লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শিবাশিস দত্তের প্রবন্ধ

কবীর সুমনের প্রতিভা : মূল্যায়নের সমস্যা

বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ে না। নামের পদবি, চরিত্র নিয়ে খোঁচা তো আছেই, তিনি যে-কথা বলেন তা নিয়েও প্রায়শই কটুকাটব্য চলে। নিন্দুকেরা অধিকাংশই আবার জানাতে ভোলেন না যে, এতদসত্ত্বেও তারা কিন্তু সুমনের গানের ভক্ত। কেউ কেউ আবার পিপিং টমদের মতো বেডরুমে উঁকি মারার ঢঙে নানা কথা ভাবেন— কারণ, Morality-র বিচার তাদের মতে জরুরি। আর কে না জানে, Morality is essentially sexual morality. ‘গানের সুমন’, ‘রাজনীতির সুমন’ ‘মরালিস্‌ট সুমন’—শিল্পী সুমনকে এমন খণ্ড খণ্ড করে দেখার প্রবণতাই সর্বাধিক। অন্যদিকে কবীর ছেঁটে সুমন নামটির সঙ্গে আগেকার চট্টোপাধ্যায় পদবি জুড়ে দিতে পারলে নিন্দুকের বুঝি বা স্বস্তি মেলে। সমালোচনার কি কোনো শেষ আছে! ব্রাহ্মণসন্তান— শেষে কিনা ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা ভেবে ধর্ম বদলেছেন, তাও আবার কিনা মোছলমানি পিরিতে গলে পড়া। ধিক্, তবে ধিক! অথচ সুমন-অনুরাগীদের নিশ্চয় স্মরণে আছে যে, হিন্দু পরিচয় ছেড়ে মুসলমানত্ব অর্জনের সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক— সুমন সে-কথা জনসমক্ষে ঘোষণাও করেছিলেন। যিনি বিজেপি নেতার পুত্রবধূরূপে সালমা খাতুনকে দেখতে চান, তাঁর মতাদর্শকে বুঝে নেওয়া কি কোনো কঠিন কাজ? নীতিবাগীশরা এসব কথায় কান দেবেন না। তারা বলবেন, সুমন সুবিধাবাদী, সুমন লোভী (বলতে শোনা যায়, আখের গোছাতেই নাকি তিনি এম. পি পদে আসীন ছিলেন, আর মমতা ব্যানার্জির যে স্তুতি তিনি মাঝেমধ্যে করেন তার মূলে আছে সরকারি সুযোগ-সুবিধা লাভের তাড়না)। তৃণমূল দলের সাংসদ হয়ে সে দলের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন যিনি, তাকেও এসব কথা শুনতে হয়েছে, আজও শুনতে হয়। অনেকে আবার সুমনের তৃণমূলবিরোধী শ্লেষাত্মক উচ্চারণের (খাও, খাও) উদাহরণ টেনে বক্তৃতাবাজিতে মুখর হয়েছেন। দুর্ভাগ্য, যিনি মেরুদণ্ডহীন রাজনীতির সংস্কৃতিকে আক্রমণ শানাতে ‘দলদাস’ শব্দটিকে ঘন ঘন ব্যবহার করেন, তাঁকেই ধান্দাবাজ বলে অপবাদ দেওয়া হল। তথাকথিত সংস্কৃতি-প্রিয়জনদের বলতে শুনি, সুমন চরিত্রহীন, মেগালোম্যানিয়াক, উয়োম্যানাইজার— আরও কত কী! কেউ বলেন সুমনের দুর্ব্যবহারের কথা, কেউ সতর্ক করে দেন— বক্তার আসনে সুমন… নৈব নৈব চ, জিভের লাগাম নেই, কী বলতে কী বলবেন, অতএব বক্তার তালিকা থেকে সুমনের নাম কেটে উড়িয়ে দাও। আর ব্যক্তিগত জীবন? এ নিয়ে তো কুৎসার অন্ত নেই— যেন এলেবেলে কোনো শিল্পী, কাজেই টুপভুজঙ্গ অথবা কোনো রিরংসু গোত্রের জীবন ধরে নিয়ে তা কাটাছেঁড়ার দায় কাঁধে তুলে নেন ন্যায়বাগীশরা।
রাজনৈতিক সুমন প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রশ্ন হল, কবীর সুমন প্রাইভেট মার্কসিস্ট, মাওবাদী, না তৃণমূলপন্থী কংগ্রেসি? আমাদের পণ্ডিতি মত যাই হোক, আসলে তিনি একজন অনিয়ন্ত্রণবাদী (anarchist). এ কথা তাঁর মুখেই শোনা গেছে। এ যাবত নিশ্চিত হওয়া যায় যে প্রথাগত রাজনীতির আসরে সুমন unpredictable, অর্থাৎ কোনো দলের পক্ষেই স্বস্তিকর নন। তবে তাঁর রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি নিয়ে যে-ঠাট্টা আর কটুক্তি চলে, তাও পরিণত রাজনীতিমনস্কতার লক্ষণ নয়।

হিন্দু পরিচয় ছেড়ে মুসলমানত্ব অর্জনের সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক— সুমন সে-কথা জনসমক্ষে ঘোষণাও করেছিলেন। যিনি বিজেপি নেতার পুত্রবধূরূপে সালমা খাতুনকে দেখতে চান, তাঁর মতাদর্শকে বুঝে নেওয়া কি কোনো কঠিন কাজ?

জীবনদর্শন জীবনে নয়, সৃষ্টিতে খুঁজতে হবে—এ কথার অর্থ কী? কোনো শিল্পী সমকামী, অ্যালকোহলিক বা কম্পালসিভ উয়োম্যানাইজার হনও যদি, তাঁর নিন্দা করব কেন? বায়রনের অস্থির কামুকতা, তলস্তয় এবং দস্তয়েভস্কির দায়িত্ববোধবিচ্যুত উচ্ছৃঙ্খল প্রেম, পিকাসোর সিরিয়াল পলিগ্যামি কি বুদ্ধিদীপ্ত মহলের কোনো গুরুত্বপূর্ণ চর্চার বিষয় হতে পারে না হওয়া উচিত? প্রতিভাবান শিল্পীর জীবনের যৌনকেচ্ছা, অপরাধ বা কেলেঙ্কারির ঘটনা অসাধারণ কৌতূহলের বিষয় বটে, কিন্তু সে-সব বিষয়কে শিল্পীর জীবনদর্শনপ্রসূত ভাবা ভুল। তবু যে ভয়ঙ্কর নানা ঘটনা সৃষ্টিশীলদের জীবনে ঘটে, তার কারণ বোঝা দরকার। ‘An artist is a creature driven by demons’. তুমুল প্রতিভাবানকে একধরনের নিউরোসিস বহন করতে হয় এবং এই নিউরোসিসকে শিল্পের উপাদানে রূপান্তরিত করার দায় তাঁরই। তাছাড়া তুমুল স্রষ্টা যে গুণের অধিকারী তা হল: excessive ability for fine analysis and extraordinary imagination. সর্বোপরি ক্রিয়েটিভ মনের মানুষ যিনি, তাঁর থাকে সংযমেরও অভ্যাস। মিশেল ফুকোর ভাষায়, একে বলে Technology of self. পারফেকশনে পৌঁছোতে শিল্পীকে সংযমের অভ্যাস গড়তে হয়। তবে শিল্পী-সাহিত্যিকদের জীবনে বিচিত্র সব কাণ্ডও ঘটে। ম্যাক্সিম গোর্কি একবার নিজেই নিজের বুকে গুলি চালিয়েছিলেন। তিনি কি উন্মাদ ছিলেন? ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর এক প্রেমিক পিয়ের দ্রিউ লা রোশেল (ফরাসি সাহিত্যিক, ফ্যাসিবাদী ও গণিকাসক্ত ছিলেন) ভিক্টোরিয়াকে বলতেন carnal genius, আবার প্রেমিকা ভিক্টোরিয়ার আচরণে তিনিই বিস্ময় প্রকাশ করে বলতেন, ‘আপনি এত ভদ্র কেন?’ স্রষ্টা সম্পর্কে আমরা তবে কোন কথা বলব? তাবড় শিল্পী-লেখকদের কেচ্ছা গাইব, না সৃষ্টিসম্ভার দেখে তাঁদের অলোকসামান্য প্রতিভাকে কুর্নিশ করব? ফ্রয়েডের মতে, নীতি বিষয়ে আমাদের প্রচলিত রীতি হল অস্পষ্টতা এবং অজ্ঞতাকে মেনে নেওয়া। তবে আর আমরা শিল্প ও শিল্পীর যথার্থ মূল্যায়ন করব কেমন করে?
এ অজ্ঞতা এবং অস্পষ্টতা কতদূর বিস্তৃত হতে পারে তার দু-একটি নমুনা পড়া যাক:
এ সময়ের এক নামী কবি লিখেছেন: ‘জীবনের অপরাধ ঢাকতে শিল্পের সাফাই হয় না’। এ ধরনের নীতিবাক্য আঁকড়ে থাকার কারণ কী? কারণ, আমরা আমাদের নৈতিক মূল্যায়নকে একমাত্র সঠিক বলে ভাবতে চাই, এবং তা দিয়ে অতীত কিংবা বর্তমানের, স্বদেশ কিংবা বিদেশের বা অন্য সংস্কৃতির মানুষের মূল্যবোধকে বিচার করি। এক ধরনের ‘মরাল অর্ডার’ আরোপ করে প্রতিভাবানদের দোষী সাব্যস্ত করার কথা ভাবি। অথবা এ হল সেই ‘কনফার্মেশন বায়াস তত্ত্ব’— যার প্রভাবে মন যা বিশ্বাস করতে চায় সেই বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি খুঁজে বেড়ায়। ঔচিত্যবোধ একধরনের গোলমেলে বিষয়। এ নিয়ে কবি উৎপলকুমার বসু প্রশ্ন তুলেছিলেন। সাম্প্রদায়িক হয়েও যে বা যাঁরা আশ্চর্য সাহিত্য বা শিল্প সৃষ্টি করে তাদের কী চোখে দেখা হবে? কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘তাদের হাত ভেঙে দেওয়া উচিত।’ দাঙ্গাবিরোধী কোনো প্রস্তাবে তাঁদের সই চাওয়া হবে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে শ্রীমুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘এঁরা সাম্প্রদায়িক, লেখক বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য নন।’ কবি উৎপলকুমার বসু লিখেছেন:
“আমি আজও ওই ঔচিত্য বিষয়ে নিঃসন্দেহ হতে পারিনি। তা হলে ইসলামবিদ্বেষী দান্তের কী হবে? ইহুদিবিদ্বেষী পশ্চিমের বিখ্যাত কবিদের কী হবে…?’

ফ্রয়েডের মতে, নীতি বিষয়ে আমাদের প্রচলিত রীতি হল অস্পষ্টতা এবং অজ্ঞতাকে মেনে নেওয়া। তবে আর আমরা শিল্প ও শিল্পীর যথার্থ মূল্যায়ন করব কেমন করে?

করণীয় তবে কী? মাননীয় কবীর সুমন— নিন্দাপঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে আপনিই বা কী করবেন? বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাজ তো নিন্দা এড়িয়ে চলা। ক্রিয়েটিভ লোকের ধূর্তামি করেই আপনাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে। বলতে হবে, ‘হে মরালিষ্ট, হে নিন্দুকবর্গ— অনর্গল কুৎসা করে যে মাঠ ভরিয়ে তুলেছ, আমি তোমাদের সে মাঠে খেলব না, অন্য মাঠে খেলব।’ মামুলি গায়ক নন, আপনি তো সংগীত-সাধক, তুমুল প্রতিভাবানদের দলে। সাধনার কাজকে ব্যাহত হতে দেবেন কেন, ধূর্তামি করেই আপনাকে সৃজনশীল কাজে আমরণ লিপ্ত থাকতে হবে। এ কাজ আপনি পারেন, আপনি যে মহাশিল্পী পিট সিগারের আশীর্বাদধন্য গায়ক-সুরকার-স্রষ্টা!
পিট সিগার তখন বেঁচে। মহাপ্রতিভাধর সিগার নজরুল মঞ্চে গান শোনাচ্ছেন, একই মঞ্চে সেদিন হাজির ছিলেন কবীর সুমন। আমরা কলকাতাবাসী সেদিন গর্বে ফেটে পড়েছিলাম। একে তো বিশ্ববন্দিত শিল্পীর আগমন ঘটেছিল কলকাতায়, তদুপরি সিগারের স্নেহধন্য সুমন মঞ্চে তাঁর পাশেই উপস্থিত, কলকাতার সুমনকে নিয়ে আমাদের আকাশছোঁয়া গর্ব জেগেছিল বই কী! সুমনের সংগীতপ্রতিভার তারিফও সেদিন শোনা গিয়েছিল মহাসংগীতকারের কন্ঠে। এ দৃশ্য বা উচ্চারণ কি ভোলা যায়!
কবি, সংগীতবেত্তা সুমনকে সেই বাঙালি বিলক্ষণ চেনেন যাদের যথার্থ রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক চেতনা আছে, স্বপ্ন দেখার সাধ ও সাধ্য আছে। রুক্ষ্ম মনের জমিতে এতকাল রোদ্দুরমাখা স্বপ্নের বীজ ছড়িয়েছেন কবীর সুমন। এ উপলব্ধি যাদের, তারা নিঃসংশয়ে বলবেন, সমস্ত কেচ্ছাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েই বলবেন, ‘শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’। বলবেন, ‘ও গানওলা, আরেকটা গান গাও’….

Facebook Comments

পছন্দের বই