লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ

সৈয়দ হায়দর রজা

[২২.০২.১৯২২ – ২৩.০৭.২০১৬]

পরিচয়
সৈয়দ হায়দর রজা ছিলেন আধুনিক ও সমসাময়িক ভারতীয় শিল্পের অন্যতম সেরা আইকন এবং প্রগতিশীল শিল্পীগোষ্ঠীর একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি পাশ্চাত্যের বিমূর্ততাকে এই দেশের চিত্রশিল্পের ঐতিহ্যের সঙ্গে সার্থকভাবে সংযুক্ত করেছিলেন। ফলস্বরূপ সমসাময়িক ভারতীয় শিল্পের একটি স্বতন্ত্র স্টাইল তৈরি করতে তিনি সক্ষম হন।

১৯২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মধ্যপ্রদেশের বাবরিয়ায় রজা জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন একজন ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসার। মধ্যপ্রদেশের দমোহ থেকে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে তিনি নাগপুর স্কুল অফ আর্টে ভর্তি হন। ১৯৪৩ সালে সেখান থেকে বৃত্তি লাভ করে তিনি মুম্বইয়ের বিখ্যাত জেজে স্কুল অব আর্টসে প্রবেশাধিকার অর্জন করেন। আর তারপরেই ১৯৫০ সালে তিনি দু-বছরের ফরাসি সরকারি বৃত্তি নিয়ে প্যারিসের ইকোল ন্যাশনাল সুপিরিওর দেস বউজ-আর্টসে উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য পাড়ি জমান। পরবর্তী ছয় দশক তিনি ফ্রান্সে বসেই জীবনের অনন্য শিল্পকর্মগুলি রচনা করে গেছেন। নিজের দেশের সঙ্গে যদিও কোনোকালেই তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। ২০১০-এর আগে বারবার তিনি সাময়িকভাবে দেশে ফিরে এসেছেন। আর তাঁর শিল্পী-মানস তো চিরকালই এই দেশের সঙ্গে বাঁধা।

মুম্বই ল্যান্ডস্কেপ: বর্ষাকালে ফ্লোরা ফাউন্টেন

১৯৪৬-এ রজা মুম্বই আর্ট সোসাইটি সালোঁয় তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী করেন। সেই সময়েই তিনি এফ এন সুজা, কে এন আরা, এম এফ হুসেন-এর মতো প্রগতিশীল শিল্পীদের সঙ্গে একাত্ম হন। তাঁদের এই গোষ্ঠী ভারতীয় শিল্পে ইউরোপীয় বাস্তববাদের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে একটি অভিনব ‘অভ্যন্তরীণ ভারতীয় দৃষ্টি’ অন্বেষণের চেষ্টা করেছিল। গোষ্ঠীর প্রথম প্রদর্শনী হয় ১৯৪৮ সালে, রজার ফ্রান্সে চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে।

রজা নিজেই তাঁর শিল্পী-জীবনকে চারটি আলাদা কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পর্যায়ে বিভক্ত করেন। প্রথম পর্যায়ে, ফ্রান্সে যাওয়ার আগে, প্রগতিশীল শিল্পীদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন।

এই সময় তাঁর আঁকা কাশ্মীর শহরের ল্যান্ডস্কেপের প্রসংশা করেন স্বয়ং প্রবাদপ্রতিম আধুনিক ফোটোগ্রাফ-শিল্পী অঁরি কার্তিয়ের ব্রেসঁ। যদিও কার্তিয়ের ব্রেসঁর মনে হয়েছিল, রজার ছবির ফ্লুইডিটি অনেক বেশি এবং সেজাঁর ছবি দেখে তাঁর অবিলম্বে চিত্রশিল্পের গঠনগত পাঠ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

দ্বিতীয় পর্যায়ে, ফ্রান্সে যাওয়ার পরে তিনি ফরাসি ল্যান্ডস্কেপে মনোনিবেশ করেন। প্যারিসের প্রথম বছরগুলিতে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলির একটি হল ‘চার্চের সাথে গ্রাম’ (১৯৫৮)। ১৯৫৬ সালে তিনি প্রথম অ-ফরাসি শিল্পী হিসেবে সম্মানীয় প্রিক্স-দে-লা-ক্রিটিক পুরস্কার লাভ করেন।

তৃতীয় পর্যায়ে রজা পাশ্চাত্য আধুনিকতার স্রোতে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকেন। আরও বেশি করে বিমূর্তের দিকে এগিয়ে যান। বিমূর্তের মাধ্যমে অনন্তের অস্তিত্বের তল্লাস তাঁর মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে।

সব ধর্মের সমন্বয় এবং ব্যক্তিগত জীবনে পরমেশ্বরের প্রেম ও অনুকম্পায় প্রবল বিশ্বাসী রজার ছবি আরও বেশি করে রহস্যবাদী হয়ে ওঠে।

লা তেরে

আর সর্বশেষ পর্যায়ে, ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ থেকে তান্ত্রিক ভিজ্যুয়াল ফর্মের উপাদানগুলিকে তিনি নিজের থিমের অন্তর্ভুক্ত করেন। এই পর্যায়েই বিন্দুর বিমূর্ত ধারণাটি তাঁর শিল্পে প্রকাশিত হয়, যা তাঁর মতে সৃষ্টি ও অস্তিত্বের কেন্দ্র। বিন্দুর পরে, তিনি পরবর্তী দশকগুলিতে ত্রিভূজ, চতুর্ভুজ, প্রকৃতি-পুরুষ, বিকিরণ ও অন্যান্য অভিব্যক্তিবাদী বিমূর্ততার সাংকেতিক মাত্রাগুলির সফল ব্যবহার করেন। পঞ্চভূতের ধারণাও আলাদা আলাদা পাঁচটি রঙে ও জ্যামিতিক আকারে তাঁর ছবির প্রধান উপাদান হয়ে ওঠে।

বিন্দু-নাদ

১৯৫৯ সালে রজা ফরাসি শিল্পী জানিন মঁজিলাকে বিবাহ করেছিলেন। মূলত তাঁর জন্যেই, তাঁকে কথা দিয়েছিলেন বলেই ফ্রান্সে বসবাস। ২০০২ সালে অল্প কিছুদিনের অসুস্থতার পর জানিন মারা গেলে এক সুখী দাম্পত্য জীবনের অবসান হয়। এর পরেই রজা পাকাপাকিভাবে ভারতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

১৯৮১ সালে তিনি এই দেশে ললিতকলা একাডেমির ফেলোশিপ ও পদ্মশ্রী, ২০০৭ সালে পদ্মভূষণ, এবং ২০১৩ সালে পদ্মবিভূষণে সম্মানিত হন। ১৪ই জুলাই, ২০১৫-এ তাঁকে ফ্রান্সের কমানদ্যর ডি লা লিজিয়ঁ দ্য নরে ভূষিত করা হয়েছিল। এছাড়াও তিনি কালিদাস সম্মান (মধ্য প্রদেশ সরকার, ১৯৭৮) অফিসার ডি এল অর্ড্রে ডেস আর্টস এট ডেস লেট্রেস (ফ্রান্স সরকার, ২০০২), বার্কলে-তে (১৯৬২) ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর, ইন্দিরা কলা সংগীত বিশ্ববিদ্যালয়, খয়রাগড়, ছত্তিশগড় (২০১৪) এবং শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরপ্রদেশ (২০১৫) ডি. লিট (অনরিস কাউসা) প্রভৃতি সম্মান লাভ করেন।

উল্লেখযোগ্য যে ২০১০ সালে ক্রিষ্টির নিলামে রজার ‘সৌরাষ্ট্র’ ছবিটি ১৬.৪২ কোটি টাকায় বিক্রি হয়। ভারতীয় শিল্পকলায় এ ছিল এক সর্বকালীন রেকর্ড। কিন্তু যখন তিনি তরুণ ছিলেন সেই অর্থাভাব ও সংগ্রামের দিনগুলির কথা এই খ্যাতনামা শিল্পী কখনোই ভোলেননি। ২০০১ সালে তাই ভারতের তরুণ শিল্পীদের উৎসাহদান ও সাহায্য করার উদ্দেশ্যে নিজের সঞ্চিত অর্থের একাংশে রাজা ফাউন্ডেশন তৈরি করেছিলেন।

সৌরাষ্ট্র

আমৃত্যু কর্মরত এবং সৃজনশীল থেকে সৈয়দ হায়দর রজা ২০১৬ সালে প্রায় পঁচানব্বই বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। পবিত্র নর্মদার তীরে, তাঁর শৈশবের ক্রীড়াভূমি মণ্ডলায়, পিতার সমাধির ঠিক পাশেই তাঁর দেহও শায়িত আছে। যে-প্রকৃতি ও পরিবেশ তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল বলে তিনি মনে করতেন, মৃত্যুর পর তার কোলেই তিনি ফিরে গেছেন। আর কিছুদিন পরেই তাঁর জন্মশতবর্ষ।

রজার সময়
[আশি বছরের জন্মদিনে চিত্রশিল্পী সৈয়দ হায়দর রজার জন্য একটি কবিতা]
অশোক বাজপেয়ী


মধ্যপ্রদেশের বনভূগোল থেকে
আমি নাম তুলে আনি
ককৈয়া, বাবরিয়া, বচই, মণ্ডলা, দমোহ, নরসিংপুর
আর সেগুলো তোমার আকাশে
শিশির ভেজা বনস্পতির মতো ঝিলমিল— ঝিকমিক করে—
যেন তোমার আদিম আত্মার বর্ণমালার
কিছু আলোকিত অক্ষর:
আমার কান এড়িয়ে যায়
ছোটোবেলায় জঙ্গল থেকে ঘরের দেওয়ালে
ফাটলের ভেতর প্রবেশরত সাপের সরসর,
কিংবা বারান্দায় কিলবিলে বিছের দংশন,
যদিও প্রার্থনার মতো ঘিরে ধরে
দেহাতি স্কুলের দাওয়ায় বসে নামতা পড়া
অথবা হিন্দীর রোগামতো পাঠ্য বই থেকে
বারংবার আউড়ে যাওয়া তুলসী— কবীর— রহিমের ভক্তির পদ।
জঙ্গলে একসঙ্গে থাকে— ভয় আর সুন্দরতা
ঘরের ভেতর আত্মীয় অন্ধকার
যখন তখন ভেদ করতে আসে জোনাকির দল।
বনের কুয়াশা
অথবা পোড়া পাতার ছড়িয়ে পড়া ধোঁয়া,
যার মধ্যে দিয়ে
এক ফরেস্ট গার্ডের সঙ্গে তুমি মণ্ডলায় চলেছ
এক জনসভায় ভাষণ দিতে আসা
গান্ধীজিকে দেখবে বলে,
আরও অনেক বছর বাদে যেন সেই ছবি
তোমায় আটকে দেয়
দেশভাগের পর
তোমার অন্যান্য ভাই ও প্রথম পত্নীর মতো
ওই-পারে চলে যাওয়া থেকে।
তোমার কঠোর, ইমানদার পিতা
পাঁচ-ওয়ক্ত নামাজের মহিমা শেখান,
আর পাশের হনুমান মন্দিরে বসে শোনো তুমি মানসের পাঠ,
প্যারিসের চার্চে অবনত হও প্রার্থনায়:
কে জানত, হয়তো-বা তুমিও নয়,
একদিন রং আর আকার তোমার প্রার্থনার মৌন শব্দ হবে,
যেন জঙ্গলে পাখির কিচিরমিচির,
যখন— তখন গ্রামবাসিদের ভয়ার্ত করে তোলা নেকড়ের হুঁকার
আর আঁধার রাতে নদীতে বেড়ে ওঠা বন্যার জলের আওয়াজ,
এইসব মিলে যেন ছিল এক প্রার্থনা
যাতে তুমি রচে যেতে পারো
খুঁজতে পারো আর পেতে পারো,
আর যেখানেই থাক না কেন
অন্যের কাজে লাগবার বর লাভ করো।
এমন এক বর যা সবার অজ্ঞাত
কিন্তু যাতে সর্বক্ষণ বজায় থাকে
আত্মার উত্তাপের উষ্ণতা
আর তারই অ-নিভন্ত ভয়।
যখন তুমি দিব্য শক্তিদের আহ্বান করো
অদৃশ্য সেই বর ঝরে পড়ে,
যেভাবে বৃষ্টিশেষে রোজ সকাল-সকাল ঝরে পড়ে শিউলির ফুল
গাছের নীচে বৃত্তাকার স্থানটুকু
খানিকটা সাদা, একটু কমলা আর অল্পক্ষণের জন্য সুরভিত করে দিয়ে।
আমরা সেটুকুই ফিরে পাই যা আমরা কখনো দিয়েছি
হয়তো অনেক আগে,
ঠিক যেন মনে নেই কাকে।


পাথরের রং বড়ো ধীরে বদলায়—
মুখের রং যে কখন বদলে যায় প্রায়শই মনেই থাকে না
মাটির গভীরে তলিয়ে গিয়েও
অন্ধকার শিকড়ের নিজস্ব রং থাকে,
জলজ উদ্ভিদও
অতলে পৌঁছে গিয়ে ঝিলমিল করে ওঠে আপনার রঙে,
কোনো স্বর রাগের আলাপে তখনি সরব হয়
গায়ক যখন তাকে রাঙিয়ে তোলেন তাঁর ব্যক্তিগত দুখে।
বুড়োবয়সে কি ফিরে আসে ছেলেবেলায় ভুলে যাওয়া রং?
যৌবনের রং কি আবার ঝকমক করে ওঠে কোনো দুঃস্বপ্নের মাঝে?
প্রেমের,
একান্তের,
বাসনার আর উৎসাহের রং
জীবনের নিজস্ব রৌদ্র-ছায়া বিতানে কি কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকে?
আঁধারের ক্যানভাসে লেগে থাকা রং
মাটিতে পড়ে থাকা কোনো টিউবের রঙের সাথে
চুপিসাড়ে বিড়বিড় করে,
বুকে হেঁটে ইজেল পর্যন্ত পৌঁছে
ধোঁয়াটে হয়ে যায় একটা রং,
একটা রং তার নিজের জায়গায় অদৃশ্য তবু করাঘাত করে চলে,
একটা রং রেখার ধারে ধারে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বৃত্তে গিয়ে পৌঁছোয়,
একটা রং পাতার মতো কাঁপতে কাঁপতে এগোতে থাকে,
নিজের বিন্যাসের দরুন শব্দের মতো বিকল হয়ে পড়ে একটা রং,
একটা রং জ্বলে না উঠে নিভে যায় নিজের জায়গায়:
রঙের এই ধুন্ধুমারে
রঙের এই অরণ্যের মাঝে
রং-ক্ষুব্ধ, রং-শান্ত
তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ
এক রং-দগ্ধ মানুষ—
নির্মল, উজ্জ্বল, সজল
আর আমি নিজের শব্দের উজালায় দেখছি
পৃথিবী আপন রং একেবারে বদলে ফেলছে
যেন সে হয়ে উঠছে আকাশ, বাতাস,
আগুন কিংবা জল।


ইতিহাসের ভেতর
গোমড়ামুখে রাখা আছে
তোমার স্টুডিয়োয় পড়ে থাকা প্রাগৈতিহাসিক পাথর।
কাঠের নারীমূর্তি
তোমার দেওয়াল থেকে ঝুলতে ঝুলতে
শতবর্ষের ওপারে রোজ হাঁটুগেড়ে বসে
রং লাগাতে দেখে তোমায়
কিংবা শুনতে পায় অস্ফুট সুরে
রিলকের কবিতার আবৃত্তি।
নর্মদার অজস্র সময় বয়ে গিয়ে
যেন প্রতিদিন তোমার আঙুল স্পর্শ করে শান্ত হয়ে যায়:
যন্ত্রণা, করুণা আর বিপ্লবের তট ভেঙে
প্যারিসের উচ্ছ্বল ফ্রেঞ্চ সময়
কখনো রোদ্দুর, কখনো কুয়াশা— ধোঁয়াশা
আবার কখনো আঁধারের মতো
তোমার জানালা আচ্ছন্ন করে।
তুমি অবিচলিত কিন্তু উদ্বিগ্ন,
মৌন কিন্তু তীব্র,
বৃদ্ধ কিন্তু নমনীয়,
খুঁজে বেড়াও—
বীজ, অঙ্কুরোদ্গম, প্রস্ফুটন,
বৃক্ষ, পল্লব, ত্রিভুজ, বিন্দু, বিকিরণ।
তোমার চোখের আড়ালে, অজ্ঞাতে সময়
তোমারই সংগ্রহ থেকে তুলে নেয়
গণেশ আর শালিগ্রাম শিলা,
একটি আরতি, জৈন পাণ্ডুলিপির এক প্রাচীন পৃষ্ঠা,
কোরাণের আয়তের একটি পাতা,
আর এই সমস্তকিছু একটা পূর্ণ রচনার মতো পড়তে থাকে,
যার মধ্যে লুকিয়ে আছে তোমার সেই হয়ে ওঠার রহস্য,
সেই তুমি
যে নিজের আয়ু, নিজস্ব রং আর সময়ের ঊর্ধ্বে।


সময় শৈশব নয়:
ওখানে সাজানো যেতেই পারে খেলনা,
বীজ, নুড়ি-পাথর, সুতো, খোলামকুচি,
কিন্তু না সে জমিয়ে রাখতে পারে সেগুলোকে
আর না রাখতে পারে মনে।
সময় প্রাইমারি স্কুলের দেহাতী ইমারতের বারান্দা নয়:
যেখানে তোমার মাস্টারমশাই
দেওয়ালে একটা বিন্দু বানিয়েছিলেন,
আর তোমায় সবকিছু ভুলে গিয়ে
তার ওপর একাগ্র দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে বলেছিলেন।
তুমি সেই দূরের বিন্দুকেই বারবার স্পর্শ করো,
আর তোমার স্পর্শমাত্রই জন্ম নেয় সারা সংসার।
রাস্তার দিকে খোলে এমন জানালা নয় সময়:
তুমি মাঝে মাঝে সেটা খুলে
রোদ আসতে দাও
কিংবা ঠাহর করবার চেষ্টা কর বাইরে কেমন হাওয়া, কতটা ঠান্ডা,
কিন্তু তোমার রঙে বা আকারের মধ্যে
সেখান থেকে কিছুই আসে না।
সময় কোনো পাথরের বাড়ি নয়, গাছপালা— ঝোপঝাড়ে ঘেরা,
তার ওপরে রাখা ভারী পাথরের টেবিলে
তুমি কখনো বিছিয়ে দাও কাগজ
কখনো নিজের আকাঙ্ক্ষা,
কখনো-বা নিজের জীবনের সমস্ত জড়ো করা অবসাদ,
অথচ তুমি সেখানে থাকতে পারো না
কারণ তুমি তো থাক নিজের চিরস্থায়ী রঙে
তাদের দ্যুতিতে
তাদের পরতের মাঝে স্পন্দিত অধরে।
যে-সময়ের কাজ হল ফেরবদল
নিজের মর্জি মাফিক আকার ভাঙা গড়া,
সে আহ্বান করে গীত গায়,
হাঁফাতে থাকে, ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে,
তার কোনো প্রভাবে তুমি নেই,
যেন তোমার জন্য সময় অনাবশ্যক,
যে-কবিতার পঙ্‌ক্তি তোমার ছবিতে উঠে আসে
তার বিন্যাসে সময়ের স্থান নেই কোনো।
সময় সিতে–দি–কুয়ায় ষোড়শ শতকের ইমারতের
সিঁড়ি নয়
যে আশেপাশের বাজারে দোকান-হাট করতে যায়:
সময় তোমার ঘরের সামনের বারান্দায় বসে থাকা নৈঃশব্দ্য,
সময় তোমার ইজেলের নীচে চাপা পড়া কার্পেটের আবরণ,
সময় তোমার তুলিকা থেকে প্রক্ষীপ্ত
একটি সূক্ষ্ম কেশ,
সময় তোমার চোখে রহস্যের প্রতীক্ষা।
সময় চামড়ার কম্পন:
কোনো হইচই ছাড়াই যার বাইরে তুমি চলেছ,
অনেকবার রংলাগা হাত মুছবার কাপড় হল সময়,
দমোহের ফুটেরা তালাও-এর পাশে পড়ে থাকা
নন্দীর মূর্তি হল সময়
যে তোমার দিকে আজও অপলকে চেয়ে আছে,
যেন তুমি এক চিরন্তন বিন্দু।


জঙ্গলের এক পাকদণ্ডিতে
পাথর-পাতা রাস্তার ধারে
দূরে কোনো উঁচু বাড়ির জানালা থেকে
কবিতার কোনো আধভোলা লাইনে
আকারের ক্ষুব্ধ নির্জনে
শিশুদের মতো খিলখিলিয়ে হাসে রং
ধীরে ধীরে বদলে যায় অশ্রুতে, শিশিরে
কামনার উত্তপ্ত জলে:
সময়ের ওপর একটি রেখা টানা হয়
যেন জ্বলন্ত ঝকঝকে আগুন।
জগৎ-সংসার স্থগিত হয়,
নিজের রঙিন আভার দ্যুতিতে
আর সৌন্দর্যের কিনারে এসে
এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়।


রঙেরা কবে আর জানতে পারল
তাদের মধ্যেও প্রার্থনা রয়েছে,
জ্যামিতির কাছে তো আভাসও ছিল না
তার মাঝেই আছে প্রার্থনার বিন্যাস,
ছবিরা কি জানত যে তারাও প্রার্থনা-পুস্তকের একটি পৃষ্ঠা?
যদি তুমি নতজানু হয়ে নাও বসো,
বিনয়ে তোমার মাথা যদি অবনত নাও হয়ে পড়ে,
সবকিছু ভুলে গিয়ে তোমার হাতের আঙুল
যদি শুধু রঙেদের সঙ্গেই মেতে থাকে,
তবুও সব সময়
তুমি প্রার্থনাতেই রয়েছ,
কেন-না এই সমস্ত সংসার
তোমার কাছে এক অসমাপ্ত প্রার্থনা,
যেখানে তুমি ইতস্তত
কিছু নতুন শব্দ যোগ করেছ মাত্র।


আত্মার উত্তাপে
ছাই হয়েও বেঁচে থাকে ইচ্ছার দল
ছবিতে খরচ হয়ে যাওয়ার পরেও
শব্দেরা বেঁচে থাকে
প্রার্থনায় হারিয়ে গিয়েও
টিকে থাকে হৃদয়ের আহ্বান
যেটুকু অবশিষ্ট থাকে
কালের প্রতিঘাত সয়েও
সময়ের পারে যা বেঁচে থাকবে
আমরা তারই অভিষেক করি
সময়ের আঘাতে দীর্ণ হাতে
যা কিছু কালাতীত
আমরা তারই অভিষেক করি।
(২০০১)

সপ্ত রস

আপন ভাষায়
আমি ইমানদারির সঙ্গে বিশ্বাস করি যে মানবীয় অবস্থার প্রতি আমার গভীর আগ্রহ রয়েছে, কিন্তু যেভাবে আমি সেটাকে কাজে লাগাই তার পদ্ধতি অন্যরকম। আর আমার প্রতিদিনের জীবনে আমি সেই পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখেছি। কোনো সুসংবদ্ধ কায়দায় নয় বরং আর পাঁচজন মানুষের মধ্যে বসবাস করা এক ব্যক্তির মতোই। আমি এটাই বুঝেছি যে, মানবতার ভাবনা, মানবীয় সংবেদনা বিশাল বড়ো গুণ যা পূর্ণ শক্তি দিয়ে আমাদের আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। কিন্তু চিত্রকলা আমার কাছে অন্য অর্থ নিয়ে এসেছে। আর আমি এমন ছবি কখনোই আঁকতে চাইনি যা আমাদের বর্তমান জীবনকেই শুধু তুলে ধরে।…

(প্রয়াত শিল্পী সম্পর্কে সমস্ত তথ্য এবং ছবিগুলি রজা ফাউন্ডেশন, নয়া দিল্লীর সৌজন্যে প্রাপ্ত। প্রথমেই এই সংস্থার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি।)

Facebook Comments

পছন্দের বই