লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শুভদীপ নায়কের প্রবন্ধ

অস্তিত্ববাদ: মানবিক সত্তার একটি মৌলিক জ্ঞান

খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৯-এ সক্রেটিস প্রাচীন গ্রিসে জন্মে জ্ঞানের ধারণা পরিবর্তন করেন। সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘জ্ঞান হল সেই স্বচ্ছ বস্তু যার কোনো প্রতিষ্ঠা নেই, শুধু অন্বেষণ আছে। প্রতিষ্ঠা নেই বলে জ্ঞানের কোনো সীমাবদ্ধতা গড়ে ওঠেনি। জ্ঞান চিরকাল মুক্ত, বিরুদ্ধ এবং অশেষ।’ এথেন্সের পথে-ঘাটে, বাজারে, মানুষের বাড়িতে, গাছতলায় বসে, গুহায় বিশ্রাম নিতে নিতে সক্রেটিস তাঁর জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে মানুষের সঙ্গে আলোচনা করতেন। তিনি নিজে কিছু রচনা করেননি। কিন্তু তাঁর সকল আলোচনা লিখিত রেখে গিয়েছেন তাঁর একমাত্র শিষ্য প্লেটো। প্লেটোর রচনা থেকেই আমরা সক্রেটিস সম্পর্কে জানতে পারি। এথেন্সের পথে পথে তিনি জিজ্ঞাসা করে বেড়াতেন, ‘জ্ঞান কী? কতটুকু জানলে মানুষকে জ্ঞানী বলা চলে? বাইরের লোকে আমাকে কেন জ্ঞানী মনে করে? কেন আমি এত জেনেও না-জানার হতাশায় ভুগি?’— কিন্তু এথেন্সের কোনো ব্যক্তি সক্রেটিসের এইসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারত না। এই প্রশ্নগুলোর জবাব আজও লেখাপড়া জানা কোনো বিদ্বান ব্যক্তি দিতে পারে না। সারাদিন এথেন্সের পথে পথে ঘুরে নিজের প্রশ্নের সদুত্তর না পেয়ে সক্রেটিস যখন বাড়ি ফিরতেন, তখন তাঁর নিজেকে ভারি ক্লান্ত মনে হত। তিনি ভাবতেন, এথেন্সের মানুষ তাদের জীবনে মৃত হয়ে আছে। তারা সাড়া দেয় না, ভাবে না, জানার চেষ্টা করে না, আলোচনার তাগিদ অনুভব করে না। একদিন তাই হতাশার সঙ্গে সক্রেটিস বললেন, ‘আমি জানি যে আমি কিছু জানি না, কিন্তু ওরা যে কিছুই জানে না; সেটুকুও ওরা জানে না।’

সক্রেটিসের এই উক্তি থেকে বোঝা যায়, তাঁর জ্ঞানের প্রাচুর্য কতখানি গভীর! এথেন্সের রাজপথে সক্রেটিস জ্ঞানের আলোচনা করতেন। যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা ও ক্ষতিগ্রস্ত দিকগুলো বোঝাতেন। কেন শাসনের ক্ষেত্রে বিরুদ্ধতার প্রয়োজন আছে, সে-সব বোঝাতেন। সক্রেটিসের জ্ঞানের আলোতে তৎকালীন গ্রিসের তরুণরা আকর্ষিত হতে লাগল। তারা অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে আরম্ভ করল। সক্রেটিস শিখিয়েছিলেন, প্রচলিত ধ্যান ধারণা, বিশ্বাস, প্রণয়, রাষ্ট্র, নীতি কোনো কিছুকেই বিনা প্রশ্নে গ্রহণ না করতে। গ্রিসের সমাজ বিদ্রোহ করা শুরু করল। তারা প্রশ্ন করতে লাগল রাষ্ট্রীয় নীতিকে, অবজ্ঞা করতে লাগল রাজহিতৈষীদের। ফলে, গ্রিসের রাজা বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রীয় অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে সক্রেটিসকে গ্রেপ্তার করলেন। তাঁকে কারাবন্দি করার পর দেখা গেল, কারাগারে যেসব অপরাধীরা আগে থাকতে বন্দী ছিল, তারা সক্রেটিসের আলোচনা শুনতে লাগল। এবং, অনেক বন্দি অপরাধ জীবন থেকে সরে দাঁড়াতেও চাইল শুধুমাত্র সক্রেটিসের আলোচনা শুনেই। সেই কারাগারে প্রহরীরাও সক্রেটিসকে শ্রদ্ধা করতে লাগল। এক রাতের অন্ধকারে এক প্রহরী সক্রেটিসকে পালানোর সুযোগ করে দিলেও সক্রেটিস পালাতে রাজি হলেন না। পালিয়ে গেলে হয়তো তিনি প্রাণে বাঁচতেন। কিন্তু সেটা তিনি চাননি। তিনি চাইতেন এথেন্সে রাজার শাসন নয়, প্রতিষ্ঠিত হোক আইনের শাসন। তাই তিনি হেমলক বিষ পান করে মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু সত্যের পথ থেকে পালিয়ে যাননি।

সক্রেটিস মূলত ভাববাদী দর্শনের প্রণেতা ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই শিষ্য দার্শনিক প্লেটো ভাববাদ থেকে দর্শনকে নিয়ে গেলেন বস্তুবাদে। প্লেটো তাঁর প্রধান শিষ্য অ্যারিস্টটল ও কিছু ভাবুকদের নিয়ে আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে বস্তুবাদের ধারণা দেন। এই তত্ত্ব বলে, প্রতিটি মানুষ বা প্রতিটি জীব, এমনকী প্রতিটি জড়বস্তু পর্যন্ত যদি নিজেকে অর্থবহ করতে চায়, তা হলে তাকে সর্বাগ্রে জীবন থেকে কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হবে। সেই অর্জনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে তার অস্তিত্ব। অর্থাৎ, প্লেটোর মতে, মানুষের জীবনের অর্থ এই যে সে মানুষ। মানুষের ভিতরে থাকা মানবিক গুণাবলী মানুষের অস্তিত্বকে সার্থক করে। সকল মানুষের মাঝেই সেসব গুণাবলী রয়েছে। যারা এসব গুণাবলীর সদ্ব্যবহার করে, তাদের আমরা সৎ মানুষ বলি। এর বিপরীত দিকে রয়েছে অসৎ মানুষ। অর্থাৎ, বস্তুবাদে অস্তিত্বের যে ধারণা প্লেটো ও অ্যারিস্টটল দিয়েছিলেন তার ভিতরে কোথাও-না-কোথাও ঈশ্বরের বা অদৃশ্য নিয়ন্তার হাত রয়েছে। অর্থাৎ, মানুষের জন্ম হচ্ছে ঐশ্বরিকতার প্রভাবে, এবং জন্মের পরে মানুষ জীবন থেকে যে প্রতিষ্ঠা খুঁজে পাচ্ছে, তাই হল তাঁর অস্তিত্ব।

এই প্রচলিত ধারণায় ছেদ ঘটান দিনেমার দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কেগার্দ। তিনি তাঁর জ্ঞানতত্ত্বে অস্তিত্বকে ব্যাখ্যার করার জন্য সারাংশবাদ বা এসেনশিয়ালজমের ধারণা দেন। ‘জীবনের অর্থ কী?’— এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া আজকের আধুনিক যুগেও মুশকিল। এসেনশিয়ালিজম বলে, প্রতিটি জীব বা প্রতিটি বস্তুর মধ্যে রয়েছে তার জীবনের সত্তা বা নির্যাস যা তার অস্তিত্ব বহন করে। জীবন সম্পর্কে যারা ভাবে না, জীবনের প্রাপ্তিকে যারা ন্যায্য প্রাপ্র্যের সঙ্গে তুলনা করে দ্যাখে না, যারা বাস্তবিক সুখে সুখী, ফলত অন্য মানুষের যে একটা বাস্তবসম্পন্ন অসুখী সত্য দশা থাকতে পারে; সেটা যারা ভাবে না, দর্শনের ভাষায় বলা যেতে পারে সেইসব মানুষের কোনো ‘এসেন্স’ নেই। প্রকৃতপক্ষে যাঁরা জীবনের অর্থ অনুসন্ধান করে, তারা বিস্ময়কে খতিয়ে দেখতে চায়, তারা সমস্ত জীবন ধরে তারা এই গভীর জ্ঞানের অনুসন্ধান করতে করতে পৃথিবী ত্যাগ করেন। দর্শনের চেতনায় মূল বিষয় ভাববাদ ও বস্তুবাদ হলেও, দর্শনের দিক পরবর্তীকালে পরিবর্তিত হয়েছে নদীর বাঁকের মতো। প্রাচীন গ্রিস ও রোম দর্শনের জন্মস্থান হলেও পরবর্তীতে আমরা ফরাসি দর্শন, জার্মান দর্শন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দর্শনকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। সাহিত্য ও দর্শন যে পরস্পর সমান্তরালভাবে মানুষের জীবনে প্রচ্ছন্ন চিত্তে বয়ে চলেছে, তা আমরা মহাদেশীয় সাহিত্যপাঠের মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারি। জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নীৎশে তাঁর ‘নায়ালিজম’ বা ‘ধ্বংসবাদ’-এ জীবনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘বিপজ্জনকভাবে বেঁচে থাকা ছাড়া জীবনের আর দ্বিতীয় কোনও মানে নেই।’ অর্থাৎ, জীবনে সবকিছুর অন্তিম অর্জন হল অর্থহীনতা। নীৎশের ভাষায়, যাবতীয় উপার্জন ও উপলব্ধির শেষ দশা হল অর্থহীনতা। এমনটা নয় যে প্লেটো কেবলমাত্র বস্তুবাদকেই সারাজীবন বহন করেছেন, বরং প্লেটো তাঁর সমগ্র জীবন জুড়ে বস্তুবাদ ও ভাববাদের দ্বন্দ্বে জীবন কাটিয়েছেন। প্লেটো ও সক্রেটিসের পূর্বে যে সকল দার্শনিক ছিলেন তাঁরা বেশিরভাগই বস্তুবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। সক্রেটিস ও প্লেটোর চেষ্টায় প্রতিষ্ঠা পায় ভাববাদী দর্শন। প্লেটো বলেন, জ্ঞানের আসল প্রসার বস্তুর অস্তিত্বে নয়, বরং ভাবেই তার সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারণ। কিন্তু পরবর্তীকালে এই দ্বন্দ্বের সবচেয়ে বেশি গভীর প্রভাব আমরা লক্ষ করব জার্মান দার্শনিক হেগেলের মধ্যে।

হেগেল তাঁর প্রতিষ্ঠিত দর্শনের মধ্যে জীবন সম্পর্কে যে-বোধ পৃথিবীর বুকে রেখে গিয়েছেন তা কার্যত অমরত্ব লাভ করেছে। জার্মান দর্শনের দিক থেকে সবচেয়ে কঠিন ও চিরন্তন হল হেগেলের জ্ঞানতত্ত্ব। হেগেলকে পড়তে হলে আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে প্লেটোর রচিত ‘রিপাবলিক’ থেকে। ‘রিপাবলিক’ হল প্লেটোর চিন্তায় রাষ্ট্রকাঠামোর বর্ণনা। রিপবালিক গ্রন্থে প্লেটো লিখেছেন, রাষ্ট্রের সবচেয়ে উঁচু স্থানে শাসকের ভূমিকায় থাকবে দার্শনিকরা, যারা প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী। তার রক্ষক হবে সৈন্যবাহিনী। এরাই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সত্তার অধিকার ভোগকারী স্বাধীন নাগরিক। এরা বস্তুবাদের দিক থেকে স্বাধীন, কেন-না এরা হবে নির্দেশদাতা, এরা কারোর অধীনস্থ নয়। অপরদিকে, ভাববাদের দিক থেকে এরা হল দেশের সমগ্র জনতার প্রতিনিধি, বকলমে আদেশ পালনকারী। কেন-না, তাকে নির্বাচন করে দিচ্ছে দেশের জনতা। এই শ্রেণির ঠিক নিচেই থাকবে শ্রমজীবী বা কারিগর ও উৎপাদকেরা। তারা নিজেদের জন্য ও শাসনকর্তার জন্য উৎপাদন করবে। অর্থাৎ, প্লেটো তাঁর রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অভিজাততন্ত্রকে সমর্থন করেছেন।

প্লেটোর এই রাষ্ট্রনীতি হেগেলের দর্শনে এসে ভেঙে যায়। হেগেলের দর্শনের মূল সারাংশ হল দ্বন্দ্ববাদ ও অমীমংসিত সত্য। হেগেল মনে করেন, সিদ্ধান্ত বলে জীবনে চিরস্থায়ী কিছুই হয় না। অমীমাংসাই হল অন্তিম মীমাংসা, দ্বন্দ্বই হল জীবনের সত্য অনুসন্ধানের ও রহস্য উৎঘাটনের একমাত্র পথ। হেগেলের দর্শন থেকেই পরবর্তীকালে জন্ম নেয় মার্কসের ভাবনা, অর্থাৎ মার্কসবাদ। প্লেটো যেমন রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অভিজাততন্ত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, হেগেল তেমনটা সম্পূর্ণভাবে দেননি। হেগেল দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রের মানুষ যতক্ষণ আত্মবোধে প্রজ্ঞাবান না হচ্ছে, ততক্ষণ তাদের শাসনভার অভিজাততন্ত্রের কাছেই থাকা উচিত। কিন্তু অধিকারের লড়াই শুরু হলে ও জনতা রাষ্ট্রীয় নির্মাণে অংশগ্রহণ করলে রাষ্ট্রের মালিক হবে সাধারণ মানুষ। অভিজাততন্ত্রকে তখন সরে দাঁড়াতে হবে। হেগেলের প্রথম ধারণা থেকে সৃষ্টি হয় ফ্যাসিবাদী দর্শন, যা আত্মমগ্ন চিন্তাকেই রাষ্ট্রকাঠামোর পরিপন্থী বলে মনে করে এবং সাধারণ মানুষের মূল্যবোধকে রাষ্ট্রীয় নির্মাণের কাজে লাগাতে দ্বিধাবোধ করেন। ফলে, শাসক যাকে জাতীয়তাবাদ বা রাষ্ট্রনির্মাণের জন্য উপযুক্ত ভাবনা বলে প্রস্তাব করে, জনতা তাকেই স্বৈরাচার বলে দাবি করে। হেগেলের দ্বিতীয় ধারণা হল, সর্বসাধারণের দ্বারা তৈরি রাষ্ট্রভাবনা। হেগেল বলেন, কোনো মানুষই কোনো মানুষের চেয়ে বড়ো নয়। অপরদিকে সব মানুষই সব মানুষের চেয়ে পৃথক। তাই একটি সম্মিলিত রাষ্ট্রে শ্রম দ্বারা উৎপাদিত সম্পত্তির মালিক হবে শ্রমিক বা সর্বসাধারণরাই। কার্ল মার্কস হেগেলের এই ধারণাকেই হাতিয়ার করেছিল মার্কসবাদের সূচনায়। হেগেলপন্থীরা দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। একদল স্বৈরতন্ত্র-সহ নিষ্ঠুর জাতীয়তাবাদ পন্থী, অন্যদল ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রপন্থী। প্রথম শ্রেণিটি হল অভিজাতপন্থী বা এলিটিস্ট এবং দ্বিতীয় শ্রেণিটি হল সমাজতান্ত্রিক বা সোশ্যালিস্ট। হেগেল বলেছেন, এই দুটি শ্রেণি ছাড়া পৃথিবীতে ক্ষমতাবলয় তৈরি হবে না। হেগেলের জ্ঞানতত্ত্বে সত্যের অবস্থান তুলনামূলক, দ্বান্দ্বিক। হেগেলের জীবনবোধও রাইজোম্যাটিক। অর্থাৎ, হেগেল বলেছেন, জীবনকে কোনো নির্দিষ্ট মানচিত্রে ও রূপরেখায় আনা যাবে না। আমরা জানি যে, মাটির নীচে আদা যেভাবে ছড়ায় তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় ‘রাইজোম’ বলা হয়। একটি আদার গঠনের সঙ্গে অন্য আদার গঠন অনন্তকালেও কখনো মিলবে না। জীবনও ঠিক তাই। এই কারণে বলা চলে, সমাজতন্ত্রে একদিন হয়তো মার্ক্সবাদের মৃত্যু ঘটবে, কিন্তু হেগেলের কোনো মৃত্যু নেই। হেগেলের চিন্তা অবিনশ্বর।

পরবর্তীকালে সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবন সম্পর্কে ধারণা বদলায়। দর্শনের পথে প্রবেশ করে অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রবোধ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ। দর্শনের লিঙ্গুইস্টিক তত্ত্বগত পরিবর্তন হয়। আমরা দেখেছি, মার্কসের মৃত্যুর পরে কমিউনিজমের ধারণায় মার্ক্সবাদেরও বিক্ষেপ ঘটেছে। মার্কসবাদকে সমাজবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস প্রায় মার্কসবাদের finer, subtler, diction-কে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অপরপক্ষে, সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের দর্শন থেকেই সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রকাঠামো ও আইনের ধারণা এসেছে। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘ন্যায়ের দাবি হচ্ছে, শাসিত হওয়ার পরিমাণের চেয়ে অধিকতর শাসক কেউ হবে।’ পরবর্তীকালে হেগেল অ্যারিস্টটলের এই ধারণাকে সমর্থন করে বলেন, ‘আইনের উর্ধ্বে কোনো নাগরিক থাকতে পারে না। যিনি আইনমাফিক সকলকে শাস্তি দিচ্ছে, তার অপরাধটাও ওই আইনের মাধ্যমেও শাস্তিমূলক বিধি হিসাবে গণ্য হবে।’ আরও পরে আমরা জানি যে, দেরিদা, দেলুজ, ভিটগেনস্টাইন, সার্ত্র, আডর্নো, জিজেক প্রত্যেকেই উত্তর-আধুনিক পরিকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সার্ত্র তাঁর শূন্যবাদের ধারণায় হেগেলকে সমর্থন করে বলেন, ‘মানুষের যাবতীয় সত্তা একদিন শূন্যবাদে ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ কিন্তু দর্শনের এই বহুযুগীয় পথে চিরাচরিত ধারণাকে ঘিরে প্রশ্ন তোলেন ফরাসি দার্শনিক জঁ পল সার্ত্র। তিনি বলেন, মানুষের অস্তিত্ব হল তার জীবনকে অনুসন্ধান করার অগ্রবর্তী একটি দশা। অর্থাৎ, অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার পরেই মানুষ বুঝতে পারে সে আসলে কোন জীবনকে বেছে নেবে। অর্থাৎ, সার্ত্রর ধারণায় অস্তিত্ববাদ কখনো স্বীকার করে না ঈশ্বরের উপস্থিতি। হয়তো, এতদূর এসে মনে হতেই পারে অস্তিত্ববাদ আসলে নিরীশ্বরবাদী দর্শন, কিন্তু আদতে তা নয়। অস্তিত্ববাদ মানুষের জীবনকে তার নিজের হাতে ছেড়ে দেওয়াতেই বিশ্বাসী। অস্তিত্ববাদের ধারণায়, মানুষ যদি জীবনের ঘটমান ভাব ও বৈচিত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে নিজের অভ্যন্তরীণ জগতে নিজেকে খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টা করে, তা হলেই তার অস্তিত্বের সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। বাইরে থেকে একজন মানুষের যা কিছু অর্জন, তা আসলে তার জ্ঞানের সম্প্রসারণে কাজে লাগে না, বরং তাতে ঔদ্ধত্য বৃদ্ধি পায়। এ জন্য প্রশংসা, ব্যাক্তিত্ব, বাহ্যিক সুখ, সম্মান, পুরস্কার, অভ্যর্থনা, এগুলোকে অস্তিত্ববাদ বর্দাস্ত করে না। কারণ, এগুলো মানুষের অনিবার্য সত্যকে চাপা দিয়ে রাখে। এসবের চেয়ে বিবেক, বুদ্ধি, আত্মমর্যাদা, স্বাধীনসত্তা ও বৈরাগ্যকে বেশি মূল্য দেয় অস্তিত্ববাদ। অস্তিত্ববাদের ধারণায় দার্শনিক জঁ পল সার্ত্র দেকার্তের দ্বৈতবাদকে সমর্থন করেন। হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ হল দুটি সত্তার সংঘর্ষজনক সত্য। কিন্তু পরস্পরবিরোধী হলেও দেকার্তের দর্শন হল দুটি সত্তার সম্মিলিত সংগঠন। দেকার্তের ধারণায়, মানুষের দেহ হল মনের সংগঠন এবং মন হচ্ছে বস্তুহীন সত্তা। এই দুই বিরোধী সত্তা পাইনিয়াল গ্ল্যান্ড নামক একটি তন্ত্রীর মাধ্যমে মিলিত হয়ে প্রকৃতিকে জয় করে।

দেকার্তের এই দ্বৈতবাদকে অস্তিত্ববাদে দেখাতে গিয়ে সার্ত্র ‘অথেনটিসিটি’ বা ‘প্রামাণিকতা’-র ধারণা আনেন। তিনি বলেন, ‘সকল ঘটনার পেছনে দুটি বাস্তবতা আছে। একটি হচ্ছে সত্তা এবং অন্যটি চেতনা। একদিকে থাকে আমাদের চেতনা তৈরি করার বস্তুগত সত্তা, অন্যদিকে থাকে সেই সত্তা হতে সৃষ্ট চেতনা বা জ্ঞান। সার্ত্র এক্ষেত্রে দুটি নাম ব্যবহার করেছেন। ‘দ্য বিং ইন ইটসেলফ’ যা হচ্ছে সত্তা নিজে এবং ‘দ্য বিং ফর ইটসেলফ’ যা হচ্ছে সত্তার জন্য সৃষ্ট চেতনা। অর্থাৎ, মোটা দাগে দুটি বিষয় পৃথিবীতে বিরাজমান। একটি হচ্ছে ‘থিং’ বা সত্তা/জীব/পদার্থ/বস্তু এবং অপরটি হচ্ছে ‘নো-থিং’ (Nothing= No thing) বা চেতনা, যা কোনো বস্তু নয়।’ ফ্রাঞ্চ ফানোর ‘দ্য রেচড অব দ্য আর্থ’ বইয়ের ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘একজন ইউরোপীয়কে গুলি করা মানে এক ঢিলে দুই পাখি মারা! এতে একজন অত্যাচারী এবং একজন অত্যাচারিত ব্যক্তি ধ্বংস হয়, আর অবশিষ্ট থাকে একটি মৃতদেহ এবং একজন স্বাধীন মানুষ!’

সুতরাং, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, উত্তর-আধুনিক দর্শনের সময়েও আধুনিক দর্শনের অস্তিত্ববাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে মানুষের জীবনে। মানুষ, যা একটি রাষ্ট্রের একক বা মৌলিক সত্তা, রাষ্ট্র— যা একাধিক মানুষ দ্বারা সৃষ্ট একটি যৌগিক সত্তা, উভয়েই অস্তিত্ববাদকে নিজের স্বাভাবিক সত্তার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি, হয়তো কখনো পারবেও না।

Facebook Comments

পছন্দের বই