লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রবন্ধ

বিপ্লব বিশ্বাস

অপ্রমিত ঈশ্বরের বহুচিত্রল নির্মাণ ও দেবর্ষি সারগীর দশটি গল্প

শব্দকার অসীম রায় তাঁর জবানিতে বলেছিলেন, “ক্রিয়েটিভ লেখা মানেই আত্মোপলব্ধি; আত্মোপলব্ধি ছাড়া সাহিত্য নিরর্থক।… গল্পের ভাষা হবে নিরাভরণ, কম কাব্যগন্ধী। অনেক সময় ভাষার পরীক্ষা-নিরীক্ষার খেলায় সত্য তলিয়ে যায়, ম্যানারিজম-এর কুহকে চরিত্রের অবয়ব অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। সত্যকে ধরার প্রাণপণ চেষ্টাই তো লেখকের আত্মবিকাশের একমাত্র পথ।… সাহিত্যিকদের বেশির ভাগই বাণিজ্যের আক্রমণে মৃত।… শিল্পীর খ্যাতি মানে বইয়ের কাটতি। এক দিকে লেখকেরা খ্যাতি অর্জন করে চলেছেন, অন্য দিকে লোকে তাঁদের ভুলতে শুরু করেছে।… এভাবে লেখক খ্যাতি কুড়োলেন, কিন্তু শিল্পীর সম্ভ্রম অর্জন করতে পারলেন না।… লেখকের সৃষ্টি মানেই তাঁর চৈতন্যের বিস্তার।… যে কোনো সার্থক সৃষ্টি মানে শিল্পী যা বলতে চেয়েছেন তার আধখানা প্রকাশ।”

আবার বর্তমান আলোচনীয় গল্পকার সম্পর্কে বন্ধুস্থানীয় লেখক বলছেন, সাধারণ পাঠকমহলে তিনি খুব একটা পরিচিতি লাভ করেননি। তাঁর রচিত গল্প-উপন্যাসের বাণিজ্যিক সফলতার ভাঁড়ার প্রায় শূন্যই বলা যায়। আবার বাংলা গল্পের গৌরবময় ঐতিহ্যে তাঁর ভূমিকা পিকাসো, পল ক্লী বা ভ্যান গখের মতোও, তা বলতেও কসুর করলেন না সেই আলোচক।

তাঁকে কেউ বলছেন বাংলা সাহিত্যের কাহলিল জিব্রান, কেউ বলছেন কলম্বাস। এতে তিনি কতটা সংকীর্তিত হলেন জানি না তবে আমরা অনেকেই যে আত্মপ্রসাদের চোঁয়া ঢেকুর তুললাম, তা নিশ্চিত। আসলে এই নিঃসার স্তোকোক্তির পরম্পরা আমাদের বিভল অর্জন। আমরা সেই কবেই বঙ্কিমচন্দ্রকে বাংলার স্কট, শরৎচন্দ্রকে চার্লস ডিকেন্স বানিয়ে বসে আছি। চলচ্চিত্র-জগতেও দেবানন্দকে গ্রেগরি পেক আর রাজ কাপুরকে চার্লি চ্যাপলিন বানাতে পিছপা হইনি। পশ্চিমের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি না করলে আমরা জাতে উঠি না। অথচ বাংলা সাহিত্যের অজস্র নোবেল-সম্ভাবনাময় সম্পদকে অনুবাদের মাধ্যমে পশ্চিমে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হইনি। উপেক্ষার আবিলতায় অবস্কর করে রেখেছি সে-সব। মান্যতা দিয়েছি আমাদের কাঁকড়া চারিত্র্যকে। ভূয়োদর্শী রবীন্দ্রনাথ তা বুঝেছিলেন; তাই তাঁর অর্জিত নোবেল নিয়েই আমরা লজ্জাহীন নর্তন করে যাচ্ছি আজও। সান্ত্বনাবাক্য একটাই, ইদানীং কিছু কিছু ইংরেজি তরজমা হচ্ছে বাংলা সাহিত্য সম্পদের। হয়তো দূর ভবিষ্যতে বিশ্বশ্রেষ্ঠ সম্মানের সুস্বাদ বাঙালি পেতেও পারে।

তাঁর গল্পভাবনার আবর্তন ঈশ্বরকে ঘিরে। আসলে তা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পৌত্তলিক বিগ্রহ নয়। এ ঈশ্বর তাঁর একান্তব্যক্তিক আবিষ্ক্রিয়া। তাঁর বলস্বী নির্মাণ কিংবা বিনির্মাণ। এ-ক্ষেত্রে তিনি এক নবমিথের উদ্ভাবক। কিছুটা প্রতিবাত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুও বটে। সুতরাং ঈশ্বর যখন তাঁর ভাবনামূলে তখন আস্তিকতা, নাস্তিকতা, সংশয়বাদের সরহদ্দে তাঁকে পড়তেই হয়। আস্তিকতা, নাস্তিকতা— দুটোই নেতিবাচক শব্দ। দুটোই দুই বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে। একটি ঈশ্বরের অস্তিত্বে, অপরটি অনস্তিত্বে। যিনি অনস্তিত্বে আস্থাবান তিনি আবার ঈশ্বরের পরিবর্তে প্রকৃতি বা ওই জাতীয় কোনো কিছুতে বিশ্বাস রাখেন। উপর্যুক্ত শব্দদ্বয়ের বিপ্রতীপ শব্দ, সংশয়। ধর্মগ্রন্থভুক্ত ঈশ্বরের প্রতি যাঁর বিশ্বাস নেই অথচ অন্য কোনো অমিত ক্ষমতাবান অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস আছে তাঁকে এ-দেশে কেউই হয়তো আস্তিক বলবেন না; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি তো আস্তিকই— ধর্ম মেনে চলা বা ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত মোটামুটি নিষ্ঠুর ও ভয়ংকর এক অলীক শক্তিতে বিশ্বাস করার বদলে কেউ যদি তাঁর নিজের মতো করে একজন ঈশ্বরের কল্পনা করতে পারেন, তাঁকেও তো আস্তিক বলাই যায়। লালন সাঁই যেমন বলেছেন, “যে মুর্শিদ (সাধারণ মানুষ) সেই তো রাসুল (মহামানব); ইহাতে নাই কোনো ভুল, খোদাও সে হয়।” এখানে লালন মুর্শিদ, রাসুল আর খোদাকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করেছেন কেন-না তাঁর মতে মানুষ ও খোদা একই রূপের দ্বিবিধ প্রকাশ। মানুষের মধ্যেই খোদা বিরাজমান। তাঁর আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। এই মতবাদ ইসলামের সমর্থন না পেলেও সুফিবাদের সঙ্গে এর মিল আছে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বা স্টিফেন হকিংয়েরও এমত ঈশ্বরবিশ্বাস এবং সেই ঈশ্বর কোনো ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ঈশ্বর নন। হকিং বলেছেন, “একজন ঈশ্বর যদি থেকেও থাকেন তাহলে তিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময়ই কিছু নিয়মকানুন বেঁধে দিয়েছেন যেখানে তিনি নতুন করে হস্তক্ষেপ করেন না, করেন না কোনো পরিবর্তন; সত্যি বলতে কি, সেই ক্ষমতাই তাঁর নেই— তাঁর কাজ শেষ হয়েছে, মিটে গেছে তাঁর ভূমিকাও।” এ-ও তো একজাতীয় ঈশ্বরভাবনা। এঁরা কি আস্তিক? আসলে এঁরা প্রত্যেকেই সংশয়ী। প্রচলিত ঈশ্বর-ধারণার প্রতি এঁদের সংশয় ছিল বলেই এঁরা নতুন এমন এক ঈশ্বরের প্রকল্প দর্শন করিয়েছেন যেটা তাঁদের দার্শনিক প্রতীতির সঙ্গে মেলে। এমন ঈশ্বরভাবনায় সুফিবাদ, ভারতীয় প্রেম-ভক্তিবাদ বা বৌদ্ধ সহজিয়াবাদের লক্ষণ স্পষ্ট। সুফিবাদ মতে আল্লাহ্ ও তাঁর সৃষ্ট জগতের মধ্যে মূলত কোনো পার্থক্য নেই কারণ আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টির মাঝ দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন মাত্র। এই যে সুফিবাদীরা নিজস্ব ঈশ্বর বা আল্লাহ্ সৃষ্টি করলেন তার কারণ নিজেকে সমর্পণের জন্য, স্বনিবেদনের জন্য এমন একজনের অস্তিত্ব থাকা প্রয়োজন– প্রেমময়, দয়াময়, ক্ষমাসুন্দর একজন যিনি স্বর্গের লোভ বা নরকের ভয় দেখাবেন না; অনুরাগীদের শাস্তি দেবেন না– যাঁর কাছে দাবি, অভিমান, রাগ ফলানো যায় এমনকী কোনো নির্দয়তার জন্য যাঁকে অভিযুক্তও করা যায়। তিনি ভয়ংকর নন, নন বীভৎস বা দ্বিষৎ। তিনি প্রেমময় ও সুন্দরের পূজারী– সমর্পণ আর নিবেদনই তাঁর কাছে সর্বাধিক গুরুত্ববহ। রবীন্দ্রনাথে এর যথেষ্ট প্রভাব আমরা লক্ষ করি।

আবারও খানিক আইনস্টাইনে ফিরি। তিনি তাঁর Special Theory of Relativity প্রণয়ন করেন ১৯০৫ সালে, মাত্র তেইশ বছর বয়সে। এই তত্ত্বের শুরুতেই তিনি দু-টি স্বতঃসিদ্ধ (Postulates) দেন। প্রথমটি আলোর বেগ-সংক্রান্ত যা পুরো উনিশ শতক জুড়ে চলতে থাকা বিতর্কের অবসান ঘটায়। দ্বিতীয়টিতে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মসমূহকে বিশ্বের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মুক্তি দিয়ে মহাবিশ্বের অসীম পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দেন। তাঁর তত্ত্বের মূল কথাটি হল, পরম বলে কিছু নেই। সবকিছুই আপেক্ষিক। কোনো কিছুকে বিচার করা যায় না কেবল অন্য কোনো কিছুর সাপেক্ষে। তাঁর এই গাণিতিক তত্ত্ব ঝামেলা পাকালো দর্শনভাবনায়। সেখানেও চলে এল আপেক্ষিকতার নীতি— সবকিছুই আপেক্ষিক এমনকী ঈশ্বরও; অর্থাৎ, ঈশ্বর কোনো পরম সত্তা নয়, নয় পরম সত্যও। তিনিও আপেক্ষিকভাবে সত্য। বিশ্বাসীদের কাছে তিনি সত্য, অবিশ্বাসীদের কাছে মিথ্যা। আসলে আইনস্টাইনের সমস্ত তত্ত্বই ছিল প্রচলিত ঈশ্বর-ধারণার বিরুদ্ধে। অথচ তিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে ঈশ্বরের কথা স্বয়ং তিনি বলবেন না, বলবে মানুষ। এমন সব অনিয়মী বক্তব্য কোন মগ্নতা থেকে? এঁরা মনে করেন তাঁদের সৃষ্টিকর্মের জন্ম কোনো অজানা উৎস থেকে, এ-সবের পেছনে যেন কারও হাত আছে। এ এক অনুপম সমর্পণের ভঙ্গিমা। বিশ্বাসীদের মতো অবিশ্বাসী এবং সংশয়বাদীরাও ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত হন, জীবনের কোনো না কোনো মুহূর্তে, কারো-না-কারো কাছে। হয়তো কোনো সুনির্দিষ্ট তথা মনুষ্য-সৃষ্ট মূর্তিমান ঈশ্বরের কাছে নয়, তবুও তিনি কোনো-না-কোনো অর্থে সমর্পিতজনের চেয়ে অনেক বড়ো, অনেক মহিমময়।

লালন, ওমর খৈয়াম, মির্জা গালিব, জালালউদ্দিন রূমী, আইনস্টাইন, হকিং, রবীন্দ্রনাথ— এঁরা সকলেই ছিলেন মূলত সংশয়বাদী। নিজেদের রেখেছিলেন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে। জীবনের যদি কোনো মহত্তম লক্ষ্য থাকে তবে সেই উপলব্ধি অর্জন করতে হলে সংশয়ী হতেই হবে। বর্তমান আলোচনীয় গল্পকারের নীতিভাবনা সম্পর্কেও এমন বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা যায়।

বর্তমান প্রবন্ধের সূচনামুখ হিসেবে যে-বয়ান রাখা হল এবং যে-বেপথু (ব্যাজস্তুতির ঢঙে) গল্পকার সম্পর্কে এই সংযুত উপস্থাপন তিনি দেবর্ষি সারগী— গল্পজগতে এক অনাবিদ্ধ আবিষ্করণ। সরকারি নথিতে তিনি দেবকীনন্দন আগরওয়াল। আবার তিনিই যখন কলকাতাকেন্দ্রিক দৈনিকের কলা-সমালোচক তখন শুধুই দেবকী আগরওয়াল, ‘নন্দন’ বিহীন যে-নাম শুনে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ তথা প্রাবন্ধিক অশোক মিত্র মহাশয় যাকে মহিলা ভেবেছিলেন এবং এই তিনিই গল্প-উপন্যাসের বলস্বী জগতে পা রাখাকালে ছদ্মনাম হিসেবে ধারণ করলেন দেবর্ষি সারগী। আসলে ‘সারগী’ তাঁর গোত্রপদবি আর ‘দেবর্ষি’ একান্ত-পছন্দের নাম। তিনিই সম্ভবত একমাত্র রাজস্থানী যিনি বাংলা সাহিত্যের সান্দ্র চর্চা করে থাকেন। তা নিয়ে একাধিক বক্রোক্তির স্বাভাবিক শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। এবং এই একটিমাত্র সংকল্পনার জন্য তিনি ভারত সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের পক্ষ থেকে ২০০৫ সালে ভাষা ভারতী সম্মানে মানদ হন। উক্ত বছরেই তাঁকে দেওয়া হয় ‘দিবারাত্রির কাব্য’ পুরস্কার। এছাড়া ২০০৮ সালে তিনি লাভ করেন চন্দননগর ‘গল্পমেলা’ ও ২০১৫-তে পঃ বঃ সরকারের সোমেন চন্দ পুরস্কারদ্বয়। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘আরশোলা’ বেরিয়েছিল ১৯৮৪ সালে ‘আজকাল’ পত্রিকায়। তারপর থেকে অবিরাম অগ্রগমন। এ-পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত, অপ্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ৩১; গল্পসংখ্যা কমবেশি ২৬০। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘রাজার জ্ঞানতৃষ্ণা’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬-তে, সুবর্ণরেখা থেকে। মর্যাদাপূর্ণ প্রতিক্ষণ প্রকাশনা থেকে গল্পসংকলন বের হয় ১৯৯৮ সালে। তারপর প্যাপিরাস থেকে ২০০৫ সালে ‘গল্পকুঞ্জ’। ওই বছরই করুণা প্রকাশনী থেকে বের হয় ‘নির্বাচিত গল্প’। আর পরশপাথর থেকে ২০০৮-এ বের হয় ‘দশটি গল্প’। এখানে গল্পালোচনা থাকছে বলেই উপন্যাসের তত্ত্বতালাশ দিলাম না। ইদানীং তিনি আর নতুন করে গল্প, উপন্যাস লিখতে আগ্রহী নন। কারণ হয়তো কোনো অনুচ্চার্য নির্বিণ্ণ স্বাভিমান। স্বাবমাননা কি!? তিনি বলেন, এই রাজ্যের জেলাভিত্তিক দু-তিনজন পাঠক আছেন তাঁর। তাঁর আগ্রহী প্রকাশকদেরও এই কথাই অকপটে বলেন তিনি।

এবারে গল্পরচনা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাবনার কিছু ইশারা দিই। ‘গল্পকুঞ্জ’ বইয়ের ‘আমার কথা’ অংশে তিনি বলেছেন, “মানুষের জীবনভাবনার অভ্যাস তাকে সভ্য করেছে, মৃত্যুভাবনা করেছে দার্শনিক। মানুষ এমন জীব যে শুধু চিন্তা করেই বহু বছর বেঁচে থাকতে পারে, গ্রিক দার্শনিক পারমিনিডিসের মতো। জীবনের যে কোনো সংকটের মতো আমি দার্শনিক সংকট নিয়ে কিছু গল্প লিখেছি। বেশ কিছু গল্পে এসেছে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ। আমি মনে করি সবকিছুর মাঝ দিয়ে মানুষ এমন কিছু খুঁজে চলেছে যা শাশ্বত ও অবিনশ্বর— যা সবকিছুর উৎপত্তির কারণ অথচ যার ধ্বংস নেই; এ রকম হয় কিছু আছে যা কাল্পনিক ও দুর্বোধ্য এবং যার নাম দেওয়া যায় ঈশ্বর। কোনো ধর্ম না থাকলেও মানুষের চলবে কিন্তু ঈশ্বরকে সম্ভবত তার দরকার। চিত্রকল্প সৃজনের মাঝ দিয়েই আমি গল্প বলতে ভালোবাসি।… অনাবশ্যক শব্দ আমাকে ক্লান্ত করে। অনাবশ্যক বর্ণনা ও সংলাপও। সাহিত্যে শব্দের জঞ্জালের মতো ভয়ংকর আর কিছু হতে পারে না (তুলনীয়— A big book is a misfortune – Callimacus)। শব্দই সাহিত্যের প্রাণ, শব্দই আবার তার মৃত্যুর কারণও হয়ে উঠতে পারে। আমার অনেক গল্পই তাই খুব সংক্ষিপ্ত।… একমাত্র মানুষই গোটা জগতে বাস করার ক্ষমতা রাখে। সশরীরে না হলেও কল্পনায়। এটা যেমন একজাতীয় সত্য, তেমনই সত্য পৃথিবীর যেখানে যা-ই থাকুক না কেন, সবই একরকম। তাই আমার অনেক গল্পেই লোকালয় বা চরিত্রের নাম নেই— যা ঘটছে যেন গোটা জগতের পটভূমিতেই ঘটছে— এভাবেই খানিক মহাকাব্যিক আভাস দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করি।

সমস্ত শিল্পমাধ্যমে একমাত্র সাহিত্যই সবচেয়ে বেশি কল্পনা দাবি করে। নির্জন, নিঃসঙ্গ, নিঃশব্দ কল্পনা। সাহিত্য হইচইয়ের জিনিসই নয়। সাহিত্যের মানুষজন যেন একটু অন্য প্রজাতি” (এই কারণেই তিনি গল্প-কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করেন না)।

পঃ বঃ বাংলা আকাদেমির মুখপাত্র ‘বাংলা বই’-তে ২০১৬ সালে যে-বক্তব্য তিনি রাখলেন তা তাঁর আখ্যানের অভিযান বিষয়ক যেখানে তিনি বলছেন, অ্যারাবিয়ান নাইটসের গল্প, কথাসরিৎসাগরের গল্প, ইশপের গল্প বা রূপকথার গল্পগাথা সবই অত্যন্ত প্রাচীন, মানুষের আদিম প্রবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। নিছক ঘটনা শুধু আখ্যান নয়; সেই ঘটনা যখন সাহিত্য হয়ে ওঠে, শিল্প হয়ে ওঠে তখনই আমরা তাকে আখ্যান বলি। আমরা চারপাশে প্রচুর ঘটনা দেখি। সেগুলো কিন্তু আকস্মিক। তা আখ্যান হয়ে উঠবে তখনই যখন তার মধ্যে সাহিত্য তৈরি হবে, শিল্প গড়ে উঠবে। এরপর তিনি খোলামেলা বলেছেন, “আমার আখ্যানের জন্য কোনো দেশভ্রমণ করিনি, কখনো আখ্যান থেকে, চারপাশের সমাজ থেকে যে আখ্যান পেয়েছি তাও নয়। একটা চরিত্র নির্মাণ করেছি, খুবই অসুস্থ হয়ে থাকে, ক্রমাগত তাকে সারাতে চেষ্টা করে চলেছি। সেই আমাকে খুঁজে খুঁজে এনে দেয়, সেই চরিত্র কেন্দ্রীয় চরিত্র বলুন, নায়ক বলুন। সে আমাকে সবকিছু এনে দেয়। সেই আমার প্রোটাগনিস্ট; সে আমাকে গল্প দেয় আর তাকে আমি আমার সত্তা, কল্পনা সবকিছু দিই।”

ইদানীংকালে গল্পের ক্ষেত্রে ফ্যানটাসির রমরমা চলছে। এক শ্রেণির লেখক-পাঠকের কাছে এই প্রকরণ প্রিয় হয়ে উঠেছে। এই প্রিয়তার কারণ, তথাকথিত বাস্তববাদ আর আমাদের অভিজ্ঞতার শিল্পায়নে পর্যাপ্ত বোধ সরবরাহ করতে পারছে না। যখন প্রাত্যহিক জীবনের নানা বোধ পুনরাবৃত্তিতে ক্লান্তিকর হয়ে উঠছে তখন ফ্যানটাসি বা জাদুবাস্তবতা পাঠকের সামনে অজস্র দ্বার উন্মোচিত করছে। জীবনের অর্থহীনতা জন্ম দিচ্ছে হতাশা আর বিবিক্তি, ফলে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যসকলের প্রক্ষেপণ অর্থহীন হয়ে এক কৃত্রিম অবাস্তবতা গড়ে তুলছে। বাস্তবতা গিয়ে পৌঁছুচ্ছে নাস্তিতে। দেবর্ষি সারগীর গল্প প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এমনটাই ভণিতা রেখেছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক রবিন পাল। প্রসঙ্গক্রমে অপর মনীষা আবু সয়ীদ আইয়ুবের ভাবনা খানিকটা উল্লেখ করা অযৌক্তিক হবে না। ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় ‘নাস্তিকের গীতাঞ্জলি’ বিষয়ে লিখতে গিয়ে তিনি বলছেন, একজন আধুনিক মানুষ মানে একজন নাস্তিক মানুষ। যে-মানুষ নাস্তিক নন তিনি শেষ বিচারে আধুনিক নন। কারণ, ডারউইনীয় বিবর্তনবাদের মূষলাঘাতে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মৃত্যু থেকেই আধুনিকতার জন্ম। যে-কারণে, তাঁর বিবেচনায় মানবেতিহাসে আধুনিকতার জন্মদিবস ১৮৫৯ সালের ২৪শে নভেম্বর যেদিন ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিজ’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। যাইহোক, আইয়ুব অস্তিত্ববাদী দর্শনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। প্রাচীন দার্শনিকদের মতো তিনিও মনে করতেন যে, বিস্ময় দর্শনের সূত্রপাত। মানুষ যে কেবল জৈবজগতের অধিবাসী তা নয়, সে অধ্যাত্মলোকেরও পরিব্রাজক, তারই অভিজ্ঞান রয়েছে এই শাশ্বত বিস্ময়বোধে। দেবর্ষিও মনে করেন, মহৎ গল্প প্রকাশ করে বিস্ময়, গল্পকে মিথিক করে তুলতে পারলে বা প্যারাব্‌লকে আধুনিক জীবনে মিশিয়ে দিতে পারলে এই বিস্ময় সৃজিত হয়। তিনি আরও মনে করেন, শিল্পের কাজ নব-বাস্তবতা সৃজন, নব মিথ নির্মাণ যা হুবহু বাস্তবে নেই অথচ আছে মানুষের মনে। আশি ও নব্বই দশকের বাংলা গল্পে জীবনের অনন্ত স্বপ্ন ও আনন্দের উৎসরূপে এই নতুন মিথ নির্মাণ দেবর্ষি ছাড়া আর কেউ করেননি। বিশ্বময় নাস্তিতে যে-আধুনিকতা বা উত্তর-আধুনিকতা তাতে দেবর্ষি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি দার্শনিক প্রস্থানভূমি নির্মাণ করেছেন। বস্তুত তাঁর গল্পাবলি পড়লে বোঝা যাবে যে, প্যারাব্‌ল রচনার দিকেই তাঁর ঝোঁক তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। ‘নৈঃশব্দ্য’ তাঁর একটি প্রিয় শব্দ। হোর্হে লুই বোর্হেসের ঢঙে আলো, অনুশোচনা, কান্না, দর্পণ, প্রশান্তি, স্বপ্ন, বৃষ্টি তাঁর গল্পে বার বার ঘুরে-ফিরে আসে।

ঈশ্বরকে নিয়ে খেলা করার ঝুঁকি নেবার ক্ষেত্রে দেবর্ষির দুঃসাহসিকতা উল্লেখ্য। তিনি বলেন, শিল্পক্রিয়ায় নব বাস্তবতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মনসিজ বাস্তবতার ভূমিকা প্রবল এবং সেখানে কল্পনার ভূমিকাও অতীব গুরুত্ববহ। তিনি মানুষকে বুঝতে চান তার আর্কিটাইপাল স্তর বা আদিরূপ থেকে। সচেতনভাবেই গল্পকে ঈষৎ মেটাফিজিক্যাল বা অধিবিদ্যাগত করে তুলতে চান। তাঁর গল্প যতই এগোতে থাকে ততই তার গা থেকে খসে পড়ে চরিত্র বা স্থান-নাম; আর মৃত্যু, ধ্বংস, আত্মহনন, ভয়, বেদনা, ভূমিকম্প যেমন গভীর থেকে গভীরতর তাৎপর্য পেয়েছে তেমনই স্বপ্ন, কল্পনা, অমরতা, সুখ ও অন্বেষণের অভীপ্সা, সক্রিয়তা পাশাপাশি উপলব্ধিকে প্রসারিত করেছে।

দেবর্ষির চিন্তনে মৃত্যু না থাকলে আমাদের সুখ ও আনন্দ অপরিপূর্ণ। আবার মৃত্যুতে আস্থা না রাখলে বেদনা বা বিরহের বোধ জন্মায় না। এটাই ঈশ্বর বা ঈশ্বরহীনতার বোধ। মৃত্যু যেহেতু তাঁর গল্পে প্রতীকী তাই বলা যায় মৃত্যুতে বাইরের জগতের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন হয় বটে কিন্তু আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি সংগৃহীত হতে থাকে— মিশরীয় বা তিব্বতীয় শাস্ত্রানুযায়ী এই মৃত্যু নিয়ে আসে এক সাইকিক জার্নি। ফ্রয়েড বলেছেন, “If you would endure life, be prepared for death”. ফ্রয়েডীয় ভাবনায়, এই প্রিয় অনুকূল পৃথিবীতে ব্যক্তি তার বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে মুক্তি পেতে পারে একমাত্র মৃত্যু সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্গঠিত করে। মৃত্যু মানুষকে ধ্বংস করে কিন্তু মৃত্যুভাবনা তাকে রক্ষা করে। তাই দেবর্ষির গল্পপাঠে মনে হয় every idea about death is a version of life.

আবার তাঁর গল্পে যৌনতার অভিঘাত বা নারীর ভূমিকা নেই বললেই চলে। হয়তো গভীরতর উপলব্ধি অর্থাৎ সৃষ্টিতত্ত্ব, সৌন্দর্যতত্ত্ব, অস্তিত্বতত্ত্ব তাঁকে এতটাই আলোড়িত করেছে যে যৌনতার সুড়সুড়ি আকর্ষিত করেনি। সমসাময়িক জীবনকে সমসাময়িকতার নিরিখে দেখানোতে তাঁর তীব্র অনীহা। তাঁর গল্পে মানুষ ও ইতরেতর প্রাণীর নৈকট্য লক্ষণীয়। তাঁর গল্পের কাঠামো সরল, নিয়ো কসমিক; যেখানে গল্প প্রতীকের আশ্রয়ে সত্যের কাছে পৌঁছুতে চায় সেখানে ভাবুকতার ভান নেই এবং এই নতুন পৃথিবী নির্মাণের তিনি নিপুণ কারিগর।

তাঁর ‘গল্পকুঞ্জ’ গ্রন্থের ভূমিকায় রাহুল দাশগুপ্তও মোটামুটি একই ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তিনিও বাংলা গল্পে দেবর্ষির পূর্বসূরী খুঁজে পান না। কাফকার প্যারাব্লের সঙ্গে তাঁর লেখার মিল খুঁজে পান। দেবর্ষিকে বলেন, বাংলা সাহিত্যের কাহলিল জিব্রান। যে-ঈশ্বরভাবনা তাঁর গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের পর সেভাবে আর কেউ ভাবেননি; সুতরাং সাহিত্যে ঈশ্বরকে যিনি আবার ফিরিয়ে আনলেন তিনি দেবর্ষি সারগী।

এখন প্রশ্ন হল, ঈশ্বর বলতে কী বোঝেন দেবর্ষি? তাঁর মতে জন্মগ্রহণে মানুষের হাত নেই, কিন্তু জীবন নামক সংক্ষিপ্ত অস্তিত্ব তখনই অর্থপূর্ণ হয় যখন ঈশ্বর বিষয়ে ইতিবাচক ভাবনা থাকে। দেবর্ষির ঈশ্বর আর অস্তিবাদীদের ঈশ্বর স্পষ্টতই ভিন্ন। দেবর্ষির নির্মিত ঈশ্বর যেখানে অপরিহার্য সেখানে অস্তিবাদীদের ঈশ্বর পরিত্যাজ্য। অস্তিবাদীদের good faith আর bad faith-এর উপকরণ ব্যবহার করেই তিনি স্বতন্ত্র ডিসকোর্সের জন্ম দিতে চান। তাঁর মতে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করাটাই গুড ফেইথ। জগতের প্রতিটি ঘটনা, বস্তু যখন অস্থায়িত্বের শিকার তখন কি মরণেই সব শেষ? এখানেই দেবর্ষির ঈশ্বর বলেন, সবই বেঁচে থাকে। টিকে থাকে। কোথায়? ঈশ্বরের স্মৃতিতে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও, গোটা জগৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তা টিকে থাকে ঈশ্বরের মনে; জগৎটাই তাঁর মগজ, তাঁর সমস্ত স্মৃতির আধার।

এতাবৎকাল প্রস্তাবনা হিসেবে যে-সমস্ত আলোচনা, উদ্ধৃতি, বিশিষ্টজনের বক্তব্য, গল্পকারের স্বাভিমত রাখলাম, সেইসব সংসৃষ্ট অভিজ্ঞান সঙ্গে করে আমরা প্রবেশ করব দেবর্ষি সারগীর গল্পের অন্তরপথে। বুঝে নেব, মিলিয়ে নেব তাঁর ভাবনানিচয়। পরবর্তী আলোচনায় আমি তাঁর তিনটি গল্পগ্রন্থ থেকে দশটি গল্প চয়ন করেছি। ‘রাজার জ্ঞানতৃষ্ণা’ থেকে পাঁচটি, ‘গল্পকুঞ্জ’ থেকে চারটি আর খানিক ভিন্ন ভাবনা থেকে একটিই গল্প বেছেছি ‘নির্বাচিত গল্প’ থেকে। শুরুতেই বলি, লেখকের বয়ান অনুসারী না হয়ে এই গল্পাবলির একটি বাদে বাকিগুলি খুব ছোটো নয় বা সেখানে স্থান-চরিত্রের নামেরও উল্লেখ আছে।

প্রথম আলোচনীয় গল্প ‘মৃগনাভি’ যা নিছকই চারজন সরল ডাকাতের অসরল যাপনের আখ্যান— ভিন্ন মাত্রায় দ্যোতিত হল তখনই যখন গল্পকার শুরুতেই জানিয়ে দেন যে, চারজনের একজন সনাতন হঠাৎই ডাকাতি ছেড়ে নির্বিষ যাপনের সামিল হল এবং ফলত সঙ্গীদের জ্ঞাতিরোষের অন্যায় শিকার হল। কিন্তু সে-নির্মম হত্যার মূলীভূত কারণও অধরা থেকে গেল সঙ্গীদের কাছে; পারদ যেমন ধরা যায় না, পিছলে পিছলে যায়, দুর্মূল্য হীরকখণ্ড যেমন সকলে ছুঁতে পারে না— ঠিক তেমনই সঙ্গী জংলাও খুঁজে পায় না সনাতনের গহিন কন্দরে লুকোনো আত্মসৌরভের সন্ধান; যেমন কস্তুরীমৃগ ছাড়া সন্ধান মেলে না দুর্লভ মৃগনাভির— তা সে মৃগকাজে যতই থাকুক মগ্ন হিংস্রতা।

এই গল্পে লেখক যে-সব জায়গার নাম ব্যবহার করেছেন তা তাঁর বালকবেলার পরিচিত। যেমন আরবপুর, বাথানপাড়া, কুমড়ি, নাটনা, কাঁঠালিয়া, শিকারপুর— এ-সব তাঁদের নদিয়া জেলার বাসগৃহ সংলগ্ন এলাকা যদিও গল্প-ঋদ্ধিতে এসবের ভূমিকা অকিঞ্চিৎকর। যাইহোক, সংক্ষেপে গল্পটা এইরকম: এক ডাকাতি-অনিচ্ছার রাতে যখন চাঁদের দিকে পিঠ দিয়ে তারা বসেছিল একটা ছইওয়ালা গো-গাড়ি ‘রাস্তায় পড়া তাদের চারটে ছায়া পিষে দিয়ে গেল’। এই প্রতীকী রোষ-উদ্দীপনা নিয়ে তারা গাড়ির ভিতরের দরিদ্র নবদম্পতিকে আক্রমণ করে বসল। পরিচিত সন্দেহে মুন্সি বরটাকে থেঁতলে দিল যা জংলা চায়নি। না, কচি বউটাকে কচলাতেও নয়। সে ভেবেছিল ‘কচি ছুঁড়িকে না হয় বাঁচালই একদিন, বলা যায় না ঈশ্বর তার আর সব ভুলে গিয়ে হয়তো ওটাই মনে রাখবে’। কিন্তু ঘটনাচক্রে সনাতনের হেফাজতে থাকা বউটি তার অজান্তেই তার হাতে খুন হয়ে গেল। এই অনিচ্ছাকৃত খুনের অভিঘাতে সনাতন অদ্ভুত এক মনখারাপি যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়। সে-সব ছেড়েছুড়ে বেমক্কা বেপাত্তা হয়ে যায়। ফিরে আসে দীর্ঘ ছ-বছর পর যখন সে এক পালটে যাওয়া সনাতন। রূপান্তরিত সনাতন সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য: “রূপান্তর চিরকাল ঘটে নেপথ্যে, গোপনে… মানুষের জীবনে নির্জনতার একটাই ভূমিকা তা হল নির্জনতা পালটে দেয় মানুষকে।” এভাবে পরিবর্তিত সনাতন ছোট্ট চায়ের দোকান দিয়ে দিনাতিপাত করতে লাগলে তার কুকর্মের সাগরেদরা শুধু ক্ষুব্ধই হয় না, হয়ে ওঠে হিংস্রও। প্রথমে বাজে কথায় উসকাতে চায় অবিচল সহাস্য মানুষটিকে। সে এক আশ্চর্য হাসি যার মাঝ থেকে পূর্বসঙ্গীরা আবিষ্কার করে তাদের প্রতি স্পষ্ট বিদ্রূপ। সনাতনের মন জুড়ে ছোট্ট মাছেদের মতো তিরতির সুখ। “হাসিস কেনে সব সময়?”, ওরা জানতে চাইলে সে বলে, “হাসব কেনে? ওটা তোদের মনের ভুল।” একদিন ডাকাতি করতে গিয়ে মার খেয়ে ফেরা দলটি সনাতনের দোকানে বসলে আবার সেই হাসির আক্রমণ; কিছুতেই পিছু না-ছাড়া হাসি দেখে একজন বলে, “হাসছিস কেনে?… আমরা মার খেয়েছি বলে খুব মজা লাগছে না? আজ তোর ঠোঁটদুটো ছিঁড়েই নেব শুয়োরের বাচ্চা।” অন্তর্গত ক্রোধে ফেটে পড়ে তারা সনাতনকে মারধর করলেও হাসির উৎস খুঁজে পায় না। অধরা সনাতন এবার বলে, “আমার শরীরের মধ্যে কোথাও একটা মৃগনাভি লুকিয়ে রেখেছি। হরিণের মধ্যে ওটা যেমন লুকিয়ে লুকিয়ে সুবাস ছড়ায়, আমাকেও তেমনি দিনরাত মাতিয়ে রাখে গো! দিনরাত আমোদে রাখে।” সনাতনের এই নবলব্ধ অভিজ্ঞানের ধরতাই পায় না বন্ধুরা আর তাদের রোষানলে ঘি ছিটোয় হোমগার্ড হরির সঙ্গে সনাতনের অশ্রুত বাক্যালাপ। সনাতনকে খুন করবে বলে তারা স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়; ওর মুখের হাসি ঘুচিয়ে দখল নিতে চায় সুপ্ত মৃগনাভির। বলে, “তোর হাসি আজ জন্মের মতো মুছে দেব রে ঠোঁট থেকে।” সনাতনও এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যায়। এরপর তারা অমানিশার শ্মশানে জংলাকে খুনের দায়িত্ব দিলে সে কাটারি দিয়ে ফালাফালা করতে থাকে সনাতনের দেহ, দেহকোষ আর উন্মত্ত চিৎকারে বলতে থাকে, “কোথায় লুকিয়েছিস রে সনাতন… কোথায় রে? ওডা আমায় দে, আমিও একটু ধারণ করি শরীরে…।” আক্রোশ আর আকুতি মিলেমিশে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, “জীবনের কডা দিন আমিও একটু হেসে বাঁচি। কই রে? কোথায় ওডা কোথায় লুকিয়েছিস?” এরপর বিধ্বস্ত জংলা, হতাশ জংলা কাটারি মাটিতে ফেলে “নির্নিমেষ চেয়ে রইল সনাতনের শরীরের গূঢ় গহ্বরগুলির দিকে”। তারপর সেও নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।

মৃগনাভির প্রতীক এখানে জীবনের অপ্রাপণীয় প্রশান্তি যা আধুনিক যাপনের পাশবিকতার, জান্তবতার প্রতি এক প্রতিস্পর্ধী মাধুরী, অধরা অথচ ক্রমমুক্তির রক্ষাকবচও বটে। গল্পশেষের এই নৃশংস দৃশ্যের সঙ্গে সুফি সাধক মনসুর হেল্লাজের জীবনান্ত তুলনীয়। মনসুর সাধনার এমন এক স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন যে আল্লাহর থেকে পৃথক করতে না পেরে নিজেকে ‘আনাল হক’ (আমিই সত্য) বলে দাবি করেছিলেন। শরিয়তের বিধানে এই গর্হিত অপরাধের জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁর রক্ত থেকে, দেহের টুকরো টুকরো করা মাংস থেকে এমনকী মাংস-পোড়া ছাই থেকেও ‘আনাল হক’ ধ্বনিত হতে থাকে এবং শেষ অব্দি সেই ছাই সাগরে নিক্ষেপ করলে সাগরের জল ফুলেফেঁপে শহর ভাসাতে উদ্যত হয়। পরে তিনিই সেই শহরকে রক্ষা করেন। এ-হেন সুফিবাদী প্রভাব দেবর্ষির অনেক গল্পের নির্যাস।

দ্বিতীয়টি প্রথম বইয়ের নামগল্প ‘রাজার জ্ঞানতৃষ্ণা’ যা লিখিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালের অক্টোবরে। এ-গল্পের প্রথম বাক্যই সিদ্ধান্তদায়ী— ‘রাজার জ্ঞানী হবার সম্ভাবনা কম’। কারণ, জ্ঞানবৃদ্ধি ঘটলে অস্বীকরণের ধৃষ্টতা গজায় এবং “রাজ্যভোগ আর অস্বীকরণ এক সঙ্গে চলতে পারে না।” গল্পের এক বিশেষ ভূমিকায় এক বৃদ্ধ পল্লবরাজ যার রাজসভায় একদিন এক যুবক এল, বাবার সঙ্গে। সে রাজকবি হতে চায়। রাজা তার কবিতা শুনতে চাইলে সে চারণকবিদের ঢঙে বলে “আমি মুখে মুখেই কবিতা তৈরি করার অভ্যেস করেছি।” অবাক রাজা ভাবে লিখে না রাখলে তো হারিয়ে যাবে! এর পরিপ্রেক্ষিতে যুবকের দৃঢ় বক্তব্য, “মহৎ ও সার্থক কবিতার লক্ষণ হল তা লোকের মুখে মুখে ফেরে (parabolic idea)।” আবার এও বলে, “মানুষ ভুলে যায় যে কবিতা তা মহৎ হয়নি বলেই ভুলে যায়।” এরপর রাজার নির্দেশমতো সে বর্ষার রূপকল্পে একটি কবিতা শোনায় এবং বলে, “বর্ষাই প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ ঋতু।” রাজা সন্তুষ্ট হয় না; দ্বিতীয় বারে হেমন্ত ঋতুর কবিতা শুনিয়েও সে প্রত্যাখ্যাত হয়। হয় বিমর্ষ, অপমানিত। সে এমন এক জায়গায় চলে যেতে চায় যেখানে তার প্রতিভার কদর হবে। তবুও সে তৃতীয় বারের কথা ভেবে উৎফুল্ল হয়— রাজা নিশ্চিত এবার আর তাকে ফেরাতে পারবে না কেন-না তার ধারণায় “একই লোক একই জায়গায় পরপর তিনবার বন্যায় ভেসে গেছে, পরপর তিনবার আগুনে পুড়ে গেছে, পরপর তিনবার ভূমিকম্পে আহত হয়েছে, তা কি হয় কখনও?” তাই এবার সে ভিন্নতর ভাবনা নিয়ে একটি প্রেমের কবিতা রচনা করে, প্রৌঢ় রাজার তা হয়তো মন্দ লাগবে না। এই কবিতায় সে দেখাল “নারী ছাড়া জগৎ ও জীবন কেমন মরুভূমি, খাঁ খাঁ আগুনের মতো দুঃসহ”। এই কবিতা শুনে রাজা এক আশ্চর্য সুন্দরীর প্রেম-তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে উঠল। সে কবিতাটির শক্তি স্বীকার করলেও তার রাজকবিসুলভ হয়নি বলে তাকে আবার ফিরিয়ে দিল।

চরম হতাশা আর চাপা ক্রোধে অস্থির হয়ে সে পরদিন ভোরে রাজ্য ছেড়ে চলে গেল। মানুষের সান্নিধ্য তার অসহ্য ঠেকছিল। সৌমনস্য নির্জনতার আকাঙ্ক্ষায় সে এক নিঃশব্দ জঙ্গলে প্রবেশ করল আর “এই প্রথম যুবকটির ভিতর জগৎকে ক্ষমা করার এক আশ্চর্য অনুভব এল। সে মনে মনে রাজাকে ক্ষমা করল”। সঙ্গে আনা তরোয়ালের গায়ে চুমু দিল। জঙ্গলের মাঝে সে এক অর্ধনগ্ন মানুষকে দেখল। দু-জনের মাঝখানে হঠাৎ এক নেকড়ে হাজির হল যে মানুষটির পা জড়িয়ে গড়াগড়ি খেয়ে জঙ্গলে পালিয়ে গেল। মানুষটির “তকতকে নির্মল গা, মুখটা তৃণভোজী জীবেদের মতো শান্ত”। অচেনা নেকড়ে কীভাবে শান্ত হল, সেই ভাবনায় যুবকের সামনে উঠে গেল জগতের নিগূঢ় রহস্যের পর্দা। তারপর হঠাৎ সেই অচেনা মানুষটি উধাও হয়ে যায়। সে জানতে পারে “ও রকম অর্ধনগ্ন, ঘুমঘুম মানুষ এ জঙ্গলে বহু আসে। তারপর কোথায় চলে যায়”।

এদিকে রাজা যুবকটির অপেক্ষায় অস্থির হয়ে তার খোঁজে লোক পাঠিয়ে সঠিক সন্ধান পায়। তারা বলে, সে আরও সুন্দর হয়েছে। তার মুখে আলো ফেলতেই সেই মুখ আগুনের মতো জ্বলে উঠেছে। রাজা আস্বস্ত হয়ে নিজেই ছদ্মবেশে ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে পড়ল এবং তার দেখা পেল। তার “তকতকে নির্মল গা, একজোড়া ঘুমমাখা রহস্যময় চোখ। আর মুখটা তৃণভোজী জীবেদের মতো শান্ত… ভেতরটা পাকা ফলের মতোই হলুদ, পরিপূর্ণ”। তার সঙ্গী এক অজগর। হতবাক রাজা কী বুঝে তৎক্ষণাৎ তাকে রাজসভাকবি নিযুক্ত করল কিন্তু রাজাকে ততোধিক হতবাক করে যুবক বলল, “আমি যে আমার সব কবিতাই ভুলে গেছি।… আমি যে আর কবিতা রচনা করতে পারি না মহারাজ।” সে আরও ধোঁয়া ছড়িয়ে বলে, “যা বলতে চাই তা আদৌ সম্ভব নয় বলেই হয়তো ভুলে গেছি।” বিস্ময়াবিষ্ট রাজা এরপর তাকে নানান প্রলোভন দেখালেও যুবকটি তাকে ফিরিয়ে দিল। রাজা রোষকষায়িত হলেও যুবক অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বিবশ রাজা টলতে টলতে অন্ধকার জঙ্গলে হেঁটে চলে— পাশে পাশে এক নেকড়ে, গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে চলে।

এ-রূপকধর্মী গল্প শিল্প রচনা-সক্ষমতার এক মনোরম প্যারাব্ল। এখানে নৈঃশব্দ্যের ভূমিকা গুরুত্ববহ যা চেতনায় প্রাখর্য আনে, অন্তর্গত সত্তাকে বসায় মুখোমুখি; উন্মোচিত করে জীবজগতের অরাল অধরা রহস্য।

তৃতীয় গল্প, ‘কমিউনিস্ট দেশের নটরাজ’ যা তিনি লিখেছিলেন ১৯৮৬-র মার্চে। পঞ্চাশের দশকে কেরালায় কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী সময়ে নটরাজ নামধারী একজনের সম্পর্কে এক কাল্পনিক বয়ান, গল্পকারের স্বকীয় ধ্যানধারণা ও কল্পিত দর্শন মোতাবেক। সেখানে গল্পকারের সাংবাদিক বন্ধুটির (আসলে গল্পকারের) মতে “সাম্যবাদের মূলমন্ত্রটা এক সময় প্রচার করবে শোষকেরাই… কাজ, নির্ঝঞ্ঝাট রোজগার, বিশ্রাম, বিনোদন এ সবের কাঠামোয় সুষ্ঠুভাবে ভাগ করে নিতে চাইবে জীবনটাকে। আর বুঝবে তাতেই বেশি শান্তি। শোষণের সঙ্গে মন ও শরীরের যে নিরন্তর চাপ জড়িয়ে থাকে এক সময় তা আর সহ্য হবে না তাদের।… অতীতে শোষকেরা খুব নিশ্চিন্তে শোষণ করতে পারত। কারণ সাধারণের ভিতর তখন সংগ্রাম চেতনা গড়ে ওঠেনি। শোষিতেরা তখন ভাবত তাদের দুঃখদুর্দশার কারণ ঈশ্বর আর তাদের পাপ”। শোষকেরা ভাবত ঠিক উলটোটা। পরে মানুষ যখন উপলব্ধি করেছে ঈশ্বর স্বয়ং শোষণকে ঘৃণা করেন তখন এ-যুগের শোষকদের মনে এক অদ্ভুত আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা গড়ে ওঠে। এভাবে চাপ বাড়তে থাকলে তারা নিজেরাই সমবন্টনের শ্লোগান তুলবে কেন-না “নিরন্তর আতঙ্কে ভোগার চেয়ে রাজারাও আত্মহত্যা বেশি পছন্দ করে। কিংবা দেশ ছেড়ে পালায়”। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ ঈশ্বরের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে কান্নাকাটি করছে কিংবা জগৎজুড়ে মানুষ এক অভিযোগহীন জীবনযাপন করছে— এরকম পৃথিবী তো ভয়াবহ। এমন বৈচিত্র্যহীন বিশ্বে আত্মহত্যা করা ছাড়া মানুষের মুক্তির আর কোনো পথ খোলা থাকবে বলে মনে হয় না। এমন সমাজ ইউটোপিয়ান। আসলে এ-কথায় তামাশা আছে। বাস্তবত রক্তাক্ত বিপ্লব ছাড়া শোষণ দূর হয় না; কিন্তু সম্পদের সমবন্টনেই যে সার্বিক সুখ লুক্কায়িত, এ অনেকটা রূপকথাসুলভ। সম্পদ-বৈভবে আখেরে মানুষ সুখী হয় না। এই গল্পে একজনের কথা আছে যে অপরূপ সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখেই সবকিছু ছেড়েছুড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিল। তার একান্ত ইচ্ছে জন্মেছিল, সুখলাভের জন্য জগতের সঙ্গে একাত্ম হতে। তাই “পৃথিবীর ধুলোর ভিতর, নক্ষত্রের আলোর ভিতর, গোধূলির ধীর ছায়ার ভিতর, রাত্রের অন্ধকারের ভিতর, ফুলের পরাগের ভিতর, মাটির নিচের নিশ্চিন্ত নৈঃশব্দ্যের ভিতর সে তখন গলে গলে যেতে চায়”।

এবারে নটরাজের কথা যাকে পাগলাগারদে রাখা হয়েছিল আর সেখানেই অধর্ষণীয় একাকিত্বে সে উপলব্ধি করেছিল তার চেতনার সত্যসন্ধী প্রখরতা। তার সঙ্গে সেখানে যে-বই-দু-টি ছিল তা সেই রাজ্যের সশস্ত্র বিপ্লবের ও তার সাফল্যের কাহিনি-সম্বলিত। নটরাজের বাবা সশস্ত্র বিপ্লবের অংশীদার ছিল। বেশ কিছু হত্যাশেষে সেও খুন হয়ে যায়। রাজ্যে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে নটরাজ পোস্টমাস্টারের চাকরি পায়। তার টেলিফোনে অপারেটর স্ত্রী হেমা যুক্তিবাদী মননের অধিকারী। পরবর্তীকালে তাদের সাত বছরের সন্তান দুর্ঘটনায় মারা যায়। “শীতের দুপুরের স্নিগ্ধ রোদের মতো” তাদের ছকে বাঁধা জীবন চলতে থাকে। রাজ্যের সমস্ত উৎসব থেকে ছেঁটে ফেলা হয় “সামন্ততান্ত্রিক জৌলুস ও কুসংস্কার”। ভাববাদী সাহিত্য পড়ার দিন ফুরিয়ে যায়। কিন্তু মানুষের মন বড়ো আশ্চর্য। প্রাথমিক সকল চাহিদার নিবৃত্তি ঘটলে জেগে ওঠে অন্য প্রবৃত্তি। কারো কারো জীবনে টান পড়ে মাধ্যাকর্ষণের। মানুষ ছোটে সেই অসেতুসম্ভব আকর্ষণে। এভাবেই একদিন নটরাজের প্রতিবেশী একদা বিপ্লবী চন্দ্রচূড় বলে তার স্ত্রী মোট আটবার একই স্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্নটা হল “সাদা দাড়ি ও টাক মাথার এক বৃদ্ধ প্রতিবারই দাঁড়িয়ে থাকে এক বিশাল নির্জন মাঠের ওপর। সময়টা কেমন গোধূলি গোধূলি। আকাশে অন্ধকার”। এরপর বিপ্লবকালে মন্দির ভেঙে ফেলে সেখানে সরকারি অফিস বানানো হয়েছে; গির্জায় যিশুর মূর্তি ভাঙা হয়েছে কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়ে মসজিদের গায়ে হাত পড়েনি— এইসব বক্তব্য আছে। অবশ্য লেখক চন্দ্রচূড়ের মুখ দিয়ে নিজস্ব ভাবনা প্রকাশ করে বলেন, “মন্দির না করে দিলে ঈশ্বর থাকার জায়গা পাবেন না, আমি মানি না তা।” হঠাৎই টানা বৃষ্টিতে জেরবার হয় রাজ্যবাসী, বসে বসে হাই তোলা ছাড়া কাজ থাকে না। অনেকে জীবনে প্রথম উপলব্ধি করল কাজ ছাড়া মানুষের জীবন কী ভয়াবহ, কী নিষ্ঠুর! নাগাড় স্থবির নিঃশব্দ অবস্থায় নটরাজের মাথায় অদ্ভুত সব চিন্তাসূত্র গ্রথিত হতে লাগল। বিশ্বের তাবৎ বস্তুর উৎস খুঁজতে লাগল সে। ঘুরতে লাগল যত্রতত্র, সকলের অজ্ঞাতে। নটরাজের নতুন ভাবনায়, “ঈশ্বরও বিপ্লব চান।… ঈশ্বরবিশ্বাস যে আদপে শ্রেণি-অত্যাচারেরই ফলশ্রুতি, শোষকেরা ওটা ব্যবহার করেছে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে আর শোষিতেরা দুর্দশা ভুলবার পথ হিসেবে— সে নিজে এক সময় বিশ্বাস করত এ মতবাদে। আজ তাদের দেশে অত্যাচার নেই। শোষণ নেই।… মানুষ খেয়ে-পরে তৃপ্তিতে আছে। তবু কী করে জাগল তার ভিতর আবার ঈশ্বর সম্পর্কে ক্ষুধা ও কৌতূহল? কেন জাগছে? কোথায় লুকিয়ে এ রহস্যের উৎস?” একদিন তার মনে জাগে, জগৎ ও জীবনের সকল সত্য দ্বিখণ্ডিত ফলের মতো। গোটা সত্যটি পেতে দুটোকেই মেলাতে হবে। সে আরও ভাবল “মানুষকে সুখী করার জন্য দরকার দুটো বিপ্লব। একটা তাদের দেশে হয়ে গেছে, অন্যটা বাকি।” মাথা বিগড়েছে ভেবে হেমা মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। নটরাজকে এক নিরিবিলি স্থানে ঘাসের ঢিবির ওপর বসে থাকতে দেখে, পাশে পড়ে থাকা শিলাখণ্ডে আঁকিবুঁকি কাটছে। তার মনে হচ্ছে এগুলোর মধ্যে মানুষ ও জন্তু লুকিয়ে আছে। আবার শিলাগুলিকে তার মনে হচ্ছে বিপ্লবকালে মন্দির থেকে ছুড়ে ফেলা মূর্তি সব। এই অবস্থায় তাকে দেখে হেমা ডিভোর্সের কথা ভাবে আর ডাক্তার ভাবে, “আদিম মানুষের শুরুর অবস্থায় আবার পুরোপুরি ফিরে যাবার আগেই সারিয়ে তোলা দরকার নটরাজকে”।

অবস্থান্তরিত ব্যক্তিত্বের জটিল বিন্যাস, গল্পের মধ্যে গল্পকথন, স্বপ্ন ও বৃষ্টির তাৎপর্যময় ভূমিকা, এ-গল্পের মূলভাব। দেবর্ষি তাঁর গল্প-বিষয়ক এক বক্তব্যে বলেন, “বাস্তবের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও অবিস্মরণীয় ঘটনা বা মানুষ বা সংকট দেখার পর আমি ওসব নিয়ে একটি দুঃস্বপ্ন বা সুখস্বপ্নও দেখি এবং গল্প লেখার সময় ওই স্বপ্নেরই বিবরণ দিয়ে যাই।… বস্তুত স্বপ্নে যা দেখি জাগরণের বাস্তবতায় তা অবিকল খুঁজে না পেলেও স্বপ্নের স্মৃতিটা তো থেকেই যায়।”

উনিশ শতকের শৃঙ্খলিত কল্পনাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন কাফকা। স্বপ্ন ও বাস্তবের ভূমিকা হয়েছিল একাকার। এই গল্পের প্রোটাগনিস্ট বোঝে মানুষের সমগ্র ইতিহাস চলেছে অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে। সৌন্দর্য ও শান্তির অভাব যে কমিউনিস্ট ব্যবস্থাতেও থাকে, এই বক্তব্যেই দার্শনিক মাত্রা নিয়ে আসেন দেবর্ষি— অবধারিত ঈশ্বর-প্রসঙ্গ উপস্থাপন করে।

১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি লেখেন ‘ঈশ্বর, মানুষ ও নাটক’। প্রেক্ষিত, দু-হাজার বছর আগের গ্রিসের দেলাসের নাট্যশালা দর্শন। গল্পকারের সঙ্গী ইতিহাসের অধ্যাপক পথপ্রদর্শক গ্রোসোল ও সঙ্গে তার স্বল্পবাক স্ত্রী ইসাবেলা। গ্রোসোলের মতে ভারতীয়রা প্রখর যুক্তিবাদী। তারা হেঁটে চলেছে খাঁ-খাঁ শূন্যতা আর ভগ্নস্তূপের মাঝ দিয়ে। এখানেই এক সময় বিশ্বের বৃহত্তম দাস-বাজার ছিল। দেলাসের মানুষ দাসেদের চাইতেও অধিক ঘৃণা করত কুকুরদের কেন-না তাদের প্রিয় খরগোশ আর তিতিরদের মেরে ফেলত কুকুরেরাই। তাই তারা কুকুরীদের মেরে তাদের পেট চিরে বাচ্চা বের করে আনত; তাদের ভয় ছিল “কুকুরী মরলেও পেটের ছানারা জ্যান্ত বেরিয়ে আসতে পারে।” ইসাবেলা এতে হেসে উঠলে গ্রোসোল বলে “একজন ঐতিহাসিকের চোখে সবকিছু ধরা পড়বে তা ত সম্ভব নয়। অনেক সত্যকে তাই কল্পনা করে জেনে নিতে হয়।” এ-কথায় গল্পকার-কথক বলে ওঠে, “আপনি তাহলে স্বীকার করছেন যে সত্য আবিষ্কারে কল্পনার একটা ভূমিকা আছে।… যে সত্যে বিন্দুমাত্র কল্পনার সুযোগ নেই সে সত্যে সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে মানুষ।” আর থাকে ঈশ্বরের জুড়ে রাখা জীবন ও জগতের মিলিত রহস্য; এই রহস্যের পর্দা ঈশ্বর সরিয়ে নিলে চিন্তাহীন মানুষ গাছ-পাথরের মতো নিথর হয়ে যাবে। দেলাস অ্যাপোলোর জন্মভূমি। “তাঁর রাজত্বকালে জন্ম ও মৃত্যু দুটোই ছিল নিষিদ্ধ”। এক গভীর ভাবনা-উদ্রেককারী মিথিক্যাল বিধান। এরপর ক্লিয়োপেট্রার ভাঙা প্রাসাদ নজরে পড়ে। তারপর উপত্যকার মতো এক সমতলভূমি যার মাঝখানে “ঘোড়ার নালের মতো দেখতে একটা ঘেরা জায়গা”। দেলাসের নাট্যশালা। সমস্ত জগতের প্রতীক হয়ে ওঠে সেই স্থান কেন-না “জীবন ও জগৎ বুঝতে হলে নাটক ও নাট্যশালাকে বুঝে নেওয়া দরকার”। এরপর ভগ্ন নাট্যশালার সারি সারি প্রকোষ্ঠের একটা থেকে কথকের কানে “ভেসে এল কেমন ফিসফিসানির শব্দ… পরক্ষণেই বাতাস ভেদ করে মানুষের স্পষ্ট কণ্ঠস্বর”। গ্রোসোলের গলা। ইসাবেলার সঙ্গে বিশ্রী ভাষায় ডিভোর্স সংক্রান্ত বাদানুবাদ চলছে। হঠাৎ কথকের ডাকে চমকে গ্রোসোল স্বাভাবিকতার ভান করে বলে, “নাট্যশালায় এসে আমিও একটা নাটকের চরিত্র হয়ে গিয়েছিলাম। একজন খুনি স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করছিলাম।” ইসাবেলা দু-জনকেই চমকে দিয়ে বলল, “তুমি ত অভিনয় করছিলে না। তুমি সত্যি সত্যি খুন করতে চেয়েছিলে আমাকে।” পরে অবশ্য গ্রোসোলও তা স্বীকার করে যে, ইসাবেলা তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে তাই ভালো লাগার ঘৃণার্হ অভিনয় সে আর করে যেতে পারছে না; এবং এ-কারণেই সে বলে, “আমি অভিনেতাদেরও ঘৃণা করি। কেন-না তাদের সব মিথ্যে। তাদের হাসি, তাদের দুঃখ, তাদের কান্না। তাদের ভদ্রতা। মঞ্চের উপর তাদের জন্ম মঞ্চের উপর তাদের মৃত্যু— সব মিথ্যা।… আমার মনে হয় ঈশ্বরও তাই। মিথ্যেবাদী অভিনেতাদের চেয়ে তিনি বরং সত্যবাদী খুনিদের বেশি পছন্দ করেন।” এ-কথায় কথক খানিক থমকে বলে, “না, ঈশ্বরও আসলে অভিনয়ই পছন্দ করেন। শুধু তাই নয়, ঈশ্বর নিজেও যে সবচেয়ে বড় অভিনেতা।” এমনকী ক্রুশবিদ্ধ যিশুও “জগৎ জুড়ে নাটকের স্বার্থে কষ্ট পাওয়ার নিদারুণ অভিনয়টা করে গেলেন”। কথকের শেষ বক্তব্য গল্পের নির্যাস: “ঈশ্বর চান না খুনিরা এ রহস্য জেনে ফেলুক।” জানলে মানুষ নির্দ্বিধায় খুন করবে। এ-জগৎ এক বিশাল নাট্যমঞ্চ আর আমরা এক-একজন অভিনেতা— শেকসপিয়ারের এই উক্তি সর্বজ্ঞাত। কিন্তু তাকে নিয়ে যে ধূমল রহস্য তা জিইয়ে রাখেন গল্পকারের কল্পিত ঈশ্বর। মানুষের অভিনয়ের পদে পদে রহস্যের আবিষ্কর্তা তিনিই— সেখানে আছে ভয়, পাপবোধ। দেলাসের রহস্যময় পটভূমিতে এই দার্শনিক উপলব্ধি ধ্রুপদী ঢঙে উপস্থাপিত।

‘রাজার জ্ঞানতৃষ্ণা’ বইয়ের শেষ গল্প ‘জাদুকর’ যা লেখা হয়েছিল ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে। এ-গল্পে জাদুকরের দর্শকেরা মোহাবিষ্ট, নিষ্ক্রিয় নয়, সক্রিয়। যে-গ্রামে জাদুকর খেলা দেখাতে এসেছে সেখানে অবস্থিত এক দুর্গম পাহাড়ে বহুকাল আগে নাকি এক কৃষ্ণবর্ণ বালক উঠে আর ফেরেনি। এখানে ঘন জঙ্গল আর নিরুষ্ণ নৈঃশব্দ্য। এখানকার এক মহিলা চল্লিশ বছর ধরে একটুও ঘুমোয়নি। এক ধনী ব্যক্তির একমাত্র পুত্রের তিরিশ পেরোনোর পর হঠাৎ মাথায় ঢুকল “বেঁচে থাকা আর মারা যাওয়া সমার্থক”। এই ভাবনার ফলস্বরূপ সে অনড়, নিশ্চল জীবনমৃত্যুর মাঝামাঝি এক স্তরের জীবনযাপন করে। অপর তরুণের অবস্থা আরও দুঃখজনক। সে প্রচুর পড়াশোনা করে মস্তিষ্কের অবচেতন স্তরের একটা অংশকে সক্রিয় করে ফেলেছে। এতে করে স্বপ্নরা তার কাছে অনেক ব্যাখ্যাতীত সত্যের সন্ধান দেয়। এমনই এক বিচিত্র গ্রাম বেছে নিল জাদুকর, আর এক অন্ধকার স্থান। তার কোনো সরঞ্জাম নেই, লাগে না বিশাল মঞ্চ। দরকার এক গভীর সুড়ঙ্গের মতো গর্ত। খেলা হবে প্রতি সন্ধ্যায়। সরল একটি খেলা। প্রতিদিন দর্শকদের দেখিয়ে সে গর্তের ভিতর ফেলে দেবে একটি হীরের আংটি। তারপর প্রত্যেককে বলবে গর্তে নেমে সেটি খুঁজে নিয়ে আসতে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল “আংটিটা ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শকারীর সমস্ত সত্তায় জমাট বাঁধবে এক এমন পরম আনন্দের ঘোর যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত সে আর কখনই হবে না”। এই জাদুকর মানুষের স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, চাইলে সব নিদ্রিত মানুষকে একই সময়ে একই স্বপ্ন দিতে পারে এবং সে তাই করল। আংটিটা যে তুলে আনতে পারবে সে পাবে অনির্বচনীয় আনন্দের স্বাদ কেন-না “আনন্দের একটা গোপন শিরা ঘুমিয়ে আছে প্রত্যেকের ভিতরই। আংটিটার ছোঁয়ায় এ শিরাটাই শুধু জেগে উঠবে, থিরথির করে নড়ে উঠবে একটু”। এবং এই স্বপ্নের প্রভাবে অনেকের মধ্যেই পরিবর্তন দেখা দিল ও রাতের স্বপ্ন সবাই ভুলেও গেল। প্রথম দুই সন্ধ্যায় জাদুকরের কাছে কেউ আসে না, আসে ফলদায়ক তৃতীয় রাতের স্বপ্নশেষে। কাতারে কাতারে লোক এল, কল্পিত আনন্দের ছোঁয়া পেতে। সে তাদের এক বৃদ্ধের কাহিনি শোনাল যাকে ডাকাতরা খুন করলেও সে তাদের ক্ষমা করেছিল। “ঐ বৃদ্ধও নাকি কোনভাবে স্পর্শ করেছিল এই আংটি”। এই বলে জাদুকর আংটি গর্তে ছুড়ে দিলেও কেউ এগিয়ে আসে না। আসলে তারা স্বপ্ন ভুলে যাবার মতো গোটা ব্যাপারটাই ভুলে গেছে। পরদিন এক শীর্ণ, তৃষ্ণার্ত লোক এসে গর্তে নামে। খোঁজার কিছুক্ষণ পর সে হাতে পেল কিছু পরিচিতজনের ছবি, কিছু অচেনা। নিজের শৈশবের ছবিও সে দেখতে পেল। তারপর বহুকাঙ্ক্ষিত আংটির স্পর্শ পেতেই তার ঘটল বিস্মরণ। অপ্রকৃতিস্থ সে-আংটি হাতে উঠে এল। অথর্ব জড়ে রূপান্তরিত হল সে। একাকী নিশ্চল বসে থাকে। “নিজের ছায়াকেও যেন কাছে ঘেঁষতে দেয় না”। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত স্ত্রী তাকে সচল করতে গায়ে বিছে ছেড়ে দেয়, অর্থাৎ, এক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে তাকে ফেলে দিতে চায়। কিন্তু তার কোনো ভাববৈকল্য ঘটল না। চারদিনের দিন সে স্বাভাবিক হল বটে কিন্তু সাধারণ মানুষের মতো নয়। সে যেন একটি গাছ হয়ে হেঁটে বেড়াতে লাগল, মাথায় শালিখ উড়ে উড়ে বসতে চাইছে। কেউ তার এই অদ্ভুত পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে সে তাকে জাদুকরের আংটি ছুঁয়ে আসতে বলছে কেন-না এই বিষয়টি অব্যপদেশ্য— নিজে অনুভব করা যায়, বোঝানো যায় না অপরকে। গাঁয়ের ক্রুদ্ধ দারোগা তার এই চ্যাংড়ামির শাস্তি দিতে চায়। তাকে ভণ্ড, কামচোর বলে গালাগাল দেয়। এরপর সেই লোক আবার জাদুকরের কাছে এসে সকলের জন্য আংটি ছোঁয়ার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করে যাতে সব্বাই ভালো হয়ে ওঠে। জাদুকর বলে, তা অসম্ভব। সে কারণ জানতে চাইলে জাদুকর স্পষ্ট বলে, “কেননা খেলতে আসার জন্য আমি প্রতিদিন যে স্বপ্নটা দিই, অধিকাংশ মানুষের বেলায় ওটা আবার আমিই ভুলিয়ে দিচ্ছি।”

আসলে এই গল্পে জাদুকর ঈশ্বরেরই প্রতীক। তিনিও নিজস্ব নিয়মে বন্দি। তিনি প্রত্যেককে ইচ্ছেমতো বাঁচার পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেও নিজে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারেন না। অথচ দেবর্ষির ঈশ্বর মানুষকে ত্যাগ করেও যান না।

একটা হত্যা কীভাবে আত্মহত্যায় পর্যবসিত হল, সেই বাঁকসমৃদ্ধ উত্তরণের আখ্যান ‘আত্মহত্যা’— ‘গল্পকুঞ্জ’ গ্রন্থটি থেকে আলোচিত প্রথম গল্প। খুন করবে বলে শ্যামকে নদীপাড়ে নিয়ে আসে দীনু আর নারান। মুখ-হাত বেঁধে, কাদায় শুইয়ে শ্যামকে তৈরি করা হয়। শ্যাম বাধা দেয় না। তারিণীর অপেক্ষায় ওরা। সে কোদাল আনবে। কুড়ুল এনেছে নারান। তারিণীর দেরি, নারানের অস্থিরতা আর তাড়াহুড়োহীন বিষণ্ণ দীনুর মাঝে অবিরাম বৃষ্টি আর শ্যামকে নিয়ে ন্যাকড়ানেকড়ি চলতে থাকে। চলতে থাকে তাকে নিয়ে আশু করণীয় কৃত্যালোচনাও— তারিণী না এলে কী করবে, সে-ভাবনাও ভেবে রাখে ঘাতকের দল। বলিপ্রদত্ত শ্যাম বউ-মেয়ের কথা ভাবতে থাকে। সাত বছরের মেয়ে পুতুলের মুছে যাওয়া পায়ের ছাপের কথা মনে পড়ে তার। সে গল্পকারের দর্শন মোতাবেক ভাবে ‘জগৎ থেকে জিনিস একে একে হারায় কিন্তু কারও মনে থেকে যায়’। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় শ্যামের নানান শারীরিক অস্বস্তি হয়। এরমধ্যে বৃষ্টি-বিষাদে আক্রান্ত দীনু হঠাৎ শ্যামকে ছেড়ে দিতে চাইলে নারান তীব্র আপত্তি করে। দীনু যুদ্ধাগত এক ক্লান্ত সৈনিকের কথা মনে করে যে ভেবেছিল ‘যাদের সে মারল, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে তারা একদিন আপনিই মারা যেত। তাহলে তার কৃতিত্বটা কোথায়”। বড্ড বিড়ম্বনাময় দার্শনিক প্রশ্ন! এভাবেই কি ‘জগতের প্রতিটি হত্যা অন্যদের একটু মানবিক করে দিয়ে যায়!’ শ্যামও মৃত্যু-বিষয়ক নানান ভাবনায় জারিত হয়। সে ভাবে “হত্যা করার পর থেকে হত্যাকারীকে আজীবন পেছনদিকে তাকিয়ে হাঁটতে হয়”। এর মাঝেই তারিণী চলে আসে। জোগাড় চলতে থাকে। শ্যাম ভাবছে, সে তো মরে যাবে কিন্তু বেঁচে থাকতে সে জীবনকে জড়িয়ে যা যা করত ওরাও তাই করবে। এই আকস্মিক ভাবনায় এক দুর্বোধ্য, বেদনার্ত, প্রগাঢ় ভালোবাসার উপলব্ধিতে আচ্ছন্ন হল সে। শেষ মুহূর্তে নারান যখন তার মাথার ওপর কুড়ুলটা বাগিয়ে ধরে শ্যাম মুখবাঁধা অবস্থায় চিৎকার করে বলতে চায়, “নারান, থামো থামো! নিজেকে হত্যা কেন করছ গো?”

শ্যামকে হত্যা করলে আকণ্ঠ বেঁচে থাকার যে-নিঃসীম আনন্দঘন ব্যাপারস্যাপার তাকেও তো হত্যা করা হবে। তাই সে নিবৃত্ত হতে বলে হত্যাকারীদের। আবার এমনটিও ভাবা যায়, কাউকে হত্যা করলে হত্যাকারীর অন্তর্জ্বালা তাকে আজীবন পিছু ছাড়ে না— তা সে যতই লুকোনোর দুশ্চেষ্টা করুক না কেন। কেন-না বাস্তবত সব শেষ হয়ে গেলেও স্মৃতিতে থেকে যায় সবই। ব্যক্তির কিংবা ঈশ্বরের।

‘নিষিদ্ধ ধর্ম’ গল্পে উত্তম পুরুষের বক্তা কোনো এক স্বপ্নঘোরে এসে পড়েছে এক অচেনা শহরপথে। সে শুনেছে এখানে প্রায় দেড়শো বছর আগে এমন একজন জন্মেছিলেন যিনি ঈশ্বরের উপস্থিতি বিষয়ে না বলে তিনি যে কোথাও অনুপস্থিত নন সেটাই যুক্তিযুক্ত ঢঙে বোঝাতেন। তাঁর যুক্তিমতে জগতের সমস্ত উপাসনালয় অর্থহীন। দীর্ঘলালিত ধারণা-বিরোধী এই ভয়ংকর মতবাদে ক্ষিপ্ত শাসক ও মৌলবাদীরা তাঁর প্রাণদণ্ড দেয় যখন তাঁর বয়স মাত্র তিরিশ। বক্তা হাঁটছে আর তার চোখে পড়ছে মানুষের বানানো কিছু উপাসনাগৃহ যার সিলিংগুলো আকাশসমান আর আকাশের চেয়েও বিচিত্র। এক-একটি অভূতপূর্ব স্থাপত্যের নিদর্শন। পথেই এক বৃদ্ধের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ এবং সে তার অন্তর্গত কৌতূহল নিরসনে বৃদ্ধের সঙ্গ নিল। বৃদ্ধ খানিক ভীত, সন্ত্রস্ত। সেই অলীক মানুষটি সম্পর্কে খোলামেলা কেন, গোপনে আলোচনা করাও নিষিদ্ধ। শাসকের টহলদারের সতর্ক দৃষ্টি সর্বত্র। তবু্ও বৃদ্ধ আগন্তুককে তার বাড়ি নিয়ে গিয়ে সব বলল যা সে পরম্পরাগতভাবে জেনে এসেছে। সেই নির্নিয়মী অচিন্ত্য মানুষটি শুধু যে উপাসনালয়ের প্রয়োজনহীনতা বোধ করতেন তাই নয়, ঈশ্বরকে পুজো করা, তাঁকে পাওয়ার জন্য কোনো অবতারের অনুগামী হওয়া বা কোনো তীর্থক্ষেত্রে যাওয়া, সবই অদরকারি, অহেতুক বলতেন। মূলত যা দরকার তা হল “শুধু একটু স্মরণ করা যে জগতে তিনি আছেন”। সারাজীবনে অন্তত একটিবারের জন্য সান্দ্রতাপূর্ণ উপলব্ধি। তাতেই তাঁর সঙ্গে সৌহৃদ্য স্থাপিত হয়ে যাবে। কিন্তু মজা হল, এমন সরল, অনাবিদ্ধ নীতি সাধারণ মানুষের পছন্দ হল না। তারা ভাবল “এত জটিল একটা জগতের স্রষ্টা নিজে এত সহজলব্ধ হতে পারেন না”। আবার উলটো দিকে এই সহজিয়া চিন্তার কারণেই তাঁর বিস্তর অনুগামী তৈরি হয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই তিনি শাসক ও মৌলবাদীদের কোপানলে পড়লেন। তাঁকে বেঁধে গুলির আদেশ দেওয়া হল, গুলি চলল কিন্তু সে-সব তাঁর দড়িতে লেগে তিনি ছিঁড়ে পড়লেন। জনতা খুশি হল। তারা চাইল তিনি শাসককে বলুন যে, স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর মৃত্যু চান না। ঈশ্বরের অলৌকিকতায় বিশ্বাসী নন বলে তিনি তা বলতে রাজি হলেন না। কেন-না, তাঁর মতে, এতে ঈশ্বরের স্বসৃষ্ট নিয়মের লঙ্ঘন ঘটে। যাইহোক, দ্বিতীয় বারের হত্যা-হুকুমও ব্যর্থ হল। কাজ হল তৃতীয় বারে। এইসব কথা চলছে ঘরমধ্যে। বাইরে দু-জন সৈনিক তাদের বার্তালাপ শুনে ঘরে ঢুকে বৃদ্ধকে গ্রেপ্তার ও হত্যার কথা শোনায়। আগন্তুক নিজের ঘাড়ে দোষ নিয়ে বৃদ্ধকে মুক্তি দিতে বলে। দুই সেনা বলে, একটি শর্তেই তারা তাকে মুক্তি দিতে পারে যদি সে তার বক্তব্যের সঙ্গে আরও একটি তথ্য জুড়ে দেয়— তা হল, যে-পাঁচজন সৈনিক সেই প্রাজ্ঞ মানুষটিকে হত্যা করার জন্য নিযুক্ত হয়েছিল, এরা দু-জন তাদেরই একজনের বংশধর। বিদায় নেবার আগে একজন বলে, “মনে মনে আমরাও তাঁর অনুগামী”; তাদের বিশ্বাস “একদিন সবাই তাঁর অনুগামী হবে। তখন আর গোপনে নয়, প্রকাশ্যে।”

আপ্লুত, বিমোহিত আগন্তুক সে দেশেই থেকে গেল। হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবছিল, “এই আশ্চর্য উপাসনালয়গুলো একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। অবশ্য তাতে ঈশ্বর গৃহচ্যুত হবেন না… কারণ, ততদিনে প্রতিটি মানুষ নিজেই এক একটা উপাসনালয় হয়ে গিয়েছে।”

এ-গল্পের প্রোটাগনিস্ট এমন এক মানুষ যার রয়েছে সত্যিকারের কৌতূহল, জ্ঞানতৃষ্ণা এবং গভীর বেদনাবোধ। গল্পকারের দর্শনে প্রতিটি মানুষ যখন উপাসনালয় হয়ে উঠবে তখন তার মধ্যে কোনো বিগ্রহ থাকবে না। থাকবে শুধু এক মনস্বী উপাত্ত উপলব্ধি যে, ঈশ্বর আছেন।

আমার অষ্টম আলোচ্য গল্প ‘ধ্বংসদর্শন’— এক অলীক দর্শন যা আচ্ছন্ন চেতনায় বিশেষ অনুভবে জেগে থাকে, থেমে যায় কালপ্রবাহ, জগতের গতি হয়ে যায় স্থির, সম্মোহন-বিমোহিত। হয়তো চরম কিছু ঘটতে চলেছে কেননা জাগতিক প্রাত্যহিকতায় সূর্যের উদয়াস্ত থমকে গেছে, থেমে গেছে নদীস্রোত, বাতাসের চলন; স্তব্ধ হয়েছে পশুপাখির ডাক-ডুক। কথা শুধু মানুষের মুখে। বিশ্ব-ধ্বংসের ভাবনায় কেউ-বা উচ্ছ্বসিত— চিৎকৃত কান্নায় মুখর হচ্ছে তারা। কেউ কেউ ধ্বংস-বিষয়ক ভবিষ্যদ্‌বাণী করছিল, বলছিল, “সব কিছুই যেহেতু আগুন থেকে সৃষ্ট তাই সব কিছুই আবার আগুন হয়ে যাবে।” একজন বলল, শূন্যতার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পৃথিবী চুরমার হয়ে যাবে, কারণ, “শূন্যতাও কোনও কঠিন পদার্থের মতো হয়ে যাবে”। সবই যেন তারা স্বপ্নে দেখেছে।

গল্পকথকের এ-রায় পছন্দ হল না। তার মতে “এ রকম ধ্বংস অর্থহীন নিষ্ঠুরতা বা খামখেয়ালি পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়”। হয়তো এই আশু সর্বাত্মক ধ্বংসের ফলে সকলেই মারা যাবে, কঙ্কালেরও অস্তিত্ব থাকবে না— নতুন জগৎ নির্মিত হবে। তখন বর্তমান অস্তিত্ব, স্মৃতি সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে— এটা বিশ্ববিধাতার কোনো মহৎ উদ্দেশ্য হতে পারে না। কেন-না “মানুষ ধ্বংস সহ্য করতে পারে। কিন্তু যা পারে না তা হল অর্থহীন ধ্বংস সহ্য করতে”। অথচ সকলেই যেন শান্তভাবে মেনে নিয়েছে এই অর্থহীন ধ্বংসলীলা।

এমন ভাবনাব্যাকুল মুহূর্তে একজনকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। নাম জিজ্ঞেস করাতে সে বলে, “আমি নিজেই জানি না। তবে মানুষ আমাকে ঈশ্বর বলে সম্বোধন করে।” এতে কারো কোনো ভাববিকার দেখা গেল না। জগতের অন্তিমকালে ঈশ্বর মানুষকে দেখা দেবেন এতে অবিশ্বাসের কিছু নেই। আবার এই দর্শনের স্মৃতিও তো মুছে যাবে। ঈশ্বর তা জেনেই দেখা দিয়েছেন। অন্তর্গত অক্ষম অভিযোগ নিয়ে হঠাৎই সকলে হিংস্র পশুরূপ ধারণ করে ঈশ্বরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কথকও চাইল, অবিরাম অভিশাপ আর বিদ্রূপবাক্যে ঈশ্বরকে ক্ষতবিক্ষত করতে। অবশ্য কেউই চিরন্তন ঈশ্বরভীতি বা সৌজন্যের খাতিরে তাঁর গায়ে হাত তুলল না।

কথক এবার তীব্র ব্যঙ্গোক্তিতে ঈশ্বরকে বিঁধে বলল, “জগতে তুমিই একমাত্র স্রষ্টা যার ভেতর ক্ষমতা আছে কিন্তু যুক্তিবোধ একমুঠোও নেই।” এক বয়োবৃদ্ধ বলল, “এটা খুবই দুঃখের যে মানুষের মস্তিষ্কের ভেতর তুমি যুক্তির জ্ঞানটা দিলে, অথচ বাস্তবে ওই জ্ঞান চরিতার্থ করার কোনও সুযোগ রাখলে না… তুমি একজন কাণ্ডজ্ঞানহীন, খামখেয়ালি পাগল স্রষ্টা।” অবিকার ঈশ্বর হেঁটে চললেন। অন্যরা তাঁকে অনুসরণ করতে লাগল। অবিচল ঈশ্বরকে দেখে অসহায় কথকের মনে হল “যে ভাষায় ঈশ্বরকে সমালোচনা করা যায় মানুষ হয়ত সে ভাষা জানে না। ফলে ঈশ্বর হয়ত মানুষের প্রার্থনার ভাষাও কখনও বুঝতে পারেননি”। কিন্তু আক্রমণ জারি থাকল। ঈশ্বরের মুখোমুখি হয়ে কথক বলল, “যদি একদিন সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্নই করবে, তবে সৃষ্টি কেন করেছিলে আমাদের?” এরপর তীব্র রোষে সে ফেটে পড়ল, “আমরা তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি… একদিন তুমি ভয়ঙ্কর আতঙ্কগ্রস্ত হবে তোমার সৃষ্টি নিয়ে, যার চিহ্ন তোমার স্মৃতি ছাড়া আর কোথাও থাকবে না।” এই প্রথম “ঈশ্বরের দৃষ্টিতে করুণা, ঠোঁটে অসহায় বিষাদ। তিনি হঠাৎ মুখ হাঁ করলেন এবং বড় হতে হতে তাঁর হাঁ-টা সমস্ত জগতেই বিস্তৃত হয়ে গেল”। অনেকটা বিশ্বরূপ দর্শানোর মতো। ধীরে ধীরে সমস্ত কিছু তাঁর হাঁ-এর মধ্যে ঢুকে গেল। শুধু সূর্যটা একই জায়গায় থাকল কেন-না সূর্য না থাকলে ব্রহ্মাণ্ডের অন্ধকার দূর করবে কে! এভাবে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হবার আগে কথক সময়ের অস্তিত্বহীনতার মাঝে অনুভব করল, সে টিকে আছে, অর্থাৎ, সে অস্তিত্বহীন হয়নি।

অতলান্ত তৃপ্তি ও শান্তিতে আচ্ছন্ন ‘আমি’-র চেতনায় স্বপ্ন ও বাস্তবের ভেদরেখা অন্তর্হিত এই দুঃসাহসী আখ্যানে। সমস্ত ধ্বংসের মাঝেও টিকে থাকার স্বরাট উপলব্ধি কার্যত ঈশ্বর সম্পর্কে এক অক্ষীণ সংশয়ী ভাবনা; অস্তিত্ব ও চেতনার অপরাজেয় অবস্থান বিষয়ে এক অসংশয়ী উপলব্ধি এই ফ্যানটাসিতে চমৎকার ধরেছেন গল্পকার। এ এক মৌল অনুভব, ঈশ্বরের এক নবমিথ নির্মাণ।

বর্তমান আলোচনীয় গল্পাবলির মধ্যে আকারে সবচেয়ে ছোটো ‘লীলার বিস্ময়’ গল্পটি কিন্তু বিস্তারে বিপুল। প্রথম চোটেই মনে হতে পারে এখানে ‘লীলা’ কারও নাম। আসলে তা নয়। লীলা এখানে কোনো ব্যক্তি নয়— ঈশ্বরের ঈশ্বরত্ব বলা যায় আর বিস্মিত তিনি স্বয়ং কেন-না তিনি এমন বিশেষ কিছুর সন্ধানে বেরিয়েছেন যা হারিয়ে ফেলেছেন। না, তেমন বস্তুগত কিছু নয়; হারিয়েছেন নিজস্ব সত্তাকেই যা খুঁজতে বেরিয়ে অনুসৃত হচ্ছেন এক ধড়-মুণ্ডহীন দানোর দ্বারা। সে-বেচারা ঈশ্বরকে তার বিশাল হাতের ফাঁদে আটকে তাঁর কৃপাপ্রার্থনা করছে, দানোযোনি থেকে মুক্তি পেতে; আর তাহলেই সে ঈশ্বরকে হারানো বস্তু ও পথের সন্ধান দেবে। বিস্মিত পাঠকেরাও— কে কার কৃপাপ্রার্থী। যাইহোক, হত্যার মাঝ দিয়ে দানোকে মুক্তি দিয়ে ঈশ্বর লক্ষ্যস্থলের দিকে এগোতেই এক ব্যাকুল বৃদ্ধার কাতর আকুতি। সেও ঈশ্বরদর্শনের অপেক্ষায় নৈবেদ্য-উপচার সাজিয়ে দীর্ঘকাল প্রতীক্ষারত। ঈশ্বর তার কাছেও পরবর্তী পথের দিশা জানতে চাইলেন। আপ্লুত বৃদ্ধা মিনতিপূর্বক বলল, যাবার আগে ঈশ্বর যেন তাকে পরম সত্যের রহস্যটা বলে দিয়ে যান। ঈশ্বরও বৃদ্ধার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে এগোতে থাকেন। আবারও পাঠক বিস্মিত হন, কে কার কৃপাপ্রার্থী, তা ভেবে।

এই অপার বিস্ময়ের শুরু বাল্মিকীর ঈশ্বর-জীবনী (এখানে শ্রীরামচন্দ্র!) লিখে ফেলার সূত্র থেকেই; এবং সেই জীবনীর কাহিনি অনুসারে ঈশ্বর “বেশ কিছুকাল মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকলেন”। কিন্তু কীভাবে? শ্রেষ্ঠ বিস্ময় সেখানেই। তা হল “এভাবে মানুষের মধ্যে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার সময় ঈশ্বর, যেহেতু তিনি সর্বশক্তিমান, নিজের ঈশ্বরত্ব সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন”।

আসলে এখানেই ঈশ্বরের অধরা অবতারত্ব খর্ব হয়ে তিনি যে তাঁর সৃষ্ট মানুষদেরই একজন, সেটাই প্রকট করে গল্পকার ঈশ্বরকে মানুষের মাঝে মানুষ রূপে নামিয়ে এনেছেন— রাবীন্দ্রিক ভাবনার সঙ্গে প্রভূত মিল। তিনি যে অধরা, অজ্ঞেয় কেউ নন, তিনি যে আমাদেরই একজন এবং তিনি যে তাঁর ক্ষমতাবলে নিজেকেও ভুলে যেতে পারেন— সেটাই এখানে বিস্ময়কর প্রতিপাদন। সুফিবাদেও ঈশ্বরের সঙ্গে এমনতর নৈকট্যের আভাস প্রতিভাত।

আলোচনার দশম তথা শেষ গল্প ‘শয়তানলিপি’ যা আহৃত হয়েছে দেবর্ষির ‘নির্বাচিত গল্প’ থেকে। ঈশ্বর যে শুধুই ভালোমানুষ গড়েন না, মানুষের চেহারায় দুষ্ট শয়তানও গড়েন ও সৃজনের সামঞ্জস্য রক্ষা করেন সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এই গল্প-বুনন। এই ভিন্নতর আখ্যান চার ভাগে বিভক্ত।

প্রথম ভাগে নিদ্রাহীন, নামহীন চরিত্রের অস্থির উসপিসানি। সে বিছানা ছেড়ে উঠে জানালায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায় “কিন্তু টান দিতেই জিভ ও নাকে এল পচা দুর্গন্ধ”। বিরক্ত হয়ে জ্বলন্ত সিগারেট ছুড়ে ফেলতেই তা রাস্তায় রাখা প্রতিবেশীর গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে ভিতরে পড়ে ও যথারীতি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। সে দ্বিতীয় সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে “কাকতালীয় চান্স, আকস্মিক ঘটনা”— এসব নিয়ে ভাবতে থাকে। এবার খানিক এগিয়ে ভাবে “এ রকম আকস্মিক ঘটনা থেকেই জগতের সৃষ্টি”। আকস্মিকতার হেরফের হলে জীব-জগৎও অন্যরকম হত। আকাশের রং হয়তো সবুজ হত। এর মধ্যেই গাড়িটার ভিতর থেকে ধোঁয়া উঠছে। অপরাধবোধে সে একবার জল নিয়ে গিয়ে তা নেভাতে চাইছে, আবার ভাবছে “গাড়িটা পুড়ে গেলেই বা ক্ষতি কী?” অর্থবান লোক। আবার একটা কিনে নেবে। মানুষের স্বভাবজ হিংসা প্রবৃত্তি বক্তাকেও গ্রাস করেছিল কিন্তু সেই ঈর্ষা কীভাবে জয় করতে হয় তা সে ভেবে পায় না। এমন অক্ষমতার ভাবনাই তার মধ্যে এক মতবাদের জন্ম দেয়। তা হল “যা কিছু ঘটছে তার সবই আগে থেকে নির্ধারিত ছিল”। সূর্য-চন্দ্রগ্রহণ, বেঁটে-লম্বা সবই— “ঈর্ষাপরায়ণের ঈর্ষার জ্বালা পাবারই কথা”। এতাবৎকালের ঘটনাপরম্পরা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। তাই গাড়ি-বিষয়ক তার বিবেকদংশন ঠিক নয়। সুতরাং সে নির্দোষ।

এরপর সকালবেলায় গাড়ি পোড়ার ব্যাপারে হইচই শুরু হলে এবং তা নিয়ে সেও জিজ্ঞাসিত হলে এই দুষ্কর্মের জন্য আধ-পাগলা কোনো অনামী ভিখিরির ওপর দোষ চাপিয়ে সে মুক্ত হয়। কিছুদিন পর এক ঝড়বাদলের দিনে রাস্তায় অপেক্ষারত সস্ত্রীক তাকে সেই গাড়ির মালিক ভদ্রতাসূচক লিফ্ট দেয়। আগুন লাগার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ভদ্রলোক বলেন, “কেউ ইচ্ছে করেই লাগিয়ে দিয়েছিল।” হঠাৎ সে জানতে চায়, “মানুষকে কি আপনার একটা শুয়োরের বাচ্চা বলে মনে হয় না?” ঠিক সেই মুহূর্তে চলন্ত গাড়ির সামনে একজন এসে গেলে ভদ্রলোক জোরসে ব্রেক কষেন। গল্পের এই ভাগ শেষ হয়। নিজেকে গুপ্ত রেখে অথবা বাঁকাপথে উন্মুক্ত করে বক্তা যা বোঝাতে চেয়েছিল এই পথচারী সেই সংজ্ঞায় আরোপিত হয়ে যায়।

দ্বিতীয় ভাগে কয়েকজন বন্ধু অধিকরাতে বার-এ বসে মদ্যপান করছে। হঠাৎ এক মধ্যবয়সি অদ্ভুত চাউনির লোক সেখানে ঢুকে এ-টেবিল ও-টেবিলে তাড়া খেয়ে ওদের টেবিলে বসে আর বলতে থাকে, “আপনাদের উঁচু উঁচু বাড়ির সভ্যতার মুখে আমি পেচ্ছাব করে দিই। আপনাদের রংবেরঙের গাড়ির সভ্যতার মুখে আমি পেচ্ছাব করে দিই। আপনাদের সুন্দর জামাকাপড়ের সভ্যতার মুখে আমি পেচ্ছাব করে দিই। আপনাদের এত কাজ ও ব্যস্ততার সভ্যতার মুখে আমি পেচ্ছাব করে দিই।” কেউ প্রতিবাদ না করায় লোকটা বারকয়েক একই কথা গলা চড়িয়ে বলে গেল। বন্ধুদের মধ্যে যে ধনী ও রাগী ছিল সে হঠাৎ ওকে ঠেলে বলল, “বাইরে চল, পেচ্ছাব করবি।” তাকে মানব সভ্যতার শত্রু ভাবল এরা। ম্যানেজার মজা দেখে মুচকি হেসে বলল, “ব্যাটা অনেক বই পড়েছে। আগে কবিতাও লিখত।” এরপর ওরা ওকে বাইরে এনে বলে, “কর দেখি কত পেচ্ছাব করবি।” লোকটা এবার অনুনয়ের সুরে বলে, “বিশ্বাস করুন, বেঁচে থেকে একদম শান্তি পাই না। তাই ওরকম বললাম।” যাইহোক, শেষ অব্দি ওকে দিয়ে যখন পেচ্ছাব করানো গেল না তখন সেই রাগী শয়তান বন্ধুটা “নিজের প্যান্ট খুলে লোকটার মুখে পেচ্ছাব করতে লাগল”। এ-দৃশ্যের স্মৃতি অনেক পরেও বক্তার মধ্যে হাসির উদ্রেক করেছে।

তৃতীয় ভাগে একদল আলোচনা করছিল “বিশ্বযুদ্ধের পর ঈশ্বর পৃথিবীতে এলে তাঁকে কী কী ফেরত দিতে পারে। সমুদ্র, পাহাড়, অরণ্য, মরুভূমি, ভূগর্ভস্থ লাভা, ধানহীন মাঠ, রাতের অন্ধকার, আদিম নির্জনতা, মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব— সাধারণভাবে এগুলোই ঈশ্বর, যুদ্ধের পরও অক্ষত অবস্থায় ফেরত পেতে পারেন”। এবার প্রোটাগনিস্ট এক বিশেষ বস্তুর উল্লেখ করল। “অফুরন্ত নরকঙ্কাল”। নানান বয়সের, নানান মাপের, নানান ধর্মের কঙ্কাল জোগাড় করে ঈশ্বর “মাথার মাঝখানে গর্ত হয়ে যাওয়া খুলিগুলোয় টবের মতো করে ফুলের চারা লাগাতে পারেন”। সেগুলো দিয়ে আরও অনেক প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারেন। পৃথিবী পুরস্কার হিসেবে এই নরকঙ্কালগুলো ঈশ্বরকে দেবে কেন-না এক সময় “মানুষ নামক একটা জীব সৃষ্টি করতে তিনি আশ্চর্য সফল হয়েছিলেন”। এখানে কি বিদ্রূপের ঢঙে ঈশ্বর-সৃষ্ট মানুষকে বা স্বয়ং তাঁকেই গল্পকার শয়তান বললেন!

চতুর্থ তথা শেষভাগে কুয়োর জলে সিংহের প্রতিচ্ছবি দেখার সেই পরিচিত গল্পটিকে পালটে দিয়ে গল্পকার বললেন, সিংহটা আসলে জানত যে জলের ছায়া তারই। কিন্তু তাকে আক্রমণ না করে সিংহের উপায় ছিল না, কেন-না সে পশুরাজ। আর “প্রকৃত রাজা শৌর্য ও ক্ষমতায় এতই একক থাকতে ভালবাসে যে নিজের ছায়াকেও সহ্য করে না”।

এমন রাজা হওয়ার সাধ এই বক্তাও ছোটোতে পোষণ করত। এই গল্পেও সিংহের ঈর্ষান্বিত শয়তানি প্রকটিত।
মূল আলোচনার এখানেই ইতি। গল্পকাঠামোয় একটা লক্ষণীয় বিষয় হল, অন্তত প্রথম দিকের গল্পে তাঁর অনুসৃত অনাবশ্যক বর্ণনা বা শব্দজঞ্জাল-বিষয়ক সুনীতি কিংবা সংক্ষিপ্ততার রীতি লঙ্ঘিত হয়েছে যদিও সামগ্রিকভাবে তাঁর গল্প-উপন্যাসের পরিসর পাঠকের বিরক্তি উদ্রেককারী নয় মোটেও। বানান সম্পর্কিত পূর্বতন রীতি নতুন সংস্করণে সংশোধিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। যাইহোক, দেবর্ষির গল্পের অনেক পাঠকেরই ঈশ্বর-বিষয়ক আলোচনার একঘেয়ে পুনরাবৃত্তিজনিত অনুযোগ লক্ষ করা যায়। আসলে চালু পথে না হেঁটে সুসন্নদ্ধ ফ্যানটাসি-আধারিত প্রেক্ষিতে জীবনের মূল্যবোধসমূহের পুনর্বিবেচনার যে তেউড়ে অথচ সরল পথে তাঁর চংক্রমণ তথা পদচারণ তা অনেকের কাছেই উদ্ভট ঠেকে। তাঁর গল্পে ধ্বংসের বর্ণনা থাকলেও তা ধ্বংসপ্রবণ নয়, রূপকল্পময় হলেও তা রঙ্গ-রূপকথা নয়। আত্মসৌরভের অন্তর্লীন বিচ্ছুরণ থাকলেও সেখানে আত্মবিনাশের কথা নেই। বরং তা আত্মদীর্ণতার শিল্পিত বয়ান। তাঁর গল্পে চেতনা প্রসারণের জাগরতনু সুযোগ বর্তমান। জীবন যখন অকার্যতায় বিক্ষুব্ধ, বিভল, আক্রান্ত মানুষ যখন আমর্ম হতাশায় খিন্ন ঠিক তখনই দেবর্ষির গল্প তাকে বরফগুঁড়ি প্রশান্তির সন্ধান দেয়। তাই আমার উচ্চণ্ড বিশ্বাস আজ সেভাবে না হলেও একদিন তাঁকে পড়তেই হবে; ছুঁয়ে দেখতে হবে সেই পারদসুলভ মৃগনাভিকে যা অত্যুজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে বাস্তবতা-আক্রান্ত পাঠকের মনে বুনে দেবে এক অজ্ঞাপনীয় স্বপ্নবীজ।

জীবনানন্দ হয়তো সেই রোমাঞ্চন-মুখরতা থেকেই লিখেছিলেন: “তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,/পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,/মানুষ রবে না আর, রবে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখন।”

তথ্যসূত্রসম্ভার:
১) ‘লেখকের জবান’, অসীম রায়।
২) পঃ বঃ বাংলা আকাদেমির মুখপত্র ‘বাংলা বই’ (জানুয়ারি, ২০১৬)।
৩) সংশয়ীদের ঈশ্বর, আহমদ মোস্তফা কামাল, ‘এবং পরব’, প্রথম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা।
৪) ‘নাস্তিকের গীতাঞ্জলি, আবু সয়ীদ আইয়ুবের ভাবনায়’, আলোচক, রণজিৎ দাশ, ‘চতুরঙ্গ’, বৈশাখ-আশ্বিন, ১৪১৬।
৫) ‘দেবর্ষি সারগীর গল্প’, রবিন পাল, ‘এবং মুশায়েরা’, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ১৯৯৯।
৬) ‘বাংলা সাহিত্যের কলম্বাস’, নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, দমদম জংশন।
৭) ‘গল্পকুঞ্জ’, দেবর্ষি সারগী, প্যাপিরাস।
৮) ‘রাজার জ্ঞানতৃষ্ণা’, দেবর্ষি সারগী, সুবর্ণরেখা।

Facebook Comments

পছন্দের বই