লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ধারাবাহিক।পর্ব১

সোমা মুখোপাধ্যায়

গয়নাবড়ি শিল্পী পুতুল অধিকারী

পুতুল অধিকারী

আমরা বলি মাছে ভাতে বাঙালি। কিন্তু এই মাছের ঝোল-সহ নানা রান্নাকে সুস্বাদু করতে ব্যবহার করা হয় নানা কিছু। তার অন্যতম হল বড়ি। কলাই, মুসুর, মুগ, মটর নানা ডালের বড়ি। একসময় মা ঠাকুমারা ভালো করে বেটে হাতে করে দিতেন। ব্যাবসার জন্য এখন যন্ত্রের আমদানি। তবু বড়ির রমরমা সব সংসারেই।

বাঙালির প্রিয় হল ভাত ডাল দিয়ে বড়িভাজা খাওয়া। আর এই ভাজা বড়ির এক বিশেষ রূপ গয়না বড়ি বা নকশা বড়ি। পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, তমলুক এইসব অঞ্চলের মা বউদের তৈরি। এই বড়ি শুধুমাত্র ভাজা হয়। আর এর তৈরির পদ্ধতিও আলাদা।

 

গয়নাবড়ি

বেশ কয়েকবছর ধরে নানা সরকারি মেলায় পূর্ব মেদিনীপুরের স্টলে দেখতাম একজন মহিলা সুন্দর গয়নাবড়ি বিক্রি করতেন। ওঁর নাম পুতুল অধিকারী। গয়নাবড়ি কেনার সূত্র ধরেই আলাপ আর তারপরে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। ফলে তিনি হয়ে যান পুতুলদি। মহিষাদল ব্লকের ঘাগড়া গ্রামের সাদামাটা গৃহস্থ বধূ পুতুলদি শুধু একজন বড়ি শিল্পীই নন, তিনি একজন উদ্যোগপতি। বহু মেয়েদের নিয়ে তৈরি করেছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। দেখিয়েছেন তাঁদের রোজগারের রাস্তা। মা ঠাকুমার অন্দরের এক রত্নকেই তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সবার মাঝে। এভাবেই সবলা মেলা, সরস মেলা হয়ে পুতুল অধিকারী দিল্লির প্রগতি ময়দানেও তাঁর গয়নাবড়ির সম্ভার নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।

গয়নাবড়ি তৈরির একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে। এই বড়ির জন্য লাগে বিড়ি কলাই। আষাঢ় শ্রাবণে এই গাছ বুনে আশ্বিন মাসের দিকে উপড়ানো হয়। এই তিন মাসে গাছ হয়ে কলাই পেকে যায়। এরপরে এগুলো রোদে শুকিয়ে নিয়ে একটা ভারী কিছু দিয়ে কলাইগুলোকে মাড়িয়ে নেওয়া হয়। অর্থাৎ, কলাইগুলোকে বের করে নেওয়া হয়। এরপরে ওগুলো জাঁতায় পেষা হলে ওগুলো ভেঙে দু-খোলা হয়। এরপর সকালে ভিজিয়ে দিয়ে বিকেলে একটা একটা করে খোলা বেছে বাটা হয়। ব্যাবসার বড়ির ডাল মিক্সিতে বাটা হয়। ঘরের বড়ির জন্য শিলে বাটা হয়। এই ডাল বাটা ঠান্ডা জায়গায় অনেকক্ষণ রেখে দিতে হয়। কারণ, মজে গেলে তবেই ফেটালে তা একেবারে নরম তুলতুলে হয়।

গয়নাবড়ি

আমাদের মেয়েদের নিজস্ব লোকপ্রযুক্তি এই রান্না আর তার উপকরণ বানানোতে ছড়িয়ে আছে। গয়নাবড়িতেও তার প্রভাব আছে। একসময় ডাল বেটে হাঁড়ির মধ্যে রেখে দেওয়া হত যাতে ভালোভাবে মজে যায়। এখন সবাই ফ্রিজে রাখে। আর ফেটানোর পরে অল্প একটু মিশ্রণ একটা জলভরতি জায়গায় দেওয়া হয়। যদি তা‌ ভেসে থাকে তবেই তা ঠিকমতো ফেটানো হয়েছে বলে ধরা হয়। আর যদি ডুবে যায় তাহলে আবার ফেটাতে হয়। এটা একটা প্রারব্ধ জ্ঞান।

ডাল ঠিকমতো ফেটানো হলে শুরু হয় গয়নাবড়ি দেবার বিশেষ পর্ব। খুব ভোর থেকে এই বড়ি দেওয়া শুরু সকাল অবধি তা চলে। এমনি বড়ির ক্ষেত্রে এই ডালবাটা থেকে নিয়ে আঙুলের সাহায্যে বড়ি দেওয়া হয়। কিন্তু গয়নাবড়ির নিয়ম একেবারেই আলাদা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস হল টিনের চোঙ। একটা পলিথিন বা কাপড়ে ছোটো ফুটো করে এই চোঙটা ঢোকাতে হবে। এরপর ঐ ডালবাটা পলিথিন বা কাপড়ে নিয়ে চোঙের মাধ্যমে নকশা ফুটিয়ে তুলতে হবে পোস্ত ছড়ানো বড়ি দেবার পাত্রে। পোস্ত দেওয়ার ফলে বড়ি শুকিয়ে গেলে তুলতে অসুবিধা হবে না। যাঁরা বড়ি দেন তাঁরা মন থেকে নকশা করে চলেন। এই কারণেই তাঁরা শিল্পী। এই নকশা যত সূক্ষ্ম হবে গয়নাবড়ি তত দেখতে এবং খেতেও ভালো হবে। সাধারণত এক কেজি ডালে ৮০-৮৫টা বড়ি হয়। ব্যাবসার বড়ির ক্ষেত্রে ১০০-১২৫টা মতো করা হয়। ইদানীং অনেকেই গয়নাবড়িতে চালবাটা মিশিয়ে যেন‌ তেন প্রকারেণ একটা কিছু তৈরি করে বাজারে বিক্রির জন্য। এই বড়ি দৃষ্টিনন্দন তো নয় উপরন্তু মোটা এবং স্বাদেও ভালো হয় না।

ডাল ফেটানোর ওপর গয়নাবড়ি কতটা হালকা হবে তা নির্ভর করে। আবার হালকা হলেই সুন্দর নকশা হয়। আঞ্চলিক ছড়াতেও এই বিষয়টা ফুটে ওঠে—

‘চায়ের সাথে পলকা বড়ি
আতিথেয়তার নেইকো জুড়ি’

‘গয়না বড়ি এতোই হালকা
তেল জোগাতে পকেট ফাঁকা’

আবার গয়নাবড়ি উপহারের সামগ্ৰি তাও এইসব ছড়ায় তার প্রতিফলন দেখা যায়—

‘মেয়ে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি
সাথী হল গয়নাবড়ি’

গয়নাবড়ির আদর্শ সময় শীতকাল। শীতের মিঠে রোদে মেয়েরা দলবেঁধে এই বড়ি দেন। সাধারণত কার্তিক মাসের পেড়ো ষষ্ঠী থেকে শুরু করে ফাল্গুনের শিবরাত্রি অবধি এর সময়কাল। আসলে এর পরে গরম পড়ে যায়। আর বর্ষায় তো বড়ি হবেই না। ভারি সুন্দর লাগে আমাদের এই মরসুম বা ঋতু বৈচিত্রের সঙ্গে খাবার তৈরির সম্পর্ক। এটাই হয়তো প্রাচ্যের বিজ্ঞান ভাবনা। যা মায়েরা লোকাচার নামে অভিহিত করেন।

একসময় অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে দিয়ে পুতুল অধিকারী তাঁর ব্যাবসা শুরু করেন। বাবা ছিলেন কাঠের ব্যাবসায়ী। বিবাহ সূত্রে তিনি ঘাগড়া গ্ৰামের বাসিন্দা হন। সংসারের অভাব অনটনে তিনি মানুষের এই নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং এক পরম্পরার শিল্পকে নিয়ে আসেন রোজগারের মাধ্যমরূপে। শুরুতে আশেপাশের বাজার আর অফিস কাছারিতে গিয়ে গিয়ে বড়ি বিক্রি করতে থাকেন। ২০০৪ সালে তৈরি করেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। শুরু হয় সরকারি মেলায় যোগদান। না, আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। এই সূত্র ধরেই নানা জায়গার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ব্যাবসাও বাড়তে থাকে। দুই সন্তান আর নাতি-নাতনির ভরা সংসারের সঙ্গে সঙ্গে আর পাঁচজন মেয়েদের সংসারের হাল ধরবার দিশা দেখিয়েছেন তিনি। শিল্পী থেকে হয়েছেন‌ উদ্যোগপতি। গয়নাবড়ির পাশাপাশি তিনি মশলাবড়ি, সাদা ডালের বড়ি, চালকুমড়ো বাটার বড়ি এইসব তৈরি করেন। তবে তাঁর পরিচিতি গয়নাবড়ির কারণেই।

‘সবলা’ মেলায় পুতুল অধিকারী (বাঁ-দিকে)

পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকে এই গয়নাবড়ি প্রথম দেখি প্রায় কুড়ি বছর আগে। আমাদের অফিসের কাজে গিয়ে ফেরার পথে একজন সহকর্মী উপহার দিয়েছিলেন। একটি বাড়ির লাগোয়া দোকানে ছিল। ঐ বাড়ির মেয়েরাই করতেন। একটা ছোটো সস্তা পিচবোর্ডের বাক্সে অপটু হাতে সেলোফেন কাগজে মুড়ে আঠা লাগানো। আসলে এটা এত পলকা যে সহজে নষ্ট হয়ে যায়। যাইহোক তখন জেনেছিলাম এটি স্থানীয়ভাবেই বিক্রি হয়। বেশি করে রপ্তানির কথা ওঁরা ভাবছেন। সে-সময়ে আমাদের যিনি অফিসার ছিলেন তিনি বলেছিলেন মজা করেই যে, এই গয়নাবড়ি একেবারেই ক্ষণস্থায়ী শিল্প। সত্যি এর শৈল্পিক দিকটা এত সুন্দর যে, এটা খেতে ইচ্ছে করে না। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ এটিকে কলাভবনে সংরক্ষিত করে রাখতে চেয়েছিলেন। আর ‘নকশি বড়ি’ নামটা দিয়েছিলেন অবন ঠাকুর। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু এই গয়নাবড়িকে বঙ্গমাতার ভাঙা ঝাঁপির রত্ন বলেছেন।

১৯৩৪ সাল নাগাদ শান্তিনিকেতনে পড়তেন মেদিনীপুরের সেবা মাইতি। তাঁর মা হিরন্ময়ী দেবী ও ঠাকুরমা শরৎকুমারী দেবীর তাঁকে উপহার পাঠানো গয়নাবড়ি দেখে তাঁদের চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—

“শ্রীমতী শরৎকুমারী দেবী ও শ্রীমতী হিরন্ময়ী দেবী কল্যাণেয়ষু,
তোমাদের হাতে প্রস্তুত বড়ি পাইয়া বিশেষ আনন্দলাভ করিলাম। ইহার শিল্পনৈপুন্য বিস্ময়জনক। আমরা ইহার ছবি কলাভবনে রক্ষা করিতে সংকল্প করিয়াছি। তোমরা আমার আশীর্বাদ জানিবে।

শুভাকাঙ্খী শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ইতি ২১শে মাঘ/১৩৪১”

এই ঘটনাটি যেন একটা আঞ্চলিক ছড়াকেই মনে‌ করায়—

“উপহারে নকশা বড়ি
সাফল্য আনে পুরোপুরি।”

প্রয়াত লোকসংস্কৃতিবিদ নির্মলেন্দু ভৌমিক ব্রতের আলপনার মাঝে গয়নাবড়ির উৎস লক্ষ করেছেন। তাঁর মতে, “গয়না হল স্ত্রীলোকের অন্যতম কামনার বিষয়। তাই ব্রতের আলপনায় ব্যবহৃত সেই ভঙ্গিটি এবং সংলগ্নতার বিষয়টি গয়নাবড়ি তৈরির অনুপ্রেরণা হতে পারে।”

গয়নাবড়িকে আঞ্চলিক সীমানা পার করে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পুতুল অধিকারীকে অবশ্যই কুর্ণিশ জানাতেই হয়। এক বিশাল কর্মকাণ্ডের কাণ্ডারি তিনি। তাঁর দল ঘাগরা সন্তোষী স্ব স্বসহায়ক দলের একজন সাধারণ সদস্য তিনি। এছাড়া উনি একজন সংঘনেত্রী। এই সংঘের নাম ‘কিসমৎ নাইকুন্ডি নতুনভাবে জীবন বহুমুখী প্রাথমিক মহিলা সংঘ সমবায় লিমিটেড।’ এছাড়া নানা অ্যাকটিভিটি ক্লাস্টারের সঙ্গেও তিনি যুক্ত। এর মধ্যে আছে ব্লক স্তরে খুশি অ্যাক্টিভিটি ক্লাস্টার এবং বুথ স্তরে ঘাগড়া কৈলাসনাথ গয়নাবড়ি অ্যাক্টিভিটি ক্লাস্টার। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের বড়ি তৈরি করার প্রশিক্ষণ দেওয়া থেকে কীভাবে তার বিপণন সবটাই শেখান পুতুল অধিকারী। এই কাজে তাঁর বউমা সুস্মিতা অধিকারীও তাঁকে সহায়তা করেন। এছাড়াও পাটজাত নানা সামগ্রী তিনি তৈরি করেন। নারী ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল নিদর্শন শিল্পী পুতুল অধিকারী।

সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা:
১. সন্তোষ কুমার কুন্ডু, বাংলার পেশাভিত্তিক লোকায়ত কুটিরশিল্প, লালমাটি, কলকাতা, ২০১৯।
২. কমলকুমার কুন্ডু, গয়নাবড়ি: এক অনুপম শিল্প নিদর্শন, লোকশ্রুতি, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৪।
৩. বিশেষ কৃতজ্ঞতা শ্রীমতী রঞ্জনা মন্ডল, গবেষক।

Facebook Comments

পছন্দের বই