লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শীর্ষা মণ্ডলের প্রবন্ধ

করোনা ভাইরাস এবং কোভিড-১৯

২০১৯-এর নভেম্বর-ডিসেম্বর। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের এক লোকাল সামুদ্রিক খাদ্যবাজার। এখানে সামুদ্রিক প্রাণী ছাড়াও বিভিন্ন প্রাণীর মাংস বিক্রি হয়।এখান থেকেই ১৭ই নভেম্বর এক ৫৫ বছর বয়সী ব্যক্তি কিছু নিউমোনিয়ার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। এই ঘটনার পর থেকে প্রায় এক মাস পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ১-৫টি রোগীর শরীরে একই উপসর্গ দেখা যায়। এভাবেই ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে রোগীসংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় ৬০। কিন্তু রোগের প্রকৃতি ও নাম জানা যায়নি। পরবর্তীতে উহান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন এই অজানা নিউমোনিয়া রোগের সূচনাকাল ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ বলে দাবি করেন। এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম হল ঝ্যাঙ জিক্সিয়ান। রেসপিরেটরি অ্যান্ড ক্রিটিকাল কেয়ার ডিপার্টমেন্ট অফ দ্য হুবেই প্রভিন্সিয়াল হাসপাতালের ডাক্তার। ২৬শে ডিসেম্বর এক বয়স্ক দম্পতি এক অজানা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি হন। ডিরেক্টর ঝ্যাঙ জিক্সিয়ানের বক্তব্য অনুযায়ী জ্বর, কাশি এবং ক্লান্তিই ছিল প্রধান নিউমোনিয়াজনিত লক্ষণ। আশ্চর্য্যজনকভাবে ফুসফুসের সিটি স্ক্যান রিপোর্টে অস্বাভাবিকতা (ইনভ্যাসিভ নিউমোনিক ইনফিল্ট্রেট) দেখে অভিজ্ঞ ডাক্তারটি আঁতকে ওঠেন। ২০০৩ সালে ঘটে যাওয়া সার্স আউটব্রেকের কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। ৫৪ বছর বয়সী ডাক্তারটি প্রায় জোর করেই রোগী দম্পতির ছেলেরও ফুসফুসের সিটি স্ক্যান করান। বলাই বাহুল্য যে, নিউমোনিয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও ছেলেটির ফুসফুসে একইরকম অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। অভিজ্ঞ ডাক্তার আন্দাজ করেন রোগের প্রকার ভীষণরকম ছোঁয়াচে। ঠিক তার পরদিন ২৭শে ডিসেম্বর একইরকম উপসর্গ এবং ফুসফুসের অস্বাভাবিকতা নিয়ে আরও এক ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হন। চারজনের রক্ত পরীক্ষার ফলাফল ভাইরাল সংক্রমণের দিকেই ইশারা করে। ডাক্তার জিক্সিয়ানের আশঙ্কাকে সত্যি করে পরীক্ষার ফলাফল ইনফ্লুয়েঞ্জা-নেগেটিভ আসে। ওই দিনই, কালক্ষয় না করে ডাক্তার জিক্সিয়ান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এক অজানা আউটব্রেকের সংকেত দেন এবং তা অবিলম্বে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের জেলা স্তরে পাঠানো হয় (“The report is about we discovered a viral disease, probably infectious”)। এই ঘটনার ২ দিন পরে আরও তিনজন রোগী ভর্তি হলে ২৯শে ডিসেম্বর দশজন ডাক্তারের বিশদ আলোচনার মাধ্যমে রোগের বিষয়ে প্রভিন্সিয়াল হেলথ অথরিটিকে রিপোর্ট করা হয় এবং ডাক্তার জিক্সিয়ানের পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর্মীদের মাস্ক পরার সিদ্ধান্ত চালু হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই সাতজন রোগীর মধ্যে চারজন ব্যক্তির সামুদ্রিক খাদ্যবাজারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। যাই হোক, ৩০শে ডিসেম্বর উহান মিউনিসিপাল হেলথ কমিশন জনসচেতনতার উদ্দেশ্যে অজানা কারণহেতু নিউমোনিয়া আউটব্রেকের (“Outbreak of Pneumonia of Unknown Cause”) একটি জরুরি বিজ্ঞপ্তি জারি করেন। ডাক্তার জিক্সিয়ানকে এই রোগের আবিষ্কার এবং চিকিৎসা সচেতনতার তৎপরতার জন্য প্রভিন্সিয়াল হেলথ কমিশন বিশেষভাবে সম্মানিত করে।

কোভিড-১৯-এর রোগবিস্তার বা এপিডেমিওলজি বিষয়টি এই মুহূর্তে ভীষণই পরিবর্তনশীল বা ডাইনামিক বিষয়। সংক্রমিত ব্যক্তির এবং মৃতের তালিকা প্রতিদিনই দীর্ঘতর হচ্ছে (১২ই মে-র তথ্য অনুযায়ী, সংক্রমিত: ৪,১৭৭,৫০৪, মৃত: ২,৮৬,৩৩০)। তাই কোনো একটি বিশেষ সংখ্যাকে নির্দিষ্ট বলে চিহ্নিত করা অবান্তর। চীনের বাইরে প্রথম এই রোগের শিকার হলো থাইল্যান্ড। ১৩ই জানুয়ারির রিপোর্ট অনুযায়ী। পরে বিদ্যুৎবেগে এই রোগ পৃথিবীর সব প্রান্তেই ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতে প্রথম এই রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৩০শে জানুয়ারি ২০২০-তে। কেরালায়। প্রথম রোগী চীন থেকে আগত এক উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ক্রমেই সংখ্যাটা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। ইতিমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং ডিজিজ আউটব্রেক নিউজ হিসেবে খবরটি প্রকাশ করেছে। সঙ্গে রয়েছে চীন থেকে পাওয়া রোগীর পরিসংখ্যান এবং রোগের বিবরণ। এদিকে চীনের কিছু গবেষণাগার একটানা প্রচেষ্টায় ১২ই জানুয়ারি এর জিনগত শৃঙ্খলা (জেনেটিক সিকোয়েন্স) প্রকাশ করে যা ভাইরাস নির্ধারণ এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধারায় আশার আলো দেখায়। ততদিনে উহানে একটি দু-টি করে রোগীর সংখ্যা পৌঁছে গেছে একচল্লিশে। একজন রোগীর মৃত্যুও ঘোষণা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রসঙ্গত, এরা সবাই কোনো-না-কোনোভাবে সামুদ্রিক খাদ্যবাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত। চীনের বাইরে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার পরে ১৪ই জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে গোটা বিশ্বকে এই সংক্রমণের পথ সম্পর্কে অবগত করে। আর সেটি হল মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ। ২২শে জানুয়ারি উহান পরিদর্শনের পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত বক্তব্য এই সংক্রমণের পথ হিসেবে মনুষ্যমাধ্যমকে নিশ্চিত করে। সংক্রমণের হার ক্রমাগত বাড়তে থাকায় ৩০শে জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল একটি এমার্জেন্সি কমিটি গঠন করেন এবং উপলব্ধ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই মহামারিকে একটি আন্তর্জাতিক স্তরের জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত জরুরি সমস্যা (“Public Health Emergency of International Concern”/PHEIC) বলে চিহ্নিত করেন। ততদিনে এই রোগের কবলে পড়েছে চীন ছাড়াও আরো ১৮টি দেশ। আক্রান্তের মোট সংখ্যা ৭,৮১৮। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং চীনের যৌথ উদ্যোগে করোনা ভাইরাস এবং কোভিড-১৯ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাবলী বিশদে প্রকাশিত হয়। সংক্রমণ এবং মৃত্যু উভয়ের ক্রমবর্দ্ধমান রূপ দেখে ১১ই মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই মহামারিকে প্যানডেমিক আখ্যা দেয়। যার আক্ষরিক অর্থ কোনো রোগের অত্যন্ত দ্রুতহারে বিশ্বব্যাপী বিস্তার।

ইতিমধ্যে ভাইরাসটির পরিচয় নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। ১১ই ফেব্রুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ট্যাক্সনমি অফ ভাইরাসেস (আইসিটিভি) ঘোষণা করে সংক্রমণকারী ভাইরাসটির নতুন নাম: সার্স-কোভ-২ (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিনড্রোম – ভাইরাস-২)। ২০০৩ সালে ঘটে যাওয়া বিশ্বব্যাপী মহামারি সার্সের সঙ্গে বর্তমান ভাইরাসের সাদৃশ্য থাকায় এই নামকরণ। ঐদিনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির নামকরণ করে। যদিও এর আগে কয়েকমাস রোগটির পরিচয় ছিল ২০১৯ নভেল করোনা ভাইরাস নামে। ব্যুৎপত্তিগতভাবে করোনা শব্দের অর্থ হল ক্রাউন বা মুকুট। তাই ভাইরাসের বহির্গাত্র মুকুটের মতো একরকম স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন দিয়ে সাজানো হলে সেটিকে করোনাভিরিডি ভাইরাস পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসটিও একই বৈশিষ্ট্য বহন করে। প্রসঙ্গত, ২০০৩ সালে ঘটে যাওয়া সার্স ভাইরাসের সঙ্গে সার্স-কোভ-২ এর প্রায় ৭৯ শতাংশ জিনোমগত সাদৃশ্য বর্তমান। তথ্য অনুসারে করোনা ভাইরাসের একটি সাধারণ পোষক হল বাদুড়। সার্স বা মার্স— দু-টি মহামারির ক্ষেত্রেই ভাইরাসের বিস্তার ঘটে বাদুড় থেকে। বর্তমান তথ্য অনুযায়ী সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটিও একইরকমভাবে নির্দিষ্ট পোষক বাদুড় থেকেই ছড়িয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মানব সংক্রমণের আগে প্যাঙ্গোলিন নামক একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী অন্তর্বর্তী পোষক হিসেবে ভাইরাসটিকে বহন করেছে। ইয়ান জিয়াং নামক টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের বক্তব্য অনুযায়ী ভাইরাসটি বাদুড় থেকে সরাসরি মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে না। বাদুড় থেকে প্যাঙ্গোলিন সংক্রমিত হয় এবং প্যাঙ্গোলিনের শরীরে মিউটেশনের মাধ্যমে মানুষকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা লাভ করে।
এই রোগের সংক্রমণ মূলত সংক্রমিত মানুষের স্পর্শ, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। হাঁচি-কাশির সূক্ষ্ম ড্রপলেট বা বিন্দুর মাধ্যমে নতুন শরীরে প্রবেশ করার পরে ভাইরাসটি ফুসফুসের কিছু বিশেষ কোষকে টার্গেট করে এবং টার্গেট কোষের গায়ে থাকা এসিই-২ (ACE-2) নামক গ্রাহক বা রিসেপ্টরের সঙ্গে নিজের গায়ের এস (S) নামক স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন দ্বারা আবদ্ধ হয়। এই এসিই-২ গ্রাহকটি ফুসফুস ছাড়া অন্ত্র, হৃৎপিণ্ড এবং কিডনির কোশগাত্রেও বর্তমান। আশ্চর্য্যজনকভাবে, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, সর্দি-কাশি ইত্যাদি রোগটির প্রধান উপসর্গ হলেও বেশ কিছু রোগীর প্রথম উপসর্গ ছিল ডায়েরিয়া-সহ বিভিন্ন আন্ত্রিক সমস্যা। বেশ কিছু গবেষণার ফলস্বরূপ পরবর্তীতে জানা যায় ভাইরাসটি শুধুমাত্র ফুসফুসের কোষকেই নয়, এসিই-২ গ্রাহকধারী যে-কোনো কোশকেই টার্গেট করতে পারে। সাধারণত সংক্রমণের ১৪ দিনের মধ্যে উপসর্গগুলি প্রকট হয়ে থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে উপসর্গহীন (অ্যাসিম্পটোমেটিক) সংক্রমণও লক্ষ করা গেছে। রোগীর বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিশদে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সাধারণত মধ্যবয়সী থেকে বয়স্ক মানুষেরা বেশিমাত্রায় সংক্রমণযোগ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫৫, ৯২৪ জন সংক্রমিতের মধ্যে ৭৭ শতাংশ ছিলেন ৩০-৬৯ বছর আয়ুসীমার মধ্যে। তবে ভাগ্যবশত শিশু সংক্রমণের মাত্রা যথেষ্ট কম। পূর্বতন দুরারোগ্য বা তুলনামূলক জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে মৃত্যুর সম্ভাবনা সবথেকে বেশি। ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হাঁপানি, উচ্চরক্তচাপজনিত সমস্যার রোগীদের জন্য এই ভাইরাসটি সরাসরি প্রাণঘাতী।

মাত্রাতিরিক্ত সংক্রমণ এবং ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর হার— দুটোই বিশ্বব্যাপী করোনা প্রকোপের সাঙ্ঘাতিক ক্ষতিকর দিক। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইতিমধ্যেই মানুষ থেকে অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীরে (বিশেষত বাঘ, বেড়াল) কোভিড-১৯ রোগের প্রকাশ ঘটেছে। এই প্রজাতি-বহির্ভূত সংক্রমণ মানুষ-সহ বিভিন্ন প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য এক বড়ো সঙ্কট। গৃহপালিত এবং বিভিন্ন দলবদ্ধ স্তন্যপায়ীদের সংক্রমণ নির্দ্বিধায় আরও ভয়াল রূপ দিতে পারে। ক্রমাগত বাড়তে থাকা মৃত্যুর হারও যথেষ্ট চিন্তাজনক। ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর হার ছিল ৩.৮%। মে মাসে (১২ই মে-র তথ্য অনুযায়ী) যা ৬.৮% ছুঁয়েছে। করোনাভিরিডি পরিবারের এই নতুন সদস্যকে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করার জন্য প্রয়োজন ভাইরাস-নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন। এর জন্য সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশগুলির গবেষণাগারে বহু বিজ্ঞানী অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। কিন্তু আপাতভাবে ভ্যাকসিনের আবিষ্কার না-হওয়া পর্যন্ত কিছু পূর্বতন ওষুধের পুনর্ব্যবহারই (রিপারপাসিং) একমাত্র পথ। এই প্রসঙ্গে ১৮ই মার্চ ২০২০ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি সলিডারিটি ট্রায়াল শুরু করে। এই আন্তর্জাতিক ক্লিনিকাল ট্রায়ালটির মুখ্য বৈশিষ্ট্য হল সমগ্র পৃথিবী থেকে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে সর্বাপেক্ষা কার্যকরী ওষুধের সন্ধান করা। বিভিন্ন গবেষণাগারের প্রাণীভিত্তিক ক্লিনিকাল গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলী অনুযায়ী চারটি ড্রাগ গ্রুপকে সম্ভাব্য কার্যকরী ওষুধ হিসেবে প্রস্তাবিত হয়। এগুলি হল— রেমডেসিভির, লোপিনাভির/রিটোনাভির, লোপিনাভির/রিটোনাভির/ইন্টারফেরন-বিটা-১এ এবং ক্লোরোকুইন/হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। রেমডেসিভির আগে ইবোলা ভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকী সার্স এবং মার্স মহামারীর সময়েও এই ওষুধটি সাফল্য লাভ করে। লোপিনাভির/রিটোনাভির মূলত এইডসের ওষুধ। কিছু গবেষণাগারের তথ্য অনুযায়ী এই দু-টি ওষুধের যুগ্ম প্রয়োগ কোভিড-১৯-কেও পরাস্ত করার ক্ষমতা রাখে। ইন্টারফেরন-বিটা-১এ মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ক্লোরোকুইন/হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন প্রধানত ম্যালেরিয়ার অব্যর্থ ওষুধ। চীন এবং ফ্রান্সের কিছু গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে কোভিড-১৯ মহামারিতে এই ওষুধ দু-টির কার্যকারিতা সম্পর্কে জানা যায়। বর্তমানে চিকিৎসকরা এই গ্রুপের বিভিন্ন ওষুধ এবং তাদের কিছু কম্বিনেশন থেরাপি প্রয়োগ করে অনেকাংশেই সাফল্য লাভ করেছেন। এর পাশাপাশি চীন-সহ বিভিন্ন দেশে নানাবিধ ট্রাডিশনাল ওষুধের প্রয়োগও চলছে এবং বিভিন্ন স্তরের ক্লিনিকাল ট্রায়ালে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও এসেছে। বলাই বাহুল্য, যে-কোনো ভাইরাল সংক্রমণের ক্ষেত্রেই ভ্যাকসিনের প্রয়োগ চূড়ান্ত সাফল্য ডেকে আনে। এক্ষেত্রেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ১০০টিরও বেশি গবেষণাগার এই নভেল ভাইরাসের নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। এ বিষয়ে দি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) এবং ভারত বায়োটেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (বিবিআইএল)-এর যৌথ প্রয়াস শুরু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো অনুযায়ী গবেষক ও বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আগামী ১ বছরের মধ্যেই পুরো বিশ্বকে ভ্যাকসিনের সাফল্য এনে দেবে।

বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোভিড-১৯ সম্পর্কিত বেশ কিছু ভুল তথ্য দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সচেতনতা-বার্তার সঙ্গে সঙ্গে এই অসংখ্য গুজবেরও নিরাকরণ করেছে। মশা বা মাছি এই রোগের বাহক নয়। রসুনের প্রয়োগ, শরীরে ডিসইনফেক্ট্যান্ট ছড়ানো, মদ্যপান, ৫জি মোবাইল নেটওয়ার্কের ব্যবহার, হ্যান্ড-ড্রায়ারের ব্যবহার, গরমজলে স্নান— কোনোটাই এই নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে পারবে না। তাপমাত্রার সঙ্গেও এই ভাইরাসের কোনো সম্পর্ক আপাতত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই গ্রীষ্মকালীন সময়ে ভাইরাসের প্রকোপ ব্যাহত হবে এই ধারণারও কোন সঠিক প্রমাণ আপাতত নেই। পাশাপাশি নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিনের কার্যহীনতাও উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সুতরাং, আপাতদৃষ্টিতে বলা যায় ব্যক্তিগত স্বচ্ছতা, পরিচ্ছন্নতা, বারবার হাত ধোয়া, সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে না আসা এবং সর্বোপরি সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাই এই রোগের থেকে বাঁচার সদুপায়। পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সচেতনতার মাধ্যমেই একমাত্র কোভিড-১৯-এর বিস্তারকে ঠেকানো সম্ভব।

তথ্যাসূত্র:

১. সায়েন্স, দ্য ওয়্যার: ২৭শে মার্চ, ২০২০।
২. হিন্দুস্থান টাইমস্: ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০।
৩. রিসার্চ আর্টিকল্: Liu et al., 2019; Jian et al., 2020; Xiao et al., 2020; Lam et al., 2020.
৪. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশান): নিউজলেটারস্।
৫. জনস্ হপকিন্স ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড মেডিসিনস্: করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টার।

Facebook Comments

পছন্দের বই