লেখক নয় , লেখাই মূলধন

রাহুল দাশগুপ্ত’র গল্প

প্রতিবিম্ব

চিত্র: রেনে মাগরিত

ছেলেটি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। আর তখনই শোনা গেল এক বিরাট বিস্ফোরণের শব্দ। ছেলেটির চোখের সামনে গোটা শপিং মলটা উড়ে গেল। প্রচণ্ড শব্দের পর এখন সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। লোকজন। পাগলের মতো দৌড়াদৌড়ি করছে। ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারপাশ।
ছেলেটি চুপ করে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল। তাকিয়ে রইল সামনের দৃশ্যটার দিকে। যেন বোঝার চেষ্টা করল, কী ঘটেছে সেখানে। কিন্তু কিছু বুঝতে পেরেছে বলে মনে হল না। পাথরের মতো মুখ, চোখ তার, সে আবার সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
একটি অল্পবয়সী ছেলে পিছন থেকে দৌড়ে আসছিল। ছেলেটি একচুলও সরল না। তাকে ধাক্কা মেরে যাওয়ার সময় সে চেঁচিয়ে উঠল, মানুষ না পাথর, কী রে ভাই! পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, পাগলও হতে পারে। এক বৃদ্ধ হাত নেড়ে ছেলেটিকে থামাল। তারপর বলল, বাবা, তোমার মতো বয়স থাকলে আমি এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম না। অনেক আগেই ছুটতে ছুটতে ওই শপিং মলের ভেতর ঢুকে যেতাম… কেন? ছেলেটি জানতে চাইল। কেন আবার? বৃদ্ধ বলল, ছোটো ছোটো শিশুরা রয়েছে, মহিলা, বৃদ্ধেরা রয়েছে, তাদের বাঁচাতে… ছেলেটি পাথরের মতো মুখ-চোখ করে তাকিয়ে রইল। বৃদ্ধ আবার বললেন, তুমি কী কিছুই দেখতে পাও না? শুনতে পাও না? ছেলেটি কী যেন বলে উঠল। কিন্তু বৃদ্ধ শুনতে পেল না। চারদিকে প্রচণ্ড আওয়াজ, হইচই চলছে। ছেলেটির ওপর তিনি খুবই বিরক্ত হলেন। তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল।
ছেলেটি কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা সামনের দিকে মুখ করে হাঁটতে লাগল। ঠিক সেই সময় মেয়েটি ছুটে এল তার দিকে। আর ঠিক ওর সামনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রবলভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমাকে বাঁচান।
ছেলেটি পাথরের মতো মুখ-চোখ করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটির সমস্ত পোশাক ঘামে ভিজে গেছে। দেখেই বোঝা যায়, অনেকটা পথ ছুটতে ছুটতে আসছে।
মেয়েটি আবার বলল, প্লিজ, আমাকে বাঁচান। ছেলেটির পাশে কখন এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি জানতে চাইলেন, কী হয়েছে তোমার? ওরা তাড়া করেছে। আমার ইজ্জত… কারা? বৃদ্ধ জানতে চান। তার সারা মুখে একটা কালো ছায়া নেমে আসে। মেয়েটি হাঁপাতে হাঁপাতে আবার ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, সময় নেই, কিছু করুন প্লিজ। মেয়েটি জানে, বৃদ্ধ কিছুই করতে পারবেন না। ইচ্ছা থাকলেও। কিন্তু ছেলেটির যে ইচ্ছেই নেই। যদিও তার অল্প বয়স, বলিষ্ঠ শরীর। সাহায্যের আশায় মেয়েটি তাই ছেলেটির দিকেই তাকিয়ে ছিল। বৃদ্ধ এবার ছেলেটির দিকে তাকালেন। তারপর অবাক হয়ে বলে উঠলেন, ভাই, তুমি কী মানুষ না পাথর? ছেলেটি শান্তভাবে, প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, আমাকে যেতে দিন। আমাকে বাঁচান। মেয়েটি আবার বলল। আমার তাড়া আছে। ছেলেটি আত্মমগ্নভাবে বলে উঠল। ওরা তাড়া করেছে। মেয়েটি আবার বলল। আমাকে পৌঁছতে হবে। ছেলেটি এখনও অন্যমনস্ক। মেয়েটি গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছেলেটিকে ধাক্কা মারল। তারপর আবার ছুটতে শুরু করল।

মেয়েটি হাঁপাতে হাঁপাতে আবার ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, সময় নেই, কিছু করুন প্লিজ। মেয়েটি জানে, বৃদ্ধ কিছুই করতে পারবেন না। ইচ্ছা থাকলেও। কিন্তু ছেলেটির যে ইচ্ছেই নেই।

ছেলেটি সামান্য টলে গেছিল। কিন্তু সেটাকে বিশেষ আমল দিল না। সে সামনের দিকে তাকিয়ে আবার নির্বিকারভাবে হাঁটতে লাগল। আর তখনই তার চোখে পড়ল, সামনেই একটা ক্যান্সার হাসপাতাল। সেই হাসপাতালে তার এক পরিচিত রয়েছেন। ছেলেটি হাসপাতালের ভিতর ঢুকে গেল। ভেতরে ঢুকলে কোনো বিলাসবহুল হোটেল বলে মনে হয়। আলোয় ঝলমল করছে। ছেলেটি ভিতরে ঢুকে কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে লাগল। সে ভুলেই গেল, আসলে কোনো একজন পরিচিতের কথা মনে পড়াতেই সে ভিতরে ঢুকেছিল।
ছেলেটি একটা সরু করিডোর দিয়ে হাঁটছিল। এরকম অনেক করিডোর সে পেরিয়ে এসেছে। একটার পর একটা করিডোর। একটার পর একটা সিঁড়ি। কোথাও উঠে যাচ্ছে, কোথাও বা নেমে। কোথাও আলো আছে, কোথাও বা ছায়া ছায়া। ছেলেটি ভুলে গেছিল, সে কোথা থেকে এসেছে। সে ভুলে গেছিল, সে কোথায় পৌঁছতে চায়। কাচের পার্টিশনের ওপাশে সার সার বিছানায় রোগীরা শুয়ে আছে। তাদের দিকে তাকালে ভয় করে। মানুষের শরীর এতটা সইতে পারে! মানুষের চেহারা এমন ভয়াবহ হতে পারে! কিন্তু ছেলেটির কিছুই হচ্ছিল না। তার যেন কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। ওই বেদনাময় দৃশ্যগুলো তার কাছে শুধুই দৃশ্য, ওগুলোর সঙ্গে নিজেকে যেন সে জড়াতে চায় না। ওগুলোর মধ্যে সে কোনোভাবে অংশগ্রহণ করতে চায় না। হঠাৎ তার মনে পড়ল, সে তো এখানে একজন পরিচিতর খোঁজে এসেছিল। সে কোথায় রয়েছে? আর তখনই কাচের দেওয়ালের ওপাশে সে তাকে দেখতে পেল। দড়ির মতো শীর্ণ হয়ে যাওয়া এক পুরুষ। পঞ্চাশের ঘরে বয়স। সারা শরীরে নানারকম নল লাগানো। নাক আর একটা গাল প্রায় নেই। কিন্তু শুধু এইটুকুই নয়। শরীরের বাকি অংশেও ব্যান্ডেজ করা। কোথাও কোনো ফাঁকফোকর নেই।
এই মানুষটার সঙ্গে ছোটোবেলায় সে বল নিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি খেলত। ছেলেটার স্মৃতি এখনও সজাগ। এই লোকটি ছিল তার প্রতিবেশী। এদের বাড়িতে ছিল একটা সুন্দর বাগান। সেই বাগানে এই লোকটির ফুটফুটে মেয়েটির সঙ্গে সে ছুটে ছুটে রংবেরঙের ফুল দেখে বেড়াত। টেনে টেনে ফলের গন্ধ নিত। একসঙ্গে দাঁড়িয়ে সুর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখত। কখনও কখনও লোকটিও ওদের সঙ্গে এসে যোগ দিত।
এই লোকটি কি এখনও বেঁচে আছে? এইভাবে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয়? নিজের কাছেই সে প্রশ্নগুলি রাখল। আর তারপরই তার মনে হল, সে এসব ভাবছে কেন? এসব ভেবে কী লাভ? এই লোকটির সঙ্গেই বা তার কীসের যোগ? শুধু ওই স্মৃতি? কিন্তু ওরকম তো কতই স্মৃতি থাকে মানুষের। সেগুলোকে গ্রাহ্য না করলেই হল! ছেলেটির মুখ আবার পাথরের মতোই হয়ে ওঠে। হঠাৎ ছেলেটির মনে হল, লোকটির কাছে একটা ব্যাপারে সে কৃতজ্ঞ ছিল। একবার সে একটা পুকুরের জলে জলে ডুবে যাচ্ছিল। লোকটিই তাকে বাঁচায়। সে তখন সেখান দিয়েই যাচ্ছিল। তাহলে যোগ তো একটা আছেই। লোকটি ছিল বলেই সে এখনও বেঁচে আছে। এখন লোকটি মারা যেতে বসেছে, শেষবারের মতো একটা সৌজন্য-সাক্ষাৎও কী তার প্রাপ্য নয়? কিন্তু লোকটির বীভৎস চেহারা দেখে ছেলেটি আবার পিছিয়ে গেল। এই লোকটিকে সে চেনে না। যাকে সে চিনত, সে এখানে নেই। এক ভয়াবহ বিকৃতির আড়ালে সে হারিয়ে গেছে। তাহলে আর সৌজন্যবোধ দেখিয়ে কী হবে? ছেলেটি চোখ বুজে সেই দৃশ্যটির কথা ভাবতে চাইল। পুকুরের জলে সে ডুবে যাচ্ছে। আর লোকটি হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে,… কিন্তু এটা তো নিছকই একটা দৃশ্য, এর সঙ্গে তার কোনো আবেগ, অনুভূতিই জড়িয়ে নেই। কৃতজ্ঞতাবোধ শব্দটিকেও এখন ফাপা আর অর্থহীন বলেই মনে হচ্ছে। কেন যে এসব মনে আসে! সে তো আগেই মন থেকে এসব শব্দকে মুছে দিয়েছে। শব্দ তার কাছে বোঝা ছাড়া আর কিছুই নয়। একটু একটু করে মনটাকে সে ফাঁকা করে নিয়েছে। একদিন তার মনটা পুরোপুরি শব্দহীন, শূন্য হয়ে যাবে। আর তখনই সে পুরোপুরি স্বস্তি পাবে। একদম নির্ভেজাল স্বস্তি…।

সারা শরীরে নানারকম নল লাগানো। নাক আর একটা গাল প্রায় নেই। কিন্তু শুধু এইটুকুই নয়। শরীরের বাকি অংশেও ব্যান্ডেজ করা। কোথাও কোনো ফাঁকফোকর নেই।

ছেলেটি ক্যানসার হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে। আগের মতোই সামনের দিকে তাকিয়ে টানটান হয়ে হাঁটতে থাকে। সে কী কোথাও পৌঁছতে চায়? সে নিজেও জানে না। কোথাও তার যাওয়ার নেই। কোথাও তার ফেরার নেই। একটা বাড়ি তার আছে বটে! খুব ভোরবেলা সেখান থেকেই সে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সেই বাড়ির প্রতি তার কোনো টান নেই। সে আর তার অজস্র বই ছাড়া আর কেউ থাকে না সেই বাড়িতে। তার বাবা-মা খুব ছোটোবেলায় মারা গেছেন। তাকে মানুষ করেছেন তার ঠাকুমা। কিন্তু তিনি ছিলেন বোবা। তার সঙ্গে কথাবার্তা হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে আশৈশব এক নৈঃশব্দ্যের জগতেই তার বড়ো হয়ে ওঠা। এ এমন এক জগৎ, যেখানে ফিসফিস করে কেউ কথা বললেও তা তীব্র হয়ে কানে বাজে। শব্দগুলোকে অবাঞ্ছিত মনে হয়। অবাস্তব লাগে। বিভ্রম মনে হয়। আর তখনই অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়। শব্দের জগৎ থেকে। নির্বাসন চায় সে। নিজেই নিজেকে নির্বাসিত করতে চায়। সে একটা পার্কের মধ্যে গিয়ে তোকে। সমুদ্রের ধারে একটা পার্ক। ভেতরে প্রচুর সবুজ গাছপালা। হঠাৎ সে শুনতে পায়, কে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। চুম্বকের টানের মতোই সেই আওয়াজ লক্ষ করে সে এগিয়ে যায়। আর দেখতে পায়, একটা গাছের আড়ালে ছোটো একটা বেঞ্চে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে বাইশ-তেইশ বছরের এক যুবক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাকে দেখে যুবকটি হাত সরিয়ে তাকায়। তার দু’চোখে উপচে পড়ছে জল। ছেলেটি চুপচাপ গিয়ে যুবকটির সামনে দাঁড়ায়।
যুবকটি হঠাৎ হেসে ওঠে। তারপর বলে, ও, কাদছি দেখে সহানুভূতি জানাতে এসেছ? আঁ? না, আমার কোনো সহানুভূতির প্রয়োজন নেই… ছেলেটি কিছুই বলে না। যুবকটি কিন্তু আর একজন মানুষকে দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। স্বগতোক্তি করার মতো করে বলে, না, আমার কোনো সহানুভূতির প্রয়োজন নেই। আমি জানি, সুইসাইড আমাকে করতেই হবে। আর সেটা এখনই। এই মুহূর্তে কারো করুণার পাত্র হয়ে আমি বাঁচতে চাই না। অথচ মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার কোনো উপায়ই আমার নেই! এ আমার কী করে দিল মেয়েটি! মেয়েরা কী এরকমই হয়! ছেলেটি তবু কিছু বলে না। আর এতেই যুবকটি আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারপর নিজের ব্যাগ থেকে একটা শক্ত পাকানো দড়ি বার করে, তার এক প্রান্ত গাছের একটা মোটা, শক্তপোক্ত ডালের সঙ্গে বাঁধে, অন্য প্রান্তটি নিজের গলায় বাঁধতে বাঁধতে বলে, ও, তুমি তাহলে নিজের চোখেই সব দেখতে চাও, তাই না? নিজের চোখেই! ঠিক আছে, অন্তত তোমাকে আমি দেখিয়ে যাব, আমি কোনো করুণার পাত্র নই। অন্তত একজন মানুষকেও আমি দেখিয়ে যাব, আমি কী পারি! অন্তত সে তো সাক্ষী হয়ে থাকবে, দুর্বল, ভীরু, কাপুরুষ, কোনোটাই আমি নই। যুবকটি এখন দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। তার চোখ দিয়ে দরদর করে জল ঝরে পড়ছে। কিন্তু এই সুযোগ সে হারাতে চায় না। অন্তত একজন মানুষকে পাওয়া গেছে, একজন সাক্ষীকে পাওয়া গেছে। নিজেকে প্রমাণ করতেই হবে। যুবকটি গলায় দড়ি পাকিয়ে গাছের ডাল থেকে ঝুলে পড়ে।
একদম শেষ মুহূর্তে ছেলেটির দিকে সে ভীষণ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর তীব্র স্বরে বলে ওঠে, না, আমি কোনো সহানুভূতি চাইছি না। কিন্তু তুমি কী, মানুষ না পাথর?
আর তারপরই সে ঝুলে পড়ে। কিছুক্ষণ প্রচণ্ডভাবে ছটফট করতে থাকে তার সারা শরীর। তারপর আশেপাশে সবকিছুই আবার শান্ত, নিথর হয়ে যায়। কাছেই কোথাও একটা পাখি তীব্র শিসের মতো ডেকে ওঠে। যেন কেউ ছুরি চালায় আর মুহূর্তে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে সমস্ত পরিবেশ, গোটা আকাশে কেউ যেন আবীর মাখিয়ে দিয়ে যায়। আর তখনই যেন ছেলেটির হুশ ফেরে। তার চোখের সামনে, একটু আগেই একজন যুবক গলায় দড়ি দিয়েছে। এখন গাছের ডাল থেকে তার মৃতদেহটা ঝুলছে, মাঝে মাঝে সেটা দোল খাচ্ছে। যুবকটির চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বিস্ফারিত হয়ে ফেটে, ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
কোন বইতে যেন ছেলেটি পড়েছিল, এসব ক্ষেত্রে সবার আগে মৃতদেহটিকে বন্ধনমুক্ত করে আনাই রীতি। তাকে ফাঁসমুক্ত করে এইরকম বীভৎসভাবে ঝুলে থাকার হাত থেকে মুক্ত করা দরকার। তারপর তাকে শান্তভাবে মাটিতে শুইয়ে দিতে হবে। যুবকটি এইভাবে, একা, নির্জনে, পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকতে পারে না। তার উপযুক্ত সৎকার হওয়া দরকার। তবেই না তার আত্মা শান্তি পাবে!
কিন্তু এসব তো অনেক অনেক দায়িত্বের কথা। এত দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছেলেটি ভাবতেই পারে না। যুবকটিকে সে চিনত না। একজন মানুষ হিসাবে, সামাজিক মানুষ হিসাবে, অন্য একজন মানুষের প্রতি, বিশেষ করে মানুষটি যখন মৃত, তখন যে দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়, এসব সে ভাবতেই পারে না। নিজেকে সে একজন সমাজ-বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসাবেই ভাবতে চায়। এই মৃত যুবকটির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। এই যুবকটির ব্যাপারে তার কোনো দায়িত্বও নেই। ছেলেটি আর মৃতদেহটির দিকে তাকায় না। সে সামনের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যায়, ঘাড় টানটান সোজা করে। পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে। যদিও সে জানে না, কোথায় সে পৌঁছতে চায়, তার আদৌ কোথাও পৌঁছনোর আছে কী না! একটু এগোনোর পরেই সে দেখতে পায়, সামনে ডানদিকে একটা আলো ঝলমলে বাড়ি। বাড়িটার সামনে একটা বিস্তৃত চৌকো সবুজ লন। সেই লনকে ঘিরে নানা রঙের ফুলের গাছ। সেই লনে একটা পার্টি চলছে। ছেলেটিকে দেখতে পেয়ে কেউ একজন এগিয়ে আসে। তারপর একগাল হেসে বলে ওঠে, আরে, এসো এসো, এত দেরি করলে কেন? ছেলেটি কিছুই বুঝতে পারে না। লোকটি হাসতে হাসতে বলে, তোমার ঠাকুমাকেই বলে এসেছিলাম। তোমার বাবা আমার সেই ছোটোবেলার বন্ধু। কিন্তু উনি তো চলেই গেলেন। উনি যদি আজ আসতে পারতেন! আমার মেয়েকে কী স্নেহই না উনি করতেন! আজ তার জন্মদিনে… ছেলেটি লোকটির মুখের দিকে তাকায়। আর তখনই লোকটি যেন একটু ঘাবড়ে যায়। পাথরের মতো দু’টি চোখ তার। সেই চোখে কোনো ভাষা নেই। কোনো আবেগ নেই। লোকটি তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ভেতরে চলো, বাবা, সেদিন তো তুমি ছিলে না, আজ কতদিন পরে তোমাকে দেখছি… কিন্তু লোকটির ভুরু কুঁচকে গেছিল। ছেলেটি ভেতরে ঢুকে লনের একটা কোণে একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। এই জায়গাটা একটু অন্ধকার হয়ে আছে। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। তার কথা কারো মনে নেই, কিন্তু সে সবাইকেই দেখতে পাচ্ছে। একটা সময় ছিল, যখন কোনো পার্টিতে বা অনুষ্ঠান বাড়িতে গেলেই তার খুব খিদে পেত। কিন্তু সেসব তো অনেক পুরোনো দিনের কথা। তখন তার বাবা-মা, দু’জনেই বেঁচে ছিলেন। ঠাকুমা খুব একটা বাইরে যেতেন না। ফলে বহুদিন আগেই ওসব বন্ধ হয়ে গেছে।
ছেলেটি এখন আর কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে যায় না। গেলেও তার খিদে পায় না। তার ফেরার কোনো তাড়া নেই। যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। ফলে সে নিশ্চিন্তে বসে থাকে।
ছেলেটি দেখতে পায়, লনে একজন যুবতী মেয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে। আর তার সামনে দাঁড়িয়ে কোট-টাই পরা একজন বয়স্ক লোক গল্প করছে। যার সঙ্গে গল্প করছে, তারও বয়স হয়েছে, কিন্তু এখনও সে বেশ সুন্দরী। মহিলাটি মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে জানতে চায়, তোমার মেয়ে? লোকটি বলল, হুম। ও আর ঠিক হল না, তাই না? নাঃ! চেষ্টা তো অনেক করলাম। কিন্তু আমারও সময়ের অভাব, ব্যস্ত জীবন, কত আর… লোকটি গ্লাসে চুমুক দিল। তারপর পরম তৃপ্তিতে বলে উঠল, আঃ! মেয়েটি তখন লনের ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে পুরছে। তার দিকে কারো নজর নেই। লোকটি মুগ্ধ হয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে। মহিলাটিও লোকটির সামনে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এবার লোকটি জানতে চাইল, তুমি একা? হ্যা, ছেলে তো গত মাসে… সে কী! লোকটি চমকে উঠল। কী হয়েছিল? অ্যাকসিডেন্ট। দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। লোকটি আবার জানতে চাইল, কত বয়স হয়েছিল? ছাব্বিশ। লোকটি আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। মহিলাটি ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে তাকে চুপ করিয়ে দিল। তারপর বলল, ওসব কথা এখন থাক। লোকটি চুপ করে গেল। কিন্তু কেন জানি তার মুখ-চোখ হঠাৎ খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। ঠিক এই সময় ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ লোকটির পাশে এসে দাঁড়ায়। একটু বিরক্তি নিয়েই ভুরু কুঁচকে লোকটি বৃদ্ধের দিকে তাকায়। বৃদ্ধকে দেখে মহিলার মুখ কিন্তু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে বলে ওঠে, আরে, অনন্তদা যে, কেমন আছেন? রাজু, মনে আছে, ছেলেবেলায় অনন্তদা কীভাবে তোমার সেবা করে বাঁচিয়ে ছিলেন? হাসপাতালে সে কী ছোটাছুটি, তোমার বাবা-মা, দু’জনেই তখন বাইরে। অনন্তদা না থাকলে কী যে হতো! বৃদ্ধ একটা করুণ হাসি হাসলেন। তারপর বললেন, তোমার কাছে একটা বিশেষ দরকারে এসেছিলাম, রাজু। রাজুর ভুরু কুঁচকেই আছে। তবু মহিলাটিকে খুশি করার জন্যই বোধহয় সে বলল, বলুন। অনন্ত বলল, আমাদের ক্লাবে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, আগামী রবিবার। সবাই খুব ধরেছে, তোমাকে চাই। তোমাকে কিন্তু আসতেই হবে। তুমিই হবে ওই অনুষ্ঠানের সভাপতি। রাজু বলল, না, না, তা কী করে হয়, আগামী রবিবার তো…। এবার মহিলাটি বলে ওঠে, তবু, অনন্তদা যখন বলছেন, তখন সব কাজ ফেলে রেখে, কিন্তু… অনন্তদা এবার মহিলাটির দিকে তাকান। তারপর বলেন, মিলি, তুমি আর রাজু একসঙ্গেই ছোটো থেকে বড়ো হয়েছ… আর আপনি ছিলেন আমাদের গুরু… মিলি খিলখিল করে হেসে ওঠে। তারপর যোগ করে, আপনার মতো পণ্ডিত মানুষ থাকতে ওরা হঠাৎ রাজুকে চায় কেন? আপনিই তো পারেন… অনন্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মিলিই আবার যোগ করল, অবশ্য রাজুর নামডাক অনেক বেশি। ও তো এখন সুপারস্টার। জনপ্রিয় গায়ক। কিন্তু তাই বলে আপনার সঙ্গে ওর তুলনা হয় নাকি? আপনার পাণ্ডিত্যের সঙ্গে সংগীতে কী প্রখর, গভীর জ্ঞান আপনার! ও সারাজীবন আপনার ছাত্রই থেকে যাবে… এবার রাজু বলে ওঠে, অনন্তদা, কথায় বলে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না! ওরা তাই আপনাকে ছেড়ে আমার পিছনে ছুটছে। এটা অন্যায়। আপনি এর মধ্যে থাকবেন না। ওরা আপনাকে ব্যবহার করছে। নিজের আত্মসম্মান নিয়ে সরে আসুন। আমাকে আর অনুরোধ করবেন না… অনন্ত আর দাঁড়ালেন না। বললেন, চলি মিলি, চলি রাজু। তারপর আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মিলি বলল, তুমি রাজি হলে না কেন? তুমি গান গেয়ে আজ ধনী হয়ে গেছ। উনি তো সেই গরিবই রয়ে গেছেন। তুমি রাজি হলে হয়তো উনি একটা কমিশন পেতেন… কিন্তু সেটা কী ওকে মানাত? রাজু বলল। তাছাড়া ক’টা টাকা দিত? এই টাকায় এখন আমার পোষাবে না। এসব ছোটোখাটো ফাংশনে গান-টান আমি বহুদিন ছেড়ে দিয়েছি। বহুদিন… মিলি আর কিছু বলল না। বরং প্রগাঢ় চোখে রাজুর দিকে তাকাল। তারপর ওর গালে একটা টোকা মেরে বলল, তুমি খুব হিসেবি হয়ে গেছো… সেটাই স্বাভাবিক। রাজু বলল। নইলে, আমার অবস্থাও অনন্তদার মতোই হতো… মিলি আবার খুব জোরে খিলখিল করে হেসে উঠল। ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। তারপর কাউকে কিছু না বলে, কোনোদিকে না তাকিয়ে পার্টি, হইচই, আলোয় ভরা বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এল। অন্ধকার হয়ে এসেছে। সে সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল। পিচের রাস্তা ছেড়ে এবার সে জঙ্গলের ভেতর একটা সরু পথে ঢুকে পড়ল। এখানে গাছপালা খুব ঘন নয়। কিন্তু গাছগুলো খুব উঁচু উঁচু। মাঝে মাঝে অনেকটা ফাঁকা। সেখানে ঘাড় উঁচু করে সোজা আকাশের দিকে তাকালে গোল চাঁদকে দেখা যায়। চাঁদটাও কেমন যেন ঝুঁকে আছে আজ। কেমন মায়াবী, কোমল, নরম দেখাচ্ছে তাকে। ছেলেটার খুব ইচ্ছা হল, সেই চাঁদের গায়ে মোলায়েমভাবে একবার আঁচড় কেটে দেয়। চাঁদও কী আরও একটু নীচে নেমে আসতে পারে না?
সামনেই একটা সরোবর। তার জল স্বচ্ছ, কাচের মতো। সরোবরের ঠিক মাঝখানে চাঁদটা ভেসে আছে। আর চারপাশে ছড়ানো অজস্র ঝরা পাতা আর ফুলের পাপড়ি। ছেলেটা সেই ঝরা পাতা আর ফুলের পাপড়ির স্তূপের মধ্যে গিয়ে বসল। আর তাকিয়ে রইল সরোবরের জলের দিকে। তার ভুরু এখন কুঁচকে গেছে। সে যেন কিছু একটা খুঁজছে। কিন্তু কী খুঁজছে সে? কিছু খুঁজতে তো সে এখানে আসেনি। নিতান্ত মনের খেয়ালেই এখানে সে এসে পড়েছে। এখানে আসার ব্যাপারে তার কোনো ধারনাই ছিল, একটু আগেও। সে জানতই না, এখানে এসে পৌঁছবে। পুরোটাই নেহাৎ কাকতালীয় ব্যাপার! সে শুধুই হাঁটছিল। কিন্তু এখানে আসার পরই তার ভেতরে কেমন একটা উদ্বেগ দানা বেধে উঠেছে। তার মনে হয়েছে, এখানে কিছু একটা আছে, যা তার খোঁজা দরকার। খুঁজে পাওয়া দরকার। একটু একটু করে ছেলেটির চোখ বুজে আসে। আর তখনই সে দেখতে পায়, একটা মুখ! কিন্তু মুখটা যেন ঠিক সাধারণ নয়। দেখে মনে হয়, মুখটায় সেলোটেপ দিয়ে কেউ একটা হাসি সেঁটে দিয়েছে। কোনোভাবেই মুখটা থেকে সেই হাসিকে আলাদা করা যাবে না। ছেলেটি দেখতে পায়, একটা ক্লাসঘর। সেখানে একটি ছেলে বসে আছে। তার মুখে লেগে আছে এই হাসি। এমন সময় শিক্ষক এগিয়ে আসেন। কড়া চোখে তাকান ছেলেটির দিকে। জানতে চান, তুমি সবসময় হাসো কেন?

তার ভুরু এখন কুঁচকে গেছে। সে যেন কিছু একটা খুঁজছে। কিন্তু কী খুঁজছে সে? কিছু খুঁজতে তো সে এখানে আসেনি।

কী করব স্যার! ছেলেটি নিরীহ, নিষ্পাপের মতো বলে ওঠে, আমার যে সবসময় নানা মজার কথা মনে পড়ে। শিক্ষকের মুখের ভাব এবার একটু নরম হয়। তিনি বলে ওঠেন, অদ্ভুত তো! মজার কথা! সবসময়! কী মজার কথা? নানা মজার স্মৃতি, স্যার। ছেলেটি বলে, আমার বন্ধুদের নিয়ে। ওরা যে-সব মজার কাণ্ড করে না! এই তো সেদিন… শিক্ষক তাকে চুপ করিয়ে দেন। একটা মৃদু ধমক দিয়ে বলেন, ঠিক আছে, চুপ করো। তোমার বাড়ির লোকের সঙ্গে আমি কথা বলব। তুমি ঠিক স্বাভাবিক নও। একটা ছেলে, সবসময় হাসছে, সবসময় নানা মজার কথা ভাবছে, এটা কী স্বাভাবিক?

নাঃ, সেই ছেলেটির মধ্যে কোনো দুঃখবোধ ছিল না। সে সবসময় হাসত। নিজের মনেই হাসত। সবসময়ই তার নাকি নানা মজার মজার কথা মনে পড়ত! আর তখনই তার হাসি পেত। কিন্তু কোথায় গেল সেই মুখটি? ছেলেটি জলের দিকে তাকায়। সেই মুখটিকে খোঁজে। ঝুঁকে পড়ে। আর তখনই ছিটকে সরে আসে। একটি মুখ দেখতে পায়। অস্ফুটে সে শুধু বলতে পারে, পাথর! তার চোখে ত্রাস আর আতঙ্ক, আর্তি আর বিপন্নতা মিলেমিশে যায়…

Facebook Comments

পছন্দের বই