লেখক নয় , লেখাই মূলধন

বিশ্বদীপ চক্রবর্তীর গল্প

দংশন

বাগানের ঘাসগুলো এখনও ভেজা। ভোরের শিশির নয়, বাগানের মাঝে মাঝে রাখা স্প্রিনক্লারগুলো সকালের আলো ফোটার আগেই জল ছড়িয়েছে খুব। হোস্টাস, ব্লু বেল আর অ্যানিমোনের সদ্য ফোটা পাপড়িগুলোয় জল টলমল করছে। পেরিয়ে যেতে যেতে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে রুমির। বিশেষ করে অ্যানিমোনের ঝুঁকে পড়া গোলাপি পাপড়িতে। হয়তো সেই ইচ্ছেটা শরীরে সামান্য চাঞ্চল্য জাগায়, না থাকা পায়ের কড়ে আঙুলটা একটু ঝুঁকে পড়ে বাঁ-দিকে। মৈনাকের দেখতে পাওয়ার কথা না, তবু কী করে বুঝল কে জানে! মাথা ঝোঁকাল রুমির কানের কাছে, ফুল তুলে দেব তোমায় ক-টা?

মৈনাকের এই সময়ে বেরোনোর তাড়া থাকে। এরপর ইন্টারস্টেটে বড্ড ভিড়। অফিসের ব্যাজ বুকে, কাঁধে ল্যাপটপ ঝুলিয়ে এই সময় হন্তদন্ত হয়ে বেরোত মৈনাক। রুমির যাওয়া থাকত আরও এক ঘণ্টা বাদে। রুমি মৈনাকের গলায় সেই ব্যস্ততা চাইছিল। নিস্তরঙ্গ অবয়বের অভ্যন্তরে কুয়ো খুঁড়ে খুঁড়ে খোঁজার প্রচেষ্টায় সেটাই মনে করিয়ে দেয়, তোমার দেরি হয়ে যাবে না?

মৈনাকের গলা ব্রিয়সে বানের মতো নরম। হাসিটাও। সকালবেলা বাগানে বসে তোমার সঙ্গে কফি খাওয়াটা সারাদিনের জন্য টনিকের কাজ দেয়।

বাব্বা, কথায় কী মাখন! কই আগে তো বসতে না। রুমি জানে। রুমি বোঝে এত নরম কথা, এটা ভালোবাসার উষ্ণতা নয় কিছুতেই। দয়া। পবিত্র, শীতল।

বাগানের অনেকটা জুড়ে হিকরির ডালপালা ছড়ানো। তার ঠিক নীচেই লোহার টেবিল, দু-দিকে মুখোমুখি দুটো চেয়ার। অনেক সাধ করে রুমি কিনেছিল, কিন্তু এতদিন ব্যবহার হত না সেরকম। রুমির কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মৈনাক হুইল চেয়ারটা টেবিলের অন্য দিকে লাগিয়ে দিল। টেবিলের উপর কফির পট, দুটো কাপ, দুধের পাত্র, একটা প্লেটে কফি কেক আর ব্লু বেরি স্কোন রেখে গেছিল আগেই। মৈনাক চেয়ার টেনে লম্বা দুই কাপে কফি ঢেলে রুমির কফিতে দুধ মেশায় মন দিয়ে। নিজের কফিতে দুধ খায় না কোনোদিনও।

রুমির কোলে টপ করে একটা বাদাম পড়ল। গাছের তলায় এই সময় অনেক বাদাম পড়ে। যদিও এগুলো বিটারনাট, তেতো। ওদের জন্য অখাদ্য। কিন্তু কাঠবেড়ালিদের আনাগোনা লেগেই থাকে। কফিতে প্রথম চুমুক দেওয়ার আগেই এক জোড়া কাঠবেড়ালি ছুট্টে চলে গেল মৈনাকের পায়ের তলা দিয়ে।

দেখো, তোমার কুমড়োপটাশ গুড মর্নিং বলতে চলে এসেছে সকাল সকাল।

এই কথাটা রুমিকে আর গোমড়া থাকতে দিল না। পরিচিতির তৃপ্তি মুখে ছড়িয়ে বলল, না, না এরা কুমড়োপটাশ না। কুমড়োর চোখটা লালচে, একেবারে অন্য রকম। ওরা আমাকে দেখলে পালায় না কক্ষনো।

ওরে ব্বাস, তুমি তো ওদের উপরে তোমার বশীকরণ মন্ত্র চালিয়েছ দেখছি। মৈনাকের গলা থেকে হাসি উঠে এল। দিন দিন ওরা আমার কম্পিটিটার হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

মানে? ভ্রূ কুঁচকে তাকাল রুমি।

হাসিটাকে তবু ধরে রেখে রুমির চোখে চোখ রাখল মৈনাক, আমি সব সময়েই জানি তোমার চোখে জাদু আছে। মনে নেই, মা বিয়ের পরে পরে মেজোমাসিকে বলেছিল আমার ছেলেটাকে কী মন্ত্র যে পড়িয়েছে, শুধু বউয়ের কথায় ওঠে বসে। তুমিই তো শুনতে পেয়ে আমাকে বললে। তখন সে কী রাগ তোমার।

আগেও মৈনাক এরকম কথা বলেছে আর ওরা দু-জনে সেই নিয়ে কত হাসাহাসি। এখন শুধুই রুমির বাঁ-পায়ের হাটুর নীচে চুলকানি পায়। কিন্তু চুলকানো কিংবা হাত বোলানোর কোন উপায় না থাকায় মুখটা বিরক্তিতে কুঁচকে ওঠে। কফিতে হালকা চুমুক দিতে দিতে মৈনাক চেয়ে থাকে, রুমির মুখের আলো ছায়ার কারণ জানতে পালটা প্রশ্ন করে না। বরং এই সময়ে ছুরি দিয়ে কফি কেক স্লাইস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বেশি বেশি। রুমির মুখের রেখাগুলো একটা একটা করে মুছে গেলে এক খণ্ড কেক ধরে রুমির মুখের সামনে। অপেক্ষা করে থাকে রুমির পাতলা ঠোঁটের আড়াল পেরিয়ে মুক্তোদানা দাঁতের ফাঁক হওয়ার জন্য। রুমি মুখ যতসম্ভব চেপে মৈনাকের চোখে চোখ বিঁধিয়ে প্রশ্ন করল, আচ্ছা আমার একটা পা না হয় নেই, কিন্তু হাত তো আছে। নিজে খেতে পারি না?

কোনো কার্পণ্য না করেই হাসল মৈনাক। সেটা তো আমাকে খাওয়ানোর জন্যে।

আমাকে এত বেশি বেশি ভালোবাসছ কেন মৈনি? আমার বাঁ-পাটা কাটা গেছে বলে?

এই প্রশ্নটা তো প্রথম শুনল না। তাই কেক ধরা মৈনাকের হাত একটুও কাঁপল না। মৈনাক রুমির চোখ থেকে চোখ না সরিয়েও দৃষ্টিটা ছড়িয়ে দিল। রুমির চুলে জড়ানো দুলহীন কানের লতি, গলায় না বলা শব্দের ওঠানাবা, ঠেলে আসা কণ্ঠার হাড়, পেস্তা সবুজ ছোটো হাতা টি শার্ট যার বুক জোড়া অ্যান আরবার ম্যারাথন ২০১৮ লেখাটা কালো সাদা চেক ফ্লানেলের পাজামার নেতিয়ে পড়া বাঁ-পায়ের সঙ্গে অহেতুক কৌতুক জুড়েছে— এই সমস্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে মৈনাকের চোখ রুমির অন্তঃকরণে ঢুকতে চাইছিল। থেমে থেমে যখন বলল, আমি তোমাকে আনতে যেতে পারতাম, যাইনি। তাই দোষটা আমার ছিল বলে ভাবতেই পারো। কিন্তু ভালোবাসা ক্ষতিপূরণের অঙ্ক কষে হয় না রুমি। কথাটায় গোপন কৃষ্ণ গহ্বরের আলগোছ টান। তাই তাড়াতাড়ি মুখের হাসিতে নতুন কথা মেশালো মৈনাক, তোমার বাঁ-পাটা সত্যি তো যায়নি, তুমি তো ওর নড়া চড়া বেশ টের পাও এখনও।

ডক্টর হিল তো বলে ফ্যান্টম লেগ। না থেকেও রয়ে গেছে। নতুন পা লাগানোর পরেও থাকবে কী না কে জানে! কবে লাগাবে ওরা?

রুমির প্রস্থেটিক্স লেগ তৈরি হয়ে গেছে, কিন্তু হাঁটুর তলাটা পুরোপুরি সেরে না ওঠা অবধি দেবে না। তিন মাস তো হয়ে গেল, দেখো আর ক-দিন। ডক্টর হিল তো ছ-মাসের কথা বলেছিল। বলতে বলতে মৈনাক উঠে দাঁড়িয়েছে। এবার ঝুঁকে পড়ে রুমির গালে হালকা চুমু এঁকে দিল। রোদ উঠে গেলে ঘরে চলে যেও কিন্তু। না হলে মুখ পুড়ে যাবে একদম।

হিকরির ছায়া অনেক দূর ছড়ায়। তাছাড়া রুমি হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছায়া খুঁজে নিতে পারে চাইলেই। কিন্তু মৈনাক গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া অবধি টেবিলের পাশ থেকে একটুও নড়ে না রুমি। মৈনাকের গাড়ি এখন ছুটবে ইন্টারস্টেটের গতিময়তায়, মৈনাক দেখতে দেখতে সেঁধিয়ে যাবে একটা কর্মব্যস্ত দিনের পেটের ভিতর। রুমির দিন আস্তে আস্তে সরতে থাকবে রোদের সঙ্গে। রুমি হাতের স্কোনের বাকিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল বাগানের ঘাসে। একটু বাদে গিয়ে তুলে গার্বেজ বিনে ফেলতে হবে আবার। নোংরা একদম সয় না রুমির।

ক-দিন আগে রুমিরও একটা ছোটার জীবন ছিল। মৈনাকের থেকেও বেশি। সেরকমই এক ব্যাস্ত দিনের শেষে এয়ারপোর্ট থেকে ফিরছিল। নতুন কিছু নয়, সপ্তাহে দুই একবার তাকে তো যেতেই হত। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই ইকোরস রোডে এমনভাবে অ্যাকসিডেন্টটা হল। তিন মাস হয়ে গেছে, তবু ভাবলেই ভয়ে ভিতর থেকে চেপে ধরে। বাগানের চেয়ারে বসেও সিঁটিয়ে যায় রুমি।

সেদিন একটু বেশিই টায়ার্ড ছিল, খুব সকালের ফ্লাইটে ফ্লোরিডা গেছিল। ফোনে মৈনাক বলল, আমি আসব তোমায় নিতে? মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল, তার হয় ওরকম মাইগ্রেনের থেকে। কিন্তু গাড়ি পারকিং-এ, সেটাই-বা কি করে হয় বলে রুমি না করে দিয়েছিল। মৈনাক যদি আর একটু জোর করত সেদিন! কেন করলে না মৈনাক?

এইসময় কাঠবেড়ালিটা আবার দৌড়ে এল। এবার কুমড়োটা। থমকে দাঁড়িয়ে লালচে চোখে জুলজুল করে চেয়ে আছে রুমির দিকে। রুমি হাতের কাছে বিটারনাট খুঁজে খুঁজে রাখে ওর জন্য, কে জানে তাকেই গাছ বলে ভাবছে কী না! গলার মধ্যে হাসল রুমি। হাত ঘষটে টেবিলের উপরে রাখা বিটারনাটগুলো থেকে দুটো তুলে নিল, চোখ সরাসরি কুমড়োর চোখে। কাঠবেড়ালির কি পলক পড়ে না? না কি রুমিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে থাকে মৈনাকের মতো? এটা ভাবতেই নিস্তরঙ্গ সকালে দুষ্টুমি ছড়িয়ে পড়ল। আরও ঘন চোখে তাকাল কাঠবেড়ালিটার দিকে। কাঠবেড়ালির দুটো চোখ থাকে দু-দিকে, নিজের দৃষ্টিতে বেঁধে ওদের চাহনি ঠিক কপালের মাঝখানে আনার চেষ্টা করল রুমি। তারপর দুই হাতের বিটারনাট কুমড়োর দুই দিকে ছুঁড়ে দিয়ে চোখের ইশারা করল ডান দিকে। কী আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গে কুমড়ো মাথা ঘুরিয়ে ছুটল ডান দিকে!

ও কি সত্যিই ওর ইশারা বুঝতে পারল? সেকি কাঠবেড়ালি ট্রেন করতে পারছে? পারুক না পারুক সকালবেলার স্নিগ্ধতা বেড়ে গেল নিঃসন্দেহে। এই কথাটা রসিয়ে রসিয়ে বলেছিল মৈনাককে সন্ধ্যাবেলায়। ও হাসতে হাসতে বলল, বলেছিলাম না তোমার চোখে জাদু আছে। তুমি বাঁ-দিকে ছুঁড়ে ডান দিকে যেতে বললেও যেত ঠিক।

ধ্যাৎ, তাই আবার হয় না কি?

মুখে বললেও পরের দিন সকালে কথাটা বিনবিনিয়ে উঠল রুমির মাথায়। দেখি না কি হয় ভাব নিয়েই আজকে কুমড়োর জন্যে একটা বিটারনাট হাতে নিয়েছিল রুমি, চোখের ইশাড়ায় বাঁ-দিক দেখিয়ে ডান দিকে গড়িয়ে দিয়েছিল এবার। রুমির শরীরে একটা আনন্দের স্রোত কুলকুল করে বয়ে গেল যখন বোকা কাঠবেড়ালিটা ছুট্টে চলে গেল বাঁ-দিকে। কিছুক্ষণ বাদে লেজ তুলে ফিরে এল। ওর চাহনিতে তখন কেমন বোকা বোকা ভাব, যেন বলছে ঠকালে কেন? ওকে তখন কোলে তুলে গুচুম গুচুম করতে ইচ্ছে করছিল রুমির।

সত্যিই কি তার চোখ? না কি মনের থেকে কোনো তরঙ্গ সিঁধিয়ে যাচ্ছে কাঠেবেড়ালির মাথায়। কুমড়ো কি তার মনের কথা বুঝতে পারে? এইসব ভাবতে ভাবতে ডেকেই ফেলল একবার। প্রথমে আস্তে, ফিসফিস করে, তারপর জোরে। কুমড়ো কুমড়ো! ও যখন সত্যি লেজ তুলে দৌড়ে এল খুশির থেকেও অবাক হল বেশি। ওকে তো আগে কখনো ডাকেনি, ওর এই নাম নিয়ে মৈনাকের সঙ্গে আলোচনা করেছে শুধু। তাহলে ও রুমির কথা বুঝতে পারে? ওর লালচে চোখে চোখ রেখে বলল এবার, কোলে আয় কুমড়ো। রুমির ডান হাতের পাতা বাড়ানো ছিল ডান হাটুর উপরে। তার উপর ভিজে পায়ের ছাপ ফেলে এক লাফে কোলে চলে এল রুমির। কী নরম হয় ওদের শরীর, ঘন রোমের মধ্যে হাত চালাতে চালাতে বিস্ময়ে জেরবার হচ্ছিল রুমি। একটা কাঠবেড়ালি তার কথা বুঝতে পারছে? সেটা কি শুধু কুমড়ো বলে, ওর কোনো বিশেষ ক্ষমতা আছে? না কি সে-ক্ষমতা আসলে রুমির? যে-কোনো কাঠবেড়ালিই কি বুঝতে পারবে তার কথা? মনে হতেই এবার গলা ছেড়ে ডাক দিল পটাশ, পটাশ! পটাশ এমনিতে লাজুক, এমন কিছু গা ঘেঁষাঘেঁষি করে না কুমড়োর মতো। কিন্তু রুমিকে অবাক করে দিয়ে ছুটে এল পটাশও। দুই কাঠবেড়ালি কোলে নিয়ে কী বকবক করছিল রুমি সে কি নিজেই জানে?

শেষ পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই