লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সমন্বয়ের প্রবন্ধ

আফটার আসিফা: আমরা ছবি মাটি ও শরীরের কথা বলব

“…a text is made of multiple writings, drawn from many cultures and entering into mutual relations of dialogue, parody, contestation, but there is tane place where this multiplicity is focused and that place is the reader, not, as was hitherto said, the author. The reader is the space on which all the quotations that make up a writing are inscribed without any of them being lost; a text’s unity lies not in its origin but in its destination.”

— Roland Barthes

বন্ধু সায়ন্তন দত্তর নির্মিত ‘আফটার আসিফা’ ছবিটি দেখেছি, বাজারের লেখালেখির শর্তে ছবির নির্মাতাদের সাথে লেখকের পূর্ব পরিচিতি অনুল্লিখিত রাখার অভ্যাস, একরকম ভণ্ড গোপনীয়তার চটুলতা, তবে এই যে সম্মোধনের প্রকারে উল্লেখ করলাম এ-ছবির নির্মাতা আমার পূর্ব পরিচিত, এই উল্লেখ আমি মনে করি জরুরি। আমি প্রথম থেকেই বিকল্প ছবি তোলাতুলির পক্ষে— এ-সূত্রে আমার পক্ষপাতদুষ্টতার খানিক আঁচ দেওয়া হল। ‘আফটার আসিফা’ নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি না হলেও, খুব কম মানুষ এ-ছবি সম্পর্কে জানেন— নির্দিষ্ট পরিসরের কথা মাথায় রাখলে তাও বলা যায় না। তবে আমি চাইবই এ-ছবির আঙ্গিক আরও দূর ও কাছ থেকে দেখতে। ছবির প্রথমেই কিছু টেক্সটচুয়াল রিপোর্টাজ, ছবির বিষয় শুধু বলে দেয় না বরং ছবিটি যে বিষয়টির প্রতি ঘেন্নায় তোলা হয়েছে সেটাই স্পষ্ট করে। অর্থাৎ, কাশ্মীরে আট বছরের এক শিশু আসিফার গণধর্ষণ ঘটনায় আসিফার পক্ষে এই ছবি। নাটকীয় প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে আদি পাপ ও থাবাগুলি আনফোল্ড হতে হতে ক্যামেরার রোলিং শব্দের পাশেই খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে যদি না ছবি নিজের মধ্যের ষড়রিপু ফাঁস করে দিতে সক্ষম হয় তবে তা প্রক্রিয়া কীসের! লাবণ্যদের নির্মাণ প্রক্রিয়ায়, ছবি শুধু ছবি নয়, অভিনেতা কেবলই অভিনেতা নয়। ধর্ষণ ও ধর্ষণ সংক্রান্ত ছবি (স্বঘোষিত প্রগ্রেসিভ পক্ষের) এরও এক বাজার রয়েছে, বাংলায় নারী অধিকার, মানবাধিকারকে বিষয় করে বেশ কিছু ছবি আছে, সে-সব আমরা দেখেছি, তার বেশিরভাগই আমার চোখে অশ্লীল ঠ্যাকে, মোদ্দা কারণ হচ্ছে, তাদের বলার ভঙ্গি, আঙ্গিকে চমক বেশি নিষ্ঠা কম… সেখানে দেশে যখন অধিকাংশ মিডিয়া হাউজ বিক্রি হয়ে গেছে, তখনই আগাগোড়া বিকল্প রিপোর্টিং-এর স্বর ত্যাগ না করার শুদ্ধ নৈতিকতা ওরা ভোলেনি, যা অল্টারনেটিভ মিডিয়ার সমার্থক।

ছবির ছোটো ছোটো প্রবণতা আগাগোড়াই পুরো গল্পের বৈভব রাখতে চায়নি― এই সময়টা কোনো আখ‍্যান রচনার সময় নয়, আর্জেন্সি আর্জেন্সি, কিছু একটা না করতে পারার অবসাদ থেকে একটি ভঙ্গুর আঙ্গিক তারা বেছে নেয়। সংলাপ আচরণ ও প্রতি সেগমেন্টের খাঁজে যে-সব অন্তর্বর্তী মনোলগ জমতে থাকে শেষে তা দেহ ফুঁড়ে হু হু করে বেরিয়ে আসবেই… এমনকী নির্মাণ নেপথ‍্য পুঁজিটুকুও ফাঁস করে দেবে নিজের বাজেট, এই জানাজানির মধ‍্যেই যেটুকু শ্লীলতা— দর্শক কখনোই কি চায়নি বুঝতে…

শব্দ ও দর্শক

দশটি সেগমেন্টে বিভক্ত এ-ছবির প্রথম সেগমেন্টে স্তোত্র ও আর্তনাদ মিশিয়ে দেওয়ার গভীর রাজনীতি বুঝি, ধর্ষণচিত্রের এমন প্রকটতা বাংলা ভাষার ছবিতে কবে দেখা গেছে মনে পড়ে না; যে-শব্দকাঠামোর পূর্বেই নির্মাতার বলা ‘এ‍্যাকশন’ নির্দেশটি কানে ছুরিকাঘাতের মতনই আসে এবং এরপরেই জাতীয় স্তোত্রের সাথে ধর্ষণ-শাঁখ-মন্ত্রের শব্দ ও তলে তলে ক‍্যামেরার সাটার পড়ার শব্দ যে-ছবি রচনা করে তা অস্থির ও অস্বস্তির। গোটা ছবিটিই দর্শকদের কল্পনার ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়—

বলা যায় দর্শকের অবস্থানকে শুরু থেকেই আঘাত করতে শুরু করে, যে-দর্শক যত বেশি বিক্রিত অসভ‍্য সে-দর্শকের জন‍্যে শব্দ দিয়ে নির্মিত একাধিক ইঙ্গিতবাহী দৃশ‍্যের ক্রমাগত উপরিপাতন (পর্দায় অন্ধকার) ততবেশি অস্বস্তিকর ঠেকবে। শব্দসজ্জা ঋত্বিকচিত চূড়ান্ত।

আমাদের অজান্তেই পৃথিবীর ছোটোখাটো জিনিস অর্থ থেকে তুলনায়, তুলনা থেকে চিহ্নিতকরণে ভেসে যায়, প্রায়শই এই প্রবণতা স্মৃতি ও মস্তিষ্ককে এমন অপার ছেয়ে ফেলেছ যে, শরীরকে শরীর, ফলকে ফল, মাটিকে মাটি হিসেবে দেখতে ভুল করি। শরীর শুধু শরীর নয় মাটি শুধু মাটি নয়, ফল কেবলই ফল তা আমরা বলব না। আমরা এবার আসিফার গায়ে অর্থ চাপাব।

সাগরের শব্দ। ঢেউয়ের শব্দ। এইটি বিকল্প ছবির একটি পরিচিত সাউন্ডস্কেপ। কিন্তু দৃশ‍্যের (চরিত্রের) ব‍্যবহারে শব্দের অর্থ কী করে বদলে যায়: সেগমেন্ট, ঢেউ-এর সাথে সাথে যে-ছড়ানো মৃতদেহদের দেখলাম তারা দৃশ্যত শকুন্তলা, তারা, রূক্মিনী, কেকোই, সূর্পনাখা, দ্রৌপদী, ভানুমতী, দুঃশলা, জাহ্ণবী, উর্বসী, জনার স্মৃতিতে পুরানো পাতাল থেকে যেন উঠে এল সাম্প্রতিক মানচিত্রে। পরের সেগমেন্টেই দু-টি চরিত্র একে অন‍্যের মুখোমুখি আসে, দাঁড়ায়, দেখে চলে যায়। আমার মনে হয় এ-দু-টি ঢেউ প্রাক্স্বাধীনতার ভারতবর্ষ ও স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষ অথবা প্রাক্উদারনৈতিক ও উদারনীতি লাঘু হওয়ার পরের ভারতবর্ষ, দু-টি ঢেউ।

“তোমায় ঘেন্না করি” এই সংলাপ তালে তালে বলতে বলতে তাল কেটে যায়— ক‍্যাকোফনিকে রূপান্তরিত বাস্তব, তার সমান্তরাল নেপথ‍্যশব্দ নির্বাচনে ধরে রাখে জলের নরম বুকে আর্মির মার্চ— এই যে দৃশ‍্য তা কাশ্মিরের ৩৭০ ধারার বাস্তবতা স্বকীয় ভয়েজে ধরছে বলে মনে হয়। কিছু পরের সেগমেন্টের সংলাপ এই দৃশ‍্যের ওপরই কমেন্টারি বলে মনে হয়েছে:

― তুমি নেই

― আমি আছি

― না তোমার কোনো বাবা নেই

― তুমি যুদ্ধের সন্তান, তোমার জন্ম ভয় থেকে।

এইসব সংলাপ।

নাম বিষয় ও দর্শক

ছবিতে যে নিজের নামটি প্রথম বলে সে-নির্মাতা: সায়ন্তন। এ-নামের আলটিমেট অবস্থানটি বোঝার জন‍্যে তার পরের কথাগুলি শুনতে হবে। “আমি সায়ন্তন… বাইরে আলো জ্বলছে, আসবে?… এখানে আমরা সবাই আছি… বাইরেও অনেক লোক…”। এখানে কিছু কথা, দর্শক গোটা ছবি জুড়েই বিষয়ের পক্ষে থাকে, যে-ছবিতে পার্টিকুলার কোনো POV শট্ নেই, তখন দর্শকের POV সবসময়ই ভেতর থেকে বাইরের দিকে— আসিফা থেকে ছবি নির্মাতার দিকে― বিষয় থেকে বিষয়ীর দিকে— শিল্পশরীর থেকে Body of Crowd ভিড়ের শরীরের দিকে— আত্মা থেকে বাজারের দিকে থাকে। অতএব এ-ছবির রাজনীতি অনুযায়ী ‘সায়ন্তন’ নামটি মেইনস্ট্রিম ছবির ভিলেনের ক‍্যারিকেচার ভিন্ন কিছু মনে হয়নি। এবার আবার সংলাপগুলি পড়া যাক। “…বাইরেও অনেক লোক আছে কিন্তু… বাগানটায় আসবে? সত্যি আমরা সবাই আছি… আমার তোমায় দরকার…”।

এবার এই সংলাপগুলির সুরে প্রচ্ছন্ন প্রস্তাব টের পেয়ে আমাদের ভয় লাগবেই, দর্শকের নিরাপত্তা সংলাপের নেপথ‍্য মতলব আঁচ করে উড়ে যাবে; গোড়া থেকেই ছবির ভেতরের বিষয় তাকে নিজের জায়গায় টেনে আনবে এবং সারাক্ষণ ওই স্থানাঙ্ক থেকেই দর্শক ছবির বাইরেটা দেখতে থাকে।

অন্ধকার স্পেস ও দর্শক

অন্ধকার ব‍্যতিরেকে আর কোনো ব‍্যাকড্রপ অথবা প্রপস্ নেই আসিফা ও মা, মা ও আসিফার শরীর দর্শকের একমাত্র ফোকাস পয়েন্ট, তাদের উপস্থিতির ভেতর দিয়েই স্ক্রিনের বাইরের বাস্তব স্ক্রিনের ভেতরের অন্ধকার ফুঁড়ে স্বচ্ছ উঠে আসে। যেহেতু বিশেষ কোনো ক‍্যামেরাভঙ্গি নেই, দু-একবার মিড টু লং-মিড এবং এক দুইটি ক্লোজ আপ রয়েছে। এছাড়া ক‍্যামেরার আর কোনো ঝাঁকুনি নেই, ফ্রেমের ভেতরে চরিত্রদের শরীরী ভঙ্গি যা কি না ইংরেজি বিভিন্ন লেটারের (চিহ্ণ) মতন অবয়ব তৈরি করে, যেমন L I M A C… এখানে এসেই দর্শকের চোখ বারে বারে ধাক্কা খায়— ছবিতে চরিত্রদের জেসচারই দর্শকদের কাছে প্রধান ব্লকেজ পয়েন্ট হয়ে ওঠে।

ছবিজুড়ে প্রতিটি মুহূর্তেই রয়েছে ইঙ্গিত, স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি বলেই হয়তো এত ইঙ্গিত গিজগিজ করে— দর্শককে তিষ্ঠতে না দেওয়া এও এক রাজনীতি, ছবিটি তা মণিবীজের মতো আগাগোড়া ধরে রেখেছে— একটি ইঙ্গিতের পূর্ব ইঙ্গিতটি তার ঠিক পরের ইঙ্গিতটির জন‍্যেই রাখা তা তো নয় আরও আরও অনেক দূরের ইঙ্গিতের সঙ্গে যেন তার অধিক আত্মীয়তা। প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত আখ‍্যানধর্মীতা বর্জনের ফলেই স্ক্রিনে ইঙ্গিতগুলো তাই অজস্র মাছির মতনই গিজগিজ করে।

তবে ছবিটি ‘স্লাইটেজ হায়ারার্কি’ ছোটোখাটো ক্ষমতাকেও কি ছেঁটে দিতে পেরেছে? ছবিটির প্রতিটি দৃশ‍্য, সংলাপ, শব্দদের গায়ে যেহেতু পূর্বপরিকল্পিত উদ্দেশ্য লেগে থাকে; ছবিটি দর্শকদের একটি মৃত‍্যুকূপে ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হলেও (শকথেরাপি) আমি স্বতঃস্ফূর্ততা পাইনি, কিছুটা জড়ত্ব পেয়েছি, ছবিটির সুনির্বাচিত অলংকারগুলোর মধ‍্যেই ছবির ভেতরের পরবর্তী ড্রামাটিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কায়িত করার তাড়া লক্ষ‍ করেছি। নির্মাতা নিজের ছবির ডিটেলসের প্রতি উগ্র রকমের মনোযোগী, তাই তার নির্লিপ্ততাও উগ্র। এমনকী ছবিটির নির্মাণ যে ‘Death of the Author’ এই ক্রিয়াটির কার্যকারিতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তা প্রকাশ পায় তারই লিখিত সংলাপে, যখন তিনি চরিত্রকে দিয়ে বলাচ্ছেন, “জীবন শক্তিশালী নয়, মৃত‍্যু আরও বেশি শক্তিশালী”, অতএব কাউন্টার হায়ারার্কির ঘ্রাণ যেমন প্রায়শই থেকে যায়; এখানেও তাই।

চরিত্ররা, যাদের উপস্থিতি তাদের আচরণ সমানুপাতে প্রকট হয়েছে, তারা নির্মাতার সঙ্গে সহযোগিতা (Harmony) করবে কি করবে না এই মোদ্দা অনিশ্চয়তা এ-ছবির শুরু থেকেই গায়ে লেগেছিল… চরিত্ররা পরে সম্পূর্ণভাবেই এ-ছবির জমি দখল করে নেয়।

তবে অনেকেই বলেছেন এ-ছবি নিজেদের প্রপাগ্যান্ডার পজিশন ছাড়েনি, সদিচ্ছায় ধরে রেখেছে। কথা ঠিক তবে এও বোঝা গেছে এ-ছবি ব্রেখট্-এর Verfremdungseffekt— মেনে নিজেকে নাকচ করতেও ছাড়েনি— কথা ঠিক, তবে এ-দু-টি কথা পাশাপাশি রাখলে কেমন গুলিয়ে যায়। নিজেকে নাকচ করতেও ছাড়েনি আবার প্রপাগ‍্যান্ডার পজিশনকেও ধরে রেখেছে, এ কেমন করে হয়। শুরুতে বলেছিলাম দর্শককে গোড়াতেই এ-ছবি বিষয়ের সঙ্গে সমর্থনে যুক্ত করে। কিন্তু শেষ সেগমেন্টের শেষে যখন আসিফার মুখ স্ক্রিনে ভেসে পিকসেলে পিকসেলে ফেটে যায়, স্ক্রিনে ওই ঝাপসা মুখই ভাসতে থাকে। খানিকক্ষণ। প্রতিবাদস্বরূপ আসিফার মুখ দর্শককে দেখতে দেওয়া হবে কি হবে না সে-সিদ্ধান্তের আগে ছবিটির আর একটি সিদ্ধান্ত থাকে: নির্মাতারা আসিফার মুখ দেখতে সক্ষম তো? এ-প্রশ্ন বেশি জরুরি। তাদের প্রপাগান্ডা, তাদের নির্বাচিত মেরু কতটা শুদ্ধ হলে আসিফার মুখ তারা দেখতে পারবে— এ-ছবি নিজেদের আদর্শ অথবা যে-কোনো আদর্শবাদকেই, নিজেদের বিকল্পপন্থাকেও সন্দেহ করতে ছাড়েনি। যে-ছবি শুরুতে দর্শকদের অন্ধকারের কৌণিক অবস্থানে বসিয়ে বাইরের কর্কশকে দেখিয়েছে, তারা নিজেরাই নিজেদের আদর্শের স্থানাঙ্ক থেকে সরে গিয়ে দর্শকের কাছে বিকল্পপন্থাকেও সন্দেহ করবার সূত্র ধরিয়ে দেয়, স্বেচ্ছায়, তাদের ঘোষণায়, এ-তল্লাটে ঈশ্বরকণ্ঠী কোনো বিকল্প অথর নেই; শুধু বখাটে।

Facebook Comments

পছন্দের বই