লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শতানীক রায়ের প্রবন্ধ

সমর সেন: bird of passage

অনেক বছর ঘুমিয়ে থাকলাম আর নয়। যে-কাজটা করতে চেয়েছিলাম সমর সেনকে কেন্দ্র করে তা মূল থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে। মাছি মিষ্টির ওপর থেকে অনেকক্ষণ ভন ভন করার পর দূরে বহু দূরে সরে যায় যেমন। তারপর লিখব এই তাগিদ বোধ করলেও নানাভাবে আমার নিজের ব্যক্তিবিভ্রান্তি জুড়ে অগোছালো ভাবনাগুলো এসে বসেছে। বরং বলব এরকম নির্নিমেষ দূরে থাকার ভেতর ফিরে আসার এক অনাবিল আনন্দ আছে। এভাবে বাক্যের পর বাক্যের ভেতর সমর সেনীয় ঋজুভাব টের পাচ্ছি। কারণই হল এই লেখাটার মূলেই ব্যক্তি সমর সেন ও তাঁর কবিতার নানা অনুষঙ্গ আসবে। যদিও লেখা বিবেচনা করা উচিত লেখককে নয়। তবুও বলি, অনেকেই সমর সেনকে কেন্দ্র করে তাঁদের নিজেদের স্মৃতিচারণা করেছেন। তার জন্য কোনো শিল্পবোধ আলোচকদের কাজ করেনি। ওঁর ভেতর অতলের যে একটি বিচিত্র মানুষ লুকিয়ে আছে তাঁর অনুসন্ধান করাটাও একটি ব্যক্তি-ডিসকোর্সের ভেতর দিয়ে করার চেষ্টা করলাম।
সমর সেন ওঁর আত্মজীবনী ‘বাবুবৃত্তান্ত’-তে শুরুর দিকে অদ্ভুতভাবে নিজেকে আড়াল করে এক বিচিত্র মানসিক গঠনকে কেন্দ্র করে নিজের জন্মবৃত্তান্ত বা তাঁর পারিবারিক সূত্র এনেছেন। ‘শৈশবের প্রথম স্মৃতি বাগবাজারের বিশ্বকোষ লেনের একান্নবর্তী পরিবার— বিশ্বকোষ রচয়িতা প্রখ্যাত নগেন বসুর বাড়ির লাগোয়া তিনতলা বাড়ি।’ এভাবে নিজের আমি-কে ব্যবহার করলেন স্মৃতির ভেতর দিয়ে। আমাদের মনে পড়ে শ্রীরামকৃষ্ণের কথা। উনি নিজেকে উল্লেখ করতেন কথা প্রসঙ্গে ‘এই শরীর’ ‘এই খোলটা’ বলে। এর ভেতর যতটা না খর্ব আছে তার চেয়ে নিজেকে আলাদা করে বিচ্ছিন্ন হয়ে দেখার বিচিত্র আনন্দ আছে। স্বস্তি আছে তেমনই। নিজেকে জড়িয়ে ফেলা অর্থাৎ, নিজের আমিত্বকে লেখায় খুঁজে পাওয়ার প্রসঙ্গ খুবই আবছায়া হয়ে ওঠে।
দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন সমর সেনের ঠাকুর্দা। তিনি তিরিশের দশকে সমর সেনের সাহিত্যচর্চা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে বলতেন: ‘তুই একটা এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান’। এখানেও অদ্ভুতভাবে আমরা দীনেশচন্দ্র সেনের দৃষ্টিতে সমর সেনকে দেখছি। কোনো একজন মানুষকে এমনভাবে দেখা অর্থাৎ, তাকে ধূসর করে তোলা তাকে রোগা করে দেখা। রিপুসঞ্চারের মতো। দাদু বিলেত যাওয়ার কথা বলতেই দাদুকে বলেছিলেন সমর সেন: ‘দাদু, পুরুষাঙ্গ বাঁধা দিয়ে বিলেত যাব না।’ বিয়েতে শ্বশুরের অর্ধেক খরচায় বিলেত যাওয়ার প্রসঙ্গে বলেছিলেন। এখানে পুরুষাঙ্গ প্রসঙ্গে যে-শারীরিক বোধের কথা বলা হল তার একটা পুরুষের অহংকার যতটা না আছে তার থেকে বেশি সমর সেনের শরীরের একটা প্রতিবাদ আছে ডিনায়াল আছে যা তাঁকে আরও বেশি বেঁচে থাকার একটা তাগিদ দিয়েছে হয়তো। একটা বোধ যা সঞ্চারিত হয়। ‘বাবুবৃত্তান্ত’-এর যে-কোনো একটি পাতা অনেক মহৎ এবং সূক্ষ্ম অনেককিছু প্রকাশ করে। বারবার লক্ষ করব কীভাবে সমর সেনের শরীর এবং তার সঙ্গে অনেকের শরীর মিলে মিশে সময়ের যে-আঘাত তা চিহ্নিত হওয়াও তেমনই গভীরভাবে আছে।
সমর সেন ‘নানাকথা’ কবিতাটি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করেছেন। তার একটি পঙ্‌ক্তি: ‘পথ চলার পুরোনো শখ পাগল করে।’ এখানে উল্লেখ্য যে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে আমরা পদাতিক কবি বলে থাকি। তিনি পথ চলতে চলতে কবিতা পেতেন। যার সঙ্গে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার যোগাযোগ। সমর সেন এখানে আবার ওনাকে পথ চলার আনন্দ উল্লেখ করেছেন যা আদতেই রূূূূূূপকার্থে ব্যবহৃত। কোথাও একটা যোগসূত্রও তৈরি হচ্ছে যেন। নিজের জীবনকে রিলেট করছেন সমর সেন। কবিতাটির ‘২’ নম্বর অংশ পড়া যাক। আরও একটা প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো যে, সমর সেন ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় দু’জনেই মার্কসবাদী। এর মধ্যে এক বিচিত্র ঋজুভাব আছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার ‘ছলকে চলার’ মতো।   

“হঠাৎ আজ হাওয়া দিল
সঞ্জীবনী বার্তাবহ।
বুড়ো দিন সোনার কলপ মাথায় লাগায়
পথ চলার পুরোনো শখ পাগল করে।
অভ্যাসবশে মন নোংরা গলিতে ঢোকে,
স্বেচ্ছায় আবর্জনা দেখে গ্লানিতে ভরে;
বাইরে বিপুল বিশ্ব, সাঁজোয়া জীবনের শবযাত্রায়
আলোড়িত সমস্ত নরলোক,
কিন্তু সুদিন আসন্ন, কিছু রক্তশুদ্ধি, হয় হোক,
এ কথা ভাবে বাচাল মন।”


একা ক্ষেতে নীচু হয়ে ধান রোপণ করছি। গম ক্ষেতে গম রোপণ করছি। এই এক আনন্দ। দোতারা বাজানোর আনন্দ আর গান। গান গাইছি। শরীরময় ব্যক্তি আবেশ সব ক্লান্তি গ্লানি মুছে যাচ্ছে দূরে। শুধু দুপুর। আজকের দুপুরটা, আজকের দিনটা এত লম্বা। একাহীন মায়ার মতো। এইসব নিয়ে দিনাতিপাত করছি। আজ সকালে উঠে ‘বাবুবৃত্তান্ত’-তে একটা প্যারাগ্রাফ পড়ে আশ্চর্য হওয়ার চেয়ে বেশি আবিষ্কার করলাম। অন্য এক দৈহিক ভাষা যা আমাদের চরিত্র বা আচরণকে একটু প্রকটভাবে দেখতে সহযোগিতা করবে। ‘জ্যেঠা-কাকাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গুরুগম্ভীর ছিল না, হাসি ঠাট্টা ইয়ার্কি চলতো। বারবার ছেলের আশায় একটির পর একটি মেয়ে হবার ব্যাপার তোলাতে এক কাকা বলেন, “ওটা ভগবানের হাত”। আমরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, “ভগবানের হাত এতো ছোট?”’ এই বইটা যত পড়ছি ততই সম্পর্ক নিয়ে ভাবছি। সমর সেন এই বই লেখার সময় সম্পর্ক নিয়ে এমনকিছু কথা অনর্গল লিখে চলেছেন তা আদৌ কোনো অলীক স্যুররিয়াল অ্যাপ্রোচ নয় সতত তিনি খুব সচেতনভাবে কিছু কথা লিখছেন। যেমন ভগবানের হাত ছোটো হওয়ার কথা। পরবর্তীতে আরও দেখব এমন। একে ঠিক নিজেকে খুঁজে দেখা বলব না বরং পারিবারিক বলব বা নানা মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এবং নিগূঢ়তা পরিস্ফুট করার জন্য সেই বিশেষ মুহূর্তগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছেন যা আদতেই শিল্পের দিক থেকেও উৎকৃষ্ট। বলব না লেখার টেবিলে বসে তা উদ্দেশ্য ছিল ওঁর। বরং সমর সেন সেই সব মুহূর্তগুলোকেই মনে রেখেছেন যার ভেতর দিয়ে একজন মানুষের অন্তরঙ্গতা বা নিজেকে উজাড় করার ক্ষণ জন্ম নিয়েছে।
খুব জরুরি কথা। অভিমানী মানুষ হিসেবে সমর সেন অনেক কবিতায় হঠাৎ হঠাৎ এমন সরল গদ্যধারায় লিখে ফেলতেন সমস্ত কথা। আসলে ওঁর কবিতায় সরাসরি কোনো ডিসকোর্স না থাকলেও। যে-অভিমানী পরাভব থেকে কবিতা লিখতেন যা হয়তো সচেতন প্রয়াস হতে পারে তবে তার একটা ইতিবাচক দিকও আছে। কবি সেখান থেকে এমন এক সলিডারিটির পথ বেছে নিচ্ছেন যা কোনোভাবেই কোনো লেখাকে শুধুই নিছক আমিত্ব দিয়ে ভরে দেবে না। ইঙ্গিত করে তৎকালীন কোনো প্রসঙ্গকে যার থেকে ক্রমাগত টের পাই এমন এক নিষেধ বা সজ্ঞানে একটা বিরোধ যা সময়ের প্রতি একটি মানুষের প্রতিরোধ তুলে ধরে। ‘নিঃশব্দতার ছন্দ’ কবিতাটি পড়া যাক:
“স্তব্ধরাত্রে কেন তুমি বাইরে যাও?
আকাশে চাঁদ নেই, আকাশ অন্ধকার,
বিশাল অন্ধকার শুধু একটি তারা কাঁপে,
হাওয়ায় কাঁপে শুধু একটি তারা।

কেন তুমি বাইরে যাও স্তব্ধরাত্রে
আমাকে একলা ফেলে?
কেন তুমি চেয়ে থাক ভাষাহীন, নিঃশব্দ পাথরের মতো?
আকাশে চাঁদ নেই, আকাশ অন্ধকার,
বাতাসে গাছের পাতা নড়ে,
আর দেবদারুগাছের পিছনে তারাটি কাঁপে আর কাঁপে;
আমাকে কেন ছেড়ে যাও
মিলনের মুহূর্ত হতে বিরহের স্তব্ধতায়?

মাঝে মাঝে চকিতে যেন অনুভব করি
তোমার নিঃশব্দতার ছন্দ:
সহসা বুঝিতে পারি—
দিনের পরে কেন রাত আসে
আর তারারা কাঁপে আপন মনে,
কেন অন্ধকারে
মাটির পৃথিবীতে আসে সবুজ প্রাণ;
চপল, তীব্র, নিঃশব্দ প্রাণ—
বুঝতে পারি কেন
স্তব্ধ অর্ধরাত্রে আমাকে তুমি ছেড়ে যাও
মিলনের মুহূর্ত থেকে বিরহের স্তব্ধতায়।”
সত্যি অর্থে এটা আমরা সবাই বিশ্বাসী যে, অসচেতনভাবে আমাদের বাইরের প্রকৃতি কীভাবে ভেতরের রক্তমাংসকে তীব্রভাবে আক্রান্ত করে। যদিও আমরা এই লেখার ক্ষেত্রে লেখক আর লেখাকে সম্পূর্ণ আলাদা দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করব না কারণটাই হল, সমর সেন যে-ভাষা বা স্তর থেকে কবিতা লিখতেন তা কোনো অর্থে তাঁর ব্যক্তিসত্তাকে আড়াল করে না। সতত তা ওঁর নিজের মার্কসীয় ভাবধারা কিংবা সমাজ সচেতন একজন নাগরিক হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করে। এটা একটি সচেতন প্রয়াসও বলব। এখানে দুটো বিপরীতধর্মী বার্তা আমরা খুঁজে পাচ্ছি, একদিকে ভেতরের রক্তমাংস উদ্রেককারী বাইরের পরিবেশ যদিও সমর সেনের কবিতাকে সমূহ গড়ে না তুললেও একটা হতাশা ছেয়েই থাকে যা থেকে তাঁর মানুষ হিসেবে অবস্থান অনেকটাই সঙ্গত করে। দ্বিতীয়ত, তাঁকে যে অনুষঙ্গে ফেলে দেখব সেটা মূলতই একজন শরীর এবং মন যা একান্তভাবে সমর সেনকে গূঢ়তম এক রসিক কিন্তু আপাত সংযত মানুষের কাছাকাছি দাঁড় করায়।


যে-কথাটা সহজভাবে বলতে চাই সেটা সহজেই জটিল হয়ে ওঠে। এটা ভাবনা বা চিন্তার এক প্রকার দুর্দশাও বটে। ভ্রান্তি। আসলে ভুল দিয়ে মেপে রেখেছি নিজেকে৷ সেইজন্য বিশেষ কিছু নেই। যার অর্থ প্রয়োগে আমরা স্বয়ংক্রিয় হব। অর্থাৎ যদি আমরা সমর সেনের কবিতায় জীবনানন্দের কোনো ছায়া বা দশা সচরাচর দেখে থাকি না। কিংবা সহজতম বাক্যে তিনি ক্রমাগত ভাবছেন এবং লিখছেন খুব বেশি জটিল কোনো আরশির প্রয়োগ নেই। এভাবে তবে আমরা ভুল করব। সেই সময়টা ভাবতে হবে। সবার আগে তিনি একজন সাংবাদিক। সেই তৎকালীন ভারতে বা বিশ্বে পরাধীনতা, যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষের মতো করুণ সমস্ত ঘটনা অবিচল এবং সাবলীল ঘটে চলেছিল। তাই সমাজের শরীর বলব। শব্দ দুটোর মধ্যে কেমন এক তীক্ষ্ণ ধারালো বোধ আছে। একা আমি নই আমরা একা একা সবাই সম্মিলিত হয়ে একটি শরীর হয়ে উঠছি৷ দুর্ভিক্ষে মৃত্যু হচ্ছিল। তা পরোক্ষে যুদ্ধেরই প্রভাব আমরা দুর্ভিক্ষে দেখি। মৃণাল সেন আস্ত একখানা চিত্রনাট্য লিখে ফেললেন ‘বাইশে শ্রাবণ’ এবং চলচ্চিত্রায়িত করলেন। মানুষের খাদ্যাভাব বা অর্থাভাব কীভাবে তাদের মনের উপর প্রভাব ফেলেছিল তা দেখানো হয়েছিল। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে। এটি ভারতীয় কেন বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অভাবনীয় অবদান। আমরা অন্নের অধিকারের প্রসঙ্গ লক্ষ করি যা কি না প্রতিফলিত হয় স্বাধীন হওয়ার অনঙ্গ তিতিক্ষায় যা খুব সাবলীলভাবে রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’-র ক্ষুধার অন্ন আর উদ্বৃত্তের অন্নকে পৃথক করে দেখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যদিও মুক্তধারার মূল বক্তব্য ওটা নয়, আমাদের অন্তর্গত স্বাধীনতার কথা পরিস্ফুট করবার জন্য যখন রবীন্দ্রনাথ নানা দিক অনুসন্ধান করতে করতে এ হেন রূপক আমাদের সামনে দাঁড় করান তখন কোনো অংশে তাঁকে মার্কসের থেকে কম মনে হয় না। সমর সেনও সেই অর্থে মার্কসীয় চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তাঁঁর জীবনে এবং সৃষ্টিতে। তাঁর কবিতার সহজতা বলব না সতেজতা আমাদের সরাসরি আঘাত করার নিরিখে বড়োই সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই সময়।
‘বাবুবৃত্তান্ত’-এর একটি স্মৃতি এমন: ‘একান্নবর্তী পরিবারে নানা কাণ্ড ঘটে। বাড়ির বাইরে ছেলে-মেয়েদের মেলামেশা তখন অভাবনীয় ছিল ব’লে পরিবারের গণ্ডির মধ্যে কিছুটা আদি-রসাত্মক সম্পর্ক গড়ে উঠতো, গুরুজনদের ‘অজ্ঞাতসারে’। মা আমাদের কড়াশাসনে রাখতেন। পূর্ববঙ্গীয় সেন পরিবারে চায়ের প্রবর্তন তিনি করেন বটে কিন্তু বড়োদের সঙ্গে লুকিয়ে বিড়ি খেয়ে ধরা পড়ে তাঁর কাছে হাতপাখার আঘাত খেয়েছি অনেকবার। বাবা গায়ে পড়ে শাসন করতেন না। চরম শাস্তি ছিল কাপড়চোপড় খুলে নেওয়া। দ্বিপদের বস্ত্র-হরণ হ’লে খাটের নিচে ঘন্টার পর ঘন্টা আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় থাকত না।’ এই শরীরবোধ এবং রহস্যময়তা যত দিন যায় একজন মানুষের মনে আরও বাড়তে থাকে থাকে। নিজের শৈশব থেকেই খুঁজে শুধু এগুলোকে বলার ভেতরও একরকম বিভ্রাম্তিও কাজ করে। নিজের উলঙ্গ হওয়ার শাস্তি। আদিরসাত্মক সব স্মৃতি। যৌনতার আভাস পাওয়া। তাঁর শরীরের লজ্জাবোধ। নিজেকে এভাবে শরীরময় দেখার ভেতরও এক অদ্ভুত পুলকিত আর শিহরিত হওয়ার প্রসঙ্গ আছে। ফুরিয়ে যাওয়ার একটা বোধ যখন তৈরি হতে থাকে একজন মানুষের মধ্যে তাঁর জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়ে ওঠার পর। এরকম একটা সময়ে এসে শরীরময় হয়ে উঠলেন সমর সেন। শরীরের স্মৃতি।
‘তিন পুরুষ’ কাব্যগ্রন্থের কথা মনে হচ্ছে। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল জুন ১৯৪৪ সালে। সেখানে ‘শহরে’ নামক একটি কবিতা আছে। সেটা উদ্ধৃত করছি।
“মহিষবর্ণ জগদ্দল মেঘে
দিগন্ত রুদ্ধ করে বৈশাখের এ-দিন।
শহরের প্রান্তে
জমাট অন্ধকারে কর্দমাক্ত স্তব্ধতায়
দুর্ভিক্ষের কঙ্কাল চলে আপন পথে;
পশ্চিমে চটকল, গঙ্গা; মধ্যে সুপ্ত শান্ত প্রাসাদে
বর্ধিষ্ণু মেদে নিদ্রারত কুবেরদুলাল;
আরো আগে বিস্তীর্ণ মাঠ, ঘনিষ্ঠ সবুজ।

কী অতীত, কী স্মৃতি মনে জাগে,
শুধু শূন্যমাঠ, পোড়োবাড়ি, গ্রামের শকুন!
তামাটে প্রান্তরে বসে মানুষ কি জানে
রাত্রির কালোঘামে মলিন জীবন-উর্বশী
এখনো নৃত্যরতা কালের তপোবঙ্গে;
মেঘে-মেঘে গুমোট জোয়ারের ডাকে,
চকিত-বিদ্যুতে, সে কি ভাবে,
আর অসহায় পায়ে দুর্ভিক্ষ পার হয়ে পাবে দেশান্তরী দিন,
জনক সূর্যের আশীর্বাদে পরিচ্ছন্ন গ্রাম?”

সেই সময়ের সমকালীন ভারতের অবস্থা ছিল মর্মান্তিক। মন্বন্তর চলছে দেশে। দুর্ভিক্ষ। গ্রামের মানুষ শহরে আসছে। মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে একরকম হাড়-চামড়া এক হওয়া অবস্থা। মাংসহীন রসহীন সময় রক্তপ্রবাহ কমে আসছে। তার ইতিহাস একটু বিস্তারে আলোচনা করব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ১৯৪৩ সালে ভারতের পূর্বাঞ্চলে ঘটে যাওয়া মন্বন্তরে সরকারি পরিসংখ্যান বলেছিল ১.৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল; বেসরকারি হিসেবে তিন মিলিয়ন। তারও আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েও মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ১৯১৪-এর ৪ আগস্ট ব্রটিশ সাম্রাজ্য জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ভারতীয় সেনাদের পাঠানো হয় মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে, ৬০০০০ হাজার সেনা প্রাণ দেয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। যুদ্ধের কারণে মুদ্রাস্ফীতি, যুদ্ধ ক্ষেত্রে খাদ্যশস্য রপ্তানি এবং খরা ভারতের গ্রামাঞ্চলে গরিবদের খাদ্যসংগ্রহে অপারগ করে তুলেছিল। মন্বন্তরের আগে দেখা দিল মহামারী। ইউরোপের তুষারশীতল ট্রেঞ্চে যুদ্ধ করে সেনারা স্বদেশে ফেরার সাথে সাথে সঙ্গে করে স্পেনীয় ফ্লু নিয়ে এল যা শীর্ণ বিধ্বস্ত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে বারো মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটালো। এ গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব। মনে রাখতে হবে দেশের মানুষের মনে এবং সমাজের শরীরে এ এক দীর্ঘকালব্যাপী ছাপ ফেলে গেল। এমন এক আক্রান্ত অবস্থা শেষ হতে না হতেই আবার চার্চিলের নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হল ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে। ১৯৪২-এর মার্চে পার্ল হারবারের ওপর আক্রমণের তিন মাস পরে যুদ্ধ প্রসার লাভ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাপানি বাহিনী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে ব্রহ্মদেশ জয় করে নিল। এর ফলে ভারতের গরিবদের জন্য চাল রপ্তানি করার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ আসন্ন এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হল। এই যুদ্ধে ভারতীয়রা অংশগ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিল এর কারণ সম্ভবত এই যে, বিনিময়ে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে জাতীয় কংগ্রেস আন্দোলন শুরু করল উপনিবেশকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণে বাধ্য করার প্রতিবাদে। গান্ধি ও অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হল। ব্রিটিশ সরকার ৯০০০০ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করল, হত্যা করল ১০০০০ হাজার আন্দোলনকারীকে। ভারতীয় বাহিনী ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে লাগল। ভারতের শস্যক্ষেত্র ও কলকারখানা তাদের ও অন্যান্যদের খাদ্য, পোশাক, জুতো, প্যারাসুট, তাঁবু, গোলা-বারুদ এবং অসংখ্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী যোগান দিতে থাকল। ফলে খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটল অস্বাভাবিক হারে। আর শেষে পরিণাম হিসেবে ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। আমাদের মনে রাখতে হবে সমর সেন মূলত একজন মার্কসীয় চিন্তাধারায় দীক্ষিত এবং শিক্ষিত একজন মানুষ। তাঁর কবিতায় সেই সময়ের দুর্ভিক্ষ এবং তৎকালীন সমাজের পরিস্থিতি নিয়ে নানা উদ্বিগ্নতা দেখা দিতে থাকল। এবং বিপরীত দিকে একটা বিচিত্র আশাবাদ জন্ম নিতে থাকল কবিতাগুলিতে। তাকে আমরা আত্মসান্তনাও বলতে পারি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, সমর সেন রাশিয়া থাকাকালীনও ওঁর চেতনার ভেতর এক বিচিত্র স্বাধীনতা বা তত্ত্বোন্মোচনের ভাবধারা আরও দৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠে। যাকে আমরা তত্ত্বমসি বলতেও পারি।
অনুবাদকের চাকরি নিয়ে পাঁচ ঋতু মস্কোয় সপরিবারে কাটিয়ে অবশেষে ১৯৬১-র আগস্ট মাসে পাকাপোক্ত কলকাতায় ফিরে আসেন সমর সেন। মস্কোয় থাকাকালীন তিনটি ভারতীয় পত্রিকায় প্রতিবেদন লিখতেন। সেগুলোই ‘Five Summers in Moscow’ নামে ‘অপ্রকাশিত অগ্রন্থিত সমর সেন ২’-তে একটি বিভাগ হিসেবে প্রকাশিত হয়। সেখানে সমর সেনের এক বিচিত্র রসবোধের পরিচয় পাই। মস্কোয় নামার পর সমর সেন যেটা ভেবেছিলেন তা হল: ‘But pneumonia is easier to catch than Marxism-Leninism, so our first thoughts were about the weather.’ আসলে কথাটা বিশেষ কিছু ইঙ্গিতবহুল হতো না যদি না তিনি মার্কসিজম বা লেলিনিজমের সঙ্গে নিউমোনিয়ার তুলনা করতেন। এর ভেতর অন্তঃস্থিত একটা শারীরিক বোধ হয়তো কাজ করেছিল। কারণ, মার্কস বা লেলিনের চিন্তা সমর সেনের চেতনার সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে যে, সেটাও একটা শারিরীক বোধ।
সমর সেন মানুষটার যে কোনোমতেই নিজেকে ঘিরে কোনো বিলাসিতা বা কোনো স্বভাবের আচ্ছন্নতা ছিল না তা অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে। তার প্রমাণ তাঁর ‘বাবুবৃত্তান্ত’-এ নির্ভীক স্বীকারোক্তি থেকে পাই: ‘বিয়ের দু-একদিন পর থেকে পুরনো জীবনযাত্রায় ফিরে যাই।… তাছাড়া ২২শে জুন রুশ-জার্মান লড়াই আরম্ভ হওয়াতে সংসারের কথা মনে থাকতো না;’। নিখিল সেন সম্পর্কে এমন একখানা কথা বলেন তা থেকে বোঝা যায় আমাদের বাংলা ভাষা কতটা সমৃদ্ধ সেটাই ভাবায় সঙ্গে তাঁর রসবোধ: ‘একবার বেশ ভোরে আগের সন্ধ্যায় ফেলে আসা বর্ষাতি ও মানিব্যাগ আনতে গিয়ে দেখি একেবারে দিগম্বর হয়ে দাড়ি কামাচ্ছেন।’ জামতাড়ায় দেবী ভট্টাচার্যের ছোট বোন অপর্ণা কথাবার্তায়, ব্যবহারে বেশ সপ্রতিভ ছিলেন। সমর সেন সম্পর্কে বলতেন: ‘চেহারা ও রঙের কথা উঠলে বলতো আমাকে দেখতে ছাল-ছাড়ানো মুরগির মতো।’ শেষ তো করতেই হবে। সমর সেনের কবিতা বিশেষ কোনো ব্যঞ্জনা বহন করে না। তিনি নিজেও ‘বাবুবৃত্তান্ত’-তে স্বীকার করেছেন যে, সরাসরিভাবে পার্টিতে যোগদান করবেন না তবে ‘বিপ্লবী কবিতা’ লিখবেন। এবং গদ্য কবিতায় তাঁর অবদান অপরিসীম। খুবই স্বল্পদিন কবিতা লিখেছেন। আত্মজীবনী ‘বাবুবৃত্তান্ত’-এর শেষে বলেছেন, নিজের কথা বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গে বলেছেন তাতে দেশ ও দশের ক্ষতি কী? পারিবারিক কথা অনেকই বাদ দিয়ে গেছেন। বন্ধুবান্ধবদের কথাও। আর বলেছেন: ‘মধ্যবিত্তের দৌড় সুবিদিত।’ সমর সেনের জীবনে অনেক বৈচিত্র্য এসেছে তবে উনি কোনো কিছুতে স্থিতু হতে পারেননি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, কলেজের প্রিন্সিপ্যাল তাঁর সম্পর্কে বলতেন: ‘এখানে বেশিদিন টিকবে না, bird of passage।’

গ্রন্থঋণ:
১। পঞ্চাশের মন্বন্তর চার্চিলের ষড়যন্ত্র, মধুশ্রী মুখোপাধ্যায়, সেতু প্রকাশনী।
২। তিন পুরুষ, সমর সেন, সম্পাদনা সব্যসাচী দেব, অনুষ্টুপ।
৩। সমর সেনের কবিতা, সমর সেন, সিগনেট প্রেস।
৪। বাবুবৃত্তান্ত ও প্রাসঙ্গিক, সমর সেন, দে’জ পাবলিশিং।
৫। অপ্রকাশিত অগ্রন্থিত সমর সেন ২, সমর সেন, সম্পাদনা পুলক চন্দ, দে’জ পাবলিশিং।

Facebook Comments

পছন্দের বই