লেখক নয় , লেখাই মূলধন

রাজর্ষি রায়ের প্রবন্ধ

গল্পকার হুমায়ূন আহমেদ

সংকলনের বারোতম গল্প ‘খেলা’, যেখানে নলিনীরঞ্জনবাবুর দাবা খেলা জেতার আশ্চর্য কাহিনি বর্ণনা করেছেন লেখক। ইচ্ছা করেও তিনি খেলার সঙ্গে বেইমানি করতে পারেন না, জীবনের শেষ খেলাটিতেও জিতে যান। ‘ফেরা’ গল্পটি এক নিম্নবিত্ত বাড়ির। ছেলেমেয়েদের নিয়ে মা খেতে বসেছে, ভালো খাবার নেই বলে ছেলেমেয়েরা খাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত তাদের বাবা একটা মাছ নিয়ে আসে। বৃষ্টি থেমে জ্যোৎস্না ফুটেছে এমন রাতে সকলে মিলে খেতে বসেছে। মায়াবী আলোয় সকলেই আনন্দিত আর তাতেই চোখে জল এসে যায়। গল্পের ব্যঞ্জনা পাঠকের মনকে নাড়িয়ে দেয়। ‘তুচ্ছ’ গল্পে নিতান্ত সাধারণ এক মানুষের কথা এসেছে। অসহায় মানুষকে সাহায্য করার কথা অনেকে বললেও যখন সময় আসে তখন কেউ সাহায্য করে না। আসল সমস্যাকে একজন আরেকজনের কাঁধে দিয়ে এড়িয়ে যায়। পরের গল্প ‘মন্ত্রীর হেলিকপ্টার’। গল্পে এক মন্ত্রী নিজের গুরুত্ব বোঝাতে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে বলেন সেক্রেটারিকে। তারপর তাঁর মনে হয় গ্রামের কোনো অসুস্থ মানুষকে শহরে নিয়ে এসে চিকিৎসা করাবেন। এটাও তার নিজের নাম প্রচারের জন্যই লোক দেখানো এক কাজ। কিন্তু সেখানেই দেখা দেয় সংকট। যে-রোগীকে হেলিকপ্টারে তোলা হয় তার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ, জীবনের প্রায় শেষ অবস্থা। হেলিকপ্টার যেতে পারে না, রোগী নামানো হয় এবং সে মারা যায়। বর্তমান সময়ে লোক দেখানো মহানতার রাজনীতি, নেতা মন্ত্রীদের কাজকর্মের জন্য সমাজে যে-সংকট সৃষ্টি হয়, তাই গল্পটিতে ফুটে উঠেছে কাহিনির মধ্য দিয়ে। ‘নিশিকাব্য’ গল্পটিও মায়াবী জ্যোৎস্নার পরিবেশে রচিত। আনিসের বাড়িতে বাবা, মা, ভাই, বোন, বউ, মেয়ে আছে কিন্তু তাদেরকে ছেড়ে সে শহরে চাকরি করে, মেসে থাকে, হোটেলে খায়। জ্যোৎস্না রাতে গ্রামের বাড়িতে ছেলে ফিরেছে বাড়ির সকলে খুব খুশি। ভালো চলছিল সবকিছু, কিন্তু জীবন তো এত সোজা নয়। গল্পের শীর্ষে মুহূর্তে সংকট দেখা দেয়। মায়াবি স্বপ্নে হঠাৎ আঘাত লাগে, যখন আনিস বলে সে ভোরের ট্রেনেই ফিরে যাবে শহরে। বেসরকারি কোম্পানির চাকরি। জীবনের কোনো দাম নেই সেখানে। তাই অসুস্থ মেয়েকে রেখেই তাকে ফিরে যেতে হয়। আধুনিক জীবনের এক চরম সংকটের ঘটনা ধরা পড়েছে গল্পটিতে। ‘নিশিকাব্য’ মায়াবী চাঁদের আলোয় শুরু হলেও শেষ হয় ঘোর বাস্তবের মাটিতে। ‘সৌরভ’ গল্পেও আধুনিক ভোগবাদী জীবনের কথা এসেছে। সামান্য সামান্য করে আজকের দিনে মানুষের চাহিদা প্রচুর, যা পূরণ না হলেই মনের দুঃখ। সামান্য সেন্টের জন্য ঘুরতে থাকে আজহার, শেষ পর্যন্ত ঝড়বৃষ্টির রাতে টাকা জোগার করে সে সেন্টটা কেনে কিন্তু শিশিটা ভেঙে যায়। ‘জলছবি’ গল্পে জলিল সাহেবের দিনটা খারাপ হিসাবেই শুরু হয়েছিল, প্রথমে জুতো ছেঁড়া, তারপরে বাসে পাশের সিটে বসা মানুষটির ঘাড়ে ঘা, শেষে অফিসে দেরি করে পৌঁছানো, অফিসে বসের খোঁজে উপস্থিত না থাকতে পারা। তিনি ভেবেছিলেন চাকরিটা থাকবে না, কিন্তু দেখা গেল দিন শেষে তাঁর প্রমোশান হয়েছে। মানুষের জীবন কখন কী হয় কেউ বলতে পারে না। সেরকমই এক গল্প ‘নন্দিনী’। মুক্তিযুদ্ধের জীবন বিপন্ন মানুষের ভালোবাসার গল্প এটি। বহু বছর পর বন্ধুর মাধ্যমে দেখা হয় ভালোবাসার দু-জনের, কিন্তু পুরোনো জীবনের অপূর্ণতাকে কাটানো সহজ নয়, শীতের কুয়াশার মতো ফিরে ফিরে আসে। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে বিনুর উচ্চবিত্ত বন্ধুর বাড়িতে জন্মদিনে রাত কাটানোর গল্প ‘জলকন্যা’। বিনুর বাবা কোনোদিন তাকে বাড়ির বাইরে রাত কাটাতে দেয় না, অথচ এই বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটানোর অনুমতি দিয়েছে কিন্তু সেখানকার পরিবেশ তার ভালো লাগছে না। বড়োলোক বন্ধুদের পার্টিতে মজু আংকেলের উপস্থিতি আরও সমস্যা বাড়িয়ে তোলে বিনুর। বাড়ির চলে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও, উপায় থাকলেও, সকলের সম্মতি থাকলেও বিনু জলপরি সাজতে শুরু করে। এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব বিরাজমান বিনুর মনে, যেটিকে কাটিয়ে উঠতে সে পারে না। ম্যাজিশিয়ান মজু আংকেল কি ম্যাজিক করেছে? গল্পে মায়াবী পরিবেশে থাকতে থাকতে পাঠকের মনে আসে নানা প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর পাওয়া যায় না।

অতীতের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘পাপ’ গল্পটি। গল্পটি একজনের স্বীকারোক্তি, যে পাঠকের উদ্দেশে নিজের বিচারের দায়িত্ব দেন। কাঞ্চন নদী তীরে ধলা গ্রামে এক টিনের ঘরে সস্ত্রীক বসবাস করতেন গল্পের কথক, যিনি সেই গ্রামের স্কুল শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক বাহিনীর অত্যাচার শুরু হল অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাবাও ছেড়ে দেওয়ার নয়। কিন্তু এক বর্ষণমুখর রাতে গল্প কথকের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী তাকে একটি কথা রাখার জন্য বলে। গল্প কথক জানতে পারে তার স্ত্রী একজন ডুবন্ত পাক সেনাকে উদ্ধার করেছে যাকে বাঁচাতে হবে সেনা শিবিরে পৌঁছে দিয়ে। গল্প কথক সেই রাত্রে দেশের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা করেননি, করেছিলেন মানবতার সঙ্গে। অত্যন্ত অসহায় এক মানুষকে সাক্ষাৎ মৃত্যু মুখে পৌঁছে দিতে তিনি মুক্তিবাহিনীকে খবর দিয়েছিলেন। সন্তান প্রসবের সময়ে তাঁর স্ত্রী মারা যায়। যুদ্ধ শুধু মানুষকে নয়, মানবতাকে হত্যা করে, দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার কথা সকলে বলে, কিন্তু প্রাণ বাঁচানোর, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বাঁচানোর, মানুষের স্বপ্ন বাঁচানোর কথা বলে না। এক গভীর পাপ-পূণ্যের কথা বলেন গল্প কথক, যা মানুষের মনে চিরকাল দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। ‘সংসার’ গল্পে প্রায় পঙ্গু কুদ্দুস মিয়া চার বছরের ছেলেকে নিয়ে পাইপের বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে নিজের জীবনের কথা ভাবে। নিম্নবিত্তের সংসার কুদ্দুস মিয়ার আর মনোয়ারার। কুদুস মিয়ার কোনো আয় নেই, কিন্তু তিনজনের পেট চালিয়ে মনোয়ারা পয়সা জমায় কুদ্দুসের জন্য রিক্সা জমাতে। মনোয়ারাকে নিয়ে ভালোই থাকে কুদ্দুস, গল্পের শেষে হঠাৎ পাঠকের মনে আঘাত হানেন লেখক। মনোয়ারার টাকার উৎস কোথায়, কেমন করে তাদের সংসার চলে, খুব স্বাভাবিক— নারী উপযোগী আদিমতম ব্যবসা। ‘মন্ত্রীর হেলিকপ্টার’-র মতোই এক মন্ত্রীকে নিয়ে লেখা গল্প ‘ফজলুল করিম সাহেবের ত্রাণকার্য’। গ্রাম বাংলায় বারবার দুর্দিন নেমে আসে বন্যার ফলে। আর এতে কিছু সুবিধাভোগী মানুষ নিজের প্রচার করে আয় করে, গরিব মানুষ আরও গরিব হয়ে যায়। কোনো কিছু ব্যবস্থা ছাড়াই ফজলুল করিম সাহেব লঞ্চে করে বন্যার ত্রাণ দিতে বেড়িয়েছেন, সঙ্গে নেওয়া আছে অপ্রয়োজনীয় তাঁবু, পচা টম্যাটো জুস, ডিস্ট্রিল ওয়াটার, টকে যাওয়া খিঁচুড়ি ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত ভেলায় ভাসা এক পরিবারকে ত্রাণ দিয়ে ফিরে আসেন তিনি, অথচ খবরের কাগজে তার নাম বিপুলাকারে প্রচারিত হয়। ক্ষমতার রাজনীতিতে থাকা মানুষের প্রতি লেখকের তীব্র ব্যঙ্গ এখানে প্রতি অক্ষরে ফুটে উঠেছে। ‘সুলেখার বাবা’ এক অদ্ভুত গল্প। উচ্চবিত্ত শিক্ষিত বাড়ির অল্প বয়সি মেয়ে সুলেখা একদিন সকালে দেখে তাদের বাড়ির সামনে নোংরা গায়ের একটা লোক বসে বসে থুথু ফেলছে। অনেক ঘটনার পর সুলেখার মা সুলেখার হাত দিয়ে একশো টাকা পাঠায় লোকটিকে। সুলেখা জানে না লোকটিকে, কিন্তু সুলেখার বাবা মা আর লোকটির কথায় আন্দাজ করা যায় এই লোকটি পয়সার কারণে নিজের মেয়েকে বিক্রি করেছিল এই উচ্চবিত্ত দম্পতির কাছে, যার বড়ো হয়ে নাম হয় সুলেখা। মানুষ তার নিজের জীবন সম্বন্ধেই অনেক সময় জানে না, অথচ সে তা নিয়েই এগিয়ে চলে, সুলেখার মতো। ‘কবর’ গল্পে উচ্চবিত্ত ঘরের মনিকার বাবা মারা যায়, তার বাকি ভাই-বোনদের খবর দেওয়া হয়। ভাই-বোনদের আসতে সময় লাগবে বিদেশ থেকে, ততদিন বাবার মৃত শরীর থাকবে বারডেমে। কিন্তু এই কথা বোঝে না ফুলির মা। মনিকার বাবাকে শেষ অবস্থায় দেখাশোনা করেছিল ফুলির মা, কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর ছেলেমেয়েদের কাজ ধরতে পারে না গ্রামের মহিলা ফুলির মার। মনিকা তাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়, মনিকার বোন আরো বড়ো রকমের সন্দেহ করে। মৃত্যুর পরের জগতের থেকে জীবিত অবস্থার জগৎ যেন বেশি রহস্যময়। নানা প্রশ্নের উদয় হয় সহজ সরল ফুলির মার মনে কিন্তু আধুনিক জীবন এই সহজ প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে পারে না। সংকলনের শেষ গল্প ‘একজন শৌখিনদার মানুষ’। বড়লোক হামেস মিয়া শৌখিন মানুষ। শৌখিনতার জন্য সে ঘেঁটু দল রাখে আর তাতেই সে ভাড়া করে বালক সুলায়মানকে। দরিদ্র মানুষদের কিছু পয়সা দিয়ে তাদের পরিবারে বালকদের বছরের কিছু সময়ের জন্য নিয়ে যায় এই শৌখিন মানুষরা আদিম প্রবৃত্তি নিবারণের জন্য। ঘেঁটু বালকদের মনুষ্যেতর জীবন নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস রচনা করে তার চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন একসময়ে। তীব্র দারিদ্রের জন্য মানুষ এবং সমাজ কোথায় যেতে পারে তার নিদর্শন এই গল্পটি।

১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে বাঙালি জীবনধারায় আসে ভিন্নতা। একটি জাতির জীবনের পরিবর্তন স্বাভাবিক, কিন্তু একটি জাতির জীবনধারা দুটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে খুবই কম দেখা যায়। বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দুটি ভিন্ন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা একভাবে চলেনি, দেখা দিয়েছে নানা রকমের রাজনৈতিক সংকট, সামাজিক পরিবর্তন, তার জন্যই ব্যক্তি-গোষ্ঠী-সমাজ তার চেতনা বিকাশের দুটি আলাদা পথ বেছে নিয়েছে। এসবের প্রভাব সাহিত্যে পড়েছে স্বাভাবিক ভাবেই, তাই বইতে আলাদাভাবে চর্চিত হয়েছে দুই বাংলার সাহিত্যের ইতিহাস। কিন্তু সাহিত্য কি বেড়াজালে আটকে থাকে? দুটি দেশের জীবনধারায় ভিন্নতা থাকলেও দরিদ্র মানুষের অসহায়তা, মধ্যবিত্ত জীবন অবক্ষয়, জীবনযুদ্ধে প্রতিষ্ঠা, মানবমনের জটিলতা, আধুনিক জীবন সমস্যা দুটি দেশের সাহিত্যের কাছেই বাস্তব। শোষণ, সমাজ-রাজনীতিতে দুর্নীতি, শাসনের অব্যবস্থা প্রভৃতির কবলে থাকা মানুষের আর্থিক সংকট, খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের অবক্ষয় দুই দেশের মানুষের জীবনসঙ্গী। বাংলা সাহিত্যে এসবই প্রতিফলিত হয়েছে নানাভাবে। বাস্তবতাকে যখন তুলে ধরেন সাহিত্যিকরা তখন সাহিত্যের মধ্যে আলাদা দেশ খুঁজে পাওয়া যায় না। বিদেশি শাসন পরবর্তী বঙ্গসাহিত্য তাই কখনো আলাদা কখনো অভিন্ন সত্তায় বিরাজমান। আসলে সাহিত্য খুঁজে বেড়ায় ব্যক্তি মানুষকে। অতি সাধারণ মানুষ থেকে রাজা মহারাজা যার কথাই বলা হোক না কেন গল্প উপন্যাসের উপজীব্য মানুষের জীবন, তার আবেগ, অনুভূতি, চাওয়া পাওয়ার কাহিনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় লেখকের জীবনদৃষ্টি হয়। স্বতন্ত্র মানুষের কথা এলেও সাহিত্য কিন্তু কেবল ওই বিশেষ মানুষটিতেই সীমাবদ্ধ নয়, ব্যক্তির মধ্য দিয়ে সমগ্রতার দর্শন করাই সাহিত্যের সার্থকতা। এক দেশের মানুষের কাহিনি শুনে অন্য দেশের পাঠক যেন নিজেকেই সেই স্থান অনুভব করে। তাই যেকোনো অমর সাহিত্যই দেশ-কালের অতীত। বিচিত্র বিষয়ের অবতারণা করে নানা আঙ্গিকে গল্প পরিবেশন করে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বারবার সেই একটা মানুষকেই অন্বেষণ করে যান।

• মূল গ্রন্থ: হুমায়ূন আহমেদের স্বনির্বাচিত গল্প, ১৯৯৮, নয়া উদ্যোগ, কলকাতা।
• সহায়ক গ্রন্থ: আমার ছেলেবেলা, হুমায়ূন আহমেদ, সপ্তম মুদ্রণ ১৯৯৮, কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা।

Facebook Comments

পছন্দের বই