লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনুপম মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পর্ণমোচী’ নিয়ে লিখছেন শানু চৌধুরী

অনুপম, পর্ণমোচী ও খসাজল

ধরুন syllogism অনুযায়ী তিনটে বৃত্ত আঁকলাম। প্রথম বৃত্তটি প্রেম, দ্বিতীয় বৃত্তটি যৌনতা ও তৃতীয় বৃত্তটি রাজনীতি। তাহলে দেখতে পাব তিনটি  বৃত্তের মধ্যবর্তী অংশটি অঙ্গাঙ্গীভাবে, ছুৎমার্গহীনভাবে জড়িয়ে আছে সমাজ নামের একটি বিরাট বৃত্তের কোলে। ‘পর্ণমোচী’–র দৃষ্টিকোণ এটাই। ‘পর্ণমোচী’ তার সোশ্যাল বক্তব্যগুলিকে ছুঁড়ে দিয়েছে পাঠকের কাছে এবং বলতে চেয়েছে এই হলো মোহ এবং ক্রাইসিসের জাল। এবার পাঠক ওই জালটির প্রতি কতটা প্রতিক্রিয়াশীল ছিঁড়ে বেরোতে বা ব্যবহারিক প্রয়োগে তার দায়ভার পাঠকের নিজের হাতেই। দহের বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে লেখক বলে দিচ্ছেন জীবন, মহাজীবন ও অতিজীবনের ফলময়রূপ। বলতে চাইছেন সমাজ আজও জাতি-গোত্রের সীমা, অসীমকে encroach করতে অক্ষম।

শৈলীগতভাবে বিশ্লেষণ করলে উপন্যাসটি দৃশ্য-উপন্যাস নয় কেবলই, প্রিয় মিলনদৃশ্য বর্ণনাই এর মূল বিষয় নয় এই মিলনদৃশ্যের বর্ণনার ভারসাম্যের মাঝে রক্ষিত হচ্ছে স্রোত ও আলেয়ার একটি ঝিনুক। যে ঝিনুকে আমরা লেখকের দেখার রকমফের টের পাব, একইসঙ্গে তিনি নিজেকে উদ্ভাবকের ভূমিকা থেকে গুটিয়ে নেন এবং আবির্ভূত হন ‘অনুপম’ নামে। অনেকটা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘চতুস্কোণ’ উপন্যাসের প্রোট্যাগনিস্ট রাজকুমারের চরিত্রে নিজেকে বসিয়ে। কিংবা মহাভারতে যেমন ব্যাসদেব নিজেই এক চরিত্র। কাফকার গল্পে কাফকা নিজেই এক চরিত্র বা গোদার নির্মিত চলচ্চিত্রে গোদার অভিষিক্ত করেছিলেন নিজেকেই।  যে স্বতোৎসারিত। যে নিজের সাথে নিজের মোলাকাতটিকে ছাড়তে চাইছেন না। আদতে আমার মনে হয় ‘পর্ণমোচী’ ভাঙতে চেয়েছেন Bogus Dogma-গুলিকেই। সবশেষে একটাই কথা বলবার এই উপন্যাসটির ফর্ম ও content-এর একটা নিজস্ব গতি আছে কিন্তু এসব বাহ্যিক। আসল বিষয়টি হল philosophical view যা অনেক লেখকের হাজার হাতের গল্পে আজকাল হারিয়ে যাচ্ছে।

এবার আসি প্লটের ভিত্তিতে। অনুপম বলেন প্লটবিহীন উপন্যাস বিংশ শতাব্দির আভাঁ গার্দের শৌখিনতা। অনুপম প্লটে আস্থা রাখেন। আস্থা রাখেন একটা চরিত্রের সামাজিক ভূমিকায়। ‘চোদনপারের আলো এবং অন্ধকার…’ এইখানে অসীম যেই লাথিটা খেল, এটাই একটা আদ্যন্ত স্যাটায়ার। সামাজিক মৌনতার বিরুদ্ধে এক হাত নেওয়া যাকে বলা চলে। রবীন্দ্রনাথ একটা কথা বলে গিয়েছেন আগে সত্যনিষ্ঠ হতে হয়, তারপরে সৌন্দর্যনিষ্ঠ। ঠিক এই সৌন্দর্যনিষ্ঠার পথকেই লেখক চিকিৎসকের মতন নির্মূল করে আগুয়ান হয়েছেন সত্যনিষ্ঠতার absolute expression-এ। অর্থাৎ অসীমের লাথিটা খাওয়ার প্রকৃত বর্ণনায় লেখক দিয়েছেন ভদ্রসমাজের বিকার ও কৃত্রিমতায় তাঁর নিজেরই প্রখর লাথিটা। মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অবনমন ও জাগ্রত মিথ্যেকে চাগিয়ে তোলা যখন প্রচণ্ডরকমের বিতর্কিত বিষয়, ঠিক তখনই এই দৃষ্টিভঙ্গি যেন সাজিয়ে তোলে নিজের স্বীকারোক্তি। যেন অনুপম বলছেন সংস্কার বা ভাবপ্রবনতার ধার আমি ধারি না।

 

‘টু ফাক অর নট টু ফাক’ পরিচ্ছেদে আবার যখন স্বয়ং অনুপম বলছেন ‘আমার জীবন নিজেই তো হাঁ হয়ে দেখছে আমাকে! আমি যাই কোথায়!’ তখন তিনি বিচলিত। ‘কেন’ নামক শব্দের কাঠগড়ায়। যেখানে নিজেই সমাধান করেছেন নিজের জৈববৃত্তির প্রকাশ উপন্যাসের অন্তর্বয়নে। ‘ইমোশন’কে জলে ঘুলে খেয়ে যে সীমা ও অসীমের পথ তৈরি করেছে। এই তার অন্বিষ্ট অনুসন্ধান। উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে ঋজু রেখেছেন আবেগের পুরোপুরি বাইরে দাঁড়িয়ে এবং খাঁড়িপথ পেরিয়ে দাঁড়াচ্ছেন নিজ নামের কোনও এক মনীষীর খোঁজে। অনুপম অসীমকে একটা নিরপরাধ ব্যক্তি বলে বিবেচিত করছেন এবং পরমুহুর্তেই দোষী ঠাওরে দিচ্ছেন বক্র-কুটিল সময়ের আলেয়ায় ভিজে যাওয়া ছেলেটিকে এবং কোনও এক প্রশ্নের প্রেরণাতেই নিয়ে যাচ্ছেন নিজেকে ও লাগেজ হিসেবে কবিদের চরিত্রের এক ভাবলেপন টানাপোড়েনে। আবার ‘২২১ বি বেকার স্ট্রিট’ অধ্যায়ে তিনি নিজেকে পরামর্শদাতা লেখক বলে পরিচয় দেন। শার্লক হোমস কেস আসার পূর্বে যেরকম উদাসীন, তিনিও তাই। কিন্তু ; যখনই কেউ জীবনের জটিল গূঢ়-তত্ত্ব নিয়ে আসে তাঁর কাছে, তখন সে যেন একা রাষ্ট্র হয়ে ওঠে নিজেই। যে সীমাকে দুরন্ত, বলিষ্ঠ, খেয়ালী যাযাবর হতে বাধা দেয়। সে বেঁধে দিতে চায় অসীম নামে দ্বন্দ্বসংশয়, দ্বিধান্বিত, আত্মজিজ্ঞাসু এক সত্তার সাথে।

এইখানে। ঠিক এইখানেই যখন ‘সংসার সীমান্তে’র পাশাপাশি ‘সীমা কী জওয়ানি’র মতো শব্দ বসে যায় তখন তার বর্ণনারীতি বা তার রিচ্যুয়ালস কতটা নির্মোহ ও বাস্তববাদী তার আভাস আমরা পেয়ে যাই। সীমা ও অসীমের মাঝে যে লাইফ ফোর্স এবং তাদের যে দ্বন্দ্ব তা ক্ষয়িত হতে শুরু করে এই জায়গা থেকেই।

 

যথারীতি তার আগের অধ্যায়ে হায়না সুন্দরী বলে সীমাকে যখন ব্যক্ত করা হচ্ছে তখন যাবতীয় আচারকে নস্যাৎ করে এক চাঁড়ালের মেয়ের (সীমা) যোনিপথের ভাঁজে শালগ্রাম শিলা যেন দেবত্ব অর্জন করছে। এটা কষ্টকল্পনা নয়। এক ভঙ্গুর বিবেকের অর্জিত পৃথিবী। আমি ব্রাহ্মণের ছেলে। আমি জানি নারায়ণ পূজার উপাচার, কীভাবে চন্দনের ফোঁটা দিতে হয়। নারায়ণের সেবা করতে হয়। কিন্তু; ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতাকে আলাদা রেখে ভাবলে আজও এক বায়বীয় চিন্তা আমাদের মাথায় ঘোরে। তাহলো শালীনতার পর্দা টেনেই শালীনতার প্রশ্ন তোলা কাঁহাতক সঠিক? আর এই প্রশ্নচিহ্নটিই সারা উপন্যাস জুড়ে ঘুরতে থাকে। যা লেখক বলতে চেয়েছেন, চিৎকার করে বলতে চেয়েছেন। এবং এর মূল বিষয় বাস্তবতা ও তার ধারা। এবং তা আসতে পারে কল্পনা নামের ছাল চামড়া জড়ানো শরীরে।

 

‘দিন আর রাতের কবিতা’ নামক অধ্যায়েই লেখক বলছেন বিস্ময় আর কৌতূহলের সীমা ছাড়িয়ে সত্যি মিত্থায় জড়ানো জগত। মিথ্যারও মহত্ত্ব আছে। ঠিক মানিকীয় কায়দায়। ‘অনুপম কেমন আছেন’ এই কথাটির আড়ালেই রয়েছে শেষ অবধি তাঁর প্রাণচাঞ্চল্য। সরাসরি প্রেম ও যৌনতার সুত্র নির্মাণে তিনি সচেষ্ট হননি বরং অনুপ্রবেশ করেছেন অভিজ্ঞতা ও অসহায়তার চরম ছবিটি আঁকতে। যেখানে সীমা ও অসীম দুজনেই মান্যতা দিচ্ছেন তাদের রিক্ততাকে। এবং অনুপম মেলাতে চাইছেন অস্থিরতার এক অঙ্ক অনুপম নামেরই এক বাধ্য ও উপন্যাস জুড়ে প্রতিনিধিত্ব করা এক চরিত্রের সাথে। তারপর… গোটা আটটি পাতা জুড়ে এক ফ্ল্যাশব্যাক। যা আদৌ ফ্ল্যাশব্যাক নয়। তিনি স্বয়ং মনে করিয়ে দিতে চাইছেন  উপন্যাস পূর্বের কিছু আদিকথা একজন সংবাদদাতা হিসেবে। ‘রশোমন’ বা ‘গ্রামের নামটি মায়তা’-র এই ভুলভাঙা, সামাজিক আত্মছলনাকে চূড়ান্ত চপেটাঘাত করে। অনন্ত আলেখ্য, লাভ-ক্ষতি বুঝে নেওয়া একজন বিদগ্ধ ও পাল্টা স্রোতে নিজের কর্মফলে সাময়িক অনুতপ্ত পার্টি ওয়ার্কারের মেয়ের (সীমা) জটিলতার খোলনলচে উপড়ে ফেলে।

 

সর্বশেষ যেটা বলবার থাকে— ‘পর্ণমোচী’ নিজের প্রতিশ্রুতি নিজেই ভেঙেছে। তার এই কর্মসূচীকে রূপ দেওয়ার জন্য যে কাঠামোর প্রয়োজন, সেই কাঠামো ছেলে ভোলাবার নয়। এই উপন্যাস এক মডেল তৈরির প্রস্তুতির রিয়েল ও ইনভার্টেড ইমেজ  হতে পারে বলেই বিশ্বাস করি।

 

Facebook Comments

পছন্দের বই