লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ভাইরাল গায়িকা রাণু (মারিয়া) মণ্ডল

গৌতম চট্টোপাধ্যায়

“রাণু কোনোদিন কারোর কাছেই গান শেখেননি। তার হারমোনিয়াম ছিল না, বাজাতেও শেখেননি। শুধুমাত্র মেধা, স্মৃতি, কর্ণ ও কন্ঠ সম্বল করে তিনি রেডিও-রেকর্ড-টেপে পরিবেশিত গান পড়শিদের বাড়িতে অথবা পথচলতি শুনে শুনে শিখেছেন। রাণুর মাসি বলেছেন সে নাকি রাস্তার ছুটে যেত মাইকে বাজানো গান শুনতে।”

 

রানুর ব্যাপ্টিজমের নাম হয় মারিয়া। সেটা সম্ভবত কৃষ্ণনগর চার্চ-এ কারণ, সেখানেই জন্মেছিল রাণু সম্ভবত ১৯৬৫ সালে। অনুসন্ধানে জানা যায় যে, রাণুর ঠাকুরদার নাম ছিল বসন্ত রায়, বাড়ি ছিল ফরিদপুরে। বাবার নাম ছিল আদিত্যকুমার রায় এবং মায়ের নাম সুলেখা (মল্লিক)। এই দম্পতির প্রথম পুত্রসন্তান মারা যাবার পরে জন্ম রাণুর। কপাল পুড়তে থাকে সুলেখার, স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে চলে আসেন নদিয়ার রাণাঘাট-সন্নিহিত বেগোপাড়ায় বোন শান্তা বিশ্বাসের বাড়িতে। সেখানেই বড়ো হতে থাকে রাণু মণ্ডল।

আজ যাকে নিয়ে নেটিজেনরা বেশ অনুপ্রাণিত, যাকে কেউ বলেছেন মৈমনসিংহ স্টেশনের অনামী গায়িকা, কেউ বলেছেন রাণাঘাট স্টেশনের গায়িকা রাণু বিশ্বাস, কারোর কাছে সে ভবঘুরে কারোর কাছে ভিক্ষুক! কিন্তু রাণাঘাট স্টেশনের ৫নং প্ল্যাটফর্মের চা-দোকানি শিবু বা অন্যরা সবাই বলেছে রাণু কারোর কাছে কিছু চায় না, শুধু হাসে আর গান গেয়ে যায়। ২০১৮ থেকে ১৯ পর্যন্ত একই পোশাক পরা (ওপরে কুর্তি আর নীচে বার্মুডা) রাণুর গান ভাইরাল হচ্ছে। ভালো খবর, নিস্তরঙ্গ রাণাঘাট তবু উত্তাল হোলো!

এই গায়িকার গান প্রথম ভাইরাল হয় ২০১৮ সালের ২৫ মে, বেগোপাড়ার ‘শয়তান ক্লাব’-এর রূপেশ মণ্ডল ‘লাইভ’ গাইয়েছিলেন রাণুকে— রাণু দারুণ গেয়েছিলেন হিন্দি গান “বন্দে-মাতরম”, “কুছ ভি কহো, কুছ ভি না কহো”, “আয় মেরে বতন কি লোগোঁ” সহ আরেকটি গান আর যেটি ৩১,৪৭,১০৪জন দেখেছিলেন। পরেরদিন ২৬মে ফেসবুকে “কপাল- FOREHEAD” পেজে পোস্টটি দিয়েছিলেন কুব্রা সেতু নামে একজন। ভিডিও করেছিলেন Humayun Khan বলে উল্লেখ ছিল। রাণু গেয়েছিলেন “কুছ ভি কহো” সহ আরেকটি গান। সেটি আবার শেয়ার করেছিলেন রূপেশ মণ্ডল ও ভিকি এলেক্স মণ্ডল। ঐদিনই “এবেলা ডট ইন” নামের ই-নিউজ পেজে “পথবাসী মহিলার কণ্ঠে অসামান্য গান! ভিডিও আদল কিনা বিতর্ক তুঙ্গে” শিরোনামে সংবাদ পরিবেশিত হয়। সংবাদ থেকে জানা যায় যে, ১) ‘ফিলমি জগত’ নামের একটি ফেসবুক পেজে শেয়ার হওয়ার সাথে সাথে হৈচৈ পড়ে যায়, এবং ২) ইতোমধ্যে শেয়ার ছাড়িয়েছে ৭৪০০০।

রাণু (মারিয়া) মণ্ডল এক অত্যাশ্চর্য স্বভাবগায়িকা—যিনি নিজে স্বীকার করেছেন বারবার আর তার মাসি শান্তা বিশ্বাস সহ গ্রামবাসীরাও বক্তব্য সমর্থন করেন যে, রাণু কোনোদিন কারোর কাছেই গান শেখেননি। তার হারমোনিয়াম ছিল না, বাজাতেও শেখেননি। শুধুমাত্র মেধা, স্মৃতি, কর্ণ ও কন্ঠ সম্বল করে তিনি রেডিও-রেকর্ড-টেপে পরিবেশিত গান পড়শিদের বাড়িতে অথবা পথচলতি শুনে শুনে শিখেছেন। রাণুর মাসি বলেছেন সে নাকি রাস্তার ছুটে যেত মাইকে বাজানো গান শুনতে।

যৌবনে রাণু রাণাঘাটের “থ্রি-স্টার অর্কেস্ট্রা”-র টিমেও যুক্ত হয়েছিলেন, গান গেয়েছিলেন বহু অনুষ্ঠানে। থ্রি-স্টারের একদা-গায়ক কপিল রায় মনে করতে পারলেন যে বছর পঁচিশেক আগে যখন রাণু গাইত, তখন কপিল গাইত না কিন্তু তার গান বহুবার শুনেছে, সেও গুণমুগ্ধ!

একদিকে সীমাহীন দারিদ্র্য, যত্নহীনতা অন্যদিকে শুধুমাত্র গানকেই জীবনের ধ্রুবতারা করে রেখেছিলেন রাণু। এরকম সময়ে তার বাবলু মণ্ডলের সঙ্গে বিয়ে হয়। বাবলু একটা লজঝরে ভ্যানরিক্সা চালিয়ে যাইহোক উপার্জন করত। তাদের দু’টি সন্তান হয়— অমিত ও সাথী।

রাণুর মাসি জানান যে, এরকম সময়ে সংসার নিয়ে বাবলু বম্বেতে চলে যান এবং সেখানে জুহু বীচে ‘সান এন্ড স্যান্ড’ হোটেলের কাছেই প্রখ্যাত অভিনেতা “ফিরোজ খান”-এর বাড়িতে ‘কুক’-এর কাজ নেন। সেখানে কীভাবে কাটছিল তাদের জীবনের পরের অধ্যায় মাসির জানা নেই।

এরপর বাবলুর জ্যেঠতুতো ভাই দীনেশ (জজু) মন্ডল এর সঙ্গে ঘর বেঁধেছিল রাণু। তাদেরও দু’টি সন্তান জন্ম নেয় — ছেলে দুরান আর মেয়ে মেঘা। এটা রাণুর কাছেই শোনা।

কয়েক বছর পর সম্ভবত জজুর অত্যাচারের ফলেই প্রথম দুই সন্তানসহ রাণু কলকাতার পার্ক সার্কাসে তার মাসির কাছে চলে আসে। তখনই প্রথম রাণুর মানসিক চিকিৎসা করানো হয় NRS হাসপাতালে। কিছুদিন পরে রাণুর মাসি তাঁর বেগোপাড়ার বাড়িতে রেখে যান রাণুদের।

২০১৮ সালে প্রথমবার রাণুর গান ভাইরাল হয়েছিল এবং সেটা বেগোপাড়ারই “আমরা সবাই শয়তান” ক্লাবের সদস্যদের তৈরি ভিডিও-র সুবাদে। কিন্তু সেবার এত সদর্থক উদ্যোগ দেখা যায়নি!

এই বছরে আবার ২০ জুলাই-এ রাণাঘাট স্টেশনে বসে আপন মনে গাইতে থাকা রাণুর গান ভিডিও করেন অতীন্দ্র চক্রবর্তী। “আকাশ প্রদীপ জ্বলে” ও “ কঁহি দূর যব দিন ঢল যায়ে” গান দুটি ভাইরাল হয়। ২৩ জুলাই-এর “এক পেয়ার কী নগমা হ্যায়” গানটির ভিডিও ভাইরাল হয় (প্রায় ১৫০০০ লাইক ও ২১০০০ শেয়ার)। গায়িকার নাম লেখা হয় রাণু বিশ্বাস।

এইবার শুরু হয়ে যায় উদ্যোগ। প্রায় সব প্রিন্টেড ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে। এহেন সময়ে ১ আগস্ট তারিখে আমি বাসবীর শেয়ার করা একটি পোস্ট পাই যেখানে পরিচয়ে বলা হয়েছে রাণাঘাট স্টেশনের রাণু বিশ্বাস। অব্যবহিত পরে পাই তসলিমা নাসরিনের পোস্ট যেখানে দাবি ছিল মৈমনসিংহ স্টেশনের অনামী গায়িকা। দুটিই আমি ‘রাণাঘাট ইন নিউজ’ পেজে শেয়ার করি।

৩রা অগস্ট দেবাশীষ ঘোষ, রিম্পা দাস, ও সস্ত্রীক আমি রাণুর বাড়ি যাই ঘণ্টাতিনেক নানা কথা ও গানএর ভিডিও করে ফেসবুকে শেয়ার করি। দেখা যায় সেগুলিও ভাইরাল হচ্ছে। ফেসবুকে এমনিতে বেশি ভিউ/ লাইক/ শেয়ার পাই না কিন্তু এই ভিডিওগুলো শুধুমাত্র রাণুর গুনেই ভাইরাল হয়েছে এমনকি ইউটিউবেও! আমরা উপলব্ধি করি যে, স্থানীয় “আমরা সবাই শয়তান” ক্লাবের দেবদূতেরাই রাণুকে খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নিজের পোস্ট ভাইরাল হচ্ছে ভেবে যে দেবদূতেরা আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন তারা কেউই রাণুর পাশে সহায়তার হাত বাড়াননি! আমাদের পক্ষ থেকে দু’টি নতুন পোশাক, শুকনো খাদ্য, চাল-ডাল পেয়ে রাণুর মুখে ফুটে ওঠে সলাজ হাসি। এক পোশাকেই তাকে এতদিন থাকতে হয়েছে তাই স্নান পর্যন্ত করতে পারে না। কলকাতা থেকে এসেছিলেন স্বপ্না সাহা নামের এক মানবী যিনি রাণুকে খাদ্য ও ফলের জন্য এক হাজার টাকা দিয়ে গেছেন। পরের দিন রাণাঘাটের সুগায়িকা কমলিকা চক্রবর্তী আরেক গায়িকা রাণুকে প্রণামী দিয়ে এসেছেন চার হাজার টাকা।

এই আমরাই ভিডিও ভাইরাল হলে পাই আত্মশ্লাঘা, মিডিয়ার উপার্জন ও TRP বাড়ে কিন্তু গায়িকা রাণু মণ্ডল’! তার জন্য থেকে যায় অসীম শূণ্যতা, সদাহাস্যমুখ আর কণ্ঠভরা প্রাণের গান!!!

Facebook Comments

পছন্দের বই