লেখক নয় , লেখাই মূলধন

মুক্তিপ্রকাশ রায়ের গল্প

দাগ

অমল গোমড়া মুখে বসে ছিল। দেওয়ালে একটা হিজিবিজি দাগের দিকে তাকিয়ে। দেখলেই বোঝা যায় কোনো বাচ্চা প্যাস্টেল হাতে ইচ্ছেমতো ইকড়ি-মিকড়ি কেটেছে। আধুনিক কোনো সমালোচকের কাছে অ্যাবস্ট্রাক্টস চিত্রকলা হিসেবে এর কদর হতে পারে; মন্ত্রীরাও আজকাল এই জাতীয় ছবিটবি আঁকছেন— তাঁদের তো আবার তিন আঁচড়ে দশলাখ। কিন্তু আপাতত অমলের কাছে এটা জাস্ট অসহ্য। আর কিছু নয়। আজকাল ঘর রং করা কি কম খরচের ব্যপার? রক্ত-জল করা পয়সা দিয়ে ক-দিন আগেই রং করা হয়েছে ঘরটা। নিজের রক্ত দিয়েই রং করেছে বলা চলে। অবশ্য দেওয়ালের রংটা ফিকে গেরুয়া। রক্তের মতো লাল নয় আদপেই। তবু, ওই বলার জন্য বলা আর কি।

বিবেকানন্দ ও অবিশ্যি বলেছিলেন, জন্মালে একটা দাগ রেখে যাওয়া কর্তব্য। তবে, সে-দাগ এ-দাগ নয় নিশ্চয়ই। অন্তত অমলের তাই বিশ্বাস। এইরকম দাগ তো হল গিয়ে কলঙ্ক। চরিত্রে দাগ লেগে যাওয়ার মতো। ও পাড়ার শিবু মাস্টারের যেমন। শিক্ষক হয়ে সে কিনা মদ খায় ! সন্ধেবেলা ছেলেছোকরা অনেকেই দেখেছে শিবু মাস্টার অফ-শপে লাইনে দাঁড়িয়ে মদ কিনছে ! ছ্যাঁ ছ্যাঁ ছ্যাঁ ছ্যাঁ। ইফ ক্যারেক্টার ইজ গন, এভরিথিং ইজ গন।

একটা জ্যান্ত দাগের মতো দেওয়ালের টিউবলাইটের পাশ দিয়ে চলে গেল নাছোড়বান্দা ল্যাজকাটা টিকটিকিটা। অবশ্য যাওয়ার সময় অমলের চিন্তাকে টিক টিক করে সমর্থন জানিয়ে গেল।
অমল নিজের চরিত্রের মতোই আশপাশের জগতটাকে, মানে তার নিজের চার দেওয়ালের পৃথিবীটাকে, নির্মল রাখতে চায়। দেওয়ালগুলোকে সে বড্ড ভালোবাসে। অবসরে এই পরিচ্ছন্ন দেওয়াল দেখে দেখেই তার কত সময় কেটে যায়। ক্লিনলিনেস ইজ নেক্সট টু গডলিনেস। বন্ধুরা অবিশ্যি এজন্য তাকে ঘরকুনো বলে। কিন্তু, অমল জানে, বাইরের জগতটা ভদ্রলোকের উপযুক্ত নয়। তাদের বাড়ির সামনের মাঠটা অবধি, সন্ধে হলেই, চলে যায় তাসুড়েদের দখলে। তারা যে-ভাষায় বার্তালাপ করে, তাতে মনে হয় বেশ্যা পাড়ায় বাস করছে অমল। দেওয়ালগুলো অন্তত তাকে বাইরের এই নোংরা জগতের থেকে আড়াল করে রাখে। শুঁয়োপোকা নিজের চারদিকে একটা দেওয়াল তুলতে পারে বলেই তো একদিন প্রজাপতি হয়ে ওঠে !
তো, এত সাধের দেওয়াল যদি কেউ নোংরা করে দিয়ে যায়, মাথায় খুন চেপে যাবে না মানুষের? কাজটা কে করে থাকতে পারে সে-সম্বন্ধে একটা ধারণা অমলের আছে। পাশের বাড়িতে ঝিমলি বলে একটা বাচ্চা আছে। রঘুদার মেয়ে। নির্ঘাত সে-ই কালপ্রিট। যখন তখন ধিতিং ধিতিং করে এসে হাজির হয়। অমলের মায়ের খুব ন্যাওটা। মা-ই যে লাই দিয়ে দিয়ে ওকে মাথায় তুলেছে— এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যা ইচ্ছে তা-ই করে মেয়েটা। এই ফ্রিজ খুলে যা পাচ্ছে মুখে ভরে দিচ্ছে, তো এই পোষা বেড়ালের ল্যাজ ধরে টানছে। কারো কিছু বলার জো নেই। অমলের বইখাতা লণ্ডভণ্ড করার কর্মসূচিও তার পছন্দের তালিকায় ছিল। এখন ওকে আসতে দেখলেই অমল নিজের ঘরে তালা দিয়ে দেয়। আগেরবার ঝিমলিকে বকেছিল বলে মা একেবারে গরিবের রাজা রবিনহুডের মতো রে রে করে তেড়ে এসেছিল— ঘরে বাচ্চাকাচ্চা থাকলে ওরকম একটু করেই। তুই আর কী বুঝবি!

মায়ের ইঙ্গিতটা হল, বিয়ে করেনি বলে অমলের মনে শিশুদের জন্য কোনো স্নেহ, ভালোবাসা, বাৎসল্য ইত্যাদি নেই। অর্থাৎ, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তাকেই দায়ী করা। আরে বাবা, স্নেহ এক জিনিস, আর অন্ধভাবে বাচ্চাদের বাঁদরামি সহ্য করা আর এক ব্যাপার। কিছু ন্যাকাষষ্ঠী বাবা-মাকে দেখে অমলের ইচ্ছে করে ঠাস ঠাস করে চড় কষাতে। ধরা যাক, একটা বিয়েবাড়ি… সবাই ব্যস্ত। এর মধ্যে কিছু ডারউইন তত্ত্বকে সঠিক প্রমাণ করা বাচ্চা নরক গুলজার করে বেড়াচ্ছে। একে-ওকে ধাক্কা দিচ্ছে, খাবারদাবার উলটে ফেলছে, অন্য কোনো বাচ্চাকে সিঁড়ি থেকে ঠেলে ফেলে দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছে, দোতলা থেকে একতলার বা রাস্তার কারো গায়ে থুতু দিচ্ছে; আর তাদের বাবা-মা ছদ্ম গাম্ভীর্য নিয়ে শাসনের ভান করছেন— অ্যাইইইইই! এবার ভীষণ বকব কিন্তু!

বাচ্চাও জানে, এসব ফাঁকা আওয়াজ। তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে নষ্টামি করে যায়।

অমলের এসব সহ্য হয় না বলেই সে বিয়ে টিয়ের দিকে আর যায়নি। সে বিবেকানন্দের বইটই পড়ে। ছিমছাম, ঝাড়া হাত-পা থাকে। কয়েক বছরেই সে দিব্যি বুঝতে পেরে গেছে যে বিয়ে আসলে একটা নোংরা ব্যাপার। তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ এখন সামনের দেওয়ালে। এত সুন্দর করে রং করা একটা ঘর। একটা আশ্রম-আশ্রম ভাব। সেটা কিনা এইভাবে…
আর ভাবতে পারছিল না অমল। এই বিষয়ে বেশি চিন্তা করেও বিপদ যথেষ্ট। গতমাসে পাড়ার ক্লাবে ফ্রি হেলথ চেক-আপ করতে গিয়ে তার ব্লাড প্রেশার বিপদসীমার কাছাকাছি ছলাৎছল করতে দেখা গেছে। রাগে, টেনশনে বানভাসি হতে কতক্ষণ!

প্রাণায়াম, কপাল-ভাতি ইত্যাদি করে মনকে শান্ত করার চেষ্টায় আছে অমল। মন কি আর সহজে বশ মানতে চায়? মেয়েটাকে ল্যাংটো করে চাবকাতে পারলে মনটা শান্ত হত। ধিঙ্গি মেয়ে। বছর পাঁচেক মোটে বয়স হলে কী হয়, স্বাস্থ্য দেখলে আট-দশ বছরের কম মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। হবে না-ই বা কেন? যা পারছে, যখন পারছে গিলে চলেছে। ওই খেতেই শিখেছে কেবল। ডিসিপ্লিন বলতে কিছুই শেখেনি। শিখবে কোত্থেকে! ওই তো রঘুদার বউয়ের ছিরি। কোনো কালচার নেই। সেদিন নাইটি পরে পাড়ার দোকানে হাজির! তাও আবার স্লিভলেস নাইটি! ডিপ নেক। মুখের দিকে তাকাতে গেলে বুকের দিকে চোখ চলে যায়। একটা হাউস-কোট পরলেও কথা ছিল। আবার হেসে হেসে বলে কিনা, মেয়েটার বায়না, কী করব বলো। ললিপপ খাবে বলে এমন কান্না জুড়েছে যে পড়িমরি করে ছুটে আসতে হল।

হ্যাঁ, ওই আর এক যন্ত্রণা। ললিপপ! প্রায় সারাক্ষণ মেয়েটা ললিপপ চুষে চলেছে। অসহ্য লাগে অমলের। জিব বের করে কেউ ললিপপ চাটছে দেখলে কেমন গা শিরশির করে তার। কেন কে জানে। হয়তো ওরকম করলে মানুষকে কুকুর-কুকুর দেখতে লাগে, তাই। ওই একটা জানোয়ারকে কোনও বিশ্বাস নেই। ঘ্যাঁক করে কামড়ে দিলেই চিত্তির। কারো বাড়ির পোষা কুকুরও জঘন্য স্বভাবের। হাত-পা-মুখ চাটতে আসে। গা ঘিনঘিনে ব্যাপার। যেমন ঝিমলি একবার ললিপপ খেয়ে চ্যাটচেটে মুখ আর হাত তার কেঁচে শুকোতে দেওয়া সাদা পাঞ্জাবিতে মুছে দিয়েছিল।

একটা ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে ঘষলে দেয়ালের দাগটা উঠবে কী? যদি আরও ধেবড়ে যায়? খুঁটে তুলতে গেলে যদি রঙের চোকলা উঠে আসে? ধুর ধুর ধুর, আর ভাল্লাগে না ছাই। কেন যে মানুষ বিয়ে করে আর এইসব মাল পয়দা করে, কে জানে। সেক্স ব্যাপারটা কি এতই ইম্পরট্যান্ট? সেক্স যে কত কদর্য একটা ব্যাপার সেটা অমল ক্লাস ইলেভেনেই বুঝে গিয়েছিল। বন্ধুদের সঙ্গে ব্লু ফিল্ম দেখতে গিয়ে। সময়টা শীতকাল ছিল তাই রক্ষে। মাংকি ক্যাপে মুখ-চোখ ঢেকে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। অমল বুঝতে পারছিল, বন্ধুদের মতোই, তাকে দেখতে লাগছে শিক্ষানবিশ উগ্রপন্থীর মতো। নয়তো, কেউ দেখে ফেললে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যেত না? আর তারপর ভিডিও হলের টিভির একুশ ইঞ্চি জানালা দিয়ে যৌবন হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল অমলের জীবনে। সে এক জবরদস্ত শক। এমন সব জঘন্য কার্যকলাপ! হল থেকে বেরিয়ে বমি হয়ে গিয়েছিল তার। তাই দেখে বন্ধুদের কী খিল্লি! আসিফ তো বলেই ফেলল, সতী সুলোচনা আমার! তোর বাপও এমন করেছিল। নয়তো তুই পয়দা হতি না, বুঝলি?

তারপরই বিবেকানন্দ আসেন অমলের জীবনে।

একটা গোটা যুব-সমাজ বিয়ে করে করেই নষ্ট হয়ে গেল। এ নিয়ে বিবেকানন্দের আফসোসও কম ছিল না। জীবনে যেন আর কোনো লক্ষ্য থাকতে নেই। বিয়ে করো আর বংশবৃদ্ধি করো। আরে সে তো জানোয়ারেও করে। অবাধ্য, অসভ্য মানুষের বাচ্চাগুলোকেও দেখলে বোঝা যায় যে তারা জানোয়ারের চেয়ে খুব একটা উৎকৃষ্ট মাল নয়।

অমল যত অন্যরকম থাকতে চায়, আশপাশের লোকের যেন তত জেদ চেপে যায় যে কিছুতেই তা হতে দেবে না। যেমন ঝিমলি এই দেওয়ালটা নোংরা করেছে, তেমনি বাড়ির লোকজন উঠেপড়ে লেগেছে তার বিয়ে দিয়ে জীবনটা আস্তাকুঁড় করে তোলার জন্য। আর বিয়ে মানেই… ওফ… আর ভাবতে পারে না অমল। সদ্য পরিচিত দুজন মানুষ পরস্পরের সামনে দুম করে জামাকাপড় খুলে ফেলে কী করে? নোংরামির একশেষ। আবার তারপরে বাচ্চাকাচ্চা। তাদের পেচ্ছাপ, পায়খানা, বমি। হে ভগবান!

দেওয়ালটা একবার লাল্টু মিস্ত্রিকে দেখাতে হবে। যা হওয়ার, এক্সপার্ট হাতে হওয়াই ভালো। সে আবার কত টাকা খিঁচে নেয় কে জানে। আজকাল হাতের কাজ জানা লোকের এমন আকাল যে, মিস্ত্রিরা ধরাকে চায়ের ভাঁড় মনে করে।

রাতে শুতে যাওয়ার সময় অবধি খচখচানিটা রয়েই গেল। না হলে, ওরকম একটা উদ্ভট স্বপ্ন দেখে কেউ? লাল একটা স্লিভলেস নাইটির মতো পোশাক পরে ঝিমলি ললিপপ খাচ্ছিল তার বিছানায় বসে। একটু একটু চাটে আর বিছানার চাদরে মোছে। তারপর হঠাৎ অমল দেখে কী, ললিপপ কোথায়, তার হাতের একটা আঙুল টেনে নিয়ে গভীর মনোযোগে চুষে চলেছে মেয়েটা। হঠাৎ কামড়ে ধরেছে… রক্ত… রক্ত গড়িয়ে পড়ে অমলের সাদা বেডশিট ভিজে যাচ্ছে … বিছানাটা চ্যাটচ্যাট করছে … মেয়েটার মুখ থেকে কেমন একটা শব্দ বেরিয়ে আসছে … রাগী কুকুরের মতো চাপা গরগর শব্দ।

ধড়ফড় করে উঠে বসতেই টের পায়, দরজা ধাক্কাচ্ছে মা।

দরজা খুলতেই মা বলে, কি ঘুমই ঘুমোস বাবা! লাল্টু কতক্ষণ এসে বসে আছে। তুই নাকি কাল ফোন করেছিলি?
— হ্যাঁ, ওই বসার ঘরের দেওয়ালটা— অমল চোখ কচলাতে কচলাতে বলে— ওটা একটু ওকে দেখতে বলো তো। ঝিমলি বোধহয় রংটার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে।
— সে না-হয় বলছি। কিন্তু তুই বিছানার চাদর বগলে চললি কোথায়?
— বাথরুমে, অমল মায়ের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে; একেবারে চান করে বেরোব। চাদরটাও একটু কাচা দরকার। কী ময়লাই না হয়েছে!
— তুই আবার কাপড় কাচতে জানিস না কি?— মা অবাক হয়ে তাকান— বিন্তিকে বল, কেচে দেবে।
— নাহ… ইয়ে… এটা আমিই কাচব ভাবছি—অমল আমতা আমতা করে— ও আমি পারব ঠিক। তুমি চিন্তা কোরো না। বিন্তিকে বরং বলো, লাল্টুকে চা-টা দিক।

বলেই অমল হন্তদন্ত হয়ে বাথরুমের দিকে হাঁটা লাগায়।

Facebook Comments

পছন্দের বই