্ময়ী উমা আগমনীর সুরে ফিরোজা রঙের আকাশে, কাশফুলের দোলায় সমগ্র বাঙালি ও বাংলাদেশকে ম্যাজিক রিয়্যালিটি তে আক্রান্ত করে মর্ত্যে আসেন। তাইতো মাঠ ভরে যায় কাশফুলে, এঁদো পুকুর ভরে যায় শালুক, পদ্ম ফুলে, নতুন কাপড়ের গন্ধে আর পুজোর ভুরিভোজের আয়োজনে মনে বয় ফুরফুরে বাতাস। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বাঁধা হয় মন্ডপ, গ্রাম শহরের ক্লাবঘর গুলোতে চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালনের মহড়া। পুজোর নতুন গান আর পুজো সংখ্যার জন্য রুদ্ধনিশ্বাস অপেক্ষা চলে। দুর্গা পুজো এই সব নিয়ে। ধর্মীয় অনুষঙ্গকে ফিকে করে বাঙালি ধর্ম -বর্ণ -সম্প্রদায় নির্বিশেষে তার সাংস্কৃতিক সত্তা দিয়ে উদযাপন করে এই উৎসব— বিরাট যার পরিধি ও ব্যপ্তি— যার সব থেকে বড়ো মন্ত্র বাঙালিরূপেন সংস্থিতা।

লক্ষী পুজো:

মহালয়ার দিন যে দেবীপক্ষের সূচনা, শারদ পূর্ণিমা রাতে লক্ষী পুজোর মধ্যে তার সমাপ্তি। লক্ষীর পিতা সমুদ্র। সমুদ্রের বুকেই তো রত্নের আধার। তাই লক্ষী ধন সম্পদের দেবী। আবার লক্ষী কমলাসনা— কমল বা পদ্ম সর্বাত্মক বিকাশের প্রতীক। কথিত আছে মা লক্ষী পদ্মা ও গঙ্গা নদীরূপে বঙ্গদেশ ও ভারতের মৃত্তিকাকে উর্বর করেছেন, শস্যে ভরেছেন— ইনি তাই কৃষিজ লক্ষীও। ভাদ্র ও পৌষ মাসে (ধান রোপণ ও ধান ফলন) প্রতি বাড়িতেই লক্ষী পুজো। বাঙালির দুধে ভাতে থাকার স্বপ্ন পূরণের আশা। আর পেঁচা রাত্রি জেগে ইঁদুর ভক্ষণ করে চাষীর উপকার করে। সে কারণেই রাত্রি জাগরণ করে (কোজাগরী) লক্ষীর উপাসনার ব্যবস্থা। ধর্মীয় অনুষঙ্গে লক্ষীর পুজোর পাশাপাশি বাঙালি ঘরের নারীকেও আমরা লক্ষীর আসনে বসিয়েছি। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগা সমাজ, দেশ, বিশ্ব সংসার সামলানো নারীকেও আমরা গৃহধর্মে ‘লক্ষী’র ভূমিকায় দেখতে চাই। চেহারা, মেধা, গুন, রুচি, আচরণ, ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন ভাবনা— সব কিছুই এই লক্ষী উপমায় প্রকাশিত হয়। আর এখানেই বাঙালির ধর্মীয় ও লোকায়ত লক্ষী নিজ সংস্কৃতি চেতনায় ভাস্বর হয়ে ওঠে।

দীপাবলি ও ভাইফোঁটা:

মহালয়ায় যে পিতৃপুরুষেরা যমলোক ছেড়ে মর্ত্যলোকে আগমন করেন তাঁদের পথ দেখানোর জন্য এই দিন আলো জ্বালানো হয় বলে বিশ্বাস। শাস্ত্রনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দীপাবলি মূলত পাঁচদিন ব্যাপী উৎসব। দীপাবলির আগের দিন ‘নরকা বা ভূত চতুর্দশী’। শ্রীকৃষ্ণ এবং স্ত্রী সত্যভামা ঐদিন ‘নরকাসুর’ বধ করেছিলেন। ২য় দিন দীপাবলিতে শাক্ত ধর্মের অনুসারীরা শক্তি দেবী কালীর পুজো করেন। অবাঙালি বা অনেক বাঙালি পরিবারে ঐদিন লক্ষীর পুজোও হয় (ধনতেরাস)। ঘরদুয়ার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সারারাত আলো জ্বেলে রাখা হয় অলক্ষী বিতাড়িত হয়ে লক্ষীর আগমনের কামনায়। বিষ্ণু পুরাণ মতে এই দিনে পৃথিবীর অজ্ঞতা ও অন্ধকার দূর করার জন্য পৃথিবীতে বলিরাজাকে অযুত অযুত প্রদীপ জ্বালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। তৃতীয় দিন— কার্ত্তিকা শুদ্ধ। চতুর্থ দিন— ভাইফোঁটা, বোনেরা ভাই এর কপালে ফোঁটা দিয়ে দীর্ঘায়ু কামনা করেন। যমদ্বিতীয়া দিয়ে পাঁচদিন ব্যাপী উৎসবের সমাপ্তি। এছাড়া রামায়ণ অনুসারে দীপাবলির দিনেই রাম রাবণ বধ করে চোদ্দ বছরের বনবাস শেষে প্রত্যাবর্তন করেন। সেই খুশিতে আলোকসজ্জা এবং শব্দবাজির সমারোহ ঘটে। শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই নয় দীপাবলির দিনটি শিখ ও জৈন ধর্মের মানুষেরাও অনুষ্ঠান পালন করেন। জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর ৫২৭ অব্দে দীপাবলির দিন মোক্ষ ( নির্বাণ) লাভ করেন। আবার শিখ ধর্মগুরু হরগোবিন্দ জী সম্রাট জাহাঙ্গীরকে পরাজিত করে গোয়ালিয়র দুর্গ থেকে বাহান্ন হিন্দু রাজাকে মুক্ত করে প্রত্যাবর্তন করেন তাই শিখগণ ঐ দিবসকে ‘বন্দী ছোড়’ দিবসও বলেন।

‘দীপাবলি’ অর্থাৎ দীপের সমষ্টি। অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর উৎসব। মন্দের বিরুদ্ধে, অশুভের বিরুদ্ধে, দুঃখের বিরুদ্ধে জয়ের উৎসব, শুভর উৎসব, আনন্দের উৎসব। আলোয় আলোকময় করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মেতে ওঠে, নিজের ভেতরের ও বাইরের অজ্ঞতাকে দূর করার জন্য। এই আলোর আনন্দ দিকে দিগন্তরে ছড়িয়ে দিয়ে সকলকে প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববন্ধনে বাঁধবার উৎসব দীপাবলি ও ভাইফোঁটা। তাই তো ভাইফোঁটার উপহার, মিষ্টি, শুভেচ্ছা শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না অন্য সম্প্রদায়কেও আত্মবন্ধনে বাঁধা হয়।

নবান্ন:

বাংলার হেমন্ত ঋতুর, মূলত অগ্রহায়ণ মাসের অন্যতম ঋতুকেন্দ্রিক উৎসব নবান্ন। এই ফসল উৎসব অনেকটা তামিলের ‘পোঙ্গলের’ মতো। নবান্ন অর্থাৎ ‘নতুন অন্ন’। আমন ধান কাটার পর সেই ধানের চাল থেকে অন্ন, পায়েস, পিটুলি প্রস্তুত করে দেবতাকে উৎসর্গের পর আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশী নিয়ে খাওয়া দাওয়ার যে আনন্দ- অনুষ্ঠান তাই নবান্ন। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী নবান্ন উৎসবের অন্যতম প্রথা হচ্ছে কাকবলি। মহালয়ায় যেমন মৃত পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা হয় তেমনই নতুন ধানের অন্ন এবং খাদ্যসামগ্রী একটি কলার পাতায় করে কাক ও অন্যান্য পাখিদের খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে বাড়ির বাইরের দরজায় রেখে দেওয়া হয় ও মনে করা হয় এই খাদ্য মৃত আত্মাদের কাছে পৌঁছে যাবে। যাইহোক এই উৎসবের আসল আমেজ হচ্ছে তার মাটির সঙ্গে চিরবন্ধনে। হেমন্তে দিগন্তজোড়া সোনালি ধানের রঙে প্রকৃতি ছেয়ে যায় তখন কৃষকের মন আনন্দে ভাসতে থাকে, তার গোলা ভরে উঠবে। তাই বোধহয় হিন্দুরা ছাড়াও মুসলমান কৃষকরাও নতুন ফসল ওঠার উৎসবে মিলাদ দেয়, মসজিদে শিন্নী দেওয়ারও চল আছে। হাজার বছর প্রাচীন এই উৎসব সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী, অসম্প্রদায়িক এবং প্রাণের বাঁধনে যুক্ত।

পৌষ সংক্রান্তি ও পৌষ পার্বণ:

পৌষ মাসের শেষ দিনে সূর্যের উত্তরায়ণের প্রাক্কালে একরাশি থেকে অন্যরাশিতে প্রবেশ করাকেই বলা হয় পৌষসংক্রান্তি বা মকরসংক্রান্তি। নবান্নের পর এটি আরেকটি ফসল উৎসব হিসেবে পালিত হয়। পিঠেপুলি খাওয়া এই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ। প্রাচীন হিন্দুরা এই দিনটিতে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তিল, খেজুর গুড় ও নতুন ধান থেকে উৎপন্ন চালের তৈরি পিঠের অর্ঘ্য দিতেন এই কারণে পৌষ সংক্রান্তির অপর নাম তিলুয়া সংক্রান্তি বা পিঠে সংক্রান্তি। এই উৎসব বর্তমানে পৌষ পার্বণ নামে পরিচিত। পিঠে পুলিকে কেন্দ্র করে মেলাও বসে। এছাড়াও রয়েছে ঘুড়ি ওড়ানো। সারাদিন ঘুড়ি উড়ানোর পরে সন্ধ্যায় পটকা ফুটিয়ে ফানুস উড়িয়ে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। মকর সংক্রান্তি উপলক্ষ্যেই সাগর দ্বীপে কপিল মুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে গঙ্গাসাগর মেলা এবং বীরভূমের কেন্দুলিতে জয়দেবের মেলা ঐতিহ্যবাহী ও আনন্দ উৎসবের বাহক।

সরস্বতী পুজো:

‘সরস্বতী’র ধারণাটি অতি প্রাচীন। ঋক্‌বেদে দু-ধরণের সরস্বতীর উল্লেখ আছে। একটি সূর্যাগ্নি, অন্যটি নদী। বিভিন্ন পুরাণ ও শাস্ত্রমত অনুযায়ী সরস্বতী কখনও ইন্দ্রের, কখনও ব্রহ্মার আবার কখনও সূর্যের পত্নী। ‘ব্রাহ্মণ’ এ ইনি বাক্ নামে পরিচিতা। সরস্বতী শব্দের অর্থ জ্যোতির্ময়ী আবার সৃ ধাতু নিষ্পন্ন করে সর্ শব্দের অর্থ জল। সরস্বতী কখনও শত্রুদলনী, কখনও বা চিকিৎসক। পাটলীপুত্রের নারীরা চিকিৎসার জন্য সরস্বতী নদীর জল ব্যবহার করতেন— ‘কথা সরিৎসাগর’ (সোমদেব)। আর্জ যুগে ভারতবর্ষের ভূমিতে সরস্বতী ও সিন্ধুর পাঁচটি উপনদী সহ সপ্তসিন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে ( আঞ্চলিক নাম সুরসতী, ঋগ্বেদ, viii, 36.6 সূক্ত)। সম্ভবত সরস্বতী নদীর তীরেই ব্রাহ্মণ্য ও বৈদিক সংস্কৃতির উদ্ভব। তাই তিনি ভারতী। শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর অচ্ছেদ্য বন্ধন। তাই হয়ত হিন্দুদের দেবী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ ও জৈনদের কাছেও পুজো পেয়েছেন সরস্বতী। সারনাথে সংরক্ষিত সরস্বতী মূর্তি বা মথুরায় জৈনদের প্রাচীন কীর্তিতে সরস্বতী মূর্তি তার প্রমাণ।

শাস্ত্রীয় বিধান মেনে বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পুজোর প্রচলন আধুনিক যুগে হয়। ঊনবিংশ শতকে পাঠশালায় ধোয়া চৌকির উপর দোয়াত কলম রেখে সরস্বতী পুজোর প্রচলন হয়। বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরস্বতীর উপাসনাতে ধর্মীয় পদ্ধতি ও অনুষঙ্গ অপেক্ষা আনন্দ, খাওয়া দাওয়া (খিচুড়ি-লাবড়া), সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান (চিত্র প্রদর্শনী, প্রতিযোগিতা, নাচ-গান-নাটক-আবৃত্তি) মিলিয়ে সম্প্রদায় নির্বিশেষে এক আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়েছে।

দোলযাত্রা:

ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত বসন্তোৎসবের প্রধানত দুটি পর্যায় রয়েছে। দোলযাত্রা ও হোলিকা, সম্ভবত হোলিকা থেকেই হোলি নামটির উদ্ভব। আবার এই তিথিতে চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌর পূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়। ব্রহ্মার বরে হিরণ্যকশিপু দেব ও মানব বিজয়ী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সন্তান প্রহ্লাদ বিষ্ণুকে পিতার অগ্রে স্থান দিলে দাদার নির্দেশে হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে অগ্নিতে প্রবেশ করলে হোলিকা অগ্নিদগ্ধ হন। এই হোলিকা দহন এখন হোলির আগের দিন ‘নেড়াপোড়া’ তে রূপান্তরিত। বাঁশ, খড়, শুকনো ঝরা পাতা— তথা পুরাতনকে পুড়িয়ে নতুনকে আহবান করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। দোলযাত্রার দিন সকাল থেকে ছোটো বড়ো সকলের মনেই রঙিন নেশা ধরে। পৌরাণিক মতে শ্রীকৃষ্ণ এই দিনেই রাধাকে প্রেম নিবেদন করেছিলেন। রাধা-কৃষ্ণ প্রেমের দোলায় দুলবেন। তাই তো লাল-নীল-সবুজ-হলুদ-গোলাপী আবিরের রঙে উৎসব, পরিবেশ ও হৃদয় হয়ে ওঠে বর্ণিল। প্রকৃতিতেও লাগে অশোক-পলাশের লাল নেশা। মানুষ, প্রকৃতি উভয়েই হয়ে ওঠে সজীব-সতেজ। এই ধারা বজায় রেখে শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসবের মতো সামাজিক পার্বণের সূত্রপাত। বিশ্বজনীন ভালোবাসা, মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য স্থাপন এবং নিজেকে সকলের মাঝে প্রিয়তর করে তুলে ধরাই যেন এই উৎসবের মূল সুর।

শিবরাত্রি:

শিবলিঙ্গের পুজো বছরভর চললেও শিবরাত্রি একটু বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে কারণ মহাদেব নিজমুখে পার্বতীকে বলেছিলেন, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষীয় চতুর্দশী তিথির রাত্রিতে উপবাস করলে তিনি সন্তুষ্ট হন। ‘শিব’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ মঙ্গল। আর লিঙ্গ মানে চিহ্ন। শিবপুরাণে বলা হয়েছে শিবলিঙ্গ হল ‘আগুনের স্তম্ভ’। শিবলিঙ্গের তিনটি অংশকে বলে ব্রহ্ম পীঠ, বিষ্ণু পীঠ ও শিব পীঠ। শিবলিঙ্গ একাধারে প্রকৃতি ও পুরুষ, সত্য, জ্ঞান, অনন্তের প্রতীক। যাইহোক প্রাচীন বা পৌরাণিক কাহিনীতে সাধারণত পুরুষদের (রাবণ) শিবের ভক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে তবে বাংলাদেশে অবিবাহিত রমনীদের মধ্যে শিবরাত্রির ব্রত করার প্রবল আগ্রহের কারণ সম্ভবত ঐদিন শিব পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল (পৌরাণিক মতে)। এছাড়াও বোধহয় জ্ঞানী ও পত্নীনিষ্ঠ স্বামীর আকাঙ্ক্ষায় বাঙালি মেয়েরা শিবের নেশাগ্রস্ত, রাগী চেহারাটি মনে রাখতে চায় না।

চড়ক সংক্রান্তি:

চড়ক সংক্রান্তি সম্পূর্ণ লৌকিক উৎসব। হিন্দু সমাজের তথাকথিত নিম্নস্তরে এই উৎসবের প্রচলন রয়েছে। স্বভাবতই বৌদ্ধ ভাবনার ধর্মপুজোর প্রক্রিয়া এই উৎসবের সঙ্গে সংযুক্ত। জনশ্রুতি যে, ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পুজো প্রথম শুরু করেন। চড়ক পুজোর অন্য নাম গাজন। গাজন শব্দের উৎপত্তি গর্জন থেকে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী চৈত্র বা মাঘে এক-সাত-দশ-পনেরো কিংবা তিরিশ দিন নৃত্যগীত ও হুঙ্কার রবের মাধ্যে যে শিব সাধনা তাই গাজন রূপে প্রচলিত। গাজন উৎসবের তিনটি অংশ— ঘাটসন্ন্যাস, নীলব্রত ও চড়ক। গেরুয়া বস্ত্রধারণ করে হবিষ্যি গ্রহণের মাধ্যমে সন্ন্যাস পালিত হয়। এই সময় মুখোশ নৃত্য ও সঙ সেজে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে সন্ন্যাসীরা বের হন। পরের দিন নীলপুজোয় মহিলারা সন্তানের মঙ্গল কামনায় শিবের পুজো দেন ও গাজন সন্ন্যাসীদের ফল, নৈবেদ্য দান করেন। শেষ পর্বে শিবমন্দিরের কাছের পুকুরে ডুবিয়ে রাখা চড়ক গাছটিকে চড়কতলায় পোঁতা হয় এবং সন্ন্যাসীরা প্রকান্ড কাষ্ঠদন্ডের উপরে অনেকটা উঁচুতে আঙটায় ঝুলে শূণ্যে ঘুরতে থাকেন আর ফল-বাতাসা মানুষদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়তে থাকেন। এর পাশাপাশি বাণরাজার শিবভক্তির কথা মনে রেখে বাণফোঁড়া (চামড়ায় লৌহশলাকা ফোঁড়া), আগুনঝাঁপ, কাষ্ঠঝাঁপ, বঁটিঝাপ, ফুলঝাঁপ প্রভৃতি কৃচ্ছ্রসাধন চলতে থাকে। আর এই সব অনুষ্ঠানক্রিয়াকে কেন্দ্র করে মেলা বসে। তবে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রভাব না থাকায় এই উৎসবে কোনো পুরোহিতের প্রয়োজন পড়ে না।

ধীরে ধীরে দিন বদলেছে। বদলাচ্ছে। ভবিষ্যতে বদলাবে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রায় প্রতিটি পুরাণকল্প, ধর্মীয় শাস্ত্র ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে তাই আজ এক একটি উৎসবে রূপান্তরিত। এই ভাঙা-গড়ার দায়িত্ব মানুষ সার্বিক ভাবেই নিয়েছে। আধুনিক মানুষ বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে, কখনও বা ক্ষমতার জাহির করতে গিয়ে ধ্বংস ও লড়াই-এর খেলায় মেতে ক্লান্ত-অবসাদগ্রস্ত-বিছিন্ন এক একটি দ্বীপ। জানা নেই মুক্তি কোথায়? শুধুই ছোটা। তখনই দরকার হয়ে পড়ে অপর এক জনের সঙ্গে মিলিত হবার প্রেরণায়। আর উৎসব তো সেই কাজটাই করে। মেতে থাকে, মাতিয়ে রাখে। তাই উৎসবের চেহারা যেমনই হোক না কেন যুক্তি বুদ্ধিকে পাশে সরিয়ে মানুষ কয়েকদিনের জন্য নিজের মুক্তি খুঁজে নেয় মানসিকভাবে। এইখানেই উৎসবের প্রয়োজনীয়তা ও সার্থকতা।

Facebook Comments

পছন্দের বই